মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

গণতন্ত্রের কফিনে পেরেকগুলো


আমি প্রথমে ভুল হবে ভেবেছিলাম, তোফায়েল আহমেদ সম্ভবত এই পেরেক ঠোকার কাজে অংশ নেবেন না। কিন্তু তার শপথ গ্রহণের পর আমি জনাব তোফায়েলের রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে বসেছিলাম। দেখলাম, না, তোফায়েল সঠিক কাজটি করেছেন। এর আগে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে তিনি যে রাজি হননি, সে ছিল নিছকই অভিমান। এ যাত্রা তার সে অভিমান ভেঙেছে। তিনি গণতন্ত্রের কফিনে পেরেক ঠোকার কাজে অংশ নিয়েছেন। এটি তার রাজনৈতিক জীবনের ধারাবাহিকাতারই অংশ। ১৯৭৫ সালে গণতন্ত্র হত্যা করে শেখ মুজিবুর রহমান যখন একদলীয় স্বৈরশাসন কায়েম করেন, তখন তার প্রধান লাউডস্পীকার ছিলেন তিনিই। তখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ভিন্ন দলে ছিলেন। মরহুম আবদুর রাজ্জাক ছিলেন, তিনিও ছিলেন আর এক লাউডস্পীকার। তারা বাকশালের নিড়ানি দিয়ে সকল গণতান্ত্রিক মানুষকে সমাজ থেকে উপড়ে ফেলার আন্দোলন শুরু করেছিলেন।
আমি ভেবেছিলাম, তখন তার বয়স কম ছিল। শেখ মুজিবের প্রতি অপিরিসীম ভালোবাসার কারণে তিনি ঐ কাজ করেছিলেন। এখন তার বয়স হয়েছে, হয়তো তখনকার চেয়ে অনেক পরিপক্বতা অর্জন করেছেন। দ্বিতীয়বার গণতন্ত্র হত্যার পরিকল্পনায় তিনি অংশ নেবেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখলাম, তার স্বভাবে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তিনি তেমনইভাবে স্বৈরাচারী মনোভাবাপন্নই রয়ে গেছেন। আবদুর রাজ্জাক, আমীর হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ আর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ২০০৭ সালে যখন আওয়ামী লীগের সংস্কারবাদীদের দলে যোগ দেন, তখন তারা র‌্যাটস নামে খ্যাতি বা কুখ্যাতি অর্জন করেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে এই র‌্যাটসকে লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দেন। তাদের সংস্কার চিন্তাও মাঠে মারা যায়। আওয়ামী লীগে তারা কোণঠাঁসা হয়ে পড়েন। তারপরেও কোনোমতে নৌকার কিনারা ধরে ঝুলে ছিলেন। বলেছিলেন, সারা জীবন আওয়ামী লীগ করেছি, আওয়ামী লীগেই থাকবো ।
তারপরের ঘটনাবলি বেশ চমকপ্রদ। ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জী বাংলাদেশে এসে শেখ হাসিনার সঙ্গে আধা ঘণ্টার এক বৈঠকে মিলিত হন। কিন্তু র‌্যাটস-এর সঙ্গে তিনি দুই ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। তখনই বোঝা গিয়েছিল, শেখ হাসিনা ফেলে দিলেও ভারত তাদের কতো গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আরও বোঝা গিয়েছিল যে, মন্ত্রী না থাকলেও ভারতের কাছে এদের গুরুত্ব শেখ হাসিনার চেয়েও অনেক বেশি। ঐ বৈঠকের মাধ্যমে ভারত সেকথা মোটামুটি প্রকাশ্যে শেখ হাসিনাকে জানান দিয়ে গেল। ফলে তাদের দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হলেও ফেলে দেওয়া যে সম্ভব নয়, সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভারতের মদত ও আনুকূল্যেই। প্রথম প্রথম তিনি ভারতের সকল অযৌক্তিক দাবি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ভারত যখন বাংলাদেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ মুজিবকে উৎসাহিত করছিল, তখনও ভারতে গণতন্ত্র ছিল এবং এখনও আছে। তারপরেও ভারত বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের বদলে ভারতপন্থী শাসকদের একচ্ছত্র ক্ষমতা দেখতে চায়।
ভারত একথা বিবেচনায় নিতে চায় না যে, ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে ভিন্ন মত-পথ থাকবে। ভারতে হিন্দু মৌলবাদী দল বিজেপি আছে, আরও চরমপন্থী দল আরএসএস আছে। তাদের নিয়ে কোনো দিন কেউ প্রশ্ন তুলছে না, কিন্তু বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী থাকলে তাদের নিশ্চিহ্ন করার ক্ষেত্রে ভারত অবিরাম মদত দিয়ে যাচ্ছে। পার্থক্যটা এখানেই। অর্থাৎ ভারতের হিন্দুরা যদি মুসলমানদের জবাই করে, তবে তা মৌলবাদ হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে কেউ যদি ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দেয়, তাহলে সে হয়ে উঠে ইসলামী জঙ্গিবাদী। অথচ এই বাংলাদেশে ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। ইসলাম তাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। এখানে নগরে-বন্দরে-গ্রামে-গঞ্জে দেশের প্রান্তে প্রান্তে অবিরাম আল্লাহু আকবার ধ্বনি উঠছে। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে মসজিদে আজান হলে সবাই নামাজের জন্য হাজির হচ্ছে। সেখান থেকে ইসলাম মুছে দেবেন? সেও কি সম্ভব?
আমাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় সেটা নয়। আমরা গণতন্ত্র হত্যার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করছিলাম। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরেছেন। সেই প্রক্রিয়ায় তিনি একের পর এক গণতন্ত্রঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে যাচ্ছেন। তারই সর্বশেষ সিদ্ধান্ত একদলীয় নির্বাচন। শেখ মুজিবুর রহমান এই প্রক্রিয়ায় সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। শেখ হাসিনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেননি বটে, কিন্তু টুঁটি চিপে হত্যা করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের বিতর্কিত ট্রাইবুনালের মাধ্যমে ফাঁসি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা হামেশাই কারাগারে থাকেন। এখনও আছেন।
তাদের কোনো অপরাধ নেই। এমন সব ঠুনকো অভিযোগে বিএনপি নেতাদের কারাগারে নেওয়া হচ্ছে, যা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিশ্বাসযোগ্য কি, বিশ্বাসযোগ্য নয় তাতে শেখ হাসিনা সরকারের কিছুই যায় আসে না। ষাট-সত্তর বা আশিঊর্ধ্ব বিএনপি নেতাদের কারাগারে পোরা হচ্ছে এই বলে যে, তারা বাসে আগুন দিয়েছেন। কিংবা সচিবালয়ের ভেতরে বোমা মেরেছেন। একথা কোন পাগলেও বিশ্বাস করবে না। কিন্তু তাতে শেখ হাসিনার কিছুই যায় আসে না। তিনি যা মনে করেন সেটাই বেদবাক্য। মুশকিলও সেখানে। ফলে গণতন্ত্রের কবর রচিত হতে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনা এক তামাশার নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। পার্লামেন্টও থাকবে। তিনি প্রধানমন্ত্রীও থাকবেন, সংসদ সদস্যরা যে যার পদে অধিষ্ঠিত থাকবে। তার মধ্যে হবে নির্বাচন। এমন তামাশা পৃথিবীর কোথায়ও হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। সেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তিনি নির্বাচনকালীন এক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। জনগণের সঙ্গে মশকরারও বোধ করি একটা সীমা থাকে। এটা সে সীমারও লংঘন। তার জন্য গঠন করছেন এক আজব তামাশার মন্ত্রিসভা। সে মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছেন র‌্যাটস-এর জীবিত সকল সদস্য। এরশাদের জাতীয় পার্টি, মেনন আর ইনু। গত এক সপ্তাহে আজব সব কা- করেছেন এরশাদ। সকালে এক কথা বলেছেন, বিকালে আর এক কথা বলেছেন। তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে যদি এই নির্বাচনে তিনি যান, তবে লোকে তার মুখে থুতু দেবে। কিন্তু একদিন পরই তিনি নির্বাচনে যাবার ঘোষণা দিলেন। আশা করি, তিনি জনগণের লক্ষ-কোটি থুতু মুখে নেবার জন্য তৈরি থাকবেন।
সরকার যদি ভেবে থাকে, তাদের এই অদ্ভুত ও কি¤ভুত নির্বাচন জনগণ দুহাত বাড়িয়ে স্বাগত জানাবে, তাহলে তারা আহম্মকের স্বর্গে বসবাস করছেন। বাংলাদেশের জনগণ সব সময়ই গণতন্ত্রপ্রিয়। তারা খাঁটি গণতন্ত্রের চর্চায় অভ্যস্ত। সুতরাং সরকারের এই অপচেষ্টা যে জনগণ ব্যর্থ করে দেবে, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এর আগে পরপর তিন দফায় ৬০ ঘণ্টা, ৬০ ঘণ্টা ও ৮৪ ঘণ্টার হরতালে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে দেখিয়ে দিয়েছে, তাদের শক্তি কতটুকু এবং তারা কী চায়। সরকারকে জনগণ রাজধানীতে একেবারে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। তারা জানান দিয়েছে, সরকারের সকল স্বৈরাচারী কর্মকা-, উৎপীড়ন, নির্যাতন, নিপীড়ন প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তারা রাখে। দেশ কারও বাপ-দাদার তালুক মুলুক নয়। দেশ জনগণের। জনগণ যেভাবে চায়, সেভাবেই দেশ পরিচালিত হতে হবে। এর ব্যত্যয় তারা মেনে নেবে না।
এর আগে শেখ মুজিবুর রহমান, সেনাপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সেনাপতি মইনুদ্দিন আহমদ প্রমুখ একইভাবে দেশে স্বৈরশাসন কায়েমের অপচেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। কিন্তু তাদের কেউই শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেননি। জনতার রুদ্ররোষে তাদের পতন হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয় বাকশাল সরকার খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। শেখ হাসিনা সহযোগিতা করেছিলেন বলে, এরশাদ একটু বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলেন। সব সময়ই শেখ হাসিনা এদেশে সামরিক শাসনকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি এরশাদকে স্বাগত জানিয়েছেন, সেনাপতি নাসিমকে স্বাগত জানিয়েছেন, সেনাপতি মইনকে স্বাগত জানিয়েছেন। গণতন্ত্র তার কাছে এক দুঃসহ ব্যাপার। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তার এক কবিতায় লিখেছিলেন, ‘সহে না সহে না জনতার জঘন্য মিতালি’। শেখ হাসিনার কাছেও জনতার মিতালি একেবারেই অসহ্য। সুতরাং জনতার ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়ে তিনি তাদের আকাক্সক্ষাকে ধূলায় মিশিয়ে দিতে চান।
কী হবে বলতে পরি না। ক্ষমতায় অবস্থান, সাজানো প্রশাসন, ঠুঁটো জগন্নাথ অনুগত নির্বাচন কমিশন, কিছু স্তাবক আর সিপাই-সামন্ত নিয়ে নির্বাচন হয়তো তিনি করে ফেলতে পারবেন, কিন্তু সে নির্বাচন প্রতিহত করতে জনগণ যে এগিয়ে আসবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। বিগত হরতালগুলোতে জনগণ দেখিয়ে দিয়েছে যে, তাদের আকাক্সক্ষার প্রতিপক্ষকে কীভাবে প্রতিহত করতে হয়। জনগণকে প্রতিপক্ষ দাঁড় করিয়ে পৃথিবীর কোনো স্বৈরাচারী সরকারেরই শেষ রক্ষা হয়নি। আশা করি, শেখ হাসিনা সরকারেরও শেষ রক্ষা হবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads