ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকার বিরোধী দলের ওপর যে অমানবিক ও
অগণতান্ত্রিক নির্যাতনে নেমেছে, এ দেশের মানুষ
তা বোধকরি কোনো দিন কল্পনাও করতে পারেনি। সরকার প্রতিদিন পরিস্থিতি ঘোলাটে ও
সঙ্ঘাতময় করে তুলছে। মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগে
শুভবুদ্ধিসম্পন্ন একজন লোকও নেই। যদি থাকত, তাহলে দেশ এত
সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের দিকে যেতে পারত না। মনে হচ্ছে, সরকার যেন
রক্তপাত দাওয়াত দিয়ে ডেকে আনছে। বিরোধী দলকে রাজনীতি দিয়ে নয়, পুলিশি শক্তি দিয়ে দমানোর সব রকম আয়োজন করা হচ্ছে। নির্যাতনের
মাত্রা বোধকরি হিটলারকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। প্রতিদিন ডজন ডজন বিএনপি
নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং রিমান্ড, নির্যাতন
অনুমোদন করা হচ্ছে। এ যেন বিরোধী দলকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার অপপ্রয়াস।
আমরা বহুবার বলেছি, রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করাই শ্রেয়। কিন্তু বর্তমান সরকার সে পথে নেই। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি প্রমাণ করে, দেশের বিরোধী দল সমর্থক সব মানুষকেই সরকার কারাবন্দী করে ফেলতে চায়। এ দিকে দেশের মানুষ সবচেয়ে হতবাক হয়েছে যখন বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাস-অযোগ্য ঠুনকো অভিযোগ এনে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এরা হলেনÑ ৮১ বছর বয়স্ক এম কে আনোয়ার, ৭৪ বছর বয়স্ক ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ৭১ বছর বয়স্ক ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। আর ৭০-এর ঘরের আবদুল আউয়াল মিন্টু ও ৬০-এর ঘরের শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। প্রথম তিনজনই বিএনপির নীতিনির্ধারণী স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য। এম. কে. আনোয়ার ও ব্যারিস্টার মওদুদ এমপি। আবদুল আউয়াল মিন্টু সুপ্রতিষ্ঠিত ও সফল ব্যবসায়ী। শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী। চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। এদের সবাইকে আদালত আট দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।
প্রথম তিনজন মাঠের রাজনীতি করলেও আবদুল আউয়াল মিন্টু বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হলেও অনেকটা নিভৃতচারী। তিনি মাঠের রাজনীতি করেননি। এসব বর্ষীয়ান নেতা দীর্ঘকাল ধরে রাজনীতি করে আসছেন। তারা মন্ত্রী ছিলেন। এমপি ছিলেন। আইনপ্রণেতা হিসেবে কাজ করে আসছেন। তারা দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তাদের বিরুদ্ধে প্রধানত দু’টি অভিযোগ :
এক. গত ২৪ সেপ্টেম্বর ৫৪ জন বিএনপি নেতা ও কর্মী (এফআরআইয়ে এদের নাম আছে) ও ৮০-৯০ জন অন্যান্য লোক বিএনপি ও ওই পাঁচ নেতার নির্দেশে হঠাৎ করেই আইডিয়াল স্কুল ও কলেজের সামনে ঝটিকা মিছিল করে যানবাহনের স্বাভাবিক চলাচল রুদ্ধ করে দেয় এবং জনদুর্ভোগ ঘটায়। ওই মিছিল পুলিশের ওপর হামলা চালায় এবং তাদের দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়। এ ছাড়াও আটককৃতরা বিভিন্ন টেলিভিশন টকশো ও জনসভায় এই সরকারকে ‘অবৈধ’ বলে অভিহিত করেছেন। আর সেভাবেই এরা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইন মেনে চলা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
দুই. ৫ নভেম্বর এই পাঁচ নেতা একই ধরনের কাজ করতে চেয়েছিল। হয়তো কাজের এলাকাটি ভিন্ন হতো।
এসব বর্ষীয়ান নেতাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অযৌক্তিক ও ঠুনকো অভিযোগ আনা যায় সেটা যেমন কল্পনাতীত, তেমনি এই অভিযোগের অধিকতর তদন্তের জন্য তাদের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা আইনের চরম অপব্যবহার।
এর আগে ২০১২ সালের এপ্রিলে বিএনপির সেক্রেটারি জেনারেল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সরকার জেলে পাঠিয়েছিল। তখনো অভিযোগ ছিল, তারা প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনে গাড়িতে আগুন দিয়েছেন। সেই মামলায় এম কে আনোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হান্নান শাহ এবং সাবেক জ্বালানি মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকেও অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ২০১২ সালের মে মাসে ফখরুল ও অন্যদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়েছিল যে, এরা সচিবালয়ের ভেতরে হাতে তৈরী গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছেন। অন্যান্য সময়ের মতো বর্তমান মামলাগুলোও হাস্যকর। গ্রেনেড ছোড়া মামলায় আরো আসামি করা হয়েছিল ১৮ দলীয় জোট নেতা সাবেক মন্ত্রী কর্নেল অলি আহমদ ও ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ এমপিকে।
এ পর্যায়ের জাতীয় নেতারা বাসে আগুন দিয়েছেন কিংবা সচিবালয়ে বোমা মেরেছেনÑ এ রকম কথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। এবং এদেরকে সাধারণ চোর-ছ্যাঁচড়-টোকাইয়ের সাথে এক করে ফেললে পরিস্থিতি সহজ ও স্বাভাবিক থাকতে পারে না। এদের রিমান্ড আবেদনে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে তারা ধ্বংসাত্মক ও সন্ত্রাসমূলক কী কাজের পরিকল্পনা এঁটেছেন সেটা জিজ্ঞাসাবাদের জন্যই তাদের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। যে তরুণ বিচারক এই রিমান্ড মঞ্জুর করলেন, তাদের বিবেচনাবোধ নিয়েও কোনো একদিন প্রশ্ন উঠতে পারে। এই নেতাদের কারো বিরুদ্ধেই জীবনে কোনো দিন দাঙ্গা-হাঙ্গামার অভিযোগ ওঠেনি। বরং বহু ক্ষেত্রে তারা সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে দেশকে অনেক সঙ্ঘাতের হাত থেকে রক্ষা করেছেন।
এই যে তাদের রিমান্ডে নেয়া হলো, তাতে কী ফায়দা হবে বলা মুশকিল। কিন্তু তথ্য আদায়ের নামে তাদের ওপর এমন ধরনের নির্যাতন নেমে আসতে পারে, যা হয়তো এই ভদ্রলোক ও সুশিক্ষিত রাজনীতিবিদেরা কোনো দিন কল্পনাও করেননি। রিমান্ডে নিয়ে যে পুলিশ অত্যাচার করে, সে কথা কোনো দিন তারা স্বীকার করেননি। শুধু দেখা গেছে, সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষকে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে যায়। আর রিমান্ড শেষে কখনো কখনো তাদের ফিরিয়ে আনে স্ট্রেচারে, হুইল চেয়ারে কিংবা চ্যাংদোলা করে। এদের প্রতি যদি কোনো অসদাচরণ করা না-ও হয়, এরপরও হয়তো এই বর্ষীয়ান ও জাত রাজনীতিবিদদের ওপর নির্যাতনের অন্য পদ্ধতিও আছে। যেমন সারা রাত জাগিয়ে রাখা। উচ্চ আলোর ভেতরে রাখা। উচ্চৈঃস্বরে শব্দ করা। বাজে বিছানা। টয়লেটে যেতে না দেয়া। জানালাবিহীন রুমে আটক করে রাখা প্রভৃতি নিষ্ঠুর ও অমানবিক পথে তাদের নির্যাতন করা হতে পারে। তবে এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা সাম্প্রতিক। আগে জেলখানার ভেতরে কিংবা হাজতখানায়, পুলিশ হেফাজতে রাজনীতিবিদদের যথেষ্ট সম্মান করা হতো।
সরকার যেভাবে এগোচ্ছে তাতে মনে হয়, বিএনপি-জামায়াতকে অবরুদ্ধ রেখে সব নেতাকে কারাবন্দী করে তারা একটি নির্বাচন করে আসতে চায়। সে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে এরা আরো বেশিদিন ক্ষমতায় থেকে যেতে চায়। কিন্তু এ ধরনের প্রচেষ্টা কোনো সময়েই সফল হয়নি। শেখ হাসিনা এরশাদের সময় মিলে বিএনপিকে বাদ দিয়ে ১৯৮৬ সালে এক নির্বাচন করেছিলেন। সেই নির্বাচনও সফল হয়নি। বিএনপির ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এমনই একদলীয় ছিল। কিন্তু সে নির্বাচন কেউ ধরতে চায় না। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছিলেন, এই নির্বাচন আওয়ামী লীগ, জামায়াতের দাবি অনুযায়ী শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেয়ার জন্য। আসুন আমরা সবাই মিলে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য এই নির্বাচন করি। তবে এই সংসদ শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করে তিন মাসের মধ্যে ভেঙে দেয়া হবে। তারপর সে পদ্ধতি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার নতুন নির্বাচন করবে। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। কার্যত তা একদলীয় নির্বাচনে পর্যবসিত হয়েছিল। তা হলেও সেই সংসদই সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিল। এবং সে সরকার পদ্ধতির অধীনে নির্বাচন করে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে জয়ী হয়েছিলেন।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে গাল দিই। কিন্তু সেই নির্বাচনের মাধ্যমে সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করি। এটাই ভাগ্যের পরিহাস। ফলে কোনো অবস্থাতেই ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের সাথে ১৯৯৬ সালের নির্বাচন তুলনাযোগ্য নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার জন্য একদলীয় নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। যেন শুধু তারা ছাড়া বাংলাদেশে আর কারো থাকার অধিকার নেই। সে সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে শতমুখে নানা দিক থেকে প্রশ্ন উঠছে। কূটনীতিকেরা দৌড়ঝাঁপ করছেন। তারা বলছেন, বড় সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নিলে সে নির্বাচন কিছুতেই বৈধ বলে প্রতিপন্ন হবে না। সুতরাং সে সরকারের টেকসই হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় দলের কোনো পোর্টফোলিও ছাড়াই দলের হয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনা শুরু করেছেন। সম্প্রতি ভারতীয় জনতা পার্টি নেতা ও সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সোনিয়া গান্ধীকে উদ্দেশ করে বলেছেনÑ ম্যাডাম, আপনি তো অসুস্থ, শাহজাদাকে ক্ষমতা দিয়ে দেন। বাংলাদেশেও বোধকরি সজীব ওয়াজেদ জয় এখন শাহজাদা। ফলে কূটনীতিক মহলে কলকিও পাচ্ছেন। ব্রাভো।
বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে এ দেশের প্রতি বহু দেশের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব আছে। আছে নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা। ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীন, ভারত সবাই এই কূটনীতির অংশীদার। এই প্রভাব নিশ্চিন্তা এড়াতে পেরেছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। তিনি নিজের মতো করে মালয়েশিয়াকে জিরো থেকে হিরো করে গেছেন। সে রকম নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক শক্তি বাংলাদেশে কারো নেই। ফলে হস্তক্ষেপের ধারা বোধকরি অব্যাহত থাকবে। এর মধ্যে সরকার চলছে একরোখাভাবেই। বিরোধী দলকে যদি কথা বলতে দেয়া না হয়, যদি তাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে বাধা দেয়া হয়, যদি তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়; তাহলে তার পরিণতি শুভ হতে পারে না। এতে সঙ্ঘাত অনিবার্য হয়ে উঠবে। জামায়াতকে যদি রাজনৈতিকভাবে কার্যত নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়, তাহলেও জামায়াত শেষ হবে না; বরং আরো ভয়ঙ্কর রূপে আবির্ভূত হবে। সে ধাক্কা সামলে নেয়ার ক্ষমতা সরকারের আছে কি না, তা-ও ভেবে দেখতে হবে। আমরা সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে। এখন কোনো আলো আর দেখতে পাই না।
এই সরকার অনন্তকাল স্থায়ী হবে না। পৃথিবীর কোথাও হয় না। হয়নি। কিন্তু সরকারকে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে যে, আজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা বিচার বিভাগের মাধ্যমে তারা নির্যাতনের যে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করছেন, যেদিন পুনরায় বিরোধী দলে যাবেন, সেদিনের পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য। এ দেশে কখনোই রাজতন্ত্র কায়েম হবে না।
আমরা বহুবার বলেছি, রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করাই শ্রেয়। কিন্তু বর্তমান সরকার সে পথে নেই। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি প্রমাণ করে, দেশের বিরোধী দল সমর্থক সব মানুষকেই সরকার কারাবন্দী করে ফেলতে চায়। এ দিকে দেশের মানুষ সবচেয়ে হতবাক হয়েছে যখন বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাস-অযোগ্য ঠুনকো অভিযোগ এনে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এরা হলেনÑ ৮১ বছর বয়স্ক এম কে আনোয়ার, ৭৪ বছর বয়স্ক ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ৭১ বছর বয়স্ক ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। আর ৭০-এর ঘরের আবদুল আউয়াল মিন্টু ও ৬০-এর ঘরের শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। প্রথম তিনজনই বিএনপির নীতিনির্ধারণী স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য। এম. কে. আনোয়ার ও ব্যারিস্টার মওদুদ এমপি। আবদুল আউয়াল মিন্টু সুপ্রতিষ্ঠিত ও সফল ব্যবসায়ী। শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী। চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। এদের সবাইকে আদালত আট দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।
প্রথম তিনজন মাঠের রাজনীতি করলেও আবদুল আউয়াল মিন্টু বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হলেও অনেকটা নিভৃতচারী। তিনি মাঠের রাজনীতি করেননি। এসব বর্ষীয়ান নেতা দীর্ঘকাল ধরে রাজনীতি করে আসছেন। তারা মন্ত্রী ছিলেন। এমপি ছিলেন। আইনপ্রণেতা হিসেবে কাজ করে আসছেন। তারা দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তাদের বিরুদ্ধে প্রধানত দু’টি অভিযোগ :
এক. গত ২৪ সেপ্টেম্বর ৫৪ জন বিএনপি নেতা ও কর্মী (এফআরআইয়ে এদের নাম আছে) ও ৮০-৯০ জন অন্যান্য লোক বিএনপি ও ওই পাঁচ নেতার নির্দেশে হঠাৎ করেই আইডিয়াল স্কুল ও কলেজের সামনে ঝটিকা মিছিল করে যানবাহনের স্বাভাবিক চলাচল রুদ্ধ করে দেয় এবং জনদুর্ভোগ ঘটায়। ওই মিছিল পুলিশের ওপর হামলা চালায় এবং তাদের দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়। এ ছাড়াও আটককৃতরা বিভিন্ন টেলিভিশন টকশো ও জনসভায় এই সরকারকে ‘অবৈধ’ বলে অভিহিত করেছেন। আর সেভাবেই এরা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইন মেনে চলা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
দুই. ৫ নভেম্বর এই পাঁচ নেতা একই ধরনের কাজ করতে চেয়েছিল। হয়তো কাজের এলাকাটি ভিন্ন হতো।
এসব বর্ষীয়ান নেতাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অযৌক্তিক ও ঠুনকো অভিযোগ আনা যায় সেটা যেমন কল্পনাতীত, তেমনি এই অভিযোগের অধিকতর তদন্তের জন্য তাদের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা আইনের চরম অপব্যবহার।
এর আগে ২০১২ সালের এপ্রিলে বিএনপির সেক্রেটারি জেনারেল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সরকার জেলে পাঠিয়েছিল। তখনো অভিযোগ ছিল, তারা প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনে গাড়িতে আগুন দিয়েছেন। সেই মামলায় এম কে আনোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হান্নান শাহ এবং সাবেক জ্বালানি মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকেও অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ২০১২ সালের মে মাসে ফখরুল ও অন্যদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়েছিল যে, এরা সচিবালয়ের ভেতরে হাতে তৈরী গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছেন। অন্যান্য সময়ের মতো বর্তমান মামলাগুলোও হাস্যকর। গ্রেনেড ছোড়া মামলায় আরো আসামি করা হয়েছিল ১৮ দলীয় জোট নেতা সাবেক মন্ত্রী কর্নেল অলি আহমদ ও ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ এমপিকে।
এ পর্যায়ের জাতীয় নেতারা বাসে আগুন দিয়েছেন কিংবা সচিবালয়ে বোমা মেরেছেনÑ এ রকম কথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। এবং এদেরকে সাধারণ চোর-ছ্যাঁচড়-টোকাইয়ের সাথে এক করে ফেললে পরিস্থিতি সহজ ও স্বাভাবিক থাকতে পারে না। এদের রিমান্ড আবেদনে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে তারা ধ্বংসাত্মক ও সন্ত্রাসমূলক কী কাজের পরিকল্পনা এঁটেছেন সেটা জিজ্ঞাসাবাদের জন্যই তাদের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। যে তরুণ বিচারক এই রিমান্ড মঞ্জুর করলেন, তাদের বিবেচনাবোধ নিয়েও কোনো একদিন প্রশ্ন উঠতে পারে। এই নেতাদের কারো বিরুদ্ধেই জীবনে কোনো দিন দাঙ্গা-হাঙ্গামার অভিযোগ ওঠেনি। বরং বহু ক্ষেত্রে তারা সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে দেশকে অনেক সঙ্ঘাতের হাত থেকে রক্ষা করেছেন।
এই যে তাদের রিমান্ডে নেয়া হলো, তাতে কী ফায়দা হবে বলা মুশকিল। কিন্তু তথ্য আদায়ের নামে তাদের ওপর এমন ধরনের নির্যাতন নেমে আসতে পারে, যা হয়তো এই ভদ্রলোক ও সুশিক্ষিত রাজনীতিবিদেরা কোনো দিন কল্পনাও করেননি। রিমান্ডে নিয়ে যে পুলিশ অত্যাচার করে, সে কথা কোনো দিন তারা স্বীকার করেননি। শুধু দেখা গেছে, সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষকে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে যায়। আর রিমান্ড শেষে কখনো কখনো তাদের ফিরিয়ে আনে স্ট্রেচারে, হুইল চেয়ারে কিংবা চ্যাংদোলা করে। এদের প্রতি যদি কোনো অসদাচরণ করা না-ও হয়, এরপরও হয়তো এই বর্ষীয়ান ও জাত রাজনীতিবিদদের ওপর নির্যাতনের অন্য পদ্ধতিও আছে। যেমন সারা রাত জাগিয়ে রাখা। উচ্চ আলোর ভেতরে রাখা। উচ্চৈঃস্বরে শব্দ করা। বাজে বিছানা। টয়লেটে যেতে না দেয়া। জানালাবিহীন রুমে আটক করে রাখা প্রভৃতি নিষ্ঠুর ও অমানবিক পথে তাদের নির্যাতন করা হতে পারে। তবে এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা সাম্প্রতিক। আগে জেলখানার ভেতরে কিংবা হাজতখানায়, পুলিশ হেফাজতে রাজনীতিবিদদের যথেষ্ট সম্মান করা হতো।
সরকার যেভাবে এগোচ্ছে তাতে মনে হয়, বিএনপি-জামায়াতকে অবরুদ্ধ রেখে সব নেতাকে কারাবন্দী করে তারা একটি নির্বাচন করে আসতে চায়। সে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে এরা আরো বেশিদিন ক্ষমতায় থেকে যেতে চায়। কিন্তু এ ধরনের প্রচেষ্টা কোনো সময়েই সফল হয়নি। শেখ হাসিনা এরশাদের সময় মিলে বিএনপিকে বাদ দিয়ে ১৯৮৬ সালে এক নির্বাচন করেছিলেন। সেই নির্বাচনও সফল হয়নি। বিএনপির ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এমনই একদলীয় ছিল। কিন্তু সে নির্বাচন কেউ ধরতে চায় না। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছিলেন, এই নির্বাচন আওয়ামী লীগ, জামায়াতের দাবি অনুযায়ী শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেয়ার জন্য। আসুন আমরা সবাই মিলে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য এই নির্বাচন করি। তবে এই সংসদ শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করে তিন মাসের মধ্যে ভেঙে দেয়া হবে। তারপর সে পদ্ধতি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার নতুন নির্বাচন করবে। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। কার্যত তা একদলীয় নির্বাচনে পর্যবসিত হয়েছিল। তা হলেও সেই সংসদই সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিল। এবং সে সরকার পদ্ধতির অধীনে নির্বাচন করে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে জয়ী হয়েছিলেন।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে গাল দিই। কিন্তু সেই নির্বাচনের মাধ্যমে সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করি। এটাই ভাগ্যের পরিহাস। ফলে কোনো অবস্থাতেই ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের সাথে ১৯৯৬ সালের নির্বাচন তুলনাযোগ্য নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার জন্য একদলীয় নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। যেন শুধু তারা ছাড়া বাংলাদেশে আর কারো থাকার অধিকার নেই। সে সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে শতমুখে নানা দিক থেকে প্রশ্ন উঠছে। কূটনীতিকেরা দৌড়ঝাঁপ করছেন। তারা বলছেন, বড় সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নিলে সে নির্বাচন কিছুতেই বৈধ বলে প্রতিপন্ন হবে না। সুতরাং সে সরকারের টেকসই হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় দলের কোনো পোর্টফোলিও ছাড়াই দলের হয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনা শুরু করেছেন। সম্প্রতি ভারতীয় জনতা পার্টি নেতা ও সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সোনিয়া গান্ধীকে উদ্দেশ করে বলেছেনÑ ম্যাডাম, আপনি তো অসুস্থ, শাহজাদাকে ক্ষমতা দিয়ে দেন। বাংলাদেশেও বোধকরি সজীব ওয়াজেদ জয় এখন শাহজাদা। ফলে কূটনীতিক মহলে কলকিও পাচ্ছেন। ব্রাভো।
বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে এ দেশের প্রতি বহু দেশের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব আছে। আছে নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা। ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীন, ভারত সবাই এই কূটনীতির অংশীদার। এই প্রভাব নিশ্চিন্তা এড়াতে পেরেছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। তিনি নিজের মতো করে মালয়েশিয়াকে জিরো থেকে হিরো করে গেছেন। সে রকম নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক শক্তি বাংলাদেশে কারো নেই। ফলে হস্তক্ষেপের ধারা বোধকরি অব্যাহত থাকবে। এর মধ্যে সরকার চলছে একরোখাভাবেই। বিরোধী দলকে যদি কথা বলতে দেয়া না হয়, যদি তাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে বাধা দেয়া হয়, যদি তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়; তাহলে তার পরিণতি শুভ হতে পারে না। এতে সঙ্ঘাত অনিবার্য হয়ে উঠবে। জামায়াতকে যদি রাজনৈতিকভাবে কার্যত নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়, তাহলেও জামায়াত শেষ হবে না; বরং আরো ভয়ঙ্কর রূপে আবির্ভূত হবে। সে ধাক্কা সামলে নেয়ার ক্ষমতা সরকারের আছে কি না, তা-ও ভেবে দেখতে হবে। আমরা সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে। এখন কোনো আলো আর দেখতে পাই না।
এই সরকার অনন্তকাল স্থায়ী হবে না। পৃথিবীর কোথাও হয় না। হয়নি। কিন্তু সরকারকে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে যে, আজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা বিচার বিভাগের মাধ্যমে তারা নির্যাতনের যে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করছেন, যেদিন পুনরায় বিরোধী দলে যাবেন, সেদিনের পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য। এ দেশে কখনোই রাজতন্ত্র কায়েম হবে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন