মিডিয়া জগতের কোনো কোনো মহল ফরহাদ মজহারকে প্রতিপক্ষে রেখে একটি
যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা করতে চাচ্ছে। সম্ভবত তাকেও প্রতিবিপ্লবীর কাতারে রেখে বিপ্লব
রক্ষার সৈনিকেরা কিছু একটা অর্জন করতে চান। হঠাৎ করে অনেকেই মিডিয়াপ্রেমী হয়ে
উঠেছেন। যুদ্ধটা যা না ফরহাদ মজহারের বিরুদ্ধে, তারচেয়ে বেশি
তার দূরদর্শী ও অকপট সত্য উচ্চারণের বিরুদ্ধে। তার সরকারবিরোধী অবস্থানের
বিরুদ্ধেও।
ফরহাদ মজহার এ সময়ে খ্যাতিমান ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী। তত্ত্বীয় চিন্তার প্রাগ্রসর মানুষ। মার্কসীয় ভাবধারার দেশজ ভাবনার অন্যতম পুরোধা। স্বভাবে-চরিত্রে ও চলনে-বলনে অনেকটা ভিন্ন মেজাজের মানুষ। চিন্তা করার ক্ষমতা, বলার সক্ষমতা ও নিজের চিন্তা ও বক্তব্যকে উপস্থাপনে তার রয়েছে আলাদা যোগ্যতা। একটি কবিমন ও কাব্য রচনার মুনশিয়ানা তাকে কবিখ্যাতি দিয়েছে। তিনি ভিন্নমতের সহাবস্থানে বিশ্বাসী একজন শুদ্ধ মানুষ। তিনি নিজেকে সুশীল ভাবতে নারাজ। চিন্তার স্বকীয়তা, গভীরতা ও বক্তব্য উপস্থাপনের নিজস্ব ভঙ্গিমার জন্য তিনি কিছুটা ব্যতিক্রমও বটে। সম্পূর্ণ আলাদা মেজাজের এই মানুষটি কোনো দলের নেপথ্যের কিংবা মাঠকর্মী নন। তিনি মূলত মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করেন। প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পরিবেশ রক্ষায় তার ভূমিকা প্রশংসনীয়। চিন্তা ও বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী ফরহাদ মজহার গতানুগতিক রাজনীতির ধার ধারেন না। তিনি ক্ষমতার রাজনীতির তুখোড় সমালোচক। অধিকন্তু একজন নিরপেক্ষ নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে আহমদ ছফা, নাজিম উদ্দিন মোস্তান, ফরহাদ মজহার প্রমুখ প্রগতিশীল ধারায় রাজনীতি বিশ্লেষণের তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা পালনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। আধিপত্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তারা পূর্বাপর একটি যৌক্তিক ভূমিকা পালন করতে থাকেন। আহমদ ছফা আজ আর নেই। নাজিম উদ্দিন মোস্তানও লোকান্তরে। এখন ফরহাদ মজহারের কণ্ঠ ও কলম স্তব্ধ করে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে। এত দিন মনে করতাম সাম্রাজ্যবাদীদের চিহ্নিত দালাল, সম্প্রসারণবাদীদের আজ্ঞাবহ চক্র ও আধিপত্যবাদী গোষ্ঠীর বশংবদ ছাড়া ফরহাদ মজহারের কোনো প্রতিপক্ষ নেই; কারণ মজলুম ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষের মানুষ হিসেবে তার অবস্থান স্বচ্ছ। বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী এবং বুদ্ধিজীবী হিসেবে তার গঠনমূলক ভূমিকা তর্কের ঊর্ধ্বে। শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তার ভূমিকা, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় তিনি ছিলেন প্রচণ্ড প্রতিবাদী। আবার আমেরিকান আগ্রাসনের সময়ও তিনি ফুঁসে ওঠা প্রতিবাদীদের প্রথম কাতারের মানুষ ছিলেন। ইরাক আগ্রাসনেও তাকে প্রতিবাদী অবস্থানে দেখেছি।
অথচ সেই সময়ে সোভিয়েত বলয়াধীন বামপন্থীরা শুধু মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। সোভিয়েত আগ্রাসনে সমর্থন জুগিয়েছেন। ইরাক আগ্রাসন, ইরাক-ইরান যুদ্ধেও আমাদের বামপন্থীরা যৌক্তিক ভূমিকা পালন করেননি। মিসর প্রশ্নেও বামপন্থীরা সামরিক শাসন চেয়েছেন, নির্বাচিত সরকার উৎখাতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
ব্যক্তি হিসেবে ফরহাদ মজহার কোনো দলের প্রতিপক্ষ নন। ভিন্নমতকেও তিনি যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করার মতো মানুষ। নিজের বক্তব্য, চিন্তা ও বিশ্বাসের ব্যাপারে তিনি যেমন অকপট, আবার ভিন্নমতকে জায়গা করে দেয়ার ক্ষেত্রেও তার কোনো জুড়ি নেই। চিন্তাকে চিন্তা দিয়ে, বুদ্ধিকে বুদ্ধি দিয়ে, আদর্শকে আদর্শ দিয়ে, রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করার মানুষ তিনি।
রাষ্ট্রযন্ত্র যখন নিপীড়কের ভূমিকা পালন করে, গণতান্ত্রিক সরকার যখন মানবাধিকার দমনের উৎসবে মেতে ওঠে ও স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে; তখন তিনি চুপ থাকাকে বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা মনে করেন। মানুষের ধর্ম, বর্ণ ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়কে তিনি শুধু সম্মানই করেন না, এসব অধিকার ুণœ হলে চিন্তা ও লেখায় রুখে দাঁড়ান। ছদ্মবেশী সামরিকতন্ত্র, সেনাশাসন, দেশের রাজনীতিতে বিদেশী হস্তক্ষেপ ও কূটনৈতিক ভ্রষ্টাচার তার কাছে অসহ্য লাগার মতো বিষয়।
ফরহাদ মজহারের বুদ্ধিবৃত্তিক সততা অনেক সুশীল ও রাজনীতি বিশ্লেষকের পীড়ার কারণ। তার অকপট ও সাহসী উচ্চারণ দলান্ধ মিডিয়ার কাছেও অসহনীয়। তাই একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টকশোতে দেয়া তার সামগ্রিক বক্তব্যকে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করে তাকে মিডিয়ার প্রতিপক্ষে খাড়া করার একটি পক্ষপাতদুষ্ট প্রয়াস লক্ষণীয়। ফরহাদ মজহারের পুরো বক্তব্য ও বিবৃতি পড়ে মনে হয়েছে তাকে সমালোচনার চেয়েও বিতর্কিত করে খামোশ করে দেয়াই আসল লক্ষ্য। যদিও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে কোনো মানুষ এতে ভীত হন না, খামোশও হয়ে যান না। রবার্ট ফিস্ক, অরুন্ধতী রায় ও ফরহাদ মজহারের মতো মিডিয়াবান্ধবেরা চিন্তার সতীত্বে বিশ্বাসী। তাই সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারেন। এই সত্য ও সাহসী উচ্চারণকে অসহিষ্ণুতার মোড়কে উপস্থাপন করে তাকে আজ উসকানিদাতার ভূমিকায় দেখানো হচ্ছে। দেখানো হচ্ছে মিডিয়ার শত্রু হিসেবে। আজ যারা ফরহাদ মজহারের মতের প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন, তাদেরকে ভিন্নমতের মিডিয়ার ব্যাপারে সোচ্চার হতে দেখিনি।
আজ দুনিয়াজুড়ে একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য উচ্চারণ হচ্ছেÑ আগ্রাসন ও দুঃশাসনের কারণে জুলুমপীড়ন-শোষণ-বঞ্চনা থেকে সন্ত্রাসের জন্ম নিচ্ছে। সহিংসতার উদ্ভবও অধিকার হরণের কারণে। অসহায় মানুষের অধিকার যখন মিডিয়াও অস্বীকার করে, ভিন্নমতকে উপড়ে ফেলার জন্য মিডিয়াও অপচেষ্টা চালায়, রাষ্ট্র যখন তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতা দেয়; তখন মজলুমের অনুনয়-বিনয়, আবেদন-নিবেদন, কান্নাকাতর, আর্তনাদও পদদলিত হয়। তখন নিপীড়িত মানুষ মরণকামড় বসিয়ে অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা করে। এই মরণকামড়ের কোনো ব্যাকরণ থাকে না। তখন তারা নিজেকে বাঁচানোর জন্য এতটাই সহিংস হয়ে ওঠে; যার নিন্দা করা যায়, ঠেকানো যায় না।
ফরহাদ মজহার যিনি কি না নিজেও একজন মিডিয়াকর্মী, তার বক্তব্যে এ তত্ত্বের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে বাংলাদেশের মিডিয়ার ওপর আক্রমণ ও মিডিয়ার পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। সেই অর্থে মিডিয়াকে কেন টার্গেট বানানো হচ্ছে তার একটা চিন্তাগত দিকও তুলে ধরেছেন। তিনি বক্তব্যে এ চিন্তার ধরন সম্পর্কে বলেছেন, সমর্থন করেননি; আবার তার বক্তব্যের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তাতে কোনো ধূম্রজাল নেই। অথচ মিডিয়াবান্ধব, ভিন্নমতের প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল ও মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনের সতত তৎপর এই কলমযোদ্ধা ও সৎ চিন্তককে আজ খল হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে পুলিশকে ডায়রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। মামলা করে হয়রানি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যখনই ভিন্নমত পদদলিত হয়েছে, মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, দেশে কিংবা বিদেশে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর অপচেষ্টা চালানো হয়েছে, ুদ্র নৃগোষ্ঠীকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে; তখনই তিনি প্রতিবাদী হয়েছেন।
সীমান্ত হত্যায় তিনি চুপ থাকতে পারেননি। ভিন্নমতের মিডিয়া ও সাংবাদিকদের ওপর সরকারের সীমাহীন বাড়াবাড়ি, ঔদ্ধত্য ও কণ্ঠরোধকে তিনি প্রতিহত করার ডাক দিয়েছেন। রাজনৈতিক খুন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়িকে তিনি অসহ্য বিবেচনা করেছেন। দেশের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব প্রশ্নে আপসহীন মানুষটিকে আজ অসহ্য বিবেচনা করার কারণ হতে পারে একটাইÑ তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রীকে ন্যায়সঙ্গত দাবিদাওয়ার প্রশ্নে আপসহীন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি সম্মিলিত পেশাজীবীদের বিরুদ্ধে সরকারের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া প্রতিবাদী মঞ্চে উঠেছেন। মাহমুদুর রহমানের ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছেন। ভিন্নমতের বন্ধ করে দেয়া মিডিয়া খুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। পক্ষপাতদুষ্ট, রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত ও মতান্ধ মিডিয়ার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। হেফাজতের ওপর সরকারের বাড়াবাড়ির তুখোড় সমালোচকদের তিনি অন্যতম বামপন্থী তাত্ত্বিক বুদ্ধিজীবী। অধিকন্তু মানবাধিকার সংগঠন অধিকারকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়াকে তিনি কর্তব্য ভাবেন।
ফরহাদ মজহারের শাণিত বক্তব্য এবং অকপট উচ্চারণে একজন মিডিয়াকর্মী হিসেবে আত্মসমালোচনা করার দায়বোধ করেছি। তাকে নিন্দা করার কথা ভাবিনি। কারণ তার বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করা যায়; কিন্তু তার মতকে অসহ্য বিবেচনা করে তার মুণ্ডুপাত করা যায় না। আমার যেমন একটি মত আছে, তেমনি ফরহাদ মজহারের একটি মত থাকা স্বাভাবিক। ভিন্নমতের সহাবস্থান চিহ্নিত করার জন্য যে লোকটি অবিরাম সংগ্রাম করছেন, তিনিই আজ ভিন্নমতের লোকদের আক্রোশের শিকার। এটিই বোধকরি ফরহাদ মজহারের শ্রেষ্ঠ অর্জন ও নগদ পাওনা। কারণ তিনি কারো বাড়াভাতে ছাই ছিটাননি। তার চিন্তা ও দর্শনের শক্তি এতই মোক্ষম আত্মসমালোচনা না করে দ্বিমত পোষণকারীরা যেন ক্ষেপে উঠেছে। সম্ভবত ফরহাদ মজহার এত দিনে তার চিন্তাকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। তার বক্তব্যের সারবত্তায় প্রতিপক্ষের আঁতে ঘা লেগেছে। এটিই একজন চিন্তাবিদের চিন্তার সাফল্য। রাষ্ট্রযন্ত্র, সরকার ও সরকারের অনুগতরা এককাতারে দাঁড়িয়ে তার প্রতিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় বিষয়টি আরো পরিষ্কার।
চিন্তাবিদ ও দার্শনিকেরা চিন্তা ও দর্শনের চাষ করবেন; প্রতিক্রিয়া হবে না, তাতে ফসল ফলবে না, তা তো প্রকৃতিসিদ্ধ নয়। যুগ যুগ ধরে চিন্তাবিদেরা আলোচিত-সমালোচিত হয়ে শুধু বরেণ্য হবেন, তা তো হয় না; নিন্দার ঝড় বইবে, আবার নন্দিত করার লোকেরও অভাব হবে না। এটিই স্বাভাবিক। ফরহাদ মজহারের সব বক্তব্যের সাথে একমত হওয়ার কোনো বাদ্যবাধকতা কারো নেই। তাকে উসকানিদাতার অবস্থানে রেখে তুলোধুনো করার বিরুদ্ধেও আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। তিনি ভিন্নমতের সহাবস্থানের পক্ষে লড়াই করেছেন। এবার এ লড়াইয়ে তিনি সম্মুখ সমরে। তবে এ লড়াইয়ে তিনি একা নন। এখন কোনো মহল থেকে তার ফাঁসি দাবি করলেও আশ্চর্য হবো না। তার চিন্তার ফাঁসি দাবি করলেও বলব, এটিই তো ফরহাদ মজহার বলতে চেয়েছেন। স্বাধীনভাবে কথা বলার ও দাবি করার এ সুযোগ অবারিত করে দেয়ার জন্যই ফরহাদ মজহারের এত সংগ্রাম। সব মতের, সব পক্ষের লোক যার যার অবস্থানে থেকে কথা বলবেন, দাবি জনাবেন, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করবেনÑ সুযোগটা মিডিয়া করে দেবে, রাষ্ট্র পাহারা দেবেÑ এটিই তো ফরহাদ মজহার বলতে চান। বলতে চেয়েছেন। তা হলে এত উষ্মা, হুমকি ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে স্বাগত জানানোর আয়োজন কেন!
ফরহাদ মজহার এ সময়ে খ্যাতিমান ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী। তত্ত্বীয় চিন্তার প্রাগ্রসর মানুষ। মার্কসীয় ভাবধারার দেশজ ভাবনার অন্যতম পুরোধা। স্বভাবে-চরিত্রে ও চলনে-বলনে অনেকটা ভিন্ন মেজাজের মানুষ। চিন্তা করার ক্ষমতা, বলার সক্ষমতা ও নিজের চিন্তা ও বক্তব্যকে উপস্থাপনে তার রয়েছে আলাদা যোগ্যতা। একটি কবিমন ও কাব্য রচনার মুনশিয়ানা তাকে কবিখ্যাতি দিয়েছে। তিনি ভিন্নমতের সহাবস্থানে বিশ্বাসী একজন শুদ্ধ মানুষ। তিনি নিজেকে সুশীল ভাবতে নারাজ। চিন্তার স্বকীয়তা, গভীরতা ও বক্তব্য উপস্থাপনের নিজস্ব ভঙ্গিমার জন্য তিনি কিছুটা ব্যতিক্রমও বটে। সম্পূর্ণ আলাদা মেজাজের এই মানুষটি কোনো দলের নেপথ্যের কিংবা মাঠকর্মী নন। তিনি মূলত মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করেন। প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পরিবেশ রক্ষায় তার ভূমিকা প্রশংসনীয়। চিন্তা ও বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী ফরহাদ মজহার গতানুগতিক রাজনীতির ধার ধারেন না। তিনি ক্ষমতার রাজনীতির তুখোড় সমালোচক। অধিকন্তু একজন নিরপেক্ষ নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে আহমদ ছফা, নাজিম উদ্দিন মোস্তান, ফরহাদ মজহার প্রমুখ প্রগতিশীল ধারায় রাজনীতি বিশ্লেষণের তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা পালনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। আধিপত্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তারা পূর্বাপর একটি যৌক্তিক ভূমিকা পালন করতে থাকেন। আহমদ ছফা আজ আর নেই। নাজিম উদ্দিন মোস্তানও লোকান্তরে। এখন ফরহাদ মজহারের কণ্ঠ ও কলম স্তব্ধ করে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে। এত দিন মনে করতাম সাম্রাজ্যবাদীদের চিহ্নিত দালাল, সম্প্রসারণবাদীদের আজ্ঞাবহ চক্র ও আধিপত্যবাদী গোষ্ঠীর বশংবদ ছাড়া ফরহাদ মজহারের কোনো প্রতিপক্ষ নেই; কারণ মজলুম ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষের মানুষ হিসেবে তার অবস্থান স্বচ্ছ। বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী এবং বুদ্ধিজীবী হিসেবে তার গঠনমূলক ভূমিকা তর্কের ঊর্ধ্বে। শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তার ভূমিকা, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় তিনি ছিলেন প্রচণ্ড প্রতিবাদী। আবার আমেরিকান আগ্রাসনের সময়ও তিনি ফুঁসে ওঠা প্রতিবাদীদের প্রথম কাতারের মানুষ ছিলেন। ইরাক আগ্রাসনেও তাকে প্রতিবাদী অবস্থানে দেখেছি।
অথচ সেই সময়ে সোভিয়েত বলয়াধীন বামপন্থীরা শুধু মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। সোভিয়েত আগ্রাসনে সমর্থন জুগিয়েছেন। ইরাক আগ্রাসন, ইরাক-ইরান যুদ্ধেও আমাদের বামপন্থীরা যৌক্তিক ভূমিকা পালন করেননি। মিসর প্রশ্নেও বামপন্থীরা সামরিক শাসন চেয়েছেন, নির্বাচিত সরকার উৎখাতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
ব্যক্তি হিসেবে ফরহাদ মজহার কোনো দলের প্রতিপক্ষ নন। ভিন্নমতকেও তিনি যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করার মতো মানুষ। নিজের বক্তব্য, চিন্তা ও বিশ্বাসের ব্যাপারে তিনি যেমন অকপট, আবার ভিন্নমতকে জায়গা করে দেয়ার ক্ষেত্রেও তার কোনো জুড়ি নেই। চিন্তাকে চিন্তা দিয়ে, বুদ্ধিকে বুদ্ধি দিয়ে, আদর্শকে আদর্শ দিয়ে, রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করার মানুষ তিনি।
রাষ্ট্রযন্ত্র যখন নিপীড়কের ভূমিকা পালন করে, গণতান্ত্রিক সরকার যখন মানবাধিকার দমনের উৎসবে মেতে ওঠে ও স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে; তখন তিনি চুপ থাকাকে বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা মনে করেন। মানুষের ধর্ম, বর্ণ ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়কে তিনি শুধু সম্মানই করেন না, এসব অধিকার ুণœ হলে চিন্তা ও লেখায় রুখে দাঁড়ান। ছদ্মবেশী সামরিকতন্ত্র, সেনাশাসন, দেশের রাজনীতিতে বিদেশী হস্তক্ষেপ ও কূটনৈতিক ভ্রষ্টাচার তার কাছে অসহ্য লাগার মতো বিষয়।
ফরহাদ মজহারের বুদ্ধিবৃত্তিক সততা অনেক সুশীল ও রাজনীতি বিশ্লেষকের পীড়ার কারণ। তার অকপট ও সাহসী উচ্চারণ দলান্ধ মিডিয়ার কাছেও অসহনীয়। তাই একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টকশোতে দেয়া তার সামগ্রিক বক্তব্যকে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করে তাকে মিডিয়ার প্রতিপক্ষে খাড়া করার একটি পক্ষপাতদুষ্ট প্রয়াস লক্ষণীয়। ফরহাদ মজহারের পুরো বক্তব্য ও বিবৃতি পড়ে মনে হয়েছে তাকে সমালোচনার চেয়েও বিতর্কিত করে খামোশ করে দেয়াই আসল লক্ষ্য। যদিও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে কোনো মানুষ এতে ভীত হন না, খামোশও হয়ে যান না। রবার্ট ফিস্ক, অরুন্ধতী রায় ও ফরহাদ মজহারের মতো মিডিয়াবান্ধবেরা চিন্তার সতীত্বে বিশ্বাসী। তাই সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারেন। এই সত্য ও সাহসী উচ্চারণকে অসহিষ্ণুতার মোড়কে উপস্থাপন করে তাকে আজ উসকানিদাতার ভূমিকায় দেখানো হচ্ছে। দেখানো হচ্ছে মিডিয়ার শত্রু হিসেবে। আজ যারা ফরহাদ মজহারের মতের প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন, তাদেরকে ভিন্নমতের মিডিয়ার ব্যাপারে সোচ্চার হতে দেখিনি।
আজ দুনিয়াজুড়ে একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য উচ্চারণ হচ্ছেÑ আগ্রাসন ও দুঃশাসনের কারণে জুলুমপীড়ন-শোষণ-বঞ্চনা থেকে সন্ত্রাসের জন্ম নিচ্ছে। সহিংসতার উদ্ভবও অধিকার হরণের কারণে। অসহায় মানুষের অধিকার যখন মিডিয়াও অস্বীকার করে, ভিন্নমতকে উপড়ে ফেলার জন্য মিডিয়াও অপচেষ্টা চালায়, রাষ্ট্র যখন তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতা দেয়; তখন মজলুমের অনুনয়-বিনয়, আবেদন-নিবেদন, কান্নাকাতর, আর্তনাদও পদদলিত হয়। তখন নিপীড়িত মানুষ মরণকামড় বসিয়ে অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা করে। এই মরণকামড়ের কোনো ব্যাকরণ থাকে না। তখন তারা নিজেকে বাঁচানোর জন্য এতটাই সহিংস হয়ে ওঠে; যার নিন্দা করা যায়, ঠেকানো যায় না।
ফরহাদ মজহার যিনি কি না নিজেও একজন মিডিয়াকর্মী, তার বক্তব্যে এ তত্ত্বের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে বাংলাদেশের মিডিয়ার ওপর আক্রমণ ও মিডিয়ার পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। সেই অর্থে মিডিয়াকে কেন টার্গেট বানানো হচ্ছে তার একটা চিন্তাগত দিকও তুলে ধরেছেন। তিনি বক্তব্যে এ চিন্তার ধরন সম্পর্কে বলেছেন, সমর্থন করেননি; আবার তার বক্তব্যের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তাতে কোনো ধূম্রজাল নেই। অথচ মিডিয়াবান্ধব, ভিন্নমতের প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল ও মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনের সতত তৎপর এই কলমযোদ্ধা ও সৎ চিন্তককে আজ খল হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে পুলিশকে ডায়রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। মামলা করে হয়রানি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যখনই ভিন্নমত পদদলিত হয়েছে, মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, দেশে কিংবা বিদেশে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর অপচেষ্টা চালানো হয়েছে, ুদ্র নৃগোষ্ঠীকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে; তখনই তিনি প্রতিবাদী হয়েছেন।
সীমান্ত হত্যায় তিনি চুপ থাকতে পারেননি। ভিন্নমতের মিডিয়া ও সাংবাদিকদের ওপর সরকারের সীমাহীন বাড়াবাড়ি, ঔদ্ধত্য ও কণ্ঠরোধকে তিনি প্রতিহত করার ডাক দিয়েছেন। রাজনৈতিক খুন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়িকে তিনি অসহ্য বিবেচনা করেছেন। দেশের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব প্রশ্নে আপসহীন মানুষটিকে আজ অসহ্য বিবেচনা করার কারণ হতে পারে একটাইÑ তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রীকে ন্যায়সঙ্গত দাবিদাওয়ার প্রশ্নে আপসহীন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি সম্মিলিত পেশাজীবীদের বিরুদ্ধে সরকারের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া প্রতিবাদী মঞ্চে উঠেছেন। মাহমুদুর রহমানের ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছেন। ভিন্নমতের বন্ধ করে দেয়া মিডিয়া খুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। পক্ষপাতদুষ্ট, রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত ও মতান্ধ মিডিয়ার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। হেফাজতের ওপর সরকারের বাড়াবাড়ির তুখোড় সমালোচকদের তিনি অন্যতম বামপন্থী তাত্ত্বিক বুদ্ধিজীবী। অধিকন্তু মানবাধিকার সংগঠন অধিকারকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়াকে তিনি কর্তব্য ভাবেন।
ফরহাদ মজহারের শাণিত বক্তব্য এবং অকপট উচ্চারণে একজন মিডিয়াকর্মী হিসেবে আত্মসমালোচনা করার দায়বোধ করেছি। তাকে নিন্দা করার কথা ভাবিনি। কারণ তার বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করা যায়; কিন্তু তার মতকে অসহ্য বিবেচনা করে তার মুণ্ডুপাত করা যায় না। আমার যেমন একটি মত আছে, তেমনি ফরহাদ মজহারের একটি মত থাকা স্বাভাবিক। ভিন্নমতের সহাবস্থান চিহ্নিত করার জন্য যে লোকটি অবিরাম সংগ্রাম করছেন, তিনিই আজ ভিন্নমতের লোকদের আক্রোশের শিকার। এটিই বোধকরি ফরহাদ মজহারের শ্রেষ্ঠ অর্জন ও নগদ পাওনা। কারণ তিনি কারো বাড়াভাতে ছাই ছিটাননি। তার চিন্তা ও দর্শনের শক্তি এতই মোক্ষম আত্মসমালোচনা না করে দ্বিমত পোষণকারীরা যেন ক্ষেপে উঠেছে। সম্ভবত ফরহাদ মজহার এত দিনে তার চিন্তাকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। তার বক্তব্যের সারবত্তায় প্রতিপক্ষের আঁতে ঘা লেগেছে। এটিই একজন চিন্তাবিদের চিন্তার সাফল্য। রাষ্ট্রযন্ত্র, সরকার ও সরকারের অনুগতরা এককাতারে দাঁড়িয়ে তার প্রতিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় বিষয়টি আরো পরিষ্কার।
চিন্তাবিদ ও দার্শনিকেরা চিন্তা ও দর্শনের চাষ করবেন; প্রতিক্রিয়া হবে না, তাতে ফসল ফলবে না, তা তো প্রকৃতিসিদ্ধ নয়। যুগ যুগ ধরে চিন্তাবিদেরা আলোচিত-সমালোচিত হয়ে শুধু বরেণ্য হবেন, তা তো হয় না; নিন্দার ঝড় বইবে, আবার নন্দিত করার লোকেরও অভাব হবে না। এটিই স্বাভাবিক। ফরহাদ মজহারের সব বক্তব্যের সাথে একমত হওয়ার কোনো বাদ্যবাধকতা কারো নেই। তাকে উসকানিদাতার অবস্থানে রেখে তুলোধুনো করার বিরুদ্ধেও আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। তিনি ভিন্নমতের সহাবস্থানের পক্ষে লড়াই করেছেন। এবার এ লড়াইয়ে তিনি সম্মুখ সমরে। তবে এ লড়াইয়ে তিনি একা নন। এখন কোনো মহল থেকে তার ফাঁসি দাবি করলেও আশ্চর্য হবো না। তার চিন্তার ফাঁসি দাবি করলেও বলব, এটিই তো ফরহাদ মজহার বলতে চেয়েছেন। স্বাধীনভাবে কথা বলার ও দাবি করার এ সুযোগ অবারিত করে দেয়ার জন্যই ফরহাদ মজহারের এত সংগ্রাম। সব মতের, সব পক্ষের লোক যার যার অবস্থানে থেকে কথা বলবেন, দাবি জনাবেন, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করবেনÑ সুযোগটা মিডিয়া করে দেবে, রাষ্ট্র পাহারা দেবেÑ এটিই তো ফরহাদ মজহার বলতে চান। বলতে চেয়েছেন। তা হলে এত উষ্মা, হুমকি ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে স্বাগত জানানোর আয়োজন কেন!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন