ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী :
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি যখন তুলছে সারা দেশের মানুষ, তখনও সরকার ক্ষমতার মোহে মদমত্ত হয়ে আওয়ামী লীগের অধীনেই নির্বাচনের আয়োজন করছে। আর এ নিয়ে এক এক সময়ে এক এক ধুয়া তুলছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে তার অধীনেই নির্বাচন করার পরিকল্পনা নিয়েই নির্বাচনের প্রচারণায় নেমে গেছেন। রাষ্ট্রীয় খরচে গাড়ি হেলিকপ্টার ব্যবহার করে তিনি সভা-সমাবেশ করছেন। শুধুমাত্র তার দল ছাড়া আর কেউই শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে রাজী নয়। এমন কি তার জোটের প্রধান শরিক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি পর্যন্ত বলছে, দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। দেশের সর্বস্তরের মানুষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে হলেও প্রধানমন্ত্রী তা মানতে চাইছেন না। ফলে বিরোধী দলের কাছে হরতাল, অবরোধ ছাড়া এখন আর কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই।
সে কারণেই পরপর দু’বার ৬০ ঘণ্টা হরতালের পর ১৮ দলীয় জোট এবার ৮৪ ঘণ্টা হরতালের ডাক দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী গলা উঁচু করে বলছেন যে, হরতাল ডেকে বিরোধী দল মানুষ খুন করছে আর জনদুর্ভোগ ডেকে আনছে। এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি ১৭৩ দিনের হরতাল অবরোধ করেছিলেন। সে হরতাল কার্যকর করার জন্য তিনি সারা দেশে তার মাস্তান বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর পিকেটাররা যাতে অক্লান্তভাবে তাদের জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচি চালিয়ে যেতে পারে তার জন্য নানা আয়োজন দেখেছি। শত শত ড্যাগ-ডেকচি করে তেহারী খিচুড়ী রেঁধে তাদের খাইয়েছেন। ভয়ে আতঙ্কে মানুুষ নিজ ঘরে বন্দী থাকতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। এই হরতাল ডেকে খিচুড়ী রেঁধে পিকেটারদের খাওয়াতে হচ্ছে না। কার্যত, হরতাল পালনে কাউকে বাধ্যও করা হচ্ছে না। তারপরও কেন সারা দেশের মানুষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হরতাল পালন করছে, সরকার সেটা কিছুতেই উপলব্ধি করতে পারছে না। এর কারণ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনা বিভিন্ন জরিপ থেকে নিশ্চিত হয়ে গেছেন যে, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলে তার দল বা জোটের শোচনীয় পরাজয় ঘটবে। ফলে তিনি কিছুতেই সেরকম নির্বাচনে যেতে রাজী নন।
প্রধানমন্ত্রী এখন চাইছেন, প্রধান বিরোধীদল বিএনপি ও তার জোট যাতে আগামী নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করে তার ব্যবস্থা করতে। আর সে কারণেই বিএনপি ও জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সম্প্রতি আটক করে কারাগারে পাঠিয়েছেন। অন্যান্য নেতার বাসায় বাসায় দিনে রাতে হামলা তল্লাশি চালাচ্ছে। বিরোধী দলের উপর নির্যাতন তিনি গত পাঁচ বছর যাবত করে আসছেন। কিন্তু সে মাত্রা এখন শত গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীন, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘসহ সারা বিশ্ব যখন বলছে, বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনায় বসে সরকার এর একটা সুরাহা করুক। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যেন কাউকেই এখন আমলে নিতে চাইছেন না। এরই বা পরিণতি কি হতে পারে সে বিষয়ে সরকারের ধারণার দারুণ অভাব ঘটেছে। কার্যত, এই সব দেশকে ক্ষেপিয়ে বাংলাদেশের জনগণের উন্নতির পথও তিনি রুখে দিচ্ছেন।
এতো দিন ভারত বলছিল, যেকোনো মূল্যে শেখ হাসিনাকে আর এক মেয়াদে ক্ষমতায় দেখতে চান তারা। কিন্তু তাদের সে অবস্থানেও এখন পরিবর্তন ঘটেছে। তারাও বলছেন, সংলাপের মাধ্যমে সরকার একটা সুরাহা করুক। কিন্তু এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, সরকার এর কোনো কথায়ই কর্ণপাত করবে না। সেক্ষেত্রে নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করার জন্য তিনি যে প্রশাসনিক কাঠামো সাজিয়েছেন, তার মাধ্যমে জয়ী হয়ে আবার ক্ষমতায় বসবেন। বসবেনও হয়তো। কিন্তু টিকবেন কি না সে ব্যাপারে সংশয় আছে।
বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে এ পর্যন্ত যতোগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার সবগুলোই কোনো না কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে যে তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার সুষ্ঠুতা ও নিরপেক্ষতা সারা বিশ্বে প্রশংসা পেয়েছে। শেখ হাসিনার খামখেয়ালিতে ২০০৬ সালের শেষ দিকের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাজ করতে পারেনি। সে সরকারকে ভ-ুল করে শেখ হাসিনা দেশে সামরিক শাসন ডেকে এনেছিলেন। সম্প্রতি ‘ইকোনোমিস্ট’ পত্রিকা তাদের এক নিবন্ধে লিখেছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদলে শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকেই অধিক পছন্দ করবেন।
২০০৮ সালে যে পাতানো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, তা যদি নিরপেক্ষ হতো তাহলেও আওয়ামী লীগের জয়ের সম্ভাবনা তাতে খুব ক্ষীণ ছিলো। সেই কারণেই তিনি অমন আঁতাত করেছিলেন। তখন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত মিলে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র তাকে কীভাবে ক্ষমতায় বসিয়েছিলো, সে কথা প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিতে কসুর করেননি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন। আর শেখ হাসিনার সঙ্গে হিলারী ক্লিনটনের সে কথোপকথন সারা পৃথিবীর মানুষ জেনে গেছে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। শেখ হাসিনার জঙ্গি কার্ড এবার আর খুব বেশি কাজে আসছে না। কারণ দেখা যাচ্ছে যে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার কথা বলা হচ্ছে. সেসব কা- প্রধানত আওয়ামী লীগই ঘটাচ্ছে। ঘটিয়ে নাম দিচ্ছে বিএনপি, জামায়াত বা হেফাজতকে। কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে গেছে। তদন্ত, স্থিরচিত্র ও ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, এসব ঘটনা ঘটায় আওয়ামী লীগ নিজেই। তার দলের নেতা কর্মীদের মাধ্যমে। এই ছলচাতুিরও এখন পৃথিবীর মানুষের অজানা নয়।
যুক্তরাষ্ট্রসহ দাতাদেশগুলো পুরানো অভিজ্ঞতা থেকে বারবার বলছে, তারা একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্র দেখতে চায়। কিন্তু শেখ হাসিনা চান ক্ষমতা। কেননা বিভিন্ন খাত থেকে এই সরকারের হোমরা, চোমরা থেকে চ্যালা-চামু-ারা পর্যন্ত কোটি কোটি টাকা লুণ্ঠন করেছে। নিরীহ মানুষকে খুন করেছে। গুম হয়ে গেছেন ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ শত শত বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী। নদীতে, বনে, বাদাড়ে, ধান খেতে, খালে, পুকুরে এখন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। এর প্রতিবিধান তো পরবর্তী সরকারকে কিছু না কিছু করতেই হবে। শেখ হাসিনা সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে নারাজ। সে কারণেই সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেছেন। এমন সব আইন পাস করেছেন যা পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে কল্পনাও করা যায়না। যেমন; কুইক রেন্টালের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ে ভবিষ্যতে কেউ কোনদিন কোনো আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবে না। আর গত সোমবার পার্লামেন্টে আইন পাস করেছেন, তাতে যেকোন সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতি তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সরকারের অনুমোদন নিতে হবে। অর্থাৎ দুর্নীতিবাজ সরকারের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের রেহাই দেয়ার জন্য এই আইন পাস করা হলো। এই আইন যেমন সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক, তেমনি দুদকের আইনের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। কিন্তু সরকার এসব মানতে নারাজ। যদি দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদক কোন ব্যবস্থা নিতে না পারে, তাহলে কোন বিবেচনায় তারা অন্য কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে নিজেরাই ব্যবস্থা নিবেন। এই আইন পাস করায় দাতাগোষ্ঠী সোমবারই অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তাদের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এর মাধ্যমে সরকারি কর্মচারীরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী থাকেন না। তারা সরকারের অনুগত দাসানুদাসে পরিণত হন। আর তাই আসন্ন নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচন করে আওয়ামী লীগকে পাস করিয়ে দেবেন। সেটি অবশ্য পরের কথা।
আগে যে কথা বলছিলাম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। আর তাই জনগণ স্বতঃষ্ফূর্তভাবে হরতাল করছে। সরকারকে রাজধানীর ভেতরে আটক করে ফেলেছে। এই লেখাটি লিখছি হরতালের তৃতীয় দিনে। আমি ঢাকা শহরের একটি ব্যস্ততম রাস্তার পাশে বসবাস করি। এই তিনদিন ঐ সড়ক ছিলো মোটামুটি শুনশান। কিছু রিকশা, দুই একটি স্কুটার, মোটরসাইকেল হঠাৎ একটি বাস এই ছিলো এ তিনদিন ধরে রাস্তাটির অবস্থা। কিন্তু এই তিনদিনে আমি হরতালের পক্ষে একটি মিছিলও এই সড়ক দিয়ে যেতে দেখিনি। দুই একটা হরতাল বিরোধী মিছিল দেখেছি। তাতে ১০/১২ জন করে টোকাই শ্রেণীর বালক বা লোক দেখেছি। তা থেকেও ধরে নেয়া যায় যে, এই হরতাল জোর করে কার্যকর করা হচ্ছে না। জনগণ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে নিজেরাই সবকিছু অচল করে দিয়েছে।
দেশ কারো তালুকÑমুল্লুক নয়। দেশ জনগণের। সেই জনগণের আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একটি নির্বাচন করার পরিকল্পনা কি পরিণাম ডেকে আনতে পারে সরকারকে তা ভেবে দেখতে হবে। আমার তো মনে হয় এরকম একটি নির্বাচন আয়োজন করতে গেলে এ সরকার এক ভয়াবহ গণপ্রতিরোধের মুখোমুখি হবে। জনগণের প্রতিরোধ কি তা আমরা ১৯৬৯ সালে দেখছি। ১৯৭১ সালে দেখেছি। ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর দেখেছি। ’৯০ সালেও দেখেছি। সেই প্রতিরোধ অতিক্রম করে নির্বাচন করার কাজটি সহজ হবে না।
নির্বাচন করতে তো রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তুত। কিন্তু নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ তো সৃষ্টি করতে হবে। সে পরিবেশের বিন্দুবিসর্গও এখানে নেই। এমনকি বর্তমান নির্বাচন কমিশনও নিজেরাই নিজেদেরকে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করেছে। ফলে সরকারের নির্দেশ, উপদেশ উপেক্ষা করে স্বাধীনভাবে কিছু করার ক্ষমতা তাদের নেই। এখন যে গণজাগরণ, যে গণজোয়ার, যে গণপ্রতিরোধের সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচনকালে তা আরো ভয়াবহ রূপ নেবে বলে মনে হয়। র্যাব, পুলিশ, বিজিবি আর মাস্তান দিয়ে সেই গণপ্রতিরোধ থেকে কিছুতেই রক্ষা পাবার সম্ভাবনা নেই। সূতরাং আমরা সরকারকে গণতন্ত্রের স্বার্থে, দেশ ও জনগণের স্বার্থে অবিলম্বে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন