গত বৃহস্পতিবার প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় সভায় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে সব কথা বলেছেন সে সব কথায় সাংবাদিক সমাজ মুগ্ধ হয়েছেন। যখন তিনি বলেছেন যে, আওয়ামী লীগের সাথে আর আপোষের কোন সুযোগ নাই তখন সাংবাদিক সমাজ আনন্দে বিপুল করতালি দেন। তিনি যথারীতি বলেছেন যে, অন্য কেউ সাথে না আসলেও একা একা তিনি হাসিনাবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। সেই আন্দোলনে শরীক হওয়ার জন্য তিনি উপস্থিত সাংবাদিক সমাজকে আহ্বান জানান। সাংবাদিক সমাজও নেতার প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেন এবং বলেন যে, তারাও এই আন্দোলনে সুখে দুঃখে বেগম খালেদা জিয়ার পাশে থাকবেন। শুধু প্রেস ক্লাবে নয়, ঐ মতবিনিময় সভার আগেও বেগম জিয়া যে সব সভায় গিয়েছেন অথবা সংকটকালে যারা তার সাথে দেখা করেছেন তাদের কাছেও বেগম জিয়া একই প্রত্যয়ের প্রতিধ্বনি করেছেন। কাদের সিদ্দিকীর এক প্রশ্নের উত্তরে দেশনেত্রী বলেছেন যে, কাদের সিদ্দিকীরা তার সাথে আসেন বা না আসেন তিনি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
আসলে আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। এই চলমান আন্দোলন তখনই শেষ হবে যখন নির্দলীয় সরকারের দাবি গ্রহণ করে শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে সরে যাবেন। ঠিক এই পয়েন্টে শুধুমাত্র সাংবাদিক সমাজ নন, দেশের ১৬ কোটি মানুষের ৭০ শতাংশ আজ বেগম জিয়ার পেছনে ঐক্যবদ্ধ। সরকারবিরোধী এ আন্দোলনে বিগত ৯ মাসে ২৬২ ব্যক্তি প্রাণ দিয়েছেন। যারা জীবন দিয়েছেন তাদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক রয়েছেন জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী এবং বিএনপির বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী। এছাড়াও শহীদ হয়েছেন বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ। প্রায় পৌনে তিনশত শহীদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে সরকারের সাথে আপোষের কোন সুযোগ নাই।
এটি যখন বেগম খালেদা জিয়া তথা ১৮ দলের ঐক্যবদ্ধ কথা, অন্যদিকে তেমনি শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগও অনড় অবস্থান নিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সংলাপে মোটেই আগ্রহী নয়। শেখ হাসিনা যে বেগম জিয়াকে ফোন করেছিলেন সেখানেও ছিল গরজ বড় বালাই। তার টেলিফোনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ১৮ দলের হরতাল থেকে বেগম খালেদা জিয়া তথা ১৮ দলকে বিরত রাখা। সংলাপের নামে বেগম খালেদা জিয়া তাৎক্ষণিক উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন এবং শেখ হাসিনার পাতা ফাঁদে পা দেননি। সেদিন দেশের অসংখ্য বুদ্ধিজীবী বেগম জিয়ার রাজনৈতিক পরিপক্বতায় মুগ্ধ হয়েছেন। ৩৭ মিনিটের এই আলোচনায় তিনি সরকারি দলের নেতাকে কুপোকাৎ করেছেন। সে দিনের টেলিফোন সংলাপ সরকার প্রকাশ করেছিল একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে। সেটি হলো, জনগণের কাছে বেগম জিয়ার ইমেজকে বিনষ্ট করা। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো। জনগণের চোখে বেগম জিয়া সেদিন এক দুঃসাহসী কিন্তু প্রাজ্ঞ নেতা হিসেবে প্রতিভাত হয়েছেন। বেগম জিয়ার এই সাহসী এবং আপোষহীন প্রতিকৃতি নতুন কিছু নয়। সেই ৮০ এবং ৯০ এর দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আপোষহীন নেত্রীর ভাবমূর্তি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে বেগম খালেদা জিয়ার সরব উত্থান ঘটে। জনগণ বেগম জিয়াকে তার এই দুঃসাহসিকতার পুরস্কার দিয়েছেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে প্রায় অর্ধ শতকের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বিএনপির কাছে পরাস্ত হয়। শেখ হাসিনা নিজে ঢাকায় ২টি আসনে পরাজিত হন। ১ টি আসনে তিনি পরাজিত হন মহানগর বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকা এবং অপরটি তেজগাঁও আসনে তৎকালীন বিএনপি নেতা এবং বর্তমানে বিকল্প ধারার নেতা অবসরপ্রাপ্ত মেজর মান্নানের কাছে। ৯১ এর নির্বাচনে জয়লাভ করে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি মন্ত্রিসভা গঠন করে। মন্ত্রিসভা গঠনে প্রয়োজনীয় সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জনে বিএনপির কিছুটা ঘাটতি ছিল। সেখানে জামায়াতে ইসলামী সমর্থন দেয়ায় সেই ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়। কিন্তু এই সমর্থনের বিনিময়ে জামায়াত ক্ষমতার কোন অংশদারীত্ব দাবি করেনি। জামায়াত শর্তহীনভাবে বিএনপিকে সমর্থন দেয় এবং বিএনপি মন্ত্রিসভা গঠনে সমর্থ হয়। শুধু মন্ত্রিসভা গঠন নয়, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগের তরফ থেকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দেয়া হয় তৎকালীন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীকে। বদরুল হায়দার চৌধুরীর পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য সে দিন আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমের বাসায় ছুটে যান এবং অধ্যাপক আযমের কদমবুছিও করেন। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী নীতি ও আদর্শের কারণে বিএনপি প্রার্থীকে সমর্থন দেয় এবং বিএনপি প্রার্থী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
॥দুই॥
সেদিন ছিল গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। সেই আন্দোলনে বেগম জিয়া লড়াই করেন স্বৈরাচারী এরশাদের আধা সামরিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে। তারপর ২০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এখন দেশের বুকে চেপে বসেছে ফ্যাসিবাদের জগদ্দল পাথর। আজ সেই ফ্যাসিবাদ হলো আওয়ামী ফ্যাসিবাদ। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রের নাম করে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই তারা স্বমূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। যতই দিন গেছে ততই তাদের বীভৎস ফ্যাসিবাদী চেহারা উন্মোচিত হয়েছে। তাই দেশে আবার প্রয়োজন হয়েছে দুর্বার আন্দোলন এবং কঠিন সংগ্রামের। এবারের আন্দোলন হলো আওয়ামী ফ্যাসিবাদ থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন। আবার বেগম জিয়া সেই আন্দোলনে জনতার কাতারে শামিল হয়েছেন। এবার জনগণকে সাথে নিয়ে ফ্যাসিবাদ উৎখাতে জীবন বাজি রেখে তিনি রাজপথে নেমেছেন। জনগণ তার ডাকে বিপুলভাবে সাড়া দিয়েছে।
তবে বেদনার বিষয় হলো এই যে, সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং অন্যান্য কারণে এবারের আওয়ামী লীগ বিরোধী জীবন মরণ সংগ্রামে বিএনপির অনেক নেতাকেই মাঠে দেখা যাচ্ছে না। মাঠে না নামার এই কাজটিকে অনেক নেতাই রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। কিন্তু বেগম জিয়া নিজে নির্দেশ দিয়েছেন তার নেতাকর্মীকে রাজপথে থাকার। জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রথম ও দ্বিতীয় সারির সমস্ত নেতা কারাগারে। হাজার হাজার মাঠ পর্যায়ের নেতা ও কর্মী জেলখানায়। তারপরেও সাধারণ কর্মীরা সকলেই বেগম জিয়ার প্রতিটি ডাকে রাজপথে নামছেন। তারা পুলিশের লাঠিপেটা খাচ্ছেন, টিয়ার গ্যাস খাচ্ছেন এবং পুলিশের গুলীবর্ষণের শিকার হচ্ছেন। ইতোমধ্যেই দেড় শতাধিক জামায়াত নেতা ও কর্মী পুলিশের গুলি বর্ষণ এবং আওয়ামী পা-াদের হামলায় শাহাদাতবরণ করেছেন। তার পরেও তারা মাঠ ছাড়েননি। পুলিশের তাড়া খেয়ে তারা হয়তো আন্ডার গ্রাউন্ডে গিয়েছেন। কিন্তু আন্দোলনের ডাক আসলেই তারা গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে এসেছেন এবং রাজপথে জনতার কাতারে শামিল হয়েছেন।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত সরকার তার হামলা এবং মামলার প্রধান টার্গেট করেছিল জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরকে। সরকার মনে করছে যে, তারা জামায়াত এবং শিবিরকে সাইজ করতে সক্ষম হয়েছে। এখন তাই তারা মনোযোগ দিয়েছে বিএনপির ওপর। এবার বিএনপিকে সাইজ করতে হবে। নির্বাচনের আগে বিএনপিকে সাইজ করা তাদের জন্য অতি আব্যশকীয় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ইতোপূর্বে বিএনপির অর্ধ শতাধিক নেতাকে গ্রেফতার করলেও এবার বিএনপির শীর্ষ নেতাদেরকে গ্রেফতার করে তাদেরকে ৮ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। ছাত্রদলের সাবেক প্রেসিডেন্ট সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে ২০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ আমলে রিমান্ড মানেই হলো নিষ্ঠুর শারীরিক নির্যাতন। এগুলো ভয়াবহ ব্যাপার। অতীতে শীর্ষ স্থানীয় রাজনৈতিক ও ছাত্র নেতাদেরকে রিমান্ডে নেয়ার খবর শোনা যায়নি। এভাবে শত শত নেতাকে আওয়ামী সরকার যখন হত্যা করেছে, যখন অসংখ্য নেতাকে রিমান্ডে নিয়ে মেরে হাড় হাড্ডি গুঁড়ো করেছে এবং অনেককে পঙ্গু করেছে, এখনও যেখানে হাজার হাজার নেতা কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে পচে মরছে তখন আওয়ামী লীগ নিজেই সংলাপের সমস্ত পথ রুদ্ধ করেছে, সেখানে বার বার উপযাজক হয়ে সংলাপ চাওয়াটা আত্ম সম্মানের পরিচায়ক নয়।
॥তিন॥
কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, বেগম জিয়া নয়, তার নি¤œ পর্যায় থেকে সংলাপের জন্য আওয়ামী লীগের দুয়ারে বার বার ধর্না দেয়া হচ্ছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজ থেকেই এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে ফোন করেছিলেন। সেদিন আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন যে, তার নেত্রীর সাথে আলোচনা করে তিনি জানাবেন। তারপর সৈয়দ আশরাফ মির্জা ফখরুলকে আর কিছু জানাননি। এখন দেখা যাচ্ছে যে, সৈয়দ আশরাফ সম্পূর্ণ নীরব থাকা সত্ত্বেও বিগত ১০ মে মির্জা ফখরুল পুনরায় সৈয়দ আশরাফকে ফোন করেছিলেন। তারপরেও সৈয়দ আশরাফ তাকে ফিরতি ফোন করেননি। এর পরেও দেখা যাচ্ছে যে, গত সপ্তাহে দু’দিন ধরে মির্জা ফখরুল সৈয়দ আশরাফকে টেলিফোন করছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সম্পাদক সেই টেলিফোন ধরছেন না। এই খবর যখন টেলিভিশনে প্রচারিত হয় তখন যারা টেলিভিশনে সেই নিউজ শোনেন তারা তাৎক্ষণিকভাবে মির্জা ফখরুলের ওপর মৃদু ক্ষুব্ধ হন। তাদের কথা হলো, মির্জা ফখরুল বার বার গায়ে পড়ে কথা বলতে যাচ্ছেন, আর আশরাফ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এতে কি মির্জা ফখরুলের ব্যক্তিত্ব নষ্ট হচ্ছে না?
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে। মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুল যখন কথা বলেন তখন তিনি শুধু ব্যক্তিগত ভাবেই কারও সাথে কথা বলেন না, তিনি বিএনপির মহাসচিব এবং সেই সুবাদে ১৮ দলের মুখপাত্র হিসেবে কথা বলেন। এ কথা আজ সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, ১৮ দল আজ বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনগণের সিংহভাগের আস্থাভাজন রাজনৈতিক জোট। তাই মির্জা ফখরুলকে উপেক্ষা বা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলে সেটি বিএনপি, ১৮ দলীয় জোট এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে উপেক্ষা বা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হয়। মির্জা ফখরুলকে উপেক্ষা করলে ১৮ দলীয় জোটের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে সাধারণভাবে আমাদের এবং ব্যক্তিগত ভাবে এই কলাম লেখকের গায়ে লাগে। যেখানে দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ তাদের পেছনে সেখানে আওয়ামী লীগকে তোয়াজ করার কি আছে ?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন