কর্নেল (অব:) মো: আবদুল বাতেন
ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর আমাদের জাতির ইতিহাসের যুগান্তকারী ঘটনাগুলোর
অন্যতম একটি। এই দিনটিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা গোটা জাতি একটি অনিবার্য
ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পেয়েছিল। প্রকৃত অর্থে কী ঘটেছিল ওই দিনটিতে, কী ছিল অন্তরালের কাহিনী। বিষয়টি আলোচনার সুবিধার্থে ৭ নভেম্বরের
পূর্বের ও পরের ঘটনাবলির সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরছি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সেনাবাহিনীর কিছু বিক্ষুব্ধ অফিসার কর্তৃক সপরিবারে নিহত হন।
শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার সদস্য খোন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়।
মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নতুন সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন।
৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীর তৎকালীন সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াকে বন্দী করা হয়।
৬ নভেম্বর দিবাগত মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ৭ নভেম্বরের শুরুতেই ঢাকা সেনানিবাসে বিদ্রোহী সৈনিকদের দিয়ে একটি পাল্টা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। অভ্যুত্থানকারী সৈনিকেরা জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করেন।
বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে কিছু সংখ্যক সৈনিক (অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিরত) বিপ্লবী পন্থায় সরকার পরিবর্তনের পরিকল্পনা করে। এরা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সাথে যোগাযোগ করে এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। কর্নেল তাহের ছিলেন জাসদের সশস্ত্র শাখা গণবাহিনীর নেতা।
৭ নভেম্বর সকালে ঢাকা শহরে সৈনিক-জনতা সম্মিলিতভাবে নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার, সিপাহি-জনতা ভাই ভাই, সিপাহি বিপ্লব জিন্দাবাদ ইত্যাদি স্লোগানের মধ্য দিয়ে বিপ্লবের বিজয় উদযাপন করে।
কোনো কোনো মহল থেকে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয় যে, ৭ নভেম্বর সৈনিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কর্নেল তাহের এবং বিপ্লব শেষে জেনারেল জিয়া তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে।
উল্লিখিত ঘটনাবলির মধ্যে ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমরা এই নিবন্ধে কোনো আলোচনা করব না। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান আমাদের আলোচনার মূল বিষয় না হলেও প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় আমরা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব। কৌতূহলী মহলে একটি প্রশ্ন আছে যে, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান আওয়ামী ‘লীগপন্থী বা ভারতপন্থী’ ছিল কি না! ওই সময়ের ঘটনাবলি পর্যালোচনায় মনে হয়, আওয়ামী লীগের সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার কোনো পরিকল্পনা অভ্যুত্থানকারীদের ছিল না। অভ্যুত্থানকারী অফিসারদের বঙ্গভবনের কাছে উত্থাপিত দাবি-দাওয়াগুলো পর্যালোচনা থেকে দেখা যায় যে, অভ্যুত্থানকারীদের নেতা খালেদ মোশাররফের উদ্দেশ্য ছিল জেনারেল জিয়াকে অপসারণ করে নিজে সেনাবাহিনী প্রধান হওয়া। যদিও আর্মিতে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর থেকে বঙ্গভবনে অবস্থানকারী মেজরদের সেনানিবাসে ফিরিয়ে আনার দাবিটিও ছিল অন্যতম একটি।
৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানকারীরা তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তার বাসায় ৪ ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকদের প্রহরায় গৃহবন্দী করে রাখে। সেনাবাহিনী প্রধানকে বন্দী করা হয়েছেÑ এ খবর সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এরা সেনাপ্রধানকে বন্দী করার বিষয়টি মোটেই ভালোভাবে নিতে পারে না। জেনারেল জিয়া এমনিতেই মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্ব থেকে বহুল আলোচিত ও সৈনিকপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তদুপরি এই ঘটনার ফলে তার প্রতি সৈনিক-জনতার সহানুভূতি আরো অনেক গুণ যায়। অপর পক্ষে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনে নিজের প্রমোশন ও অন্যান্য দাবি-দাওয়া নিয়ে দেন-দরবারে ব্যস্ত থাকায় সৈনিকদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা তার জানার সুযোগ হয়নি। ফলে সেনানিবাসের ভেতরে যে একটি পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি চলছিল তা তার বা তার সহযোগীদের কারো গোচরে ছিল না। ৭ নভেম্বর মধ্যরাতে সৈনিকদের নেতৃত্বে যখন সেনাবিদ্রোহ সংঘটিত হয় তখনো তিনি বঙ্গভবনে ব্যস্ত ছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক কে হবে তা নিয়ে দর কষাকষিতে। উল্লেখ্য, ৬ নভেম্বর দেশের ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। বঙ্গভবন থেকে সেনাবিদ্রোহের খবর পেয়ে পরিস্থিতির নাজুকতা বিবেচনা করে খালেদ মোশাররফ তার প্রাইভেট কার নিজে ড্রাইভ করে শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নেন। এই ইস্ট বেঙ্গল ইউনিটকে তিনি তার নিরাপত্তা বিধানের জন্য বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৩ নভেম্বরের পর ঢাকায় এনেছিলেন। ৭ নভেম্বর সকালে তিনি ওই ইউনিটের বিদ্রোহী সৈনিকদের হাতেই নিহত হন।
৭ নভেম্বরের সৈনিক বিদ্রোহের শুরুতেই বিপ্লবী সৈনিকেরা জেনারেল জিয়াকে তার বাসা থেকে মুক্ত করে ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারিতে নিয়ে যায়। জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করার অভিযানে নেতৃত্ব দেয় ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির মেজর মহিউদ্দিন ও সুবেদার মেজর আনিসুল হক। মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে সৈনিক দলটি জেনারেল জিয়ার বাসায় সামনে গেলে ৪ ইস্ট বেঙ্গলের গার্ডরা তেমন কোনো প্রতিরোধ সৃষ্টি না করে বরং পরিস্থিতি অনুধাবনপূর্বক গুলি করতে করতে বাসার পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে যায়। ২ ফিল্ডের সৈনিকেরা বাসার গেট খুলে ভেতরে প্রবেশ করে এবং জেনারেল জিয়াকে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও জোর করে গাড়িতে তুলে নেয়। জেনারেল জিয়ার অনিচ্ছার কারণ সম্ভবত তিনি বাইরের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না।
জেনারেল জিয়াকে তার বাসা থেকে ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির অফিসে নেয়া হয়। কিছু সময়ের ব্যবধানে সেখানে তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলীসহ আরো কিছু অফিসারকে বিপ্লবী সৈনিকেরা ডেকে নিয়ে আসেন। কিছু সময়ে মধ্যে সেখানে আসেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আবু তাহের। কর্নেল তাহের ও তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা চাচ্ছিছলেন জেনারেল জিয়াকে সেনানিবাসের বাইরে নিয়ে আলোচনা করতে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল জিয়াকে দিয়ে প্রচার মাধ্যমে বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া। কেননা তাদের মূল দল জাসদের কর্মসূচি ছিল শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে সেনাবাহিনীতে কোনো অফিসার শ্রেণী থাকবে না। তাদের মতলব বুঝতে পেরে ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী ও উপস্থিত অন্য অফিসারেরা জেনারেল জিয়াকে সেনানিবাসের বাইরে যেতে নিষেধ করেন। জেনারেল জিয়াও সম্ভবত কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের সাথে মধ্যরাতে সেনানিবাসের বাইরে যাওয়ার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কর্নেল তাহের জেনারেল জিয়ার সাথে দীর্ঘ সময়ে একান্তে আলোচনা করেন। তিনি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি নিয়েও কথা বলেন। তিনি জেনারেল জিয়াকে ওই দাবিগুলো মেনে নিতে চাপ প্রয়োগ করেন। জেনারেল জিয়া তার সাথে সেনানিবাসের বাইরে যেতে রাজি না হওয়ায় তিনি মনঃক্ষুণœ হয়ে চলে যান।
একটি মহল থেকে দাবি করা হয় যে, ৭ নভেম্বর বিপ্লবের নায়ক ছিলেন কর্নেল তাহের। আমরা নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করেছি ১৯৭৩ সালে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নামে একটি সংগঠনের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের তৎকালের অস্থির রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এই সংস্থাটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। এই সংস্থাটি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সশস্ত্র শাখা গণবাহিনীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করতে থাকে। জাসদ গণবাহিনীর নেতা কর্নেল তাহের সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে একটি শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাসদের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ও ৩ নভেম্বরের ঘটনাবলি সংঘটিত হওয়ার অনেক আগে এই সংস্থাটির জন্ম হলেও এসব ঘটনা সংঘটনে তাদের কোনো সক্রিয় ভূমিকা বা তাদের চালিকাশক্তির ভূমিকায় দেখা যায় না। তবে ৩ নভেম্বর ঘটনার পর ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরে ও আশপাশের এলাকাগুলোতে তাদের কিছু তৎপরতা লক্ষ করা যায়। সে তৎপরতা ছিল সাধারণ সৈনিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে শ্রেণীহীন তথা অফিসারবিহীন সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করা। তাদের কর্মকাণ্ড ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও লিফলেট বিলি করার মধ্যেই সীমিত ছিল। ৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর মধ্যরাতের পূর্ব পর্যন্ত নিজ বাসায় বন্দী জেনারেল জিয়ার সাথে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কোনো নেতা বিশেষ করে কর্নেল তাহেরের কোনো যোগাযোগ হয়েছিল কি না তার কোনো লিখিত দলিল নেই। তবে জেনারেল জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ ছিল। কেননা তারা জেনারেল জিয়ার মাধ্যমে তাদের শ্রেণীহীন সেনাবাহিনী তথা শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা জেনারেল জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে আগ্রহী থাকলেও ৩ নভেম্বর পরবর্তী সময়ের ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরের বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ কর্তৃক জেনারেল জিয়াকে বন্দী করার ঘটনায় সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও উৎকণ্ঠা দানা বাঁধতে থাকে। এতে পূর্ব থেকেই জনপ্রিয় জেনারেল জিয়ার জনপ্রিয়তা আরো দ্রুত বেড়ে যায়। ৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর মধ্যরাতের পূর্ব পর্যন্ত দেশে কার্যত কোনো সরকার না থাকায় ও সেনাবাহিনীতে কোনো সেনাপ্রধান না থাকায় গোটা জাতির সাথে সেনাবাহিনীর সদস্যগণও কাণ্ডারিবিহীন তরীর মতো অনিশ্চয়তার সাগরে ভাসতে থাকে। রেডিও-টিভি বন্ধ থাকায় এবং সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা বা দিকনির্দেশনা না থাকায় অনিশ্চয়তা আরো তীব্রতর হয়। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কর্নেল তাহেরের নির্দেশনায় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা বিভিন্ন প্রচারপত্র বিলি করে শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি বিপ্লব সংঘটনে সাধারণ সৈনিকদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করে।
৬ নভেম্বর মধ্যরাতে সৈনিক বিপ্লবেরর শুরুতেই অনিশ্চয়তার সাগরে ভাসমান সৈনিকরা একজন কাণ্ডারীর খোঁজে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করাটাকেই প্রথম কাজ মনে করে। তাই এরা জেনারেল জিয়ার বাসার দিকে ছুটতে থাকে এবং খুব সহজেই তাকে মুক্ত করে নিয়ে উল্লাস করতে করতে ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির অফিসে নিয়ে আসে। উল্লেখ্য, জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করার অভিযানে নেতৃত্ব দেয় ২ ফিল্ড আর্টিলারির সৈনিকেরা। তাদের সাথে একাধিক অফিসারও ছিলেন। জিয়াকে মুক্ত করার সময় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও বাস্তবে কোনো মুখ্য ভূমিকায় থাকার সুযোগ তাদের ছিল না। এ প্রসঙ্গে বন্দী জিয়াকে মুক্ত করার পর ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারিতে উপস্থিত তৎকালীন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের স্টেশন কমান্ডার লে. কর্নেল এম এম হামিদের ‘তিনটি সেনা-অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ গ্রন্থের ১০৬ পৃষ্ঠা থেকে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছিÑ ‘শত শত সৈনিকের পদভারে ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট তখন প্রকম্পিত। এদের মধ্যে বহু সৈনিক দেখা গেল এলোমেলো খাকি ড্রেসে। পায়ে ছিল বুটের বদলে সাধারণ জুতা। অনেকের মাথায় টুপিও নেই। এরাই ছিল জাসদের বিপ্লবী সংস্থার সশস্ত্র সদস্যবৃন্দ। সিপাহি বিদ্রোহের রাতে খাকি উর্দি পরে তারা মিশে গিয়েছিল ক্যান্টনমেন্টের সাধারণ জওয়ানদের সাথে।’ প্রত্যক্ষদর্শী এই লেখকের উদ্ধৃতি থেকেই স্পষ্ট হয় যে, বিপ্লবের রাতে জাসদের বিপ্লবী সংস্থার সশস্ত্র সদস্যরা খাকি পোশাক পরে সাধারণ সৈনিকদের সাথে মিশে গিয়েছিল মাত্র কিন্তু নেতৃত্ব দেয়ার মতো বাস্তব অবস্থায় ছিল না।
যা হোক, জিয়াকে মুক্ত করার পর সৈনিকেরা আশপাশ থেকে আরো কিছু সিনিয়র অফিসারসহ ২ ফিল্ড রেজিমেন্টে নিয়ে আসে। সেখানে আসেন কর্নেল তাহেরও। তিনি জেনারেল জিয়াকে তার সাথে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। জেনারেল জিয়া তার দীর্ঘ দিনের পেশাগত অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন, ব্যাপক পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া আবেগের বশবর্তী হয়ে বা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে শুধুমাত্র ঘোষণার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন করা যায় না। এটা বাস্তবতার পরিপন্থী। তাই তিনি ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যেতে অস্বীকৃতি জানান। কর্নেল তাহেরের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়ায় তিনি ক্ষুব্ধচিত্তে ফিরে যান। অভিযোগ করেন জিয়া তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। আসলে কী ছিল তাদের দু’জনের মধ্যে বোঝাপড়া বা আদৌ ছিল কি না, তা আজো দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার নয়।
৭ নভেম্বর সকালবেলা রেডিওতে জেনারেল জিয়ার কণ্ঠ শুনে দেশবাসী জানতে পারে যে, গত কয়েক দিনের অনিশ্চয়তা কেটে গেছে। দেশবাসী পায় একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। সেই সাথে ৭ নভেম্বর সকালবেলা ঢাকা শহরবাসী দেখল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সৈনিক-জনতার অভূতপূর্ব সম্মিলন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সেনাবাহিনীর কিছু বিক্ষুব্ধ অফিসার কর্তৃক সপরিবারে নিহত হন।
শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার সদস্য খোন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়।
মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নতুন সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন।
৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীর তৎকালীন সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াকে বন্দী করা হয়।
৬ নভেম্বর দিবাগত মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ৭ নভেম্বরের শুরুতেই ঢাকা সেনানিবাসে বিদ্রোহী সৈনিকদের দিয়ে একটি পাল্টা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। অভ্যুত্থানকারী সৈনিকেরা জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করেন।
বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে কিছু সংখ্যক সৈনিক (অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিরত) বিপ্লবী পন্থায় সরকার পরিবর্তনের পরিকল্পনা করে। এরা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সাথে যোগাযোগ করে এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। কর্নেল তাহের ছিলেন জাসদের সশস্ত্র শাখা গণবাহিনীর নেতা।
৭ নভেম্বর সকালে ঢাকা শহরে সৈনিক-জনতা সম্মিলিতভাবে নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার, সিপাহি-জনতা ভাই ভাই, সিপাহি বিপ্লব জিন্দাবাদ ইত্যাদি স্লোগানের মধ্য দিয়ে বিপ্লবের বিজয় উদযাপন করে।
কোনো কোনো মহল থেকে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয় যে, ৭ নভেম্বর সৈনিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কর্নেল তাহের এবং বিপ্লব শেষে জেনারেল জিয়া তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে।
উল্লিখিত ঘটনাবলির মধ্যে ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমরা এই নিবন্ধে কোনো আলোচনা করব না। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান আমাদের আলোচনার মূল বিষয় না হলেও প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় আমরা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব। কৌতূহলী মহলে একটি প্রশ্ন আছে যে, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান আওয়ামী ‘লীগপন্থী বা ভারতপন্থী’ ছিল কি না! ওই সময়ের ঘটনাবলি পর্যালোচনায় মনে হয়, আওয়ামী লীগের সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার কোনো পরিকল্পনা অভ্যুত্থানকারীদের ছিল না। অভ্যুত্থানকারী অফিসারদের বঙ্গভবনের কাছে উত্থাপিত দাবি-দাওয়াগুলো পর্যালোচনা থেকে দেখা যায় যে, অভ্যুত্থানকারীদের নেতা খালেদ মোশাররফের উদ্দেশ্য ছিল জেনারেল জিয়াকে অপসারণ করে নিজে সেনাবাহিনী প্রধান হওয়া। যদিও আর্মিতে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর থেকে বঙ্গভবনে অবস্থানকারী মেজরদের সেনানিবাসে ফিরিয়ে আনার দাবিটিও ছিল অন্যতম একটি।
৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানকারীরা তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তার বাসায় ৪ ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকদের প্রহরায় গৃহবন্দী করে রাখে। সেনাবাহিনী প্রধানকে বন্দী করা হয়েছেÑ এ খবর সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এরা সেনাপ্রধানকে বন্দী করার বিষয়টি মোটেই ভালোভাবে নিতে পারে না। জেনারেল জিয়া এমনিতেই মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্ব থেকে বহুল আলোচিত ও সৈনিকপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তদুপরি এই ঘটনার ফলে তার প্রতি সৈনিক-জনতার সহানুভূতি আরো অনেক গুণ যায়। অপর পক্ষে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনে নিজের প্রমোশন ও অন্যান্য দাবি-দাওয়া নিয়ে দেন-দরবারে ব্যস্ত থাকায় সৈনিকদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা তার জানার সুযোগ হয়নি। ফলে সেনানিবাসের ভেতরে যে একটি পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি চলছিল তা তার বা তার সহযোগীদের কারো গোচরে ছিল না। ৭ নভেম্বর মধ্যরাতে সৈনিকদের নেতৃত্বে যখন সেনাবিদ্রোহ সংঘটিত হয় তখনো তিনি বঙ্গভবনে ব্যস্ত ছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক কে হবে তা নিয়ে দর কষাকষিতে। উল্লেখ্য, ৬ নভেম্বর দেশের ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। বঙ্গভবন থেকে সেনাবিদ্রোহের খবর পেয়ে পরিস্থিতির নাজুকতা বিবেচনা করে খালেদ মোশাররফ তার প্রাইভেট কার নিজে ড্রাইভ করে শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নেন। এই ইস্ট বেঙ্গল ইউনিটকে তিনি তার নিরাপত্তা বিধানের জন্য বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৩ নভেম্বরের পর ঢাকায় এনেছিলেন। ৭ নভেম্বর সকালে তিনি ওই ইউনিটের বিদ্রোহী সৈনিকদের হাতেই নিহত হন।
৭ নভেম্বরের সৈনিক বিদ্রোহের শুরুতেই বিপ্লবী সৈনিকেরা জেনারেল জিয়াকে তার বাসা থেকে মুক্ত করে ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারিতে নিয়ে যায়। জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করার অভিযানে নেতৃত্ব দেয় ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির মেজর মহিউদ্দিন ও সুবেদার মেজর আনিসুল হক। মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে সৈনিক দলটি জেনারেল জিয়ার বাসায় সামনে গেলে ৪ ইস্ট বেঙ্গলের গার্ডরা তেমন কোনো প্রতিরোধ সৃষ্টি না করে বরং পরিস্থিতি অনুধাবনপূর্বক গুলি করতে করতে বাসার পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে যায়। ২ ফিল্ডের সৈনিকেরা বাসার গেট খুলে ভেতরে প্রবেশ করে এবং জেনারেল জিয়াকে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও জোর করে গাড়িতে তুলে নেয়। জেনারেল জিয়ার অনিচ্ছার কারণ সম্ভবত তিনি বাইরের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না।
জেনারেল জিয়াকে তার বাসা থেকে ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির অফিসে নেয়া হয়। কিছু সময়ের ব্যবধানে সেখানে তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলীসহ আরো কিছু অফিসারকে বিপ্লবী সৈনিকেরা ডেকে নিয়ে আসেন। কিছু সময়ে মধ্যে সেখানে আসেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আবু তাহের। কর্নেল তাহের ও তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা চাচ্ছিছলেন জেনারেল জিয়াকে সেনানিবাসের বাইরে নিয়ে আলোচনা করতে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল জিয়াকে দিয়ে প্রচার মাধ্যমে বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া। কেননা তাদের মূল দল জাসদের কর্মসূচি ছিল শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে সেনাবাহিনীতে কোনো অফিসার শ্রেণী থাকবে না। তাদের মতলব বুঝতে পেরে ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী ও উপস্থিত অন্য অফিসারেরা জেনারেল জিয়াকে সেনানিবাসের বাইরে যেতে নিষেধ করেন। জেনারেল জিয়াও সম্ভবত কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের সাথে মধ্যরাতে সেনানিবাসের বাইরে যাওয়ার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কর্নেল তাহের জেনারেল জিয়ার সাথে দীর্ঘ সময়ে একান্তে আলোচনা করেন। তিনি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি নিয়েও কথা বলেন। তিনি জেনারেল জিয়াকে ওই দাবিগুলো মেনে নিতে চাপ প্রয়োগ করেন। জেনারেল জিয়া তার সাথে সেনানিবাসের বাইরে যেতে রাজি না হওয়ায় তিনি মনঃক্ষুণœ হয়ে চলে যান।
একটি মহল থেকে দাবি করা হয় যে, ৭ নভেম্বর বিপ্লবের নায়ক ছিলেন কর্নেল তাহের। আমরা নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করেছি ১৯৭৩ সালে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নামে একটি সংগঠনের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের তৎকালের অস্থির রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এই সংস্থাটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। এই সংস্থাটি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সশস্ত্র শাখা গণবাহিনীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করতে থাকে। জাসদ গণবাহিনীর নেতা কর্নেল তাহের সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে একটি শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাসদের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ও ৩ নভেম্বরের ঘটনাবলি সংঘটিত হওয়ার অনেক আগে এই সংস্থাটির জন্ম হলেও এসব ঘটনা সংঘটনে তাদের কোনো সক্রিয় ভূমিকা বা তাদের চালিকাশক্তির ভূমিকায় দেখা যায় না। তবে ৩ নভেম্বর ঘটনার পর ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরে ও আশপাশের এলাকাগুলোতে তাদের কিছু তৎপরতা লক্ষ করা যায়। সে তৎপরতা ছিল সাধারণ সৈনিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে শ্রেণীহীন তথা অফিসারবিহীন সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করা। তাদের কর্মকাণ্ড ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও লিফলেট বিলি করার মধ্যেই সীমিত ছিল। ৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর মধ্যরাতের পূর্ব পর্যন্ত নিজ বাসায় বন্দী জেনারেল জিয়ার সাথে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কোনো নেতা বিশেষ করে কর্নেল তাহেরের কোনো যোগাযোগ হয়েছিল কি না তার কোনো লিখিত দলিল নেই। তবে জেনারেল জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ ছিল। কেননা তারা জেনারেল জিয়ার মাধ্যমে তাদের শ্রেণীহীন সেনাবাহিনী তথা শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা জেনারেল জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে আগ্রহী থাকলেও ৩ নভেম্বর পরবর্তী সময়ের ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরের বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ কর্তৃক জেনারেল জিয়াকে বন্দী করার ঘটনায় সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও উৎকণ্ঠা দানা বাঁধতে থাকে। এতে পূর্ব থেকেই জনপ্রিয় জেনারেল জিয়ার জনপ্রিয়তা আরো দ্রুত বেড়ে যায়। ৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর মধ্যরাতের পূর্ব পর্যন্ত দেশে কার্যত কোনো সরকার না থাকায় ও সেনাবাহিনীতে কোনো সেনাপ্রধান না থাকায় গোটা জাতির সাথে সেনাবাহিনীর সদস্যগণও কাণ্ডারিবিহীন তরীর মতো অনিশ্চয়তার সাগরে ভাসতে থাকে। রেডিও-টিভি বন্ধ থাকায় এবং সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা বা দিকনির্দেশনা না থাকায় অনিশ্চয়তা আরো তীব্রতর হয়। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কর্নেল তাহেরের নির্দেশনায় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা বিভিন্ন প্রচারপত্র বিলি করে শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি বিপ্লব সংঘটনে সাধারণ সৈনিকদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করে।
৬ নভেম্বর মধ্যরাতে সৈনিক বিপ্লবেরর শুরুতেই অনিশ্চয়তার সাগরে ভাসমান সৈনিকরা একজন কাণ্ডারীর খোঁজে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করাটাকেই প্রথম কাজ মনে করে। তাই এরা জেনারেল জিয়ার বাসার দিকে ছুটতে থাকে এবং খুব সহজেই তাকে মুক্ত করে নিয়ে উল্লাস করতে করতে ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির অফিসে নিয়ে আসে। উল্লেখ্য, জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করার অভিযানে নেতৃত্ব দেয় ২ ফিল্ড আর্টিলারির সৈনিকেরা। তাদের সাথে একাধিক অফিসারও ছিলেন। জিয়াকে মুক্ত করার সময় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও বাস্তবে কোনো মুখ্য ভূমিকায় থাকার সুযোগ তাদের ছিল না। এ প্রসঙ্গে বন্দী জিয়াকে মুক্ত করার পর ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারিতে উপস্থিত তৎকালীন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের স্টেশন কমান্ডার লে. কর্নেল এম এম হামিদের ‘তিনটি সেনা-অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ গ্রন্থের ১০৬ পৃষ্ঠা থেকে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছিÑ ‘শত শত সৈনিকের পদভারে ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট তখন প্রকম্পিত। এদের মধ্যে বহু সৈনিক দেখা গেল এলোমেলো খাকি ড্রেসে। পায়ে ছিল বুটের বদলে সাধারণ জুতা। অনেকের মাথায় টুপিও নেই। এরাই ছিল জাসদের বিপ্লবী সংস্থার সশস্ত্র সদস্যবৃন্দ। সিপাহি বিদ্রোহের রাতে খাকি উর্দি পরে তারা মিশে গিয়েছিল ক্যান্টনমেন্টের সাধারণ জওয়ানদের সাথে।’ প্রত্যক্ষদর্শী এই লেখকের উদ্ধৃতি থেকেই স্পষ্ট হয় যে, বিপ্লবের রাতে জাসদের বিপ্লবী সংস্থার সশস্ত্র সদস্যরা খাকি পোশাক পরে সাধারণ সৈনিকদের সাথে মিশে গিয়েছিল মাত্র কিন্তু নেতৃত্ব দেয়ার মতো বাস্তব অবস্থায় ছিল না।
যা হোক, জিয়াকে মুক্ত করার পর সৈনিকেরা আশপাশ থেকে আরো কিছু সিনিয়র অফিসারসহ ২ ফিল্ড রেজিমেন্টে নিয়ে আসে। সেখানে আসেন কর্নেল তাহেরও। তিনি জেনারেল জিয়াকে তার সাথে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। জেনারেল জিয়া তার দীর্ঘ দিনের পেশাগত অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন, ব্যাপক পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া আবেগের বশবর্তী হয়ে বা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে শুধুমাত্র ঘোষণার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন করা যায় না। এটা বাস্তবতার পরিপন্থী। তাই তিনি ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যেতে অস্বীকৃতি জানান। কর্নেল তাহেরের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়ায় তিনি ক্ষুব্ধচিত্তে ফিরে যান। অভিযোগ করেন জিয়া তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। আসলে কী ছিল তাদের দু’জনের মধ্যে বোঝাপড়া বা আদৌ ছিল কি না, তা আজো দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার নয়।
৭ নভেম্বর সকালবেলা রেডিওতে জেনারেল জিয়ার কণ্ঠ শুনে দেশবাসী জানতে পারে যে, গত কয়েক দিনের অনিশ্চয়তা কেটে গেছে। দেশবাসী পায় একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। সেই সাথে ৭ নভেম্বর সকালবেলা ঢাকা শহরবাসী দেখল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সৈনিক-জনতার অভূতপূর্ব সম্মিলন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন