মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৩

বর্তমান গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও জনগণের প্রত্যাশা


বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষের সমর্থিত নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, অর্থাৎ আওয়ামী লীগের ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচনের বিপরীতে একটি গ্রহণযোগ্য সব দল ও জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি আদায়ের আন্দোলনের দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়েছে বিএনপির ওপর। এই আন্দোলনই বাংলাদেশের চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলন; কিন্তু চলমান আন্দোলনের কৌশল নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা নিয়ে পর্যবেক্ষক, সমালোচক, এমনকি জনগণের মধ্যেও বিশ্বাসের অভাব দেখা দিয়েছে যে, বিএনপি কি আসলেই একটি বৃহত্তর আন্দোলন ও দাবি আদায়ে সক্ষম? আর তার প্রধান কারণ হচ্ছে অনেক দায়িত্বশীল নেতার দায়িত্বহীন ভূমিকা। বিগত হরতাল ও অন্যান্য কর্মসূচিতে পুলিশের লাঠি, গুলি ও রক্তচুর বিপরীতে তাদের কাপুরুষোচিত পলায়ন। এ কথা সত্য স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জ্যঘন্যতমভাবে গুলি করে আন্দোলনরত নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে এ আন্দোলনকে দমন করে দিতে চায় আওয়ামী লীগ ও তার পুলিশ; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এর সমাধান কী ? সমাধান একটাই, তা হচ্ছেÑ ব্যাপক অংশগ্রহণ; আর এটিই হচ্ছে রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব কিভাবে এই আন্দোলনের সমর্থক বেশির ভাগ মানুষকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা যায়; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, যারা মানুষকে সম্পৃক্ত করবেন তারা নিজেরাই যদি অসম্পৃক্ত হন তাহলে মানুষ সম্পৃক্ত হবে কিভাবে। সুতরাং, তার জন্য প্রয়োজন সাবার আগে দল ও জোটের প্রত্যেক নেতাকর্মীরা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণভিত্তিক সম্পৃক্ততা।
বিএনপি চেয়ারপারসন ও জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভূমিকা প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু জাতীয় নির্বাহী কমিটি, ঢাকা মহানগর বিএনপি, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিক দল, মহিলা দল ও অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের ভূমিকা নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটি প্রায় ৩৯০ সদস্যবিশিষ্ট। সংখ্যার দিক থেকে দেখলে একটি বিশাল মিছিলের মতো মনে হয়; কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ দেখলে সংখ্যা অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে হয়। একই নেতা কেন্দ্রীয়, জেলা ও থানা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে কোথাও আন্দোলনে অংশ না নিয়ে চুপচাপ ঘরে বসে আছেন। এদের অনেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের বলেন জেলা, থানায় আছি আর থানা ও জেলার নেতাকর্মীদের বলেন, ‘বুঝিস না কেন্দ্রে দায়িত্বপালন করতে হয়।’ এদের চিহ্নিত ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিএনপির বিগত জাতীয় কাউন্সিলে একটি নিয়ম করার কথা ছিলÑ এক ব্যক্তি এক পদ বাস্তবায়ন হলে এসব সুযোগসন্ধানীদের হাত থেকে দল রক্ষা পেত।
জাতীয়তাবদী ছাত্রদলের হাজার হাজার নেতাকর্মী যারা এখনো আন্দোলনের প্রাণ হতে পারেন, কিন্তু বিএনপি ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কৌশলগত ভুলের কারণে যত ভূমিকাই থাকুক ছাত্রদলের ভূমিকা দৃশ্যমান ও প্রশংসনীয় হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তার প্রধান কারণÑ ছাত্র আন্দোলনের প্রাণক্ষেত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের নির্মম ওয়াকওভার দেয়া। যার ফলে তাদের কোনো আন্দোলনই মানুষের কাছে আন্দোলন বলে মনে হচ্ছে না। আর বিএনপির সবচেয়ে বড় ভুল হচ্ছে তাদের ধারণা সব আন্দোলন ছাত্রদল করে দেবে আর ওনারা শুধু স্যুট-বুট পরে মন্ত্রিত্বের শপথ গ্রহণ করবেন। তাই যেসব দায়িত্ব ছাত্রদলের নয় সেসব দায়িত্বও ছাত্রদলকে পালন করতে হয়। ফলে ছাত্র আন্দোলন বলতে ছাত্রদলের মধ্যে আর কিছুই নেই।
যুবদল বিএনপির সেই অঙ্গসংগঠন, যা হাতির মতো। হাতির যেমন বিশাল শরীর তেমন তার শক্তি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো তার চোখ ছোট। হাতি সম্পর্কে একটি কথার কথা আছে, তা হচ্ছে হাতির চোখ ছোট, শরীর বড়; তাই সে তার শরীর দেখতে পায় না। যদি হাতি তার শরীর দেখতে পেত তাহলে হাতি পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীকে তার শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে পায়ের তলায় পিষ্ট করে মারত। হাতির যেমন দুর্ভাগ্য সে তার শরীর দেখতে পায় না আর যুবদলের দুর্ভাগ্য যে, সে তার সংগঠনের শক্তি, ব্যাপ্তি আর পরিধি দেখতে পায় না। যুবদলের উচিত তার চোখ ও মনকে বড় করা। মনের কথাটি এ জন্য বললাম যে, গত চার বছরে তাদের অনেক কাজ ছোট মনের পরিচয় বহন করেছে।
বিএনপির আরেক গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল। যদিও একটি সুপ্ত সংগঠনকে জীবন্ত করেছেন বর্তমান নেতৃত্ব। তাদের সততা ও দতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু তাদের ব্যক্তিগত ইমেজ ও পরিশ্রম সংগঠনকে যে পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারত তা পারেনি। তাদের সাংগঠনিক সিদ্ধান্তহীনতার কারণে বিশাল বড় কেন্দ্রীয় কমিটিÑ যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কোনো দিন কোনো কর্মসূচিতেই আসেননি, আন্দোলন তো দূরের কথা। এখনো অনেক প্রতিশ্রুতিশীল নেতাকর্মী আছেন যাদের কোনো সাংগঠনিক পদবি ও দায়িত্ব কোনোটাই নেই। জেলায় জেলায় সাংগঠনিক সিদ্ধান্তহীনতায় সংগঠন বিকাশ লাভ করেনি।
আন্দোলন-সংগ্রামে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিক থাকার কথা ছিল জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের। কিন্তু শ্রমিক দল বলতে বিএনপির কিছুই নেই। একজাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য শ্রমিক দলকে ধবংসের দ্বারপ্রান্তে পৌছে দিয়েছেন। কোনো শ্রমিক আন্দোলন তো নয়ই, মে দিবস আর কোনো কোনো জাতীয় দিবস ছাড়া শ্রমিক দলের কোনো কর্মসূচি মানুষের চোখে পড়েনি বিগত পাঁচ বছরে। বাংলাদেশের সর্র্ববৃহৎ শ্রমিক সেক্টর গার্র্মেন্টশ্রমিকদের মধ্যে তাদের কোনো সংগঠনই নেই। কী আশ্চর্য আর ভায়াবহ ব্যাপার! যেই আন্দেলনের কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ আলোচিত সেখানে তাদের কোনো ভূমিকাই নেই, সংগঠনও নেই।
জাতীয়তাবাদী মহিলা দল তার প্রত্যাশিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেনি। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের প্রধান ভূমিকা ছিল আওয়ামী মহিলা লীগ ও আওয়ামী যুবমহিলা লীগের। বর্তমান সময়ে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের ভূমিকা ও বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী মহিলা ও যুবমহিলা লীগের ভূমিকা তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে বিএনপি ও মহিলা দলের নেত্রীদের চোখের ছানি দূর হবে এবং পরিষ্কার দেখতে পারবেন।
সারা দেশের নেতাকর্মীদের একটাই প্রশ্নÑ ঢাকা মহানগরীতে আন্দেলন হচ্ছে না কেন? যৌক্তিক কারণেই সেই প্রশ্ন ঢাকা মহানগর বিএনপির সফলতা ও ব্যর্থতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। পুরো সময় কেটেছে কিন্তু তাদের সাঠিক ভূমিকা কখন দেখা যাবে এই অপেক্ষা নিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আজো তা দেখা হয়নি। ঢাকা মহানগর বিএনপি, ৪০টি থানা কমিটি, প্রতিটি ওয়ার্ড কমিটি কার কী ভূমিকা কেউ জানেন না, কেউ প্রশ্নও করেননি। মহানগর বিএনপির কাছে কী জাদুর কাঠি আছে তা দেখার অপেক্ষায় আছে সবাই। কাউকে ছোট করার জন্য নয়, বরং নেতাদের সঠিক ভূমিকায় দেখার জন্যই কথাগুলো বলছি। এখন প্রশ্নÑ এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে সফর হওয়ার উপায় কী?
উপায় একটাইÑ সবার অংশগ্রহণ, কমিটিভুক্ত প্রতিটি নেতাকর্মীকে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে হবে। চেয়ারপারসন ও জাতীয় স্থায়ী কমিটি গুরুত্বপর্ণ সিদ্ধান্ত ও নেতাকর্মীদের ভূমিকা মূল্যায়ন করবে। জাতীয় নির্বাহী কমিটি, ঢাকা মহাগনর বিএনপি, সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও মহানগরের নেতারা আন্দোলনে বাধ্যতামূলক অংশ নেবেন। যদি না করেন জাতীয় স্থায়ী কমিটি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যারা আন্দোলনে অংশনেবে না তাদের পদ থেকে অব্যাহতি দেবেন। কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতাদের, অধীনস্থ ইউনিট, থানার কমিটিভুক্ত নেতাদের ভূমিকা মূল্যায়ন করবেন ও ব্যর্থতার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। যেকোনো ব্যবস্থাপনার মধ্যে সফলতা ও ব্যর্থতার জন্য পুরস্কার ও শাস্তিই হচ্ছে একমাত্র উপায়, তা সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য। এই সাধারণ মূল্যায়নটি বিএনপি করতে পারছে না বলেই আন্দোলন সফল হচ্ছে না আর সাধারণ সমর্থক ও জনগণ ইচ্ছা থাকলেও নেতৃত্বের অভাবে এই আন্দোলনে অংশ নিতে পারছেন না।
যদি বিএনপির নেতাকর্মীরা সবাই অংশগ্রহণ করেন তাহলে জনগণও অংশনেবে একটি কার্যকর গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং মানুষ একটি গণতান্ত্রিক সরকার পাবে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণ সম্ভব হবে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads