শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৩

চরম বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশ


জানুয়ারি মাস যতই ঘনিয়ে আসছে আমাদের শরীরের উত্তাপ ততই বেড়ে চলেছে। সবাই আজ সশঙ্কিত। নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশে না জানি কী ঘটে যায়! এখন আর সংলাপের সুযোগ নেই। বিএনপি সমাবেশ ঘটিয়েছে, তিন দিন লাগাতার হরতাল দিয়েছে, পরে আরো চার দিন হরতালে দেশ অচল করে দিয়েছে। হরতাল এবং সেই হরতাল প্রতিরোধের তাণ্ডব দেশের মানুষ দেখেছে। প্রতিরোধের প্রচেষ্টা না থাকলে সহিংসতা হয় না। রাস্তাঘাট ছিল নিরাপত্তাবাহিনীতে ঠাসা। সেই নিরাপত্তাবাহিনীর বেষ্টনী ভেদ করে যারা হরতালকারীদের ওপর ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, হাতেনাতে কেউ ধরা পড়েনি। তবুও গ্রেফতার করা হয়েছে বেছে বেছে জামায়াত ও বিএনপির নেতাকর্মীদের। হরতাল প্রতিরোধকারীরা পুলিশ প্রটেকশনে থেকে হরতালকারীদের ওপর হামলা চালিয়েছে বহু স্থানে। ফলে মানুষ মরেছে, অগ্নিদগ্ধ হয়েছে, গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে, রাস্তায় রাস্তায় টায়ারে আগুন ধরিয়ে এক বীভৎস অবস্থার সৃষ্টি করেছে। ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়েছে রাস্তাঘাট। এ দিকে শেখ হাসিনা নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন দেশব্যাপী। প্রশাসনের সব ধরনের সুবিধা নিয়ে সভা করে বেড়াচ্ছেন। সরকারি হেলিকপ্টার, গাড়ি, লঞ্চ ব্যবহার করছেন। সভায় মঞ্চ ও তোড়ণ বানিয়ে রাস্তাঘাট সুসজ্জিত করেছে ছাত্র ও যুবলীগের ক্যাডাররা। প্রয়োজনীয় সব রকম সহায়তা পাচ্ছেন স্থানীয় প্রশাসন থেকে। প্রধানমন্ত্রী যেসব উক্তি সভামঞ্চ থেকে করে যাচ্ছেন, তা সঠিক নয়, সত্যের অপলাপ ও কুরুচিপূর্ণÑ এমন অভিযোগ উঠেছে। তিনি বলেন, বিএনপির সৃষ্টি হয়েছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে; তাই দেশের মানুষের প্রতি তাদের দরদ থাকতে পারে না। তারা যখন ক্ষমতায় ছিল তখন সীমাহীন দুর্নীতি করেছে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি করে দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। জিয়াউর রহমান জোরজবরদস্তি ক্ষমতা দখল করেছিলেনÑ এসব বিতর্কিত কথা বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দেশের মানুষ জানে, খালেদ মোশাররফ এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। মাত্র সাত দিনের মধ্যে সিপাহিরা কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে এক কাউন্টার ক্যুর মাধ্যমে খালেদ মোশাররফসহ বেশ কিছু সামরিক অফিসারকে হত্যা করেন। জিয়াউর রহমানকে তারা বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে ক্ষমতায় বসান। শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে আরো বলেন, তিনি নাকি দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছেন। এ নিয়েও আছে নানা বিতর্ক। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের কবর রচনা করে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করে। অন্য সব পার্টির রাজনীতি বন্ধ করে দেয়। চারটি সরকারি পত্রিকা ছাড়া সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের চরম নির্যাতন করা হয়। এ সময় বিরোধী দলের অসংখ্য নেতাকর্মী রক্ষীবাহিনীর হাতে খুন হন। জিয়াউর রহমান সর্বদলীয় নির্বাচন দেন। সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এনে একদলীয় বাকশালী শাসন বাতিল করে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেন। বর্তমান আওয়ামী লীগও গণতন্ত্রের চর্চা করেনি; গণতন্ত্রের পরিবর্তে দেশে স্বৈরশাসন কায়েম করা হয়েছে। দেশের মানুষ এখনো ভুলে যায়নি যে, এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার বিএনপি ক্ষমতায় আসে। নির্বাচনের দিন শেখ হাসিনা বহু নির্বাচনী কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। সাংবাদিকেরা তাকে জিজ্ঞেস করেনÑ ম্যাডাম, নির্বাচন কেমন হয়েছে? কোনো অনিয়ম, কারচুপি হয়েছে কি? শেখ হাসিনা বলেছেনÑ না, আমি কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে দেখেছি। কোথাও কোনো কারচুপি বা অনিয়ম চোখে পড়েনি। নির্বাচনের ফল প্রকাশ হলে সেই সাংবাদিকেরা তাকে বলেনÑ ম্যাডাম, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে কিন্তু আপনি নির্বাচনে জিততে পারলেন না কেন? তখন তিনি উত্তর দিলেনÑ নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে। আমি এক দিনের জন্যও খালেদা জিয়াকে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করতে দেবো না। কার্যত তিনি তা-ই করেছিলেন। পাঁচটি বছর হরতাল, সংসদ বর্জন করে দেশ অচল করে দেন। আওয়ামী লীগ নেতানেত্রীরা এখন প্রায় সবাই বলে থাকেন, ‘আমরা যখন ক্ষমতায় থাকি তখন দেশে উন্নয়নমূলক কাজ হয়। আমরা দেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্নতা অর্জন করেছি। রাস্তাঘাট সংস্কার করেছি, দুর্ঘটনা রোধেবিভিন্ন রাস্তায় ডিভাইডার করে দিয়েছি। বিদ্যুৎ সমস্যাসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আর বিএনপি যখনই ক্ষমতায় আসে, তখনই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যায়। দেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা শুরু হয়। বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। আরেকবার যদি আমরা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসি দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করব।কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ১৯৯৬ সালে কয়েক হাজার কোটি টাকার বিমান ক্রয় করা হয়, যদিও মিগ বিমানের আবশ্যকতা আমাদের দেশে নেই। কিন্তু কেনার পর দেখা গেল বিমানগুলো আকাশে উড়তে পারে না। বিমানগুলো সম্পূর্ণ বিকল। পুরনো লোহালক্কড় হিসেবে নয়াবাজারে বিক্রি করা ছাড়া অন্য কোনো কাজে লাগানো যাবে না। দুর্নীতি করার জন্য এই বিকল মিগ কেনা হয়েছে। টাকাগুলো কয়েকজনের মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছে। বিশাল পদ্মা সেতু প্রজেক্টের নির্মাণকাজ শুরুর প্রাক্কালে দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের কাছে অনিয়ম ও দুর্নীতি ধরা পড়ল। তারা চেয়েছিল দুর্নীতিবাজদের প্রজেক্টের কাজ থেকে অব্যাহতি দেয়া হোক। যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ ছিল। তখন যদি তিনি পদত্যাগ করতেন, তাহলে কোনো ঝামেলাই থাকত না। বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পের ঋণচুক্তি বাতিল করলে এ সরকারের চৈতন্য ফেরে। আবুল হোসেন পদত্যাগ করেন। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। বর্তমান সরকারের আমলে সীমাহীন দুর্নীতি, বিরোধী দলের ওপর অমানবিক ও অগণতান্ত্রিক দমনপীড়ন যখন সরকারকে অজনপ্রিয় করে তুলেছে ভয়াবহভাবে, ঠিক তখন সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছে বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনের বাইরে রেখে দলীয় সরকারের অধীনে যেনতেন একটা নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে। কিন্তু জনমত এরই মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে চলে গেছে। জনমত উপেক্ষা করে একতরফা নির্বাচন করার পরিণতি যে ভালো নয়, তা সরকারকে মাথায় রাখতে হবে। না হলে দেশের সামনে অপেক্ষা করছে এক ভয়াবহ বিপর্যয়। এর তীব্রতা কতটা হবে, তা আঁচ করাও মুশকিল। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads