রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৩

পুলিশী সন্ত্রাসে বিপন্ন নাগরিকতা

ফরহাদ মজহার 
 পুলিশী নির্যাতন, পুলিশী হেফাজতে মৃত্যু, নাগরিকদের গুম করে ফেলা ইত্যাদি ঘৃণ্য ও জঘন্য মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে নাগরিক ও মানবাধিকার কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে লড়ছেন। এই ধরনের মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনের শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে। দেশে বিদেশে বাংলাদেশ সরকারকে এর জন্য জবাবদিহিও করতে হচ্ছে। কিন্তু অন্যান্য নাগরিক ও মানবিক অধিকারের তুলনায় আইনশৃংখলা বাহিনীর ‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ’ কিভাবে প্রকট মানবাধিকারের সংকট তৈরী করে সে সম্পর্কে আমরা বিশেষ সচেতন নই। নাগরিকদের মিছিলে কিংবা তাদের ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভ সরকারকে জানাবার কোন সমাবেশে আইনশৃংখলা বাহিনীর ‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ’ অত্যন্ত বিপজ্জনক মানবাধিকার লংঘন। সাধারণত একেই আমরা আমাদের দৈনন্দিন ভাষায় পুলিশী সন্ত্রাস বলে থাকি। তার নানান রূপ ও মাত্রাভেদ আছে।
‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ’ আইনী ধারণা। মানবাধিকার কর্মীরা এই ধারণা ব্যবহার করে পুলিশী সন্ত্রাস বা আইনশৃংখলা বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি থেকে নাগরিকদের রক্ষার চেষ্টা করেন। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের সমাজে সচেতনতা খুবই কম। একদিকে মতপ্রকাশ, সমাবেশ ও বিক্ষোভ প্রকাশ যে কোন নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার; অন্যদিকে, যারা মিছিল বা বিক্ষোভ করছেন তারা যেন অন্য নাগরিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা বিঘিœত করতে না পারেন তার দেখভালের দায়ও রাষ্ট্র স্বীকার করে। দুইয়ের ভারসাম্য রক্ষা করেই আইনশৃংখলা বাহিনীকে সংবিধান ও আইনের বাধ্যবাধকতার মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। আইনশৃংখলা বাহিনী এই ভারসাম্য রক্ষার কর্তব্য না মেনে কোন মিছিল, সমাবেশ বা বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে বিনা কারণে চড়াও হচ্ছে কিনা কিংবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ঘটেছে কিনা-- তা আইন ও মানবাধিকারের মানদ- দিয়ে বিচার করবার জন্যই এই গুরুত্বপূর্ণ ধারণাটি ব্যবহার করা হয়। অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটলে আইনশৃংখলা বাহিনী জাতীয় বা আন্তর্জাতিক আইনে অভিযুক্ত হতে পারে। বাংলাদেশের আইনশৃংখলা বাহিনী জাতিসংঘের শান্তি মিশনে নিয়মিত অংশগ্রহণ করছেন। এই ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে মিশনে অংশ নেবার ক্ষেত্রেও আপত্তি উঠতে পারে। বিষয়টি আইনশৃংখলা বাহিনীর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ও বিব্রতকর। কোন সদস্য দেশের সংবিধান বা আইন কিংবা এই ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করলে তার দায় পুরা বাহিনীর ভাবমূর্তি বিনষ্টের কারণ হতে পারে। গুটিকয়েকের দায় এসে পড়তে পারে সকলের ওপর।
অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের সুনির্দিষ্ট উদাহরণ এখানে পেশ করা সূচনা মন্তব্যে আমার উদ্দেশ্য নয়। নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটির দিক থেকে আমরা চাইছি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে বাংলাদেশে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ঘটনাগুলোর আশু তদন্ত হোক। তদন্তের প্রয়োজনীয়তা আইন ও মানবাধিকারের দিক সকল পক্ষকে মনে করিয়ে দেয়াই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য।
সাধারণত দেখা যায় দুটো কারণে শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে আইনশৃংখলা বাহিনীর বাড়াবাড়ি ঘটে। এক, এ বিষয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ঘাটতির কারণে ‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ’ সংক্রান্ত ধারণার অনুপস্থিতি, বিশেষত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের সঙ্গে এর সরাসরি সম্পর্ক সম্বন্ধে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের জ্ঞান ও উপলব্ধির অভাব। দ্বিতীয়ত, আইন না মেনে এবং মানবাধিকারের তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ণ দলীয় স্বার্থে আইনশৃংখলা বাহিনীকে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যবহার।
নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটি আয়োজিত ‘পুলিশী সন্ত্রাস ও বিপন্ন নাগরিকতা’ শীর্ষক নাগরিক সংলাপের (২ অগ্রহায়ণ ১৪২০/১৬ নবেম্বর ২০১৩) সূচনা মন্তব্য। আপনার চিন্তা জানাতে ই-মেইল করুন: farhadmazhar@hotmail.com
তবে রাজনৈতিক দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় রাজনৈতিক বিরোধ রাজনৈতিকভাবে নিরসনের ব্যর্থতা আইনশৃংখলার প্রকট সমস্যা হিসেবে হাজির হয়। যেমন, ক্ষমতাসীনদের আইন ও মানবাধিকার বিরোধী ভূমিকার কারণে যদি বিরোধী রাজনীতিকে তাদের মত প্রকাশ ও সভা সমাবেশ মিছিল বিক্ষোভ করবার অধিকার থেকে ক্রমাগত বঞ্চিত করা হয়, ক্রমাগত তাদের ওপর দমন নিপীড়ন ও নির্যাতন চলে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে তা সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের শর্ত এভাবেই তৈরী হয়। ক্ষমতাসীনদের তৈরী রাজনৈতিক সংকট আইনশৃংখলার সমস্যা হিসেবে মোকাবিলা করতে গিয়ে আইনশৃংখলা বাহিনী অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটায়। পুলিশী সন্ত্রাসের সঙ্গে রাজনৈতিক সংস্কৃতির সম্পর্ক নিবিড়। রাজনীতি ও আইনের দূরত্বও খুবই ক্ষীণ। রাজনৈতিক সমস্যা যখন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যে বড় বড় দলগুলো মীমাংসা করতে ব্যর্থ হয়, তখন দুই পক্ষই আইনের সীমা লংঘন করতে থাকে। একটি দেশের জন্য তখন সেটা চরম বিপদ হয়ে দেখা দেয়।
পুলিশী সন্ত্রাসে কিভাবে নাগরিকতা বিপন্ন হচ্ছে নাগরিক সংলাপে আমরা সে বিষয়ে আজ সকলে কথা বলব। নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটির দিক থেকে আমার দায়িত্ব হচ্ছে আলোচকদের আলোচনার সূত্র ধরিয়ে দেয়া। এটা আমার বা নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে কোন পরিপূর্ণ নিবন্ধ পেশ বা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হাজির করা নয়। আপনাদের নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ বিষয়ে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা। তবে একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে দেশে বিদেশের যে কোন নাগরিক ও মানবাধিকার কর্মীর মতোই কিছু সর্বসম্মত ধারণা আমরাও ধারণ করি।
বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটছে। আজকের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ সম্পর্কে একটি গণতদন্ত কমিশন গঠন করা যায় কিনা সে বিষয়ে আপনাদের পরামর্শ শুনতে আমরা আগ্রহী। কিভাবে সেটা গঠিত হতে পারে এবং তার কার্যবিধি কেমন হবে সে বিষয়েও আমরা আপনাদের সুচিন্তিত মতামত জানতে চাই।
দুই
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতা নতুন কিছু নয়। দেশে বিদেশের মানবাধিকার কর্মীরা এ ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরেই তাদের উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে আসছেন। যেটা নতুন সেটা হচ্ছে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার প্রতি নাগরিক হিসাবে আমাদের সংবেদনশীলতার চরিত্র ও মাত্রার পরিবর্তন। সংবেদনশীলতার একটা পর্ব বাংলাদেশ পেরিয়ে এসেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে এই পরিবর্তনটা বোঝা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। একটা সময় ছিল রাষ্ট্রীয় সহিংসতা নাগরিকরা মেনে নিতেন না। মিছিল বা বিক্ষোভে পুলিশ বাধা দিলে বা কোন কারণে মিছিল উত্তেজিত হয়ে গেলে আইনশৃংখলা বাহিনীর ওপর ইট পাটকেল ছোঁড়া কিংবা বড় জোর লাঠিসোঁটা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি নতুন কিছু নয়। আইনশৃংখলা বাহিনীও লাঠি মেরে এবং প্রয়োজনে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে মিছিল বা বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করে দিত। তারপরও তার জন্য সরকারেরই নিন্দা হতো। সহিংসতা যদি গুলীর পর্যায়ে গড়াত তাহলে সরকার খুবই নিন্দিত হতো। শুধু তাই নয় সরকারের দিক থেকে আইনী বাধ্যবাধকতা পূরণের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতিতে ‘ফায়ার ওপেন” করতে হত। এর পরেও গুলী চালানোতে কেউ আহত বা নিহত হলে একটা তদন্ত কমিশন করে ঘটনায় অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের দিকসহ গুলী ছোঁড়া এড়ানো যেত কিনা ও কি পরিস্থিতিতে গুলী ছোঁড়া হয়েছিল তা খতিয়ে দেখা হতো। বিভিন্ন সময়ে গুলী ছোঁড়াকে কেন্দ্র করে সরকারের পতনও ঘটেছে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রদের গুলী করে হত্যার পরিণত গড়িয়েছে স্বাধীনতার সংগ্রামে ও মুক্তিযুদ্ধে। আজ আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি আপনাদের তা ভেবে দেখতে বলি।
মিছিলকারী বা ক্ষুব্ধ জনতা সব সময় নির্দোষ থাকে সে দাবি কেউ করে না। বিক্ষোভ বা মিছিল অধিকাংশ সময়ই ইট পাথর ছোঁড়া ও লাঠি প্রদর্শনে পরিণতি লাভ করলেও একে “শান্তিপূর্ণ’ মিছিল বলেই গণ্য করা হয়। শান্তিপূর্ণ মিছিল বা বিক্ষোভের সীমা সম্পর্কে নাগরিকদের সকলের উপলব্ধি এক রকম বা সকলেই একইভাবে আইনের সীমা মেনে চলতেন তাও নয়। ফলে সবসময় মিছিল বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ ছিল দাবি করা কঠিন। কিন্তু সাধারণভাবে দায় বর্তাতো আইনশৃংখলা বাহিনীর ওপর। অর্থাৎ রাষ্ট্রের ওপর। উত্তপ্ত মিছিল বা বিক্ষোভের উত্তর হিসেবে এখনকার মতো আইনশৃক্সংখলা বাহিনীর নির্বিচার গুলী ছোঁড়া ও নাগরিকদের হত্যার ঘটনা রাষ্ট্র পরিচালনায় ও রাজনীতিতে সম্পূর্ণ নতুন উপাদান।
এক সময় আইনশৃংখলা বাহিনীর বাড়াবাড়ি সরকারের পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু এখন আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলছে। সরকারের নীতি নির্ধারকরা এতে বিচলিত নন, নাগরিকদের শংকা গণমাধ্যমে প্রতিফলিত হচ্ছে না। তদুপরি একতরফাভাবে বিক্ষুব্ধ নাগরিকদেরই দায়ী করা হচ্ছে। অর্থাৎ বলা হচ্ছে যারা বিক্ষোভ ও হরতালের কর্মসূচি দিচ্ছে পুরা দায় তাদের।
যারা বর্তমান সরকারের নানান অন্যায়ের কারণে বিক্ষুব্ধ, তাদের অবশ্যই প্রতিবাদ বিক্ষোভ জানাবার অধিকার আছে। কিন্তু সেই অধিকারও সরকার কেড়ে নিয়েছে। সমাবেশ তো দূরের কথা, ঘরে বসে সভা করার সময়ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চড়াও হচ্ছে। গ্রেফতার করছে। যেখানে এই অবস্থা সেখানে আবার রাস্তায় বেরুলেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গুলী চালাচ্ছে। অথচ কখন কোন অবস্থায় কি কারণে পুলিশ মানুষ হত্যা করছে তার তদন্ত না করে ঢালাওভাবে মিছিল ও বিক্ষোভে যারা অংশগ্রহণ করছে তাদের বিরুদ্ধে প্রচার প্রপাগা-া চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারকে দায়মুক্ত রাখবার এই সংস্কৃতি নাগরিক ও মানবিক অধিকার লঙ্ঘনের দিক থেকে ভয়াবহ। পুলিশী সন্ত্রাসে নাগরিকতা যেভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছে সে সম্পর্কে দেশে বিদেশে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের এই সংলাপের আয়োজন।
এই অবস্থা নিয়ে সারা পৃথিবীর মানবাধিকার কর্মীরা বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিচার হত্যাকা-ের নিন্দা জানাচ্ছেন নানাভাবে। উদাহরণ হিসাবে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিউমেন রাইটস ওয়াচের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের উল্লেখ করতে পারি। যার শিরোনাম হচ্ছে, Blood on the streets: The use of Excessive force during Bangladesh protects। বাংলাদেশে প্রতিবেদনটির গুরুত্ব বিচার করে একটি বাংলা সারমর্মও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রকাশ করেছে। শিরোনাম : রাজপথে রক্তপাত: বাংলাদেশে বিক্ষোভকালে ব্যাপক বলপ্রয়োগ’ প্রতিবেদনটির ভেতরে না গিয়ে যদি শুধু শিরোনামেই আমাদের নজর নিবন্ধ রাখি তাহলেও পরিস্থিতির ভয়াবহতা আমরা বুঝতে পারব। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এই নিরন্তর সহিংসতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে কোন প্রতিবাদ হয়নি বললেই চলে। বাংলাদেশে সহিংসতা, বোমাবাজি ও জ্বালাও পোড়াও-এর জন্য বিরোধী পক্ষকে একতরফা দায়ী করা হচ্ছে, কিন্তু এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সরকারের দায় ও দায়িত্ব সম্পর্কে কোন কথাই বলা হচ্ছে না। যারা একতরফা বিরোধী দলকে দায়ী করছেন, কিন্তু হরতাল, বিক্ষোভ বা সমাবেশ মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের কথা কিছুই বলছেন না তারা ‘রাজপথে রক্তপাত’ বন্ধ না করার পরিবর্তে নিরন্তর রক্তপাতকে প্রশ্রয় দেবার অভিযোগেই অভিযুক্ত হবেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এটা বিচিত্র ব্যাপার যে, অন্যান্য সকল ক্ষেত্রের মতো বাংলাদেশে মানবিক ও নাগরিক অধিকারের বিষয়টিকেও দলীয় জায়গা থেকেই দেখা হয়। ধরে নেয়া হয় যে, যারা নিহত ও আহত হচ্ছে তারা বিরোধী দলের আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত, অতএব তাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার সম্পর্কে অবস্থান নেয়ার অর্থ হচ্ছে বিরোধী দলের পক্ষে অবস্থান নেয়া। অথচ যারা মৃত্যুবরণ করছেন, আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন তারা তো এদেশেরই নাগরিক। দলীয় পক্ষপাতমুক্ত স্বাধীন গণমাধ্যম এই ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের ভূমিকা কিংবা দায় নৈর্ব্যক্তিক জায়গা থেকে তুলে ধরতে পারত। কিন্তু বিরোধী দলের কর্মসূচিকে ব্যর্থ করে দেবার জন্য ক্রমাগত তাদের কর্মসূচির বিরুদ্ধে প্রপাগা-ার কারণে আসলে সারাদেশে কি ঘটছে সে সম্বন্ধে নিরপেক্ষভাবে তথ্য জানাও কঠিন হয়ে পড়েছে। বিরোধী দল অভিযোগ করেছে, কয়েকটি মৃত্যু ও পুড়ে যাবার কারণ হিসাবে হরতালকারীদের সহিংসতাকে যারা দায়ী করছেন তারা আসলে মিথ্যা বলছেন। কারা ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে তার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া দরকার।
নাগরিক ও মানবিক অধিকার কর্মীদের জন্য এই ধরনের পরিস্থিতি খুবই নাজুক। হরতাল কিংবা সহিংসতার জন্য কোন নাগরিকের মৃত্যু কিংবা আহত হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক এবং খুবই উদ্বেগের বিষয়। প্রতিটি প্রাণই মূল্যবান। নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটিও দায় নির্বিশেষে এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত। কিন্তু একই সঙ্গে উদ্বিগ্নতা ও উৎকণ্ঠার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র পুলিশী সন্ত্রাস বা অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের বিষয়টিকে আইন ও মানবাধিকারের বিবেচনা থেকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য করে রাখাকে আমরা ভীষণ বিপজ্জনক মনে করি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবশ্যই নাগরিক ও মানবিক অধিকারকে সম্মান করতে হবে। ক্ষমতাসীনদের দলীয় ক্যাডার হিসাবে ভূমিকা পালন করলে তাদের অবশ্যই একদিন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। যারা এই ধরনের কুকা-ে অভিযুক্ত এবং জড়িত বলে প্রমাণিত হবেন তারা জাতিসংঘের শান্তিবাহিনীতে যোগদান দূরের কথা, বরং আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখিও হতে পারেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংবিধান ও আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সরকার বিরোধীদের নির্বিচার দমনপীড়ন সাধারণভাবে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা হিসাবে পরিচিত। এই সন্ত্রাস ও সহিংসতা রাষ্ট্রের নামে করা হলেও মূলত করে ক্ষমতাসীন সরকার। অতএব, নির্বিচারে গুলী করে নাগরিকদের হত্যার ষোল আনা দায় সরকারের। এই দায় থেকে মুক্তির একমাত্র পথ প্রতিটি হত্যার নিরপেক্ষ তদন্ত। অতিরিক্ত বল প্রয়োগই এই নির্বিচার হত্যার কারণ কিনা তা নির্ধারণ। অথচ নাগরিকদের হত্যা ও আহত করবার ঘটনা অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের কারণে হয়েছে কিনা তা বিচার করবার কোনো আইনী বা মানবাধিকারের মানদ- সরকার মানছে না। কোথাও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ হয়েছে কিনা তা আইনী ও মানবাধিকারের দৃষ্টিতে বিচারের কোন মানদ- সরকারের আদৌ আছে বলেও আমাদের জানা নেই। এই ধরনের মানদ-ের
অভাবে অমানবিক দমন-পীড়ন, আহত করা ও হত্যাকা-ের মতো চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে যেতেই থাকবে। পুলিশ বাহিনী, র‌্যাব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সরকারের এই দায় এড়ানোর কোন উপায় নাই।
সরকার কিভাবে নিজের নাগরিকদের গুলী করে হত্যা করতে পারে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কিভাবে এই দায় থেকে মুক্ত থাকে সেই সকল গোড়ার প্রশ্নে প্রবেশ করলে স্বভাবতই বিদ্যমান রাষ্ট্রের চরিত্রের পর্যালোচনা করার দরকার হয়ে পড়ে। কিন্তু আমরা মূলত পুলিশী সন্ত্রাসে নাগরিকতা বিপন্ন হয় সেই আলোচনাতেই আপাতত সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছি। যৌক্তিক কারণেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয় হিসেবে রাষ্ট্রের বিকার নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্র এতে প্রশস্ত হবে।
পুলিশ কিভাবে মানুষ হত্যা করেছে সে সম্পর্কেও তথ্য আমরা এখন এখানে পেশ করছি না। বরং আপনাদের অভিজ্ঞতা শোনাই আমাদের ইচ্ছা। মানবাধিকার সংস্থাগুলো তাদের সাধ্যমতো তা করছে। কিন্তু সরকার তাদের ওপরও জেল, জুলুম, নিপীড়ন চালাচ্ছে। আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এখনও কারাগারে। ফলে ভিন্নমতের বক্তব্য শুনতে পাচ্ছি না। ‘অধিকার’-এর সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক নাসিরুদ্দিন এলানের জন্য আমরা উদ্বিগ্ন। সারাদেশে মানবাধিকার কর্মীরা কাজ করতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মানবাধিকার কর্মীদের কাজ করতে না দিলে এই ধরনের ঘটনার নিরপেক্ষ তথ্য পাবার সুযোগও আমরা হারাচ্ছি। আমরা মনে করি অবিলম্বে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের গুলী ও দমন-পীড়নের নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য আমাদের জোরালো দাবি তোলা দরকার। কোথায় পুলিশ সঠিক ভূমিকা পালন করেছে এবং কোথায় কারা কিভাবে ও কখন নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে তার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত।
হিউমেন রাইটস ওয়াচ বলছে “পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন  র‌্যাব (জঅই) এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (ইএই) মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে বিক্ষোভকারী ও আশপাশে থাকা সাধারণ ব্যক্তিদের হত্যা করে বিক্ষোভের মোকাবিলা করে। সুরক্ষা বাহিনীগুলো অযথাযথভাবে বা কোন কারণ ছাড়াই রাবার বুলেট ও গুলী ব্যবহার করেছে, বিক্ষোভের গ-গোলের মধ্যে কিছু বিক্ষোভকারীকে মেরে ফেলেছে এবং অনেককে ঠা-া মাথায় হত্যা করেছে। মৃতদের অনেককে মাথায় ও বুকে গুলী করা হয়েছে, যা থেকে পরিলক্ষিত হচ্ছে যে সুরক্ষা বাহিনীগুলো ভিড়ের মধ্যে গুলী চালিয়েছে। বাকিদেরকে পিটিয়ে বা কুপিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। সুরক্ষা বাহিনীর হাতে অন্তত সাতজন শিশু মারা গিয়েছে... এটি এড়ানোর জন্য, সম্মিলিত হওয়া ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারের নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করার কথা ভাবা উচিত। কর্তৃপক্ষের শক্তি ও আগ্নেয়াস্ত্রের বেআইনী ব্যবহার থেকে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারী ও আশপাশে থাকা সাধারণ জনগণকে সুরক্ষিত রাখতে হবে”। আমরা নিজেরা কিছু পেশ না করে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন আপনাদের পড়তে অনুরোধ করবো।
হিউমেন রাইটস ওয়াচের এই ছোট উদ্ধৃতি থেকেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা আমরা বুঝতে পারবো। এ থেকে নিষ্কৃতির উপায় সম্পর্কে আপনারা পরামর্শ দেবেন আশা করি। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই ক্ষেত্রে সাধারণত যে সুপারিশ করে থাকে আমাদের সে সম্পর্কে অবহিত থাকা দরকার। যেমন তারা বলেন, আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের দ্বারা বলপ্রয়োগ ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার সংক্রান্ত ইউনাইটেড নেশন্স বেসিক প্রিন্সিপলস (United Nations Basic Principles) অনুসরণ করতে বাধ্য করতে হবে। জাতিসংঘের এই নীতি মেনে চলার জন্য সরকারের প্রকাশ্যে নির্দেশ দেবার দাবি জানানো তারা জরুরি মনে করেন। জাতিসংঘের বেসিক প্রিন্সিপালসে বলা হয়েছে যে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো “বলপ্রয়োগ ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের আগে অহিংস উপায়গুলো প্রয়োগ করবে” এবং “যেখানে বলপ্রয়োগ ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের আইনসম্মত ব্যবহার এড়ানো সম্ভব নয়, সেখানে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা  (ক) এই ধরনের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংযত থাকবেন এবং অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী এবং আইনসম্মত লক্ষ্য অনুসারে কাজ করবেন (খ) ক্ষয়ক্ষতি ও আঘাত সর্বনি¤œ রাখবেন এবং মানুষের জীবনকে সম্মান করবেন ও সংরক্ষিত রাখবেন।”
আমরা নিশ্চিত যে নাগরিক সংলাপ খুবই ফলপ্রসূ হবে এবং আমরা কিছু সর্বসম্মত দাবি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবো। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads