দেশে যে রাজনৈতিক সঙ্কট এখন চরমে,
তা কাউকে বুঝিয়ে বলতে হয় না। অথচ সরকারি দলের নেতাকর্মীদের অনেকের
কথাবার্তায় মনে হয়, দেশে কোনো সঙ্কট নেই। সংবিধান
মতে, যথাসময়ে আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। আর এ
নির্বাচন হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দলীয় সরকারের অধীনেই, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নয়। অপরপক্ষে ১৮ দলীয়
জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, শেখ হাসিনার
নেতৃত্বে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আর যদি বিরোধী
দল-জোটকে বাইরে রেখে একতরফা নির্বাচন করার চেষ্টা হয়, তবে বিরোধী দল-জোট দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে তা প্রতিহত করবে।
এমনই যখন অবস্থা, আমরা দেখছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার জোটের মাত্র চারটি দলের নেতাদের নিয়ে ২৯ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সমন্বয়ে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। এতে জাতীয় পার্টির ছয়জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন। এই মন্ত্রিসভাকে নানা নামে ডাকা হচ্ছে সরকারপক্ষ থেকেÑ বহুদলীয় সরকার, নির্বাচনকালীন সরকার বা সর্বদলীয় সরকার। তবে নানা আলোচনা-সমালোচনার মুখে সরকারপক্ষ এখন এ সরকারকে নির্বাচনকালীন সরকার বলে আখ্যায়িত করছে। পূর্ববর্তী ৫১ সদস্যের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন ৩০ জন। তাদের মধ্যে আছেন ১৬ জন মন্ত্রী ও ১৪ জন প্রতিমন্ত্রী। তবে নতুন সরকারে প্রধানমন্ত্রী তার উপদেষ্টার সংখ্যা কমাননি। পুরনো সাতজন উপদেষ্টার সাথে নিয়োগ পেয়েছেন নতুন আরো তিনজন উপদেষ্টা। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বহরের এই উপদেষ্টারা কেউই নির্বাচিত নন। সরকারপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপি চাইলে ওই মন্ত্রিসভায় ১০-১২ জন মন্ত্রীর পদ নিতে পারে। আরও বলা হচ্ছে, বিএনপি যেসব মন্ত্রণালয় চাইবে, তাই তাদের দেয়া হবে। বিএনপি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এরা শেখ হাসিনার এই সরকারে কোনোমতেই যোগ দেবে না। এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনেও অংশ নেবে না। বরং একতরফা নির্বাচন এ দেশে হতে দেবে না।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরস্পর বিপরীতমুখী এ অনড় অবস্থানের ফলে দেশ আজ এক অনিবার্য সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সরকারের ওপর এ সঙ্কট সমাধানে বিরোধী দলের সাথে সমঝোতায় পৌঁছার ব্যাপারে দেশ-বিদেশে সরকারের ওপর ক্রমেই চাপ বাড়ছে। গণফোরাম সভাপতি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেছেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের গণদাবি উপেক্ষা করে সরকার নির্বাচন নিয়ে ‘নাটক’ করছে। এরশাদের ভূমিকা প্রশ্নে তিনি বলেন, এর মধ্যে একজন নাটকীয় বিরোধী দলের ভূমিকায় রয়েছেন। তিনি বলেন, তার গণফোরাম এই সাজানো নির্বাচনে অংশ নেবে না। এক ব্যক্তির অধীনে নির্বাচনী প্রক্রিয়া চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন পুনর্গঠিত সরকার সর্বদলীয়, নির্দলীয় না অন্তর্বর্তীকালীনÑ তা আমি বুঝতে পারছি না। নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ ভূমিকা ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সুনিশ্চিত করা ছাড়া কোনো নির্বাচনই জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। মানুষ চেয়েছে নির্দলীয় সরকার, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন। এ দাবি কোনো একক দলের নয়। তিনি বলেন, এ দেশে একজনই সংবিধান বিশেষজ্ঞ (শেখ হাসিনা) আছেন। এ দেশে অন্য কেউ সংবিধান বিশেষজ্ঞ দাবি করতে পারে না। তিনি যা বলেন, সেটাই সংবিধান। আর যেটাই করেন সেটাই সংবিধান।
১৮ দলীয় জোটের বাইরে ড. কামালের গণফোরাম, বি. চৌধুরীর বিকল্পধারা, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা দল, চরমোনাই পীরের ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনসহ বাম ঘরানার ছয়টি দলসহ দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের নেতা বর্তমান নির্বাচনকালীন সরকারের প্রবল সমালোচনা করে এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। এরা বলেছেন, প্রধান বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে এরা অংশ নেবেন না। দেশের পেশাজীবী সংগঠন ও সুশীলসমাজও চায় একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদের নির্বাচন হোক। সর্বোপরি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন একটি গণদাবি। বিভিন্ন জরিপ থেকে উঠে এসেছে, দেশের ৭০-৯০ শতাংশ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে; কিন্তু সরকার একগুঁয়েমি করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে মরিয়া। যদিও সরকার বলছে, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন; কিন্তু সরকারের এ ধরনের কথায় বিরোধী দল যেমন আস্থা রাখতে পারছে না, তেমনি আস্থাহারা দেশের সাধারণ মানুষও। কারণ, এ সরকার নির্বাচনী ফলাফল নিজের পক্ষে টানার জন্য যেসব কূটকৌশল অবলম্বন করে চলেছে, তা তাদের চোখের সামনেই ঘটছে। সরকার সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অবসান ঘটিয়েছে। সংসদ বহাল রেখে, মন্ত্রী-এমপিদের ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন আয়োজনের পথ পাকাপোক্ত করেছে। বশংবদ নির্বাচন কমিশন দিয়ে জাতীয় সংসদের নির্বাচনী আসনের সীমানা যথেচ্ছ বদল করেছে। আরপিও সংশোধন করিয়ে নিয়েছে। দলীয়করণ চলেছে প্রশাসনে ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে। সরকার-বিরোধী পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর সীমাহীন দমন-পীড়ন চলছে। বিরোধী দলের রাজনৈতিক অফিসে তালা দেয়া হয়েছে। প্রধান বিরোধী দলের কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, নেতাকর্মীদের অফিসে যেতে বাধা দেয়া হয়েছে, নানা কাল্পনিক মামলা দিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের জেলে পোরা হয়েছে। রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা হচ্ছে। সর্বোপরি সর্বদলীয় সরকার নামের ফাঁদ পেতে বিরোধী দলকে সে ফাঁদে আটকিয়ে অস্তিত্বহীন করার খেলায় মেতে উঠেছে সরকার। চলছে বিরোধী দল-জোট ভাঙার অনৈতিক নানা খেলা।
এসবই দেখছে দেশের ও সেই সাথে দেশের বাইরের মানুষ। সরকারের এসব কর্মকাণ্ড ও সেই সাথে একতরফা নির্বাচন থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে সরকারের ওপর সময়ের সাথে চাপ ক্রমেই বাড়ছে। সরকার তা স্বীকার না করলেও, বিষয়টি ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। অতি সম্প্রতি লক্ষ করা গেছে, বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন থেকে সরে এসে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকারের ওপর চাপ আসছে আন্তর্জাতিক নানা মহল থেকেও। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে একটা সমঝোতায় পৌঁছানোর যাবতীয় কূটনৈতিক তৎপরতায় ব্যর্থ হয়ে এখন এরা তৈরি হচ্ছে সরকারের ওপর নানামুখী চাপ প্রয়োগের জন্য। জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছে। তাদের সাম্প্রতিক তৎপরতা থেকে মনে হচ্ছে, এসব আন্তর্জাতিক মহল থেকে অপ্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ আসতে পারে সব দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সরকারকে বাধ্য করতে। এমনও বলা হচ্ছেÑ তা করতে সরকার ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক মহল নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমরা জানি, ২০০৭ সালে বিএনপি সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের বয়কটের মুখে যখন আজকের মতোই বিরোধী দলবিহীন একটি একতরফা নির্বাচন হতে যাচ্ছিল, তখন জাতিসঙ্ঘ বলেছিল জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয়া হবে যদি বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে একতরফাভাবে একদলীয় নির্বাচন করা হয়, আর সেনাবাহিনী যদি তাতে সহায়তা দেয়। এবারো শেষপর্যন্ত সে ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে অনেকেই বলছেন।
এ দিকে বাংলাদেশ ইস্যুতে গত বৃহস্পতিবার মার্কিন কংগ্রেসে শুনানি হয়েছে। এ শুনানিতে হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়, রাজনৈতিক অবস্থা বিস্ফোরণোন্মুখ থাকলে জিএসপি সুবিধা ও জাতিসঙ্ঘে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। বলা হচ্ছে, বিরোধী দলগুলোর সাথে সমঝোতা ছাড়াই একটি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আসন্ন নির্বাচনকেন্দ্রিক আস্থাশীলতা এবং নির্বাচনোত্তর সহিংসতার আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র কেবল উদ্বিগ্ন নয়, শঙ্কিতও। মার্কিন কংগ্রেসে ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটি অন এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক’ আয়োজিত বাংলাদেশবিষয়ক এ শুনানিতে যুক্তরাষ্ট্রের এ উদ্বেগ ও শঙ্কার বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এতে বলা হয়Ñ আগামী দিনে শুধু রাজনৈতিক সহিংসতাই বাড়বে না, একই সাথে সুশীল ও রাজনৈতিক অধিকার লঙ্ঘিত হবে। এতে করে বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতারা আটক ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার পাশাপাশি মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আসতে পারে ‘উচ্চমাত্রার দমননীতি’, সাংবাদিকেরা হয়রানির শিকার হতে পারেন। শুনানিতে পররাষ্ট্রবিষয়ক সাব-কমিটির উপস্থিত সবাই বাংলাদেশে একতরফা ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। এ ধরনের নির্বাচনের ফলে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় ও কৌশলগত সম্পর্কে কী ধরনের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে কিভাবে বাংলাদেশকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে নিয়ে আসা যায়, সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের করণীয় নির্ধারণে পররাষ্ট্রবিষয়ক সাব-কমিটির সদস্যদের তাগিদ লক্ষ করা যায়।
অপর দিকে একই দিনে নিরপেক্ষ ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব পাস হয় ইউরোপীয় পার্লামেন্টেও। বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল এবং আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা আছে এমন নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব জানিয়ে এ প্রস্তাব পাস করা হয়। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক উত্তেজনার মুহূর্তে গত বৃহস্পতিবার ফ্রান্সের স্ট্রসবার্গের লুইস ওয়েসিসে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে সদস্যদের বিতর্ক থেকে এই প্রস্তাব পাস করা হয়। এতে আগামী জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও বাংলাদেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিডিআর বিদ্রোহের বিচার ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম নিয়েও আলোচনা হয়। এ প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের উচিত আগামী জাতীয় নির্বাচন পূর্ণ স্বচ্ছতার সাথে আয়োজন করা, যাতে সব দল নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে এবং সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে পারে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বলেছেন, আমেরিকা চায় বাংলাদেশের সব দলের অংশগ্রহণে একটি অর্থবহ নির্বাচন। গণতন্ত্র অুণœ রাখার স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ অবশ্যই জরুরি। নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ একটি চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে। সঙ্ঘাত সংঘর্ষ নৈরাজ্য কোনো রাজনৈতিক দলের জন্যই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবার থাকা উচিত। সম্প্রতি ঢাকা সফর করে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। তিনি তার সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করে তাদের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে মতপার্থক্য দূর করে সমঝোতায় পৌঁছার তাগিদ দেন। তিনি বলেছেন, কে নির্বাচনে জিতল সে ব্যাপারে তার সরকারের কোনো আগ্রহ নেই, তবে যুক্তরাষ্ট্র চায় সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। নিশা দেশাই বাংলাদেশ সফরে আসার আগে ১৫ নভেম্বর রয়েটারে যে প্রেস স্টেটমেন্ট প্রকাশ করেন, সেখানেও তিনি একই ধরনের তাগিদ দেন। সেখানে তিনি স্পষ্ট করে এ কথাও উল্লেখ করেন : শুধু মার্কিন কূটনীতিকেরাই নন, বিশ্বের সব দেশের কূটনীতিকেরা একই ধরনের অভিমত প্রকাশ করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন কামনা করছেন।
এ দিকে গত ২০ নভেম্বর নিউ ইয়র্ক টাইমস ‘পলিটিক্যাল ক্রাইসিস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে সুস্পষ্টভাবে বলেছেÑ ' প্রশ্ন হচ্ছেÑ কেনো বাংলাদেশ আজ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকির মুখে? নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছেÑ এর কারণ, বিরোধী মতের জনগণের ওপর সরকার দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আগামী জানুয়ারি নির্বাচনের আগে পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে যে কোনোভাবে তার প্রতিপক্ষকে থামিয়ে দিতে। এ সম্পাদকীয়তে আরো অভিযোগ করা হয়, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনালকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের একটি হাতিয়ার হিসেবে।
পত্রিকাটি এ সম্পাদকীয়তে বলেÑ বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে হয়তো দেশটি নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ধরনের চাপের মুখে পড়বে। এ কারণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, মানবাধিকার কর্মীদের হয়রানি বন্ধ করা এবং গ্রহণযোগ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে বিরোধী দলগুলোর সাথে কাজ করা শেখ হাসিনার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সম্পাদকীয়ের শুরুতে বলা হয়Ñ চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত একের পর এক ধর্মঘট বাংলাদেশকে অচল করে দিয়েছে। রাজনৈতিক পক্ষ-প্রতিপক্ষের সহিংস সঙ্ঘাতে শত শত লোক মারা গেছে। বিরোধী দলের শীর্ষ নেতা ও মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। যথাযথ প্রক্রিয়া মৌল মানকে পাশ কাটিয়ে আদালতগুলো অনেককে দোষী সাব্যস্ত করে তাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। এই সম্পাদকীয় প্রকাশের এক দিন পরেই ‘নৈরাজ্যে বাংলাদেশ : খাদের কিনারে একটি দেশ?’ শীর্ষক শুনানিতে মার্কিন কংগ্রেস বাংলাদেশ নিয়ে তাদের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ওই শুনানিতে হিউম্যান রাইট ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক বাংলাদেশকে এখনই জিএসপি সুবিধা না দেয়ার পরামর্শ দেন।
উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে বাংলাদেশ। এদের কিছু ঘোষিত, কিছু অঘোষিত। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার (জিএসপি) তুলে নেয়া হয়। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সাথে লেনদেন বন্ধ করে দেয় যুক্তরাজ্যের বার্কলেস ব্যাংক। সৌদি আরব, কুয়েত, মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়া বন্ধ করে দেয়। প্রতিশ্রুতি দিয়েও অনুদান দেয়নি, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ফিরিয়ে নেয় অনেক প্রকল্পের অর্থ। এ পরিস্থিতিতে বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সময়ে নতুন করে আরো প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিদ্যমান এ পরিস্থিতিতে গত শুক্রবার টাইমস অব ইন্ডিয়া গ্রুপের বাংলা দৈনিক এই সময় একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে বাংলাদেশ নিয়ে। ‘গণতন্ত্রের ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা’Ñ শিরোনামের এ সম্পাদকীয়তে পত্রিকাটি বলেছেÑ বাংলাদেশের প্রধান বিরোধীদলীয় জোট (১৮ দলের) যদি নির্বাচনে না থাকে, তা হলে সে নির্বাচন হবে প্রহসনের নামান্তর। বিপুলসংখ্যক ভোটারকে সরিয়ে রেখে ভোট করে যে সরকার গঠিত হবে তা জনতার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তা ছাড়া প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করে সরকার গঠন করলে আওয়ামী লীগের গায়ে স্বৈরচারী ছাপ লেগে যাবে। অপর দিকে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ভারতের শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিক সুনন্দ কে দত্ত তার নিবন্ধে লিখেছেন, আজ হোক কাল হোক বিএনপি ক্ষমতায় আসবেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন না।
আমরা লক্ষ করছিÑ আওয়ামী লীগ নেতানেত্রীরা এখন সুখস্বপ্নে ভাসছেন বিরোধী দলকে কঠোর দমন-পীড়নে রেখে একতরফা নির্বাচন করে আরেক মেয়াদের জন্য সরকারে যাবেন। আর সেখানে বিরোধী দলের নেতা হবেন জেনারেল এরশাদ। জেনারেল এরশাদের স্বপ্ন অবশ্য ভিন্নÑ বিএনপিবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী বিরোধী সব ভোট যাবে এরশাদের বাক্সে। আর তখন সরকার গঠন করবে জাতীয় পার্টি। আর বিরোধী দলে থাকবে আওয়ামী লীগ। আর আগামী ৫ বছরে বিএনপি হারাবে অস্তিত্ব; কিন্তু এরই মধ্যে দেশে-বিদেশে এই একতরফা নির্বাচনের পথ থেকে সরে আসার জন্য শেখ হাসিনার ওপর দেশের ভেতরে ও বাইরে যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, সে চাপ মোকাবেলা করা এ সরকারের পক্ষে কতটুকু সম্ভব হবেÑ তা বলা মুশকিল। ইংরেজি ডেইলি স্টার প্রতিনিধিকে বেশ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, তারা একতরফা এ নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষকই পাঠাবেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কূটনীতিক এ প্রতিনিধিকে স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন
দেশবাসীর প্রত্যাশা, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের দাবির প্রতি সরকার শ্রদ্ধাশীল হয়ে অবিলম্বে একতরফা নির্বাচনের পথ থেকে সরে এসে বিরোধী দলের সাথে সমঝোতা করে একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনে মনোযোগ দেবে। সেই সাথে দেশকে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ থেকে বাঁচাবে এবং দেশকে আন্তর্জাতিক মহল থেকে বিচ্ছিন্ন করার পথ পরিহার করবে। সর্বোপরি যাবতীয় একগুঁয়েমি পরিহার করে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ভবিষ্যৎ সব পদক্ষেপে এগিয়ে আসবে।
এমনই যখন অবস্থা, আমরা দেখছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার জোটের মাত্র চারটি দলের নেতাদের নিয়ে ২৯ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সমন্বয়ে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। এতে জাতীয় পার্টির ছয়জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন। এই মন্ত্রিসভাকে নানা নামে ডাকা হচ্ছে সরকারপক্ষ থেকেÑ বহুদলীয় সরকার, নির্বাচনকালীন সরকার বা সর্বদলীয় সরকার। তবে নানা আলোচনা-সমালোচনার মুখে সরকারপক্ষ এখন এ সরকারকে নির্বাচনকালীন সরকার বলে আখ্যায়িত করছে। পূর্ববর্তী ৫১ সদস্যের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন ৩০ জন। তাদের মধ্যে আছেন ১৬ জন মন্ত্রী ও ১৪ জন প্রতিমন্ত্রী। তবে নতুন সরকারে প্রধানমন্ত্রী তার উপদেষ্টার সংখ্যা কমাননি। পুরনো সাতজন উপদেষ্টার সাথে নিয়োগ পেয়েছেন নতুন আরো তিনজন উপদেষ্টা। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বহরের এই উপদেষ্টারা কেউই নির্বাচিত নন। সরকারপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপি চাইলে ওই মন্ত্রিসভায় ১০-১২ জন মন্ত্রীর পদ নিতে পারে। আরও বলা হচ্ছে, বিএনপি যেসব মন্ত্রণালয় চাইবে, তাই তাদের দেয়া হবে। বিএনপি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এরা শেখ হাসিনার এই সরকারে কোনোমতেই যোগ দেবে না। এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনেও অংশ নেবে না। বরং একতরফা নির্বাচন এ দেশে হতে দেবে না।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরস্পর বিপরীতমুখী এ অনড় অবস্থানের ফলে দেশ আজ এক অনিবার্য সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সরকারের ওপর এ সঙ্কট সমাধানে বিরোধী দলের সাথে সমঝোতায় পৌঁছার ব্যাপারে দেশ-বিদেশে সরকারের ওপর ক্রমেই চাপ বাড়ছে। গণফোরাম সভাপতি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেছেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের গণদাবি উপেক্ষা করে সরকার নির্বাচন নিয়ে ‘নাটক’ করছে। এরশাদের ভূমিকা প্রশ্নে তিনি বলেন, এর মধ্যে একজন নাটকীয় বিরোধী দলের ভূমিকায় রয়েছেন। তিনি বলেন, তার গণফোরাম এই সাজানো নির্বাচনে অংশ নেবে না। এক ব্যক্তির অধীনে নির্বাচনী প্রক্রিয়া চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন পুনর্গঠিত সরকার সর্বদলীয়, নির্দলীয় না অন্তর্বর্তীকালীনÑ তা আমি বুঝতে পারছি না। নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ ভূমিকা ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সুনিশ্চিত করা ছাড়া কোনো নির্বাচনই জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। মানুষ চেয়েছে নির্দলীয় সরকার, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন। এ দাবি কোনো একক দলের নয়। তিনি বলেন, এ দেশে একজনই সংবিধান বিশেষজ্ঞ (শেখ হাসিনা) আছেন। এ দেশে অন্য কেউ সংবিধান বিশেষজ্ঞ দাবি করতে পারে না। তিনি যা বলেন, সেটাই সংবিধান। আর যেটাই করেন সেটাই সংবিধান।
১৮ দলীয় জোটের বাইরে ড. কামালের গণফোরাম, বি. চৌধুরীর বিকল্পধারা, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা দল, চরমোনাই পীরের ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনসহ বাম ঘরানার ছয়টি দলসহ দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের নেতা বর্তমান নির্বাচনকালীন সরকারের প্রবল সমালোচনা করে এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। এরা বলেছেন, প্রধান বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে এরা অংশ নেবেন না। দেশের পেশাজীবী সংগঠন ও সুশীলসমাজও চায় একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদের নির্বাচন হোক। সর্বোপরি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন একটি গণদাবি। বিভিন্ন জরিপ থেকে উঠে এসেছে, দেশের ৭০-৯০ শতাংশ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে; কিন্তু সরকার একগুঁয়েমি করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে মরিয়া। যদিও সরকার বলছে, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন; কিন্তু সরকারের এ ধরনের কথায় বিরোধী দল যেমন আস্থা রাখতে পারছে না, তেমনি আস্থাহারা দেশের সাধারণ মানুষও। কারণ, এ সরকার নির্বাচনী ফলাফল নিজের পক্ষে টানার জন্য যেসব কূটকৌশল অবলম্বন করে চলেছে, তা তাদের চোখের সামনেই ঘটছে। সরকার সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অবসান ঘটিয়েছে। সংসদ বহাল রেখে, মন্ত্রী-এমপিদের ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন আয়োজনের পথ পাকাপোক্ত করেছে। বশংবদ নির্বাচন কমিশন দিয়ে জাতীয় সংসদের নির্বাচনী আসনের সীমানা যথেচ্ছ বদল করেছে। আরপিও সংশোধন করিয়ে নিয়েছে। দলীয়করণ চলেছে প্রশাসনে ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে। সরকার-বিরোধী পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর সীমাহীন দমন-পীড়ন চলছে। বিরোধী দলের রাজনৈতিক অফিসে তালা দেয়া হয়েছে। প্রধান বিরোধী দলের কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, নেতাকর্মীদের অফিসে যেতে বাধা দেয়া হয়েছে, নানা কাল্পনিক মামলা দিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের জেলে পোরা হয়েছে। রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা হচ্ছে। সর্বোপরি সর্বদলীয় সরকার নামের ফাঁদ পেতে বিরোধী দলকে সে ফাঁদে আটকিয়ে অস্তিত্বহীন করার খেলায় মেতে উঠেছে সরকার। চলছে বিরোধী দল-জোট ভাঙার অনৈতিক নানা খেলা।
এসবই দেখছে দেশের ও সেই সাথে দেশের বাইরের মানুষ। সরকারের এসব কর্মকাণ্ড ও সেই সাথে একতরফা নির্বাচন থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে সরকারের ওপর সময়ের সাথে চাপ ক্রমেই বাড়ছে। সরকার তা স্বীকার না করলেও, বিষয়টি ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। অতি সম্প্রতি লক্ষ করা গেছে, বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন থেকে সরে এসে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকারের ওপর চাপ আসছে আন্তর্জাতিক নানা মহল থেকেও। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে একটা সমঝোতায় পৌঁছানোর যাবতীয় কূটনৈতিক তৎপরতায় ব্যর্থ হয়ে এখন এরা তৈরি হচ্ছে সরকারের ওপর নানামুখী চাপ প্রয়োগের জন্য। জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছে। তাদের সাম্প্রতিক তৎপরতা থেকে মনে হচ্ছে, এসব আন্তর্জাতিক মহল থেকে অপ্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ আসতে পারে সব দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সরকারকে বাধ্য করতে। এমনও বলা হচ্ছেÑ তা করতে সরকার ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক মহল নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমরা জানি, ২০০৭ সালে বিএনপি সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের বয়কটের মুখে যখন আজকের মতোই বিরোধী দলবিহীন একটি একতরফা নির্বাচন হতে যাচ্ছিল, তখন জাতিসঙ্ঘ বলেছিল জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয়া হবে যদি বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে একতরফাভাবে একদলীয় নির্বাচন করা হয়, আর সেনাবাহিনী যদি তাতে সহায়তা দেয়। এবারো শেষপর্যন্ত সে ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে অনেকেই বলছেন।
এ দিকে বাংলাদেশ ইস্যুতে গত বৃহস্পতিবার মার্কিন কংগ্রেসে শুনানি হয়েছে। এ শুনানিতে হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়, রাজনৈতিক অবস্থা বিস্ফোরণোন্মুখ থাকলে জিএসপি সুবিধা ও জাতিসঙ্ঘে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। বলা হচ্ছে, বিরোধী দলগুলোর সাথে সমঝোতা ছাড়াই একটি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আসন্ন নির্বাচনকেন্দ্রিক আস্থাশীলতা এবং নির্বাচনোত্তর সহিংসতার আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র কেবল উদ্বিগ্ন নয়, শঙ্কিতও। মার্কিন কংগ্রেসে ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটি অন এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক’ আয়োজিত বাংলাদেশবিষয়ক এ শুনানিতে যুক্তরাষ্ট্রের এ উদ্বেগ ও শঙ্কার বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এতে বলা হয়Ñ আগামী দিনে শুধু রাজনৈতিক সহিংসতাই বাড়বে না, একই সাথে সুশীল ও রাজনৈতিক অধিকার লঙ্ঘিত হবে। এতে করে বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতারা আটক ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার পাশাপাশি মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আসতে পারে ‘উচ্চমাত্রার দমননীতি’, সাংবাদিকেরা হয়রানির শিকার হতে পারেন। শুনানিতে পররাষ্ট্রবিষয়ক সাব-কমিটির উপস্থিত সবাই বাংলাদেশে একতরফা ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। এ ধরনের নির্বাচনের ফলে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় ও কৌশলগত সম্পর্কে কী ধরনের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে কিভাবে বাংলাদেশকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে নিয়ে আসা যায়, সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের করণীয় নির্ধারণে পররাষ্ট্রবিষয়ক সাব-কমিটির সদস্যদের তাগিদ লক্ষ করা যায়।
অপর দিকে একই দিনে নিরপেক্ষ ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব পাস হয় ইউরোপীয় পার্লামেন্টেও। বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল এবং আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা আছে এমন নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব জানিয়ে এ প্রস্তাব পাস করা হয়। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক উত্তেজনার মুহূর্তে গত বৃহস্পতিবার ফ্রান্সের স্ট্রসবার্গের লুইস ওয়েসিসে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে সদস্যদের বিতর্ক থেকে এই প্রস্তাব পাস করা হয়। এতে আগামী জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও বাংলাদেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিডিআর বিদ্রোহের বিচার ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম নিয়েও আলোচনা হয়। এ প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের উচিত আগামী জাতীয় নির্বাচন পূর্ণ স্বচ্ছতার সাথে আয়োজন করা, যাতে সব দল নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে এবং সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে পারে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বলেছেন, আমেরিকা চায় বাংলাদেশের সব দলের অংশগ্রহণে একটি অর্থবহ নির্বাচন। গণতন্ত্র অুণœ রাখার স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ অবশ্যই জরুরি। নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ একটি চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে। সঙ্ঘাত সংঘর্ষ নৈরাজ্য কোনো রাজনৈতিক দলের জন্যই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবার থাকা উচিত। সম্প্রতি ঢাকা সফর করে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। তিনি তার সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করে তাদের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে মতপার্থক্য দূর করে সমঝোতায় পৌঁছার তাগিদ দেন। তিনি বলেছেন, কে নির্বাচনে জিতল সে ব্যাপারে তার সরকারের কোনো আগ্রহ নেই, তবে যুক্তরাষ্ট্র চায় সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। নিশা দেশাই বাংলাদেশ সফরে আসার আগে ১৫ নভেম্বর রয়েটারে যে প্রেস স্টেটমেন্ট প্রকাশ করেন, সেখানেও তিনি একই ধরনের তাগিদ দেন। সেখানে তিনি স্পষ্ট করে এ কথাও উল্লেখ করেন : শুধু মার্কিন কূটনীতিকেরাই নন, বিশ্বের সব দেশের কূটনীতিকেরা একই ধরনের অভিমত প্রকাশ করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন কামনা করছেন।
এ দিকে গত ২০ নভেম্বর নিউ ইয়র্ক টাইমস ‘পলিটিক্যাল ক্রাইসিস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে সুস্পষ্টভাবে বলেছেÑ ' প্রশ্ন হচ্ছেÑ কেনো বাংলাদেশ আজ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকির মুখে? নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছেÑ এর কারণ, বিরোধী মতের জনগণের ওপর সরকার দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আগামী জানুয়ারি নির্বাচনের আগে পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে যে কোনোভাবে তার প্রতিপক্ষকে থামিয়ে দিতে। এ সম্পাদকীয়তে আরো অভিযোগ করা হয়, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনালকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের একটি হাতিয়ার হিসেবে।
পত্রিকাটি এ সম্পাদকীয়তে বলেÑ বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে হয়তো দেশটি নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ধরনের চাপের মুখে পড়বে। এ কারণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, মানবাধিকার কর্মীদের হয়রানি বন্ধ করা এবং গ্রহণযোগ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে বিরোধী দলগুলোর সাথে কাজ করা শেখ হাসিনার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সম্পাদকীয়ের শুরুতে বলা হয়Ñ চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত একের পর এক ধর্মঘট বাংলাদেশকে অচল করে দিয়েছে। রাজনৈতিক পক্ষ-প্রতিপক্ষের সহিংস সঙ্ঘাতে শত শত লোক মারা গেছে। বিরোধী দলের শীর্ষ নেতা ও মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। যথাযথ প্রক্রিয়া মৌল মানকে পাশ কাটিয়ে আদালতগুলো অনেককে দোষী সাব্যস্ত করে তাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। এই সম্পাদকীয় প্রকাশের এক দিন পরেই ‘নৈরাজ্যে বাংলাদেশ : খাদের কিনারে একটি দেশ?’ শীর্ষক শুনানিতে মার্কিন কংগ্রেস বাংলাদেশ নিয়ে তাদের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ওই শুনানিতে হিউম্যান রাইট ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক বাংলাদেশকে এখনই জিএসপি সুবিধা না দেয়ার পরামর্শ দেন।
উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে বাংলাদেশ। এদের কিছু ঘোষিত, কিছু অঘোষিত। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার (জিএসপি) তুলে নেয়া হয়। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সাথে লেনদেন বন্ধ করে দেয় যুক্তরাজ্যের বার্কলেস ব্যাংক। সৌদি আরব, কুয়েত, মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়া বন্ধ করে দেয়। প্রতিশ্রুতি দিয়েও অনুদান দেয়নি, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ফিরিয়ে নেয় অনেক প্রকল্পের অর্থ। এ পরিস্থিতিতে বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সময়ে নতুন করে আরো প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিদ্যমান এ পরিস্থিতিতে গত শুক্রবার টাইমস অব ইন্ডিয়া গ্রুপের বাংলা দৈনিক এই সময় একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে বাংলাদেশ নিয়ে। ‘গণতন্ত্রের ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা’Ñ শিরোনামের এ সম্পাদকীয়তে পত্রিকাটি বলেছেÑ বাংলাদেশের প্রধান বিরোধীদলীয় জোট (১৮ দলের) যদি নির্বাচনে না থাকে, তা হলে সে নির্বাচন হবে প্রহসনের নামান্তর। বিপুলসংখ্যক ভোটারকে সরিয়ে রেখে ভোট করে যে সরকার গঠিত হবে তা জনতার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তা ছাড়া প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করে সরকার গঠন করলে আওয়ামী লীগের গায়ে স্বৈরচারী ছাপ লেগে যাবে। অপর দিকে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ভারতের শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিক সুনন্দ কে দত্ত তার নিবন্ধে লিখেছেন, আজ হোক কাল হোক বিএনপি ক্ষমতায় আসবেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন না।
আমরা লক্ষ করছিÑ আওয়ামী লীগ নেতানেত্রীরা এখন সুখস্বপ্নে ভাসছেন বিরোধী দলকে কঠোর দমন-পীড়নে রেখে একতরফা নির্বাচন করে আরেক মেয়াদের জন্য সরকারে যাবেন। আর সেখানে বিরোধী দলের নেতা হবেন জেনারেল এরশাদ। জেনারেল এরশাদের স্বপ্ন অবশ্য ভিন্নÑ বিএনপিবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী বিরোধী সব ভোট যাবে এরশাদের বাক্সে। আর তখন সরকার গঠন করবে জাতীয় পার্টি। আর বিরোধী দলে থাকবে আওয়ামী লীগ। আর আগামী ৫ বছরে বিএনপি হারাবে অস্তিত্ব; কিন্তু এরই মধ্যে দেশে-বিদেশে এই একতরফা নির্বাচনের পথ থেকে সরে আসার জন্য শেখ হাসিনার ওপর দেশের ভেতরে ও বাইরে যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, সে চাপ মোকাবেলা করা এ সরকারের পক্ষে কতটুকু সম্ভব হবেÑ তা বলা মুশকিল। ইংরেজি ডেইলি স্টার প্রতিনিধিকে বেশ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, তারা একতরফা এ নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষকই পাঠাবেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কূটনীতিক এ প্রতিনিধিকে স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন
দেশবাসীর প্রত্যাশা, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের দাবির প্রতি সরকার শ্রদ্ধাশীল হয়ে অবিলম্বে একতরফা নির্বাচনের পথ থেকে সরে এসে বিরোধী দলের সাথে সমঝোতা করে একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনে মনোযোগ দেবে। সেই সাথে দেশকে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ থেকে বাঁচাবে এবং দেশকে আন্তর্জাতিক মহল থেকে বিচ্ছিন্ন করার পথ পরিহার করবে। সর্বোপরি যাবতীয় একগুঁয়েমি পরিহার করে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ভবিষ্যৎ সব পদক্ষেপে এগিয়ে আসবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন