‘নির্বাচনী ট্রেন বাধাগ্রস্ত’ এটি একটি জাতীয় দৈনিকের প্রধান শিরোনাম। এ শিরোনামের খবরে বলা হয় : তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে গত সোমবার থেকে যাত্রা শুরু করেছে সর্বদলীয় নির্বাচনী ট্রেন। তবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের তফসিল প্রত্যাখ্যানমূলক ৪৮ ঘণ্টার সড়ক, রেল ও নৌপথ অবরোধে অনেকটাই বাধাগ্রস্ত সেই ট্রেন। শুধু নির্বাচনী ট্রেনই নয়, বাধাগ্রস্ত বাস্তবের ট্রেনও। গত মঙ্গলবার এই অবরোধের প্রথমদিন ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নাটোরসহ বিভিন্ন স্থানে রেললাইন উপড়ে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। অবরোধকালে সহিংস ঘটনায় বিজিবি জওয়ান, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ নিহত হয়েছেন ৮ জন। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর সহিংসতায় এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৯। তফসিল ঘোষণার পর পরই সোমবার রাতে শুরু হওয়া সহিংসতায় রাজধানীতে ১ ও কুমিল্লা নগরীতে ১ জন নিহত হন। গত মঙ্গলবার আহতের সংখ্যা ৬৩২ ছাড়িয়ে গেছে। আহতদের মধ্যে রাজশাহী ও খুলনা সিটি করপোরেশনের দুই মেয়রও রয়েছেন। নাশকতার আশঙ্কায় পুলিশ আটক করেছে ১৮ দলের ১২৫ নেতা-কর্মীকে। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের এমন চিত্র থেকে সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, দেশে নির্বাচনের পরিবেশ নেই। এই কারণেই হয়তো পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে, ‘নির্বাচনী ট্রেন বাধাগ্রস্ত’।
কিন্তু নির্বাচনী ট্রেন কেন বাধাগ্রস্ত হলো? এর কারণ দেশের জনগণের কাছে স্পষ্ট। সরকারও বিষয়টি জানেন। কিন্তু আবারও ক্ষমতা হস্তগত করার লোভে সমাধানের পথে যেতে চাইছে না সরকার। দেশের জনগণ চায় একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। কিন্তু সরকার নিত্যনতুন আইন, কৌশল ও চাতুর্যের মাধ্যমে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিপরীতে নানা কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশে সৃষ্টি হয়েছে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। এমন অবস্থায় গত মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের সাথে সাক্ষাৎ করেন ড. কামাল হোসেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান, সুলতানা কামাল, ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ও আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিশিষ্ট নাগরিকদের এই প্রতিনিধি দল প্রেসিডেন্টকে জানান, প্রধান বিরোধী দল ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে গণতান্ত্রিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। তারা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা জানিয়ে প্রেসিডেন্টকে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার অনুরোধ করেন। বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে আকবর আলি খান সাংবাদিকদের বলেন, সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও দেশের মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে দুই প্রধান দলের নেত্রীকে ডেকে একটি সমঝোতার মাধ্যমে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে উদ্যোগী হওয়ার জন্য রাষ্ট্রের অভিভাবককে অনুরোধ জানানো হয়েছে। প্রেসিডেন্টকে তারা জানান, নির্বাচনের আগেই নির্বাচনী তফসিল নিয়ে দেশে সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি চলছে। হরতাল-অবরোধের কারণে দেশের মানুষ আতঙ্কে জীবনযাপন করছে। সবার অংশগ্রহণেই কেবল একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে স্বস্তি ফিরে আসতে পারে। তারা প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার কাছেও যাবেন কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে ড. আকবর আলি খান বলেন, প্রতিপক্ষের কাছে গিয়ে কোনো সমাধান মিলবে না, তাই রাষ্ট্রের অভিভাবকের কাছে আমাদের প্রস্তাব রেখেছি। দেশে আবারও সামরিক শাসন আসবে কিনা, সরাসরি এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, দেশের মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। তারা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়। গণঐক্যের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা সে কথাই প্রেসিডেন্টকে জানিয়েছি। উল্লেখ্য যে, প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ এই ছয় বিশিষ্ট নাগরিককে আশ্বস্ত করে বলেছেন, তার সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবে এই পরিস্থিতিতে সমাধান খুঁজে পেতে তিনি চেষ্টা করছেন। সাংবিধানিক কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু করতে পারবেন না, যা করার অনানুষ্ঠানিকভাবে করবেন।
বিপর্যয় রোধে এখন প্রেসিডেন্টের অভিভাবকত্ব কামনা করছেন দেশের নাগরিকরা। কিন্তু দেশ এমন বিপর্যয়ের মুখে পড়লো কেন? আমরা তো একথা জানি যে, দেশ পরিচালনার দায়িত্ব সরকারের। সরকারের ব্যর্থতার কারণেই দেশ আজ বিপর্যয়ের মুখে। শুধু ব্যর্থতা নয়, এর সাথে যুক্ত হয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহার ও চাতুর্যের নানা ছলাকলা। এমন অবস্থায় নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশন যথাযথ ভূমিকা ও যথার্থ আচরণের মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারতো। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, নির্বাচন কমিশনও জনমনে আশার সঞ্চার করতে পারেনি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার আশায় তারা তফসিল ঘোষণায় বিলম্ব করছেন। কিন্তু এমন বক্তব্যের পর ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করে বসলো। তাও আবার জাতির উদ্দেশে ভাষণের মাধ্যমে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এই তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। বিকল্প ধারা প্রধান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী একতরফা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, এই তফসিল দেশকে এক গভীর সংকটের মধ্যে ঠেলে দিল। এর জন্য ইতিহাস কোনোদিনই তাদের ক্ষমা করবে না। গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, এই তফসিল জাতিকে সংঘাত-বিভক্তি ও নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে গেল। জাসদ সভাপতি আসম আবদুর রব বলেন, এ ঘোষণার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন জাতিকে একতরফা নির্বাচনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এতে সব দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সম্ভাবনা তিরোহিত হয়েছে। গত সোমবার এক বিবৃতিতে সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, আমরা বার বার সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক সমঝোতার আগে তফসিল ঘোষণা না করতে অনুরোধ ও দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু তারা তফসিল ঘোষণা করে দেশকে এক গভীর সংকটের মধ্যে ঠেলে দিল। এই সংকটের কারণে দেশে যত প্রাণহানি, অগ্নিসংযোগ এবং সম্পদহানি হবে তার জন্য সরকার ও নির্বোধ নির্বাচন কমিশনই দায়ী থাকবেন। এছাড়া এর ফলে দেশে যদি কোনো অসাংবিধানিক সরকার আসে তাহলে এর দায়দায়িত্বও এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে বহন করতে হবে। তিনি আরো বলেন, নির্বাচন কমিশনের সরকারকে বলা উচিত ছিল, নির্বাচনে সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করুন। তাদের বলা উচিত ছিল, রাজনৈতিক সমস্যা শুধু রাজনীতির মাধ্যমেই সমাধান করা উচিত, গায়ের জোরে নয়। তিনি একতরফা এই নির্বাচনী তফসিল প্রতিহত করার জন্য জনগণকে একযোগে সারা দেশে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ কর্মসূচি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। প্রসঙ্গত এখানে আরো উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিও (সিপিবি) এই একতরফা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে সংবাদপত্রে এখন নানা বিশ্লেষণও প্রকাশিত হচ্ছে। ‘আবার কালো সোমবার!’ শিরোনামের সংবাদ বিশ্লেষণে বলা হয়, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদের ভাষণে ‘সংবিধান রক্ষার’ অঙ্গীকার ২০০৬ সালের নবেম্বরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সাধারণভাবে সমঝোতার কথা বললেও তার ভাষণে স্পষ্ট যে, বিএনপির অংশগ্রহণের আশা তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সাহস দিয়েছেন। নিরাপত্তা জোরদারের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। আবার প্রকারান্তরে নির্বাচনী যুদ্ধে যাওয়ার আহ্বানের সুরও চাপা রাখেননি। কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেছেন, দেশের ঋণ শোধ করার ডাক এসেছে। ২০০৬ সালের ২৭ শে নবেম্বরের এক কৃষ্ণ সোমবারেই নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০১৩ সালেও আরেকটি কৃষ্ণ সোমবারে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হলো।”
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিনকে এখন বলা হচ্ছে ‘কৃষ্ণ সোমবার’। কেন এই কথা বলা হচ্ছে তা আমাদের নির্বাচন কমিশন কিংবা সরকার ভেবে দেখবেন কিনা জানি না। তবে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগকে জনগণ যে গ্রহণ করছে না তা তাদের উপলব্ধি করতে হবে। দেশের জনগণ জানে গত ৫ বছর সরকার সুশাসনের পথে চলেনি, নির্বাচনকালীন এই নাজুক সময়েও সরকার সঠিকপথে চলছে না। তারা নিজেরাই ঘোষণা দিয়ে জনগণকে জানিয়েছিল, দৈনন্দিন রুটিন কাজ ছাড়া তারা এ সময় নীতি নির্ধারণমূলক কিংবা বড় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না। কিন্তু তারা কথা রাখেননি। নির্বাচনকালীন এই সময়ে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিতর্কিত টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করলো। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও সংসদ সদস্যদের ১৩টি টিভি ও ১৪টি রেডিও লাইসেন্স দিল। এছাড়া বড় বড় অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তও গ্রহণ করছে সরকার। নির্বাচনকালীন সরকার কি এইসব কর্মকা- চালাতে পারে? এদিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরেও আচরণবিধি মানছে না সরকারি দল আওয়ামী লীগ। রাজধানী জুড়ে এখন নৌকায় ভোট চেয়ে বিলবোর্ডের ছড়াছড়ি। বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ও দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে সরকারের পক্ষে প্রচারণার ব্যানার ও পোস্টার। সোমবার সন্ধ্যায় তফসিল ঘোষণার পর মঙ্গলবার সারাদিন চলে গেলেও নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। নির্বাচনী আচরণবিধি রক্ষা করছে না শাসক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তফসিল ঘোষণার পরপরই তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিজয় মিছিল ও নির্বাচনী মিছিল করেছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ট্রাক, বাস ও মোটরসাইকেল নিয়ে নির্বাচনী মিছিল করতে দেখা গেছে, যা নির্বাচনী আচরণবিধির ১২ ধারার সম্পূর্ণ লঙ্ঘন।
দিন যতই গড়াচ্ছে, ততই এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠছে যেÑ নির্বাচনকালীন এই সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশন দিয়ে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। ফলে বিরোধী জোটের রাজপথের আন্দোলনের যৌক্তিকতা এখন সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে। বিরোধী দলের সড়ক-রেল ও নৌপথ অবরোধের কর্মসূচির মুখে এখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলছেন, বিএনপি নির্বাচনে এলে তফসিলে পরিবর্তন করা যেতে পারে। এমন অবস্থায় আমরা মনে করি, সরকার ও নির্বাচন কমিশন বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন এবং ছয় বিশিষ্ট নাগরিকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে এগিয়ে যাবেন। কিন্তু এরপরেও যদি সরকার ক্ষমতা দখলের জন্য স্বৈরাচারের পথেই চলতে থাকে, তাহলে জনগণের কাছে রাজপথের আন্দোলন ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না। আর বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতন মানুষ মাত্রই একথা জানেন যে, রাজপথের লড়াইয়ে সবসময় জনগণই বিজয় লাভ করে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন