বৃহস্পতিবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৩

সংঘাত নয় সমঝোতা


২৭ থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত ৬০ ঘণ্টার প্রথম দফার হরতালের পর তো বটেই, ৪ থেকে ৬ নবেম্বর পর্যন্ত পালিত ™ি^তীয় দফার সফল হরতালের পরও ধারণা করা হয়েছিল, ক্ষমতাসীনদের মনোভাবে নিশ্চয়ই শুভ ও ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। তারা বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য উদ্যোগ নেবেন। ১৮ দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রস্তাবিত রূপরেখা অনুযায়ী নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবেন। অন্যদিকে এমন কোনো উদ্যোগের ধারেকাছে যাওয়ার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীনরা বরং নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কথিত সর্বদলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার জন্য উঠেপড়ে লেগে আছেন। উদ্দেশ্যেও কোনো রাখঢাক করছেন না তারা। এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে তাদের বক্তব্যে ও কর্মকা-ে। যেমন ™ি^তীয় দফার হরতালের সময়ও যথারীতি পুলিশ ও র‌্যাবকে দিয়ে দমন-নির্যাতনের নিষ্ঠুর অভিযান চালিয়েছে সরকার। আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ ও যুবলীগের গু-া-সন্ত্রাসীরাও এসব অভিযানে অংশ নিয়েছে। এর ফলে সারাদেশে প্রায় ১০ জনের মৃত্যু ঘটেছে। আহতদের সংখ্যাও পাঁচশ ছাড়িয়ে গেছে। সেই সাথে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ঢালাওভাবে গ্রেফতার তো করা হয়েছেই। একই সঙ্গে হুমকিও যথেষ্টই দিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু একথা পর্যন্ত বলেছেন যে, বেগম খালেদা জিয়াকে নাকি ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ পরিণতি বরণ করতে হবে। অর্থাৎ বেগম খালেদা জিয়াকে তারা ফাঁসীর মঞ্চে ওঠাবেন! কথাটাকে হাল্কাভাবে নেয়ার উপায় নেই। কারণ, ইনু সাহেবদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কম যাচ্ছেন না। ৬০ ঘণ্টার হরতালের মধ্যে ৫ নবেম্বর নওগাঁর পোরশায় অনুষ্ঠিত জনসভায় শুধু নয়, বৃহস্পতিবার কেরানীগঞ্জের জনসভায়ও একদিকে তিনি খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করার এবং দাওয়াত দেয়ার সেই নাটকীয়তার কাহিনী শুনিয়েছেন, অন্যদিকে বলেছেন, তার দাওয়াত কবুল না করলেও বিএনপি নেত্রীকে তিনি নাকি বলেছেন, কোন কোন মন্ত্রণালয় তারা চান তা যেন তাকে জানিয়ে দেন। দৃশ্যত ‘উদারতা’ মনে হলেও দুটি জনসভারই পুরো বক্তৃতাজুড়ে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে বেগম খালেদা জিয়াকে ধোয়ামোছা করেছেন, ‘খুনি’ হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যঙ্গ-তামাশা করেছেন তা থেকে এটুকু অন্তত বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, মন্ত্রিত্ব দেয়া দূরে থাকুক বিরোধী দলকে এমনকি নির্বাচনে নিয়ে আসার ব্যাপারেও তাদের সামান্য আন্তরিকতা নেই। অর্থাৎ এতকিছুর পরও সমঝোতায় আসার নাম করেননি তারা। শুধু তা-ই নয়, একযোগে কথিত সর্বদলীয় সরকার গঠনের লক্ষ্যেও পদক্ষেপ নিয়েছেন তারা। এ উদ্দেশ্যে ৪ নবেম্বর সব মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে এক সপ্তাহের মধ্যে পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সে অনুযায়ী আগামী ১০ নভেম্বর মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা পদত্যাগপত্র জমা দেবেন বলে জানিয়েছেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। শেখ হাসিনার নিজের নেতৃত্বে পরিকল্পিত ওই সরকারে আওয়ামী লীগের ১০ জন এবং অন্য দলগুলোর ১০ জনকে মন্ত্রী বানানো হবে। সে সরকার গঠিত হওয়ার পরই নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে বলেও জানা যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসার পথ ধরেই এগিয়ে চলেছেন। এর অর্থ, প্রধানমন্ত্রী যা কিছুই বোঝাতে চান না কেন, সর্বদলীয় নামে তিনি আসলে বর্তমান সরকারেরই নতুন এক রূপ দেখানোর জন্য পা বাড়িয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের কেউই কথিত ওই সর্বদলীয় সরকারে যোগ দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। ৫ নবেম্বর প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা প্রচারিত হওয়ার পরপর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঘোষণা করেছেন, তারা ‘তথাকথিত’ সর্বদলীয় সরকারের মন্ত্রিত্ব নেবেন না। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর ফলে দেশের রাজনৈতিক সংকট আরো জটিল ও মারাত্মক হয়ে উঠবে। পাশাপাশি সভা-সমাবেশের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এবং বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা ও তাদের গ্রেফতারের কর্মকা-ও সমঝোতার সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করবে। আর সমঝোতায় না পৌঁছানো গেলে এবং বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে বাইরে রেখে একতরফা নির্বাচন করার চেষ্টা চালানো হলে পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নিতে পারে সে সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীরও জানা থাকার কথা। তা সত্ত্বেও তারা রাজপথেই সংকটের সমাধান করতে চাচ্ছেন বলেই গণঅভ্যুত্থানের অশুভ পরিণতির কথাও এখন স্মরণ করছেন দেশের সচেতন সকল মহল। বলা বাহুল্য, ক্ষমতাসীনদের জন্য এই পরিণতি সাধারণত ভয়ংকরই হয়ে থাকে। অথচ এমন পরিস্থিতি সহজেই এড়ানো যেতোÑ ক্ষমতাসীনরা যদি বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাবকে সরাসরি নাকচ করে দেয়ার পরিবর্তে এ বিষয়ে সংলাপের আয়োজন করতেন। সে সংলাপে বিএনপির পাশাপাশি অন্য দলগুলোকেও আমন্ত্রণ জানানো যেতো। এর কারণ, বেগম খালেদা জিয়া তার উপস্থাপিত রূপরেখা থেকে ‘এক চুল’ও নড়বেন না ধরনের কোনো ঘোষণা দেননি। এর মাধ্যমে তিনি বরং সংলাপ ও সমঝোতার দরজা খুলে দিয়েছিলেন। হতে পারে তার প্রস্তাব অসম্পূর্ণ ছিল, রূপরেখা অনুযায়ী ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের সব উপদেষ্টাকেও হয়তো পাওয়া যেতো না, কিন্তু রূপরেখার প্রাধান্যে ছিল উদ্দেশ্যের দিকটি। খালেদা জিয়া এতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রশ্নেও ছাড় দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যে নামেই ডাকা হোক, নির্বাচনকালীন সরকারকে অবশ্যই নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হতে হবে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টার পদে শেখ হাসিনাকে রাখা চলবে না। বিষয়টি নিয়ে সংলাপে বসলে এবং বিকল্প কিছু প্রস্তাব আনা হলে খালেদা জিয়া নিশ্চয়ই সরাসরি নাকচ করে দিতেন নাÑ যেমনটি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু গণতন্ত্রসম্মত সে পদ্ধতিতেও পা রাখেননি প্রধানমমন্ত্রী। অর্থাৎ সব মিলিয়েই ক্ষমতাসীনরা সংঘাতের অশুভ পথকে বেছে নিয়েছে। একই কারণে জনমনেও আশংকা ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা মনে করি, সময় এখনো একেবারে পেরিয়ে যায়নি। ক্ষমতাসীনদের উচিত ৬০ ঘণ্টার দুটি হরতালের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত জনমতকে বিবেচনায় নেয়া। সেই সাথে তারা যদি জাতিসংঘসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের অনুরোধ ও পরামর্শের প্রতি সম্মান দেখান তাহলে এখনো সমঝোতা ও শান্তির পথে ফিরে আসা সম্ভব। সে পথে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই সকলের জন্য মঙ্গল রয়েছে বলে আমরা মনে করি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads