গত কয়েক দিনে বাংলাদেশে ক্ষমতার রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে একটার পর একটা
প্রহসন অভিনীত হয়েছে। নিশ্চয়ই কিছু দিনের মধ্যে আরো কয়েকটি মঞ্চস্থ হবে। তবে
দেশপ্রেমিক এবং সত্যিকার গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ মনে করে, এসব প্রহসন দেখে কিছু অজ্ঞ-অর্বাচীন ও অন্ধভক্ত আপাতত হাসলেও
ভবিষ্যতে জাতির কাঁদার কারণ যে সৃষ্টি হচ্ছে, তা বোঝার মতো
মেধা ও বিবেক তাদের নেই। এসব রাজনৈতিক প্রহসনের মধ্য দিয়ে কিছু ভিলেন ও ভাঁড়ের
সাময়িক উত্থান রাজনীতির অঙ্গনে নীতিনৈতিকতার পতনেরই প্রমাণ দিচ্ছে। এই দেশের
দুর্ভাগা জনগণ অনেক মেলোড্রামা আর ট্রাজেডি দেখেছে। স্বাধীনতার চার দশক পরে এখন
তাদের একান্ত প্রত্যাশা, রাজনৈতিক কুশীলবেরা দক্ষতার
সাথে ভূমিকা রেখে উপহার দেবেন একটি আদর্শ কমেডি। এই মিলনান্তক নাটকে থাকবে হিংসা-ঘৃণা-বিদ্বেষ
থেকে মুক্ত হয়ে এগিয়ে যেতে জাতীয় সম্প্রীতি সম্মিলনের বাণী।
এখন দেশের মানুষকে যা সবচেয়ে বেশি বিস্মিত করছে, তা হলোÑ এতদিন জাতীয় জীবন কণ্টকিত দলবাজির দরুণ, আর এবার রাজনীতির অঙ্গনে রেকর্ড সৃষ্টি হলো ডিগবাজির। ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে এভাবে পলিটিক্যাল সার্কাস মুফতে দেখতে পেয়ে জনগণ দুঃখের মাঝে কিঞ্চিৎ হাসির খোরাক পেয়েছে। সত্যিই কত রঙ্গ ভরা এই ভঙ্গ বঙ্গদেশ!
জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও ‘স্বৈরাচারী’রূপে বহুলালোচিত এরশাদ এই তো সেদিন বলেছিলেন, অনেক শিক্ষা হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগের সাথে বেহেশতে যেতেও রাজি নই। আর তিনিই দলটির ডাকে বঙ্গভবনে গেলেন। সেখানে এরশাদের দলের হাফডজন নেতানেত্রী মন্ত্রী হলেন। আওয়ামী লীগের সাথে বেহেশতের স্বাদ দিতে না-রাজি হলেও তাদের সাথে ক্ষমতার স্বাদ নিতে তিনি পুরোপুরি রাজি। একজন নাগরিকের মন্তব্য : এরশাদ ঠিকই জানতেন, বেহেশতে যাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে না পারলেও মন্ত্রিত্বের নিশ্চয়তা শেখ হাসিনা তাদের দিতে পারবেন।
এরশাদ আগে বলেছেন, বিএনপি ছাড়া নির্বাচনে গেলে মানুষ আমাকে থুতু দেবে। আর এখন বলছেন, নির্বাচনে না গেলে মানুষ থুতু দেবে। এখন যে ‘মানুষ’-এর কথা বলছেন, তারা কারা, তিনি কিন্তু খুলে বলেননি। এরশাদ বলেছিলেন, বিএনপি বাদে নির্বাচনে গিয়ে দালাল হিসেবে চিহ্নিত হতে চান না। এখন তিনি প্রমাণ করছেন, ক্ষমতা নয়, ক্ষমতার রাজনীতির খুদকুঁড়া খাওয়ার জন্যও সবই তাদের কাছে হালাল হওয়া অসম্ভব নয়। তিনি বেঈমান হয়ে মরতে চাননি। ১৮০ ডিগ্রি উল্টে গেলে মানুষের কাঁচা ঈমান পাকা হয় বলেই হয়তো তিনি মনে করেন।
এরশাদ সাহেব ছুটে গেলেন হাটহাজারী। সেখানে হেফাজতে ইসলাম প্রধান আল্লামা আহমদ শফীর সাথে সাক্ষাৎ করে দোয়া চাইলেন। মাওলানা সাহেব এরশাদের মনের কামনা পূরণের জন্য দোয়া করে দিলেন। পত্রিকায় এটা দেখে পাঠকেরা অবাক হয়ে ভাবলেন এই ‘কামনা’টা কী? এরশাদ জানালেন, রাজনৈতিক আলাপ হয়নি মাওলানা শফীর সাথে। অথচ ‘হুজুর’-এর পক্ষ থেকে জানানো হলো, এমন কিছু আলোচনা হয়েছে। পরে জানা গেছে, জাপা নেতা আল্লামা শফীকে বলেছেন একটি ইসলামি জোট গঠনের উদ্যোগের কথা। আর সেই তিনিই কিনা হাটহাজারী থেকে ঢাকায় ফিরে তার দলকে সরকারের অংশীদার বানিয়ে ফেললেন।
রবিঠাকুর বলেছেন, ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না।কবি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অনেক সময়ে যা চান বলে বক্তব্য দেন, সেটা ‘ভুল করে’ চান। তবে যা পেয়ে যান, তা যে চান না, তা নয়। হয়তো এটাই তার প্রকৃত কামনা।
এরশাদের দলের সুপরিচিত সাবেক মহাসচিব এবং তার আমলের জাঁদরেল মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এখন জাতীয় পার্টির ‘জেপি’ অংশের প্রধান। ১৭ নভেম্বর একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে মঞ্জু বলেছেন, ‘আমি তো তার মন্ত্রিসভায় সাত বছর ছিলাম। তাকে চিনি। গতকালও যিনি বললেন, সবাই না এলে নির্বাচনে যাবো না। পরে বললেন, গণতন্ত্র রক্ষার জন্য নির্বাচনে যাবেন। তিন দিন আগেও তার কথাবার্তা শুনলে কেউ বিশ্বাস করতে পারত না যে, তিনি নির্বাচনে যাবেন।মঞ্জু আরো বলেছেন, শুনেছি বি. চৌধুরীর বাড়িতে বৈঠক হলো, খাওয়া দাওয়া হলো। সেখানে আলোচনা হয়েছেÑ এই নেত্রীও না, ওই নেত্রীও না, আমরা একটা থার্ড ফোর্স করব; কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব না ।এরশাদ সাহেব বেরিয়ে এসে বললেন, গণতন্ত্র রক্ষার জন্য নির্বাচনে যাবো। ........... এরশাদ সাহেব সরকারের পতন চাচ্ছেন, চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছেন, অথচ তার ভাই মন্ত্রী।আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এরশাদের ‘ভোজবাজি’ প্রসঙ্গে বলেছেন, তার ভাইকে দু’এক দিনের মধ্যে মন্ত্রিসভা থেকে বের করে নিয়ে আসার কথা, অথচ আজ উল্টো সাতজনকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।আর সবাই দেখছে তাদের মধ্যে তার বৃদ্ধ স্ত্রীও রয়েছেন। অসুস্থতার কারণে তিনি রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে দূরে ছিলেন বেশ কিছু দিন ধরে। সেই তিনিই এখন দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী!
এরশাদ এক মুখে দু’রকম কথা বলে, রাজনৈতিক ডিগবাজি খেয়ে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতার স্তরকে সর্বনি¤œ পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। আওয়ামী লীগের চাপে কিংবা তাদের খুশি করতে তিনি নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দিলেন। সে আওয়ামী মহলের সর্বপ্রধান কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘এরশাদ সাহেব মহাজোটে আছেন কি নেই, এ প্রশ্ন তোলা নিরর্থক। কারণ তার দল নির্বাচনকালীন সরকারে আছে এবং স্বভাবতই নির্বাচনে থাকবে। এখন যদি তিনি বলেন, আমি মহাজোটে নেই, তা হলে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের টগর বোষ্টমীর একটি উক্তি স্মরণ করতে হবে। টগর বোষ্টমী বলেছিলেন, মিনসের সাথে ২০ বছর ঘর করেছি বটে, কিন্তু তাকে হেঁসেলে ঢুকতে দেইনি।’ এ ক্ষেত্রে এরশাদ সাহেবের অবস্থান কোথায়, তা আজ আর আলোচনা করতে চাই না।
কলামিস্ট আগাচৌ’র মতে, সবার আগে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও তার দল নির্বাচনে অংশ নেবেন ঘোষণা দিয়ে এরশাদ সাহেবের জাতীয় পার্টিতে প্রায় ভূমিধস সৃষ্টি করতে চলেছিলেন। এরশাদ নির্বাচনে না গেলে দলের একটা বড় অংশ মঞ্জুর সাথে চলে যেতেন বলে এই কলামিস্ট মনে করেন।
‘নামে কী-ইবা আসে যায়। বাস্তবে এটা অনেক ক্ষেত্রেই সত্য নয়। ‘নামে নামে যমে টানে’ কথাটাই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। শেখ হাসিনার ‘সর্বদলীয়’ সরকারকে আওয়ামী জোটের অন্ধভক্ত ছাড়া অন্যরা এ নামে ডাকতে নারাজ। তাদের কেউ বলছেন, এটা মহাজোটেরই সম্প্রসারিত সরকার। কেউ বলছেন, এটা আরেক চারদলীয় সরকার। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বললেন, কোয়ালিশন সরকারকে সর্বদলীয় বলা যায় না। মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, যারা অনির্বাচিত কাউকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের বিরুদ্ধে, তাদের গঠিত সরকারে সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল কয়েকটি দল নেই। তা হলে এটি কী করে ‘সর্বদলীয়’ হতে পারে? তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর ভাষায়, এটি বহুদলীয় সরকার। আর একজন নয়ামন্ত্রী জ্ঞান দিলেন, একের অধিক দল থাকলে সর্বদলীয়!
আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এপি’র সাবেক ব্যুরো চিফ ফরিদ হোসেন ডেইলি স্টারে লিখেছেন সর্বদলীয় সরকার : এটা মিত্র যোগ মিত্র শিরোনামে। তার লেখার শুরু এভাবেÑযখন এক গ্যালন পানি আরেক গ্যালন পানিতে মেশানো হয়, এর ফলে পানির পরিমাণ বাড়ে। তবে এতে পানির গুণগত মান উন্নত হয় না)
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক দিন আগে বলেছেন, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না; দেশের মানুষের শান্তি চাই।এ কথা শুনে দেশের মানুষ আশার আলো দেখতে পেয়েছিল। কারণ, এখন জাতীয় সঙ্কট তার অধীনে নির্বাচন করা না করা নিয়ে। এর সমাধান তার হাতেই, প্রেসিডেন্টের নয়। তিনি যদি সরকারপ্রধানের পদ ছেড়ে দেন, তা হলে সব ল্যাঠা চুকে যায়। এর পর সরকারের নাম তত্ত্বাবধায়ক, না অন্তর্বর্তী, না কি নির্বাচনকালীনÑ সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
হা হতোস্মি! সব আশার গুড়েবালি ঢেলে দেয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী বহাল রইলেন। তার অধীনেই ‘বহুদলীয়’ সরকার গঠিত হয়েছে। ৩০ মন্ত্রী বাদ দিয়ে ২৯ মন্ত্রীর সরকার এখন। প্রধানমন্ত্রীর হাতে আগে থেকেই ছিল প্রতিরক্ষা ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এখন যোগ হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের সাথে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যা নির্বাচনকালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আজ দেশে নির্বাচনকালীন সরকার হচ্ছে রাজনৈতিক সঙ্কটের কেন্দ্রবিন্দু। আর এই সরকার নির্দলীয় থাকার বিধান বাতিল করে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন করার জেদে এখন জাতীয় জীবনে মারাত্মক বিপদ ডেকে এনেছে। এটা সম্ভব হয়েছে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা নামে সরকার প্রধানের হাতে সর্বময় ক্ষমতা তুলে দিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানকে ক্ষমতাহীন অসহায় ব্যক্তিতে পর্যবসিত করার কারণে। আমাদের সংবিধান এক ব্যক্তি নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কুক্ষিগত করার মাধ্যমে ‘নির্বাচিত স্বৈরাচার’ কায়েমের সুযোগ রেখেছে। আর রাষ্ট্রপতির কাজ ‘জানাজা পড়া ও মিলাদ মাহফিলে’ সীমাবদ্ধ। এতে যেকোনো সরকারের প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা করলেই পরিবারতন্ত্র বা দলতন্ত্র কায়েম করতে পারেন। অথচ জাতীয় সঙ্কটে রাষ্ট্রপ্রধান অভিভাবক হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন না। এ অবস্থা শুধু বর্তমান আমলে নয়, মূলত সৃষ্টি হয়েছে ’৭২ সালের সংবিধানের মাধ্যমেই। গোড়ায় গলদ ছিল, যা পরবর্তীকালে আরো প্রকট হয়েছে। এই পরিস্থিতির দায় সেই সংবিধান প্রণয়নে যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাদের এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
গত ১৯ নভেম্বর একটি টিভি চ্যানেলে ’৭২-এর সংবিধানের অন্যতম প্রধান প্রণেতা এবং তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে সংবিধানের এই বেহাল দশা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি নিজেদের ভূমিকার সাফাই গাইলেন এভাবেÑ ‘আমরা তখন আসলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়াতে চেয়েছিলাম। তার যদি তা থাকত, তাহলে এখন সঙ্কট নিরসনে ভূমিকা রাখা তার জন্য সহজ হতো।’ কিন্তু কামাল হোসেন বলেননি, স্বাধীন দেশের সংবিধান ১৯৭২ সালে প্রণয়নকালে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করার কারণ কী? কে তাদের এটা করতে বাধ্য করেছিল? তখন তারা দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের স্বার্থে গণতান্ত্রিক চেতনতার প্রতিফলন কেন অনেক ক্ষেত্রে ঘটাতে পারেননি? এসব প্রশ্নের জবাবের মাঝে সমস্যাটির প্রতিকারের সন্ধান মিলবে বলে আশা করা যায়।
এখন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী তোড়জোড়। মনে হচ্ছে, দলটির বিশ্বাসÑ নির্বাচনী হুজুগে মানুষকে মাতিয়ে নির্দলীয় কেয়ারটেকার ইস্যু ভুলিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু এটা কিসের নির্বাচন? নিয়ম রক্ষার, না গণতন্ত্র রক্ষার? ১৯৮৮ সালে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন করেছিলেন এরশাদ। তাতে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন এবং এর ধাক্কায় নিজের পতন, কোনোটাই এড়ানো যায়নি। ১৯৯৬ সালে বেগম জিয়া সরকার নিয়ম রক্ষার নির্বাচন করেছিল। তার মাধ্যমে গঠিত সংসদে কেয়ারটেকার ব্যবস্থার বিধান করেও তার দল পরের নির্বাচনে জিততে পারেনি। নিছক সংবিধানের ধারাবাহিকতার কথা বলে নিয়ম রক্ষার যে নির্বাচন, তা রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে অভিনীত প্রহসনের নামান্তর। এটা বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের একটি বিপুল অপচয়। এমন পরিস্থিতির কারণ যাতে সৃষ্টি না হয়, সেজন্য প্রধানত ক্ষমতাসীন সরকার, সেই সাথে অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির আগে থেকেই সজাগ থাকা আবশ্যক। কিন্তু এ জাতির দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে দূরদর্শী ও প্রাজ্ঞ নেতানেত্রীর আকাল। এখানে রাজনীতিকের ছড়াছড়ি; অথচ রাষ্ট্রনায়কের (অথবা নায়িকা) দেখা মেলে না। রাজনৈতিক নেতানেত্রীর নজর পরবর্তী নির্বাচনের দিকে। আর একজন রাষ্ট্রনায়কের ভাবনায় থাকে পরবর্তী প্রজন্মের ভালোমন্দ।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনে যত বেশি সম্ভব, ছোট দলকে নামানোর যারপরনাই চেষ্টা করছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিরোধী দল (যারা তিনটি সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল) বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করছে না। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে তারা চায় না যে, বিএনপি নির্বাচনে আসুক। এ দিকে কয়েকটি নতুন অপরিচিত অনুল্লেখ্য ‘ইসলামী’ সংগঠন দাঁড় করিয়ে দেখানোর চেষ্টা চলছে, ইসলামপন্থীরাও এ নির্বাচনে শামিল হয়েছেন।
এই পরিকল্পনামাফিক খেলাফত মজলিসের একাংশসহ কয়েকটি ুদ্র সংগঠনের একটি জোট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়েছে। তবে শুরুতেই আওয়ামী লীগ ধাক্কা খেয়েছে। শায়খুল হাদিস মরহুম মাওলানা আজিজুল হকের সংগঠন, খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমির ও সাংগঠনিক সম্পাদকসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিরুদ্ধে। তারা বিবৃতির মাধ্যম স্মরণ করিয়ে দিলেন, গত সংসদ নির্বাচনের আগে এই আওয়ামী লীগ পাঁচ দফা চুক্তি করেছিল মজলিসের সাথে। কিন্তু অচিরেই সে চুক্তি আওয়ামী লীগই বাতিল করে দিয়েছিল।
১৯৭০ সালের নির্বাচনকে আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার প্রশ্নে ম্যান্ডেট হিসেবে তুলে ধরেছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে। তখন দলের নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এখন তার কন্যার আমলে সরকার বিতর্কিত ও একপেশে নির্বাচনের জন্য মেতে উঠেছে। স্বেচ্ছাচারীভাবে সংবিধানে কাটাছেঁড়া করে তার ভিত্তিতে এমন নির্বাচন করার তোড়জোড় চলছে যা গণতন্ত্রকে আরো বিপন্ন করে দলতন্ত্রের ভিতই পাকাপোক্ত করবে। এমন একটি নির্বাচনকে ‘১৯৭০ সালের নির্বাচনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ’ বলেছেন সদ্য বিগত মন্ত্রী ফারুক খান। ১৬ নভেম্বর গোপালগঞ্জে এক সমাবেশে এই মন্ত্রী বক্তৃতা করছিলেন। আজ যদি বিরোধী দলের কোনো নেতা একই কথা বলতেন, সাথে সাথে বঙ্গবন্ধুর অবমাননাই শুধু নয়, হয়তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে তাকে করা হতো অভিযুক্ত।
কথিত সর্বদলীয় সরকার বানিয়ে সংসদ নির্বাচন করার জন্য সরকার উঠেপড়ে লেগেছে। প্রধান বিরোধী দলকে বাগে আনতে না পেরে নিজেদের জোটের কয়েকটি দলকে শামিল করে আড়াই ডজন সদস্যের মন্ত্রিসভা ঘোষণা করা হয়েছে। কিছু খুচরা পার্টিকেও নির্বাচনী দৌড়ে নামানো হবে। কিন্তু এ নির্বাচন গণতন্ত্রের বিকাশ, না বিনাশ ত্বরান্বিত করবে, সেটাই এখন চিন্তাশীল নাগরিকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটকে বাইরে রেখে নির্বাচন করা হলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়বে ও দীর্ঘায়িত হবেÑ এমন শঙ্কা এখন আওয়ামী লীগ সমর্থক অনেকেরও।
বর্তমান সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক একটি পত্রিকায় এই ‘নির্বাচনী ট্রেন’ গন্তব্যে পৌঁছবে না বলে ছড়ায় ছন্দে উল্লেখ করা হয়েছে। ছড়াকার বলছেন, বিকল ট্রেনে উঠলে কি আর/ট্রেন চলবে গতিতে/ লাইনচ্যুতি ঘটে যদি/ পড়বে সবে ক্ষতিতে/--- জটিল কুটিল বুদ্ধি সকল/আছে জমা যাদের ব্রেনে/বুকের পাটায় সাহস নিয়েই/ উঠছে তারা বিকল ট্রেনে।
পাদটীকা : টিভি, পত্রিকা ও বিল বোর্ডে একটি বিজ্ঞাপন ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে। এতে দেখা যায়, দু’যুবক দোকানে বিস্কুট খাচ্ছে পাশাপাশি বসে। প্রথমে ন্যাড়া মাথার একজন খাচ্ছিল। পরে ‘চুলওয়ালা’ আরেকজন এসে হাজির হলো। একটু পরই দ্বিতীয় ব্যক্তি নিজের মাথার পরচুরা খুলে নিলে দেখা গেল, সে-ও আসলে ন্যাড়া। তখন দু’ন্যাড়া মিলেঝুলে খুশি মনে একই প্যাকেটের বিস্কুট উপভোগ করা শুরু করে দিলো। সর্বদলীয় সরকারের মহাজোট সঙ্গীরা সে বিজ্ঞাপনের ভাষায় এখন সমস্বরে বলতে পারেন আমরা আমরাই তো
এখন দেশের মানুষকে যা সবচেয়ে বেশি বিস্মিত করছে, তা হলোÑ এতদিন জাতীয় জীবন কণ্টকিত দলবাজির দরুণ, আর এবার রাজনীতির অঙ্গনে রেকর্ড সৃষ্টি হলো ডিগবাজির। ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে এভাবে পলিটিক্যাল সার্কাস মুফতে দেখতে পেয়ে জনগণ দুঃখের মাঝে কিঞ্চিৎ হাসির খোরাক পেয়েছে। সত্যিই কত রঙ্গ ভরা এই ভঙ্গ বঙ্গদেশ!
জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও ‘স্বৈরাচারী’রূপে বহুলালোচিত এরশাদ এই তো সেদিন বলেছিলেন, অনেক শিক্ষা হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগের সাথে বেহেশতে যেতেও রাজি নই। আর তিনিই দলটির ডাকে বঙ্গভবনে গেলেন। সেখানে এরশাদের দলের হাফডজন নেতানেত্রী মন্ত্রী হলেন। আওয়ামী লীগের সাথে বেহেশতের স্বাদ দিতে না-রাজি হলেও তাদের সাথে ক্ষমতার স্বাদ নিতে তিনি পুরোপুরি রাজি। একজন নাগরিকের মন্তব্য : এরশাদ ঠিকই জানতেন, বেহেশতে যাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে না পারলেও মন্ত্রিত্বের নিশ্চয়তা শেখ হাসিনা তাদের দিতে পারবেন।
এরশাদ আগে বলেছেন, বিএনপি ছাড়া নির্বাচনে গেলে মানুষ আমাকে থুতু দেবে। আর এখন বলছেন, নির্বাচনে না গেলে মানুষ থুতু দেবে। এখন যে ‘মানুষ’-এর কথা বলছেন, তারা কারা, তিনি কিন্তু খুলে বলেননি। এরশাদ বলেছিলেন, বিএনপি বাদে নির্বাচনে গিয়ে দালাল হিসেবে চিহ্নিত হতে চান না। এখন তিনি প্রমাণ করছেন, ক্ষমতা নয়, ক্ষমতার রাজনীতির খুদকুঁড়া খাওয়ার জন্যও সবই তাদের কাছে হালাল হওয়া অসম্ভব নয়। তিনি বেঈমান হয়ে মরতে চাননি। ১৮০ ডিগ্রি উল্টে গেলে মানুষের কাঁচা ঈমান পাকা হয় বলেই হয়তো তিনি মনে করেন।
এরশাদ সাহেব ছুটে গেলেন হাটহাজারী। সেখানে হেফাজতে ইসলাম প্রধান আল্লামা আহমদ শফীর সাথে সাক্ষাৎ করে দোয়া চাইলেন। মাওলানা সাহেব এরশাদের মনের কামনা পূরণের জন্য দোয়া করে দিলেন। পত্রিকায় এটা দেখে পাঠকেরা অবাক হয়ে ভাবলেন এই ‘কামনা’টা কী? এরশাদ জানালেন, রাজনৈতিক আলাপ হয়নি মাওলানা শফীর সাথে। অথচ ‘হুজুর’-এর পক্ষ থেকে জানানো হলো, এমন কিছু আলোচনা হয়েছে। পরে জানা গেছে, জাপা নেতা আল্লামা শফীকে বলেছেন একটি ইসলামি জোট গঠনের উদ্যোগের কথা। আর সেই তিনিই কিনা হাটহাজারী থেকে ঢাকায় ফিরে তার দলকে সরকারের অংশীদার বানিয়ে ফেললেন।
রবিঠাকুর বলেছেন, ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না।কবি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অনেক সময়ে যা চান বলে বক্তব্য দেন, সেটা ‘ভুল করে’ চান। তবে যা পেয়ে যান, তা যে চান না, তা নয়। হয়তো এটাই তার প্রকৃত কামনা।
এরশাদের দলের সুপরিচিত সাবেক মহাসচিব এবং তার আমলের জাঁদরেল মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এখন জাতীয় পার্টির ‘জেপি’ অংশের প্রধান। ১৭ নভেম্বর একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে মঞ্জু বলেছেন, ‘আমি তো তার মন্ত্রিসভায় সাত বছর ছিলাম। তাকে চিনি। গতকালও যিনি বললেন, সবাই না এলে নির্বাচনে যাবো না। পরে বললেন, গণতন্ত্র রক্ষার জন্য নির্বাচনে যাবেন। তিন দিন আগেও তার কথাবার্তা শুনলে কেউ বিশ্বাস করতে পারত না যে, তিনি নির্বাচনে যাবেন।মঞ্জু আরো বলেছেন, শুনেছি বি. চৌধুরীর বাড়িতে বৈঠক হলো, খাওয়া দাওয়া হলো। সেখানে আলোচনা হয়েছেÑ এই নেত্রীও না, ওই নেত্রীও না, আমরা একটা থার্ড ফোর্স করব; কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব না ।এরশাদ সাহেব বেরিয়ে এসে বললেন, গণতন্ত্র রক্ষার জন্য নির্বাচনে যাবো। ........... এরশাদ সাহেব সরকারের পতন চাচ্ছেন, চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছেন, অথচ তার ভাই মন্ত্রী।আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এরশাদের ‘ভোজবাজি’ প্রসঙ্গে বলেছেন, তার ভাইকে দু’এক দিনের মধ্যে মন্ত্রিসভা থেকে বের করে নিয়ে আসার কথা, অথচ আজ উল্টো সাতজনকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।আর সবাই দেখছে তাদের মধ্যে তার বৃদ্ধ স্ত্রীও রয়েছেন। অসুস্থতার কারণে তিনি রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে দূরে ছিলেন বেশ কিছু দিন ধরে। সেই তিনিই এখন দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী!
এরশাদ এক মুখে দু’রকম কথা বলে, রাজনৈতিক ডিগবাজি খেয়ে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতার স্তরকে সর্বনি¤œ পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। আওয়ামী লীগের চাপে কিংবা তাদের খুশি করতে তিনি নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দিলেন। সে আওয়ামী মহলের সর্বপ্রধান কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘এরশাদ সাহেব মহাজোটে আছেন কি নেই, এ প্রশ্ন তোলা নিরর্থক। কারণ তার দল নির্বাচনকালীন সরকারে আছে এবং স্বভাবতই নির্বাচনে থাকবে। এখন যদি তিনি বলেন, আমি মহাজোটে নেই, তা হলে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের টগর বোষ্টমীর একটি উক্তি স্মরণ করতে হবে। টগর বোষ্টমী বলেছিলেন, মিনসের সাথে ২০ বছর ঘর করেছি বটে, কিন্তু তাকে হেঁসেলে ঢুকতে দেইনি।’ এ ক্ষেত্রে এরশাদ সাহেবের অবস্থান কোথায়, তা আজ আর আলোচনা করতে চাই না।
কলামিস্ট আগাচৌ’র মতে, সবার আগে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও তার দল নির্বাচনে অংশ নেবেন ঘোষণা দিয়ে এরশাদ সাহেবের জাতীয় পার্টিতে প্রায় ভূমিধস সৃষ্টি করতে চলেছিলেন। এরশাদ নির্বাচনে না গেলে দলের একটা বড় অংশ মঞ্জুর সাথে চলে যেতেন বলে এই কলামিস্ট মনে করেন।
‘নামে কী-ইবা আসে যায়। বাস্তবে এটা অনেক ক্ষেত্রেই সত্য নয়। ‘নামে নামে যমে টানে’ কথাটাই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। শেখ হাসিনার ‘সর্বদলীয়’ সরকারকে আওয়ামী জোটের অন্ধভক্ত ছাড়া অন্যরা এ নামে ডাকতে নারাজ। তাদের কেউ বলছেন, এটা মহাজোটেরই সম্প্রসারিত সরকার। কেউ বলছেন, এটা আরেক চারদলীয় সরকার। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বললেন, কোয়ালিশন সরকারকে সর্বদলীয় বলা যায় না। মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, যারা অনির্বাচিত কাউকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের বিরুদ্ধে, তাদের গঠিত সরকারে সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল কয়েকটি দল নেই। তা হলে এটি কী করে ‘সর্বদলীয়’ হতে পারে? তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর ভাষায়, এটি বহুদলীয় সরকার। আর একজন নয়ামন্ত্রী জ্ঞান দিলেন, একের অধিক দল থাকলে সর্বদলীয়!
আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এপি’র সাবেক ব্যুরো চিফ ফরিদ হোসেন ডেইলি স্টারে লিখেছেন সর্বদলীয় সরকার : এটা মিত্র যোগ মিত্র শিরোনামে। তার লেখার শুরু এভাবেÑযখন এক গ্যালন পানি আরেক গ্যালন পানিতে মেশানো হয়, এর ফলে পানির পরিমাণ বাড়ে। তবে এতে পানির গুণগত মান উন্নত হয় না)
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক দিন আগে বলেছেন, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না; দেশের মানুষের শান্তি চাই।এ কথা শুনে দেশের মানুষ আশার আলো দেখতে পেয়েছিল। কারণ, এখন জাতীয় সঙ্কট তার অধীনে নির্বাচন করা না করা নিয়ে। এর সমাধান তার হাতেই, প্রেসিডেন্টের নয়। তিনি যদি সরকারপ্রধানের পদ ছেড়ে দেন, তা হলে সব ল্যাঠা চুকে যায়। এর পর সরকারের নাম তত্ত্বাবধায়ক, না অন্তর্বর্তী, না কি নির্বাচনকালীনÑ সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
হা হতোস্মি! সব আশার গুড়েবালি ঢেলে দেয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী বহাল রইলেন। তার অধীনেই ‘বহুদলীয়’ সরকার গঠিত হয়েছে। ৩০ মন্ত্রী বাদ দিয়ে ২৯ মন্ত্রীর সরকার এখন। প্রধানমন্ত্রীর হাতে আগে থেকেই ছিল প্রতিরক্ষা ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এখন যোগ হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের সাথে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যা নির্বাচনকালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আজ দেশে নির্বাচনকালীন সরকার হচ্ছে রাজনৈতিক সঙ্কটের কেন্দ্রবিন্দু। আর এই সরকার নির্দলীয় থাকার বিধান বাতিল করে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন করার জেদে এখন জাতীয় জীবনে মারাত্মক বিপদ ডেকে এনেছে। এটা সম্ভব হয়েছে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা নামে সরকার প্রধানের হাতে সর্বময় ক্ষমতা তুলে দিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানকে ক্ষমতাহীন অসহায় ব্যক্তিতে পর্যবসিত করার কারণে। আমাদের সংবিধান এক ব্যক্তি নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কুক্ষিগত করার মাধ্যমে ‘নির্বাচিত স্বৈরাচার’ কায়েমের সুযোগ রেখেছে। আর রাষ্ট্রপতির কাজ ‘জানাজা পড়া ও মিলাদ মাহফিলে’ সীমাবদ্ধ। এতে যেকোনো সরকারের প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা করলেই পরিবারতন্ত্র বা দলতন্ত্র কায়েম করতে পারেন। অথচ জাতীয় সঙ্কটে রাষ্ট্রপ্রধান অভিভাবক হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন না। এ অবস্থা শুধু বর্তমান আমলে নয়, মূলত সৃষ্টি হয়েছে ’৭২ সালের সংবিধানের মাধ্যমেই। গোড়ায় গলদ ছিল, যা পরবর্তীকালে আরো প্রকট হয়েছে। এই পরিস্থিতির দায় সেই সংবিধান প্রণয়নে যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাদের এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
গত ১৯ নভেম্বর একটি টিভি চ্যানেলে ’৭২-এর সংবিধানের অন্যতম প্রধান প্রণেতা এবং তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে সংবিধানের এই বেহাল দশা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি নিজেদের ভূমিকার সাফাই গাইলেন এভাবেÑ ‘আমরা তখন আসলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়াতে চেয়েছিলাম। তার যদি তা থাকত, তাহলে এখন সঙ্কট নিরসনে ভূমিকা রাখা তার জন্য সহজ হতো।’ কিন্তু কামাল হোসেন বলেননি, স্বাধীন দেশের সংবিধান ১৯৭২ সালে প্রণয়নকালে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করার কারণ কী? কে তাদের এটা করতে বাধ্য করেছিল? তখন তারা দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের স্বার্থে গণতান্ত্রিক চেতনতার প্রতিফলন কেন অনেক ক্ষেত্রে ঘটাতে পারেননি? এসব প্রশ্নের জবাবের মাঝে সমস্যাটির প্রতিকারের সন্ধান মিলবে বলে আশা করা যায়।
এখন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী তোড়জোড়। মনে হচ্ছে, দলটির বিশ্বাসÑ নির্বাচনী হুজুগে মানুষকে মাতিয়ে নির্দলীয় কেয়ারটেকার ইস্যু ভুলিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু এটা কিসের নির্বাচন? নিয়ম রক্ষার, না গণতন্ত্র রক্ষার? ১৯৮৮ সালে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন করেছিলেন এরশাদ। তাতে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন এবং এর ধাক্কায় নিজের পতন, কোনোটাই এড়ানো যায়নি। ১৯৯৬ সালে বেগম জিয়া সরকার নিয়ম রক্ষার নির্বাচন করেছিল। তার মাধ্যমে গঠিত সংসদে কেয়ারটেকার ব্যবস্থার বিধান করেও তার দল পরের নির্বাচনে জিততে পারেনি। নিছক সংবিধানের ধারাবাহিকতার কথা বলে নিয়ম রক্ষার যে নির্বাচন, তা রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে অভিনীত প্রহসনের নামান্তর। এটা বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের একটি বিপুল অপচয়। এমন পরিস্থিতির কারণ যাতে সৃষ্টি না হয়, সেজন্য প্রধানত ক্ষমতাসীন সরকার, সেই সাথে অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির আগে থেকেই সজাগ থাকা আবশ্যক। কিন্তু এ জাতির দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে দূরদর্শী ও প্রাজ্ঞ নেতানেত্রীর আকাল। এখানে রাজনীতিকের ছড়াছড়ি; অথচ রাষ্ট্রনায়কের (অথবা নায়িকা) দেখা মেলে না। রাজনৈতিক নেতানেত্রীর নজর পরবর্তী নির্বাচনের দিকে। আর একজন রাষ্ট্রনায়কের ভাবনায় থাকে পরবর্তী প্রজন্মের ভালোমন্দ।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনে যত বেশি সম্ভব, ছোট দলকে নামানোর যারপরনাই চেষ্টা করছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিরোধী দল (যারা তিনটি সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল) বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করছে না। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে তারা চায় না যে, বিএনপি নির্বাচনে আসুক। এ দিকে কয়েকটি নতুন অপরিচিত অনুল্লেখ্য ‘ইসলামী’ সংগঠন দাঁড় করিয়ে দেখানোর চেষ্টা চলছে, ইসলামপন্থীরাও এ নির্বাচনে শামিল হয়েছেন।
এই পরিকল্পনামাফিক খেলাফত মজলিসের একাংশসহ কয়েকটি ুদ্র সংগঠনের একটি জোট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়েছে। তবে শুরুতেই আওয়ামী লীগ ধাক্কা খেয়েছে। শায়খুল হাদিস মরহুম মাওলানা আজিজুল হকের সংগঠন, খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমির ও সাংগঠনিক সম্পাদকসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিরুদ্ধে। তারা বিবৃতির মাধ্যম স্মরণ করিয়ে দিলেন, গত সংসদ নির্বাচনের আগে এই আওয়ামী লীগ পাঁচ দফা চুক্তি করেছিল মজলিসের সাথে। কিন্তু অচিরেই সে চুক্তি আওয়ামী লীগই বাতিল করে দিয়েছিল।
১৯৭০ সালের নির্বাচনকে আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার প্রশ্নে ম্যান্ডেট হিসেবে তুলে ধরেছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে। তখন দলের নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এখন তার কন্যার আমলে সরকার বিতর্কিত ও একপেশে নির্বাচনের জন্য মেতে উঠেছে। স্বেচ্ছাচারীভাবে সংবিধানে কাটাছেঁড়া করে তার ভিত্তিতে এমন নির্বাচন করার তোড়জোড় চলছে যা গণতন্ত্রকে আরো বিপন্ন করে দলতন্ত্রের ভিতই পাকাপোক্ত করবে। এমন একটি নির্বাচনকে ‘১৯৭০ সালের নির্বাচনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ’ বলেছেন সদ্য বিগত মন্ত্রী ফারুক খান। ১৬ নভেম্বর গোপালগঞ্জে এক সমাবেশে এই মন্ত্রী বক্তৃতা করছিলেন। আজ যদি বিরোধী দলের কোনো নেতা একই কথা বলতেন, সাথে সাথে বঙ্গবন্ধুর অবমাননাই শুধু নয়, হয়তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে তাকে করা হতো অভিযুক্ত।
কথিত সর্বদলীয় সরকার বানিয়ে সংসদ নির্বাচন করার জন্য সরকার উঠেপড়ে লেগেছে। প্রধান বিরোধী দলকে বাগে আনতে না পেরে নিজেদের জোটের কয়েকটি দলকে শামিল করে আড়াই ডজন সদস্যের মন্ত্রিসভা ঘোষণা করা হয়েছে। কিছু খুচরা পার্টিকেও নির্বাচনী দৌড়ে নামানো হবে। কিন্তু এ নির্বাচন গণতন্ত্রের বিকাশ, না বিনাশ ত্বরান্বিত করবে, সেটাই এখন চিন্তাশীল নাগরিকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটকে বাইরে রেখে নির্বাচন করা হলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়বে ও দীর্ঘায়িত হবেÑ এমন শঙ্কা এখন আওয়ামী লীগ সমর্থক অনেকেরও।
বর্তমান সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক একটি পত্রিকায় এই ‘নির্বাচনী ট্রেন’ গন্তব্যে পৌঁছবে না বলে ছড়ায় ছন্দে উল্লেখ করা হয়েছে। ছড়াকার বলছেন, বিকল ট্রেনে উঠলে কি আর/ট্রেন চলবে গতিতে/ লাইনচ্যুতি ঘটে যদি/ পড়বে সবে ক্ষতিতে/--- জটিল কুটিল বুদ্ধি সকল/আছে জমা যাদের ব্রেনে/বুকের পাটায় সাহস নিয়েই/ উঠছে তারা বিকল ট্রেনে।
পাদটীকা : টিভি, পত্রিকা ও বিল বোর্ডে একটি বিজ্ঞাপন ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে। এতে দেখা যায়, দু’যুবক দোকানে বিস্কুট খাচ্ছে পাশাপাশি বসে। প্রথমে ন্যাড়া মাথার একজন খাচ্ছিল। পরে ‘চুলওয়ালা’ আরেকজন এসে হাজির হলো। একটু পরই দ্বিতীয় ব্যক্তি নিজের মাথার পরচুরা খুলে নিলে দেখা গেল, সে-ও আসলে ন্যাড়া। তখন দু’ন্যাড়া মিলেঝুলে খুশি মনে একই প্যাকেটের বিস্কুট উপভোগ করা শুরু করে দিলো। সর্বদলীয় সরকারের মহাজোট সঙ্গীরা সে বিজ্ঞাপনের ভাষায় এখন সমস্বরে বলতে পারেন আমরা আমরাই তো
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন