মাসুদ আহমেদ তালুকদার
অভিপ্রায় বা ইচ্ছা ব্যক্ত করা বা আগ্রহ প্রকাশ করা বা আকাক্সা পোষণ
করা এই ক’টি শব্দই সম অর্থবোধক।
অভিপ্রায় ব্যক্ত ও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার অবশ্য আলাদা আলাদা অভিব্যক্তি আছে। সে দিন
প্রধানমন্ত্রীর শেষ ক্যাবিনেট মিটিংয়ে যা ঘটেছিল,
অর্থাৎ দলবেঁধে লাইন ধরে, মন্ত্রীরা
যেভাবে তাদের লিখিত পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়েছিলেন, তা কোনোক্রমেই পদত্যাগের অভিপ্রায় ব্যক্ত করার অনুষ্ঠান ছিল না।
ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার অনুষ্ঠান। বহু দিন
ধরে দেশের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিচ্ছিলেন যে, নির্বাচনকালীন
সময়ে তিনি সর্বদলীয় সরকার গঠন করবেন। প্রধানমন্ত্রীর সেই ঘোষণা এবং পরে মন্ত্রীদের
পদত্যাগের নির্দেশ দেয়ার কারণেই ওই দিন সবাই মিলে পদত্যাগ করেন। মন্ত্রীরা
পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়েছেন। ফলে মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেননি, পদত্যাগপত্র এখনো গৃহীত হয়নি, পদত্যাগপত্র
রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গৃহীত হওয়া পর্যন্ত সবাই মন্ত্রী পদে বহাল আছেন, প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য অসত্য এবং অযৌক্তিক ও বেআইনি।
এ েেত্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলামের সিদ্ধান্ত। সব মন্ত্রীর আগে তাজুল ইসলাম পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়েছেন। প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, নিজের এলাকায় চলে যাবো, তাই আগেভাগে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে গেলাম। সব মন্ত্রী যে দিন জমা দিয়েছেন, সে দিন তাজুল ইসলাম এলাকায় ছিলেন। গত ১১/১১/২০১৩ ইংরেজি তারিখ প্রাপ্ত তথ্য মতে ছিল সরকারের সর্বশেষ ক্যাবিনেট মিটিং। সে সভায় সবাই পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। কুশল বিনিময়ে করেছেন। পা ধরে অনেকে প্রধানমন্ত্রীকে সালাম করেছে (অ্যাডভোকেট কামরুলসহ আরো অনেকে)। দেশের সব মানুষ এসব টেলিভিশনে দেখেছেন। অতএব, খুব সহজেই বলা যায়, গত ১১ নভেম্বর তারিখের সর্বশেষ ক্যাবিনেট মিটিংয়ে ঘটে যাওয়া বিষয়টি অভিপ্রায় ব্যক্ত করার অনুষ্ঠান ছিল না। ছিল পদত্যাগপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেয়ারই অনুষ্ঠান। সে কারণে ওই অনুষ্ঠান, ওই দিন ঘটা করে দেখানো হয়েছে দেশবাসীকে। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন, ফলে পদত্যাগপত্র জমা দেয়া মন্ত্রীরা (মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী) তখন থেকেই আর সরকারের মন্ত্রী নেই। এক কথায় সে সময় থেকে দেশে সরকারও নেই। এমনটি ভাবাই যৌক্তিক। এমনকি পদত্যাগপত্র সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের (৩) উপধারার (ক) ও (খ) মন্ত্রী ও সরকার বিদ্যমান আছে এমন বক্তব্যের সত্যতা বা স্বীকৃতির কোনো নিশ্চয়তা প্রদান করেন না। প্রধানমন্ত্রীর ক্যাবিনেটে সব মন্ত্রী গত ১১ নভেম্বর লিখিত পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র প্রাপ্তি স্বীকার করেছেন। ফলে পদত্যাগপত্র জমা দেয়া ও এর প্রাপ্তি স্বীকারের পর আর ওই অবস্থান থেকে প্রধানমন্ত্রী বা তার সাবেক মন্ত্রীদের কারো আর ফিরে আসার কোনো সুযোগ অবশিষ্ট নেই। পদত্যাগের বিষয়টি স্বীকার করে ক্যাবিনেট সচিব মোশারফ হোসেন ভূঞা দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তব্য দিয়েছেন। ফলে পদত্যাগ নিয়ে আর কোনো বিভ্রান্তির অবকাশ নেই।
মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র গৃহীত না হওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দেয়ার মাধ্যমে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। প্রশ্ন হচ্ছে মন্ত্রীরা কি আসলেই পদত্যাগ করেছেন? না কি প্রধানমন্ত্রীর মতে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন? এই বক্তব্যের কোনটা সঠিক? গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এ েেত্র কী বলে? সে বিষয় নিয়ে একটু আলোকপাত অতীব জরুরি মনে করছি।
সংবিধানের ৫৮(খ) পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করার কারণে নির্বাচনকালীন কোনো সরকারের কোনো অস্তিত্ব সংবিধানে নেই। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮(খ) মতে ‘নির্বাচনকালীন সেই সরকারকে বলা হতো’ নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। নির্বাচিত সরকারের সময়কাল শেষ। সংসদের অবসান হয়েছে। ‘নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য দেশের সুষ্ঠু নির্বাচন, দলীয় প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দায়িত্বভার গ্রহণ করতেন। তাদের আয়ু ছিল ৯০ দিন। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫৮(খ) রহিত করা হয়। তার স্থলে নিয়ে আসা হয় সংবিধানের ১২৩ (৩) (ক) ও (খ) অনুচ্ছেদকে। সংবিধানের বর্তমান বিধান মতে সরকার ও সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন পূর্বে সংসদ একবার মৃত্যুবরণ করবে। আবার কোনো রকম ভোট ছাড়া ৯০ দিনের জন্য হঠাৎ করে বেঁচে উঠবে।
এ েেত্র আর একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। বাংলাদেশের সংবিধানে অভিপ্রায় বলতে কিছু নেই। মন্ত্রী যারা নির্বাচিত সংসদ সদস্যও বটে পদত্যাগ করেছেন, পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতে জমা দিয়েছেন, সাথে সাথে পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়েছে মর্মে বিবেচিত হবে। তবে সংসদ সদস্য নহেন, এমন মন্ত্রীদের (টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের) পদত্যাগের েেত্র কেবল পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার পর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন প্রয়োজন হবে। সুতরাং সংসদ সদস্য হতে নিয়োগপ্রাপ্ত মন্ত্রী, যারা গত ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন, তারা এখন আর কোনোক্রমেই মন্ত্রী নেই। ফলে তাদের মধ্যে কারো রাষ্ট্রীয় কাজে মন্ত্রী হিসেবে অংশগ্রহণ বেআইনি হবে, দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ভবিষ্যতে বিবেচিত হবে।
আর্টিকেল ৫৮(১) এ বলা আছে :-
প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য মন্ত্রীদের আসন শূন্য হবে, যদি-
(ক) তিনি (মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী) রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দেন। সংসদ সদস্য ও পরে মন্ত্রী হয়েছেন, তাদের ব্যাপারে এ কথা বলা হয়েছে।
(খ) তিনি মন্ত্রী, সংসদ সদস্য না থাকেন, তবে ৫৬ অনুচ্ছেদের (২) দফার শর্তাংশের অধীন মনোনীত মন্ত্রীর ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে না।
সংবিধানের ৫৮(১)(ক) বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, নির্বাচিত সংসদ সদস্য যিনি মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছেন, তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার সাথে সাথে তার পদত্যাগ গৃহীত হয়েছে মর্মে বিবেচিত হবে। এর কোনো ব্যতিক্রম সংবিধানে, সংসদ সদস্যদের মধ্য হতে মনোনীত মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে নেই। এক্ষেত্রে ৫৮(১) ক) অনুচ্ছেদের বক্তব্যই শেষ বক্তব্য।
৫৬(২) অনুচ্ছেদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী তার ক্যাবিনেটের এক-দশমাংশ মন্ত্রী সংসদ সদস্য নন এমন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে পূরণ করতে পারবেন এবং করবেন। ওই সব মন্ত্রী টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হিসেবে পরিচিত হবেন।
৫৬(১)(খ) মতে টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী বা মন্ত্রীরা পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দিলে শুধু তাদের পদ ত্যাগপত্র গৃহীত হবে না। যতণ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি অনুমোদন না করেন। সুতরাং সংসদ সদস্যদের মধ্যে যারা মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন এবং ইতঃপূর্বে প্রধানমন্ত্রীর হাতে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন, তারা কেউ সংবিধানের ৫৮(১) (ক) মতে আর সরকারের মন্ত্রী নেই। ব্যতিক্রম শুধু এক-দশমাংশ টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের েেত্র আছে। ফলে প্রধানমন্ত্রী এমন লোকদের (সাবেক মন্ত্রীদের) দ্বারা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করালে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হবে। এর জন্য ভবিষ্যতে শাস্তিও হতে পারে।
এ েেত্র আরো একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ৫৮(২) অনুচ্ছেদ মতে প্রধানমন্ত্রী যদি কোনো মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করেন। ওই মন্ত্রী যদি প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ রা করে পদত্যাগ না করেন কেবল সে েেত্র ওই মন্ত্রী বা মন্ত্রীদের দায়িত্ব অবসানের জন্য প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেবেন। বর্তমান পরিপ্রেেিত কোনো মন্ত্রীই প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেননি। ফলে কারো পদত্যাগ বা পদের অবসানের জন্য সংবিধানের ৫৮(২) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বর্ণিত ব্যবস্থা নেয়ারও প্রয়োজন নেই।
সুতরাং বর্তমান সরকারের (নেই সরকারের) আর কোনো মন্ত্রী নেই। পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার অর্থই হলো তাদের পদত্যাগপত্র সাথে সাথে গৃহীত হয়েছে। মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন থেকে তাদের বিরত থাকাই ছিল শ্রেয়।
একটি ছোটগল্প মনে পড়ে গেল। এক ব্যক্তি লঞ্চের হুইসাল শুনে বাড়ি থেকে বের হয় লঞ্চে করে শহরে যাওয়ার জন্য। লঞ্চ ঘাটে দাঁড়ানো। যাত্রী দৌড়াচ্ছেন। কাদার রাস্তা। সুকানি চিৎকার করে বলেন, আরে ভাই হেঁটে আসুন (অর্থাৎ আরো জোরে আসুন)। যাত্রী দৌড় বন্ধ করে হাঁটতে শুরু করেন। সারেং লঞ্চ ছেড়ে দিলেন। যাত্রী নিরুপায় দাঁড়িয়ে। পা তুলে হাঁটতে শুরু করতেই যাত্রীর পঞ্চের স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে যায়। যাত্রী এবার আেেপর সুরে বললেন ও আল্লাহ! মোর লঞ্চও গেল, পঞ্চও গেল।
পরিশেষে বলতে হয়, প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি খুব তেজে চলছে। তেজে চলা গাড়ি হঠাৎ ব্রেক করলে গাড়ি উল্টে যেতে পারে, যাত্রাবিরতি হয়ে যেতে পারে, প্রধানমন্ত্রী মাঝে মধ্যে এ কথা বেমালুম ভুলে যান। পদত্যাগকে পদত্যাগের অভিপ্রায় হিসেবে চালানোর অপপ্রয়াস বাদ দেয়াই ভালো। এ যাবৎ তিনি সবার সাথে চালাকি করেছেন কমবেশি। বাকি ছিল নিজের সাথে চালাকি করাটা। এবার বোধ হয় সে কাজটাও সেরে ফেললেন। ‘অতি চালাকের ভবিষ্যৎ কিন্তু ভালো হয় না’ কেন বারবার এ কথা ভুলে যাচ্ছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
এ েেত্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলামের সিদ্ধান্ত। সব মন্ত্রীর আগে তাজুল ইসলাম পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়েছেন। প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, নিজের এলাকায় চলে যাবো, তাই আগেভাগে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে গেলাম। সব মন্ত্রী যে দিন জমা দিয়েছেন, সে দিন তাজুল ইসলাম এলাকায় ছিলেন। গত ১১/১১/২০১৩ ইংরেজি তারিখ প্রাপ্ত তথ্য মতে ছিল সরকারের সর্বশেষ ক্যাবিনেট মিটিং। সে সভায় সবাই পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। কুশল বিনিময়ে করেছেন। পা ধরে অনেকে প্রধানমন্ত্রীকে সালাম করেছে (অ্যাডভোকেট কামরুলসহ আরো অনেকে)। দেশের সব মানুষ এসব টেলিভিশনে দেখেছেন। অতএব, খুব সহজেই বলা যায়, গত ১১ নভেম্বর তারিখের সর্বশেষ ক্যাবিনেট মিটিংয়ে ঘটে যাওয়া বিষয়টি অভিপ্রায় ব্যক্ত করার অনুষ্ঠান ছিল না। ছিল পদত্যাগপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেয়ারই অনুষ্ঠান। সে কারণে ওই অনুষ্ঠান, ওই দিন ঘটা করে দেখানো হয়েছে দেশবাসীকে। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন, ফলে পদত্যাগপত্র জমা দেয়া মন্ত্রীরা (মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী) তখন থেকেই আর সরকারের মন্ত্রী নেই। এক কথায় সে সময় থেকে দেশে সরকারও নেই। এমনটি ভাবাই যৌক্তিক। এমনকি পদত্যাগপত্র সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের (৩) উপধারার (ক) ও (খ) মন্ত্রী ও সরকার বিদ্যমান আছে এমন বক্তব্যের সত্যতা বা স্বীকৃতির কোনো নিশ্চয়তা প্রদান করেন না। প্রধানমন্ত্রীর ক্যাবিনেটে সব মন্ত্রী গত ১১ নভেম্বর লিখিত পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র প্রাপ্তি স্বীকার করেছেন। ফলে পদত্যাগপত্র জমা দেয়া ও এর প্রাপ্তি স্বীকারের পর আর ওই অবস্থান থেকে প্রধানমন্ত্রী বা তার সাবেক মন্ত্রীদের কারো আর ফিরে আসার কোনো সুযোগ অবশিষ্ট নেই। পদত্যাগের বিষয়টি স্বীকার করে ক্যাবিনেট সচিব মোশারফ হোসেন ভূঞা দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তব্য দিয়েছেন। ফলে পদত্যাগ নিয়ে আর কোনো বিভ্রান্তির অবকাশ নেই।
মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র গৃহীত না হওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দেয়ার মাধ্যমে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। প্রশ্ন হচ্ছে মন্ত্রীরা কি আসলেই পদত্যাগ করেছেন? না কি প্রধানমন্ত্রীর মতে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন? এই বক্তব্যের কোনটা সঠিক? গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এ েেত্র কী বলে? সে বিষয় নিয়ে একটু আলোকপাত অতীব জরুরি মনে করছি।
সংবিধানের ৫৮(খ) পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করার কারণে নির্বাচনকালীন কোনো সরকারের কোনো অস্তিত্ব সংবিধানে নেই। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮(খ) মতে ‘নির্বাচনকালীন সেই সরকারকে বলা হতো’ নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। নির্বাচিত সরকারের সময়কাল শেষ। সংসদের অবসান হয়েছে। ‘নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য দেশের সুষ্ঠু নির্বাচন, দলীয় প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দায়িত্বভার গ্রহণ করতেন। তাদের আয়ু ছিল ৯০ দিন। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫৮(খ) রহিত করা হয়। তার স্থলে নিয়ে আসা হয় সংবিধানের ১২৩ (৩) (ক) ও (খ) অনুচ্ছেদকে। সংবিধানের বর্তমান বিধান মতে সরকার ও সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন পূর্বে সংসদ একবার মৃত্যুবরণ করবে। আবার কোনো রকম ভোট ছাড়া ৯০ দিনের জন্য হঠাৎ করে বেঁচে উঠবে।
এ েেত্র আর একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। বাংলাদেশের সংবিধানে অভিপ্রায় বলতে কিছু নেই। মন্ত্রী যারা নির্বাচিত সংসদ সদস্যও বটে পদত্যাগ করেছেন, পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতে জমা দিয়েছেন, সাথে সাথে পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়েছে মর্মে বিবেচিত হবে। তবে সংসদ সদস্য নহেন, এমন মন্ত্রীদের (টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের) পদত্যাগের েেত্র কেবল পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার পর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন প্রয়োজন হবে। সুতরাং সংসদ সদস্য হতে নিয়োগপ্রাপ্ত মন্ত্রী, যারা গত ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন, তারা এখন আর কোনোক্রমেই মন্ত্রী নেই। ফলে তাদের মধ্যে কারো রাষ্ট্রীয় কাজে মন্ত্রী হিসেবে অংশগ্রহণ বেআইনি হবে, দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ভবিষ্যতে বিবেচিত হবে।
আর্টিকেল ৫৮(১) এ বলা আছে :-
প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য মন্ত্রীদের আসন শূন্য হবে, যদি-
(ক) তিনি (মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী) রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দেন। সংসদ সদস্য ও পরে মন্ত্রী হয়েছেন, তাদের ব্যাপারে এ কথা বলা হয়েছে।
(খ) তিনি মন্ত্রী, সংসদ সদস্য না থাকেন, তবে ৫৬ অনুচ্ছেদের (২) দফার শর্তাংশের অধীন মনোনীত মন্ত্রীর ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে না।
সংবিধানের ৫৮(১)(ক) বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, নির্বাচিত সংসদ সদস্য যিনি মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছেন, তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার সাথে সাথে তার পদত্যাগ গৃহীত হয়েছে মর্মে বিবেচিত হবে। এর কোনো ব্যতিক্রম সংবিধানে, সংসদ সদস্যদের মধ্য হতে মনোনীত মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে নেই। এক্ষেত্রে ৫৮(১) ক) অনুচ্ছেদের বক্তব্যই শেষ বক্তব্য।
৫৬(২) অনুচ্ছেদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী তার ক্যাবিনেটের এক-দশমাংশ মন্ত্রী সংসদ সদস্য নন এমন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে পূরণ করতে পারবেন এবং করবেন। ওই সব মন্ত্রী টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হিসেবে পরিচিত হবেন।
৫৬(১)(খ) মতে টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী বা মন্ত্রীরা পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দিলে শুধু তাদের পদ ত্যাগপত্র গৃহীত হবে না। যতণ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি অনুমোদন না করেন। সুতরাং সংসদ সদস্যদের মধ্যে যারা মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন এবং ইতঃপূর্বে প্রধানমন্ত্রীর হাতে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন, তারা কেউ সংবিধানের ৫৮(১) (ক) মতে আর সরকারের মন্ত্রী নেই। ব্যতিক্রম শুধু এক-দশমাংশ টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের েেত্র আছে। ফলে প্রধানমন্ত্রী এমন লোকদের (সাবেক মন্ত্রীদের) দ্বারা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করালে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হবে। এর জন্য ভবিষ্যতে শাস্তিও হতে পারে।
এ েেত্র আরো একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ৫৮(২) অনুচ্ছেদ মতে প্রধানমন্ত্রী যদি কোনো মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করেন। ওই মন্ত্রী যদি প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ রা করে পদত্যাগ না করেন কেবল সে েেত্র ওই মন্ত্রী বা মন্ত্রীদের দায়িত্ব অবসানের জন্য প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেবেন। বর্তমান পরিপ্রেেিত কোনো মন্ত্রীই প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেননি। ফলে কারো পদত্যাগ বা পদের অবসানের জন্য সংবিধানের ৫৮(২) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বর্ণিত ব্যবস্থা নেয়ারও প্রয়োজন নেই।
সুতরাং বর্তমান সরকারের (নেই সরকারের) আর কোনো মন্ত্রী নেই। পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার অর্থই হলো তাদের পদত্যাগপত্র সাথে সাথে গৃহীত হয়েছে। মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন থেকে তাদের বিরত থাকাই ছিল শ্রেয়।
একটি ছোটগল্প মনে পড়ে গেল। এক ব্যক্তি লঞ্চের হুইসাল শুনে বাড়ি থেকে বের হয় লঞ্চে করে শহরে যাওয়ার জন্য। লঞ্চ ঘাটে দাঁড়ানো। যাত্রী দৌড়াচ্ছেন। কাদার রাস্তা। সুকানি চিৎকার করে বলেন, আরে ভাই হেঁটে আসুন (অর্থাৎ আরো জোরে আসুন)। যাত্রী দৌড় বন্ধ করে হাঁটতে শুরু করেন। সারেং লঞ্চ ছেড়ে দিলেন। যাত্রী নিরুপায় দাঁড়িয়ে। পা তুলে হাঁটতে শুরু করতেই যাত্রীর পঞ্চের স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে যায়। যাত্রী এবার আেেপর সুরে বললেন ও আল্লাহ! মোর লঞ্চও গেল, পঞ্চও গেল।
পরিশেষে বলতে হয়, প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি খুব তেজে চলছে। তেজে চলা গাড়ি হঠাৎ ব্রেক করলে গাড়ি উল্টে যেতে পারে, যাত্রাবিরতি হয়ে যেতে পারে, প্রধানমন্ত্রী মাঝে মধ্যে এ কথা বেমালুম ভুলে যান। পদত্যাগকে পদত্যাগের অভিপ্রায় হিসেবে চালানোর অপপ্রয়াস বাদ দেয়াই ভালো। এ যাবৎ তিনি সবার সাথে চালাকি করেছেন কমবেশি। বাকি ছিল নিজের সাথে চালাকি করাটা। এবার বোধ হয় সে কাজটাও সেরে ফেললেন। ‘অতি চালাকের ভবিষ্যৎ কিন্তু ভালো হয় না’ কেন বারবার এ কথা ভুলে যাচ্ছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন