আমাদের দুই জাতীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থান নিজ নিজ দলে সুসংহত। দলের বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও তাদের ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে, তবে তা সময়ের ব্যবধানে ওঠানামা করায় কখনো একজনের অনুকূলে আবার কখনো বা একজনের প্রতিকূলে যায়। তাদের দু’জনের প্রথমোক্ত জন দু’বার এবং শেষোক্ত জন তিনবার সরকারের শীর্ষ নির্বাহী প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হওয়ার বিরল সম্মানে গৌরবান্বিত। নিছক গৃহবধূ থেকে উভয়ের রাজনীতিতে আগমন আকস্মিক। তাদের একজন উত্তরাধিকার সূত্রে এবং অপরজন বৈবাহিক সূত্রে মহান। আর তাই মহত্ত্ব তাদের উভয়ের ক্ষেত্রে অভিষিক্ত, পুরোটাই স্বোপার্জিত নয়।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেকোনো জাতীয় দুর্যোগে জাতীয় নেতৃত্বে সমাসীন ব্যক্তিবর্গকে জাতীয় স্বার্থে অভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করতে দেখা যায়। আমাদের দুই নেত্রীর ক্ষেত্রে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় এ ধরনের অভিন্ন অবস্থান একবার পরিলক্ষিত হয়েছে। অন্য সময় তাদের একজনকে অপরজনের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন দেখা গেছে। তাদের উভয়ের বৈরিতা কত তীব্র ও প্রকট তা দেশবাসী উভয়ের টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ও পত্রিকায় প্রকাশিত ফোনালাপ থেকে জানতে পেরেছে। দুই নেত্রীর ফোনালাপের ব্যাপ্তি ছিল ৩৭ মিনিট। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কম সময় এবং বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বেশি সময় কথা বলেন। ফোনালাপের একপর্যায়ে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে বলতে শোনা গেছেÑ ‘আমার এখানে ক্যামেরা-ট্যামেরা কেউ নেই। বুঝছেন। আমি নিজেই কথা বলছি। আমি বাসায় বসে কথা বলছি। অফিসে হলে আমার জন্য সুবিধা হতো, ক্যামেরা-ট্যামেরা থাকত।’ বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার ফোনালাপের উপরি উক্ত উক্তিগুলো থেকে অনুমান করা যায় ফোনালাপের গোপনীয়তা রক্ষায় তিনি সচেষ্ট ছিলেন।
এখন জাতির সামনে প্রশ্নÑ উভয়ের মধ্যে যে ফোনালাপ হয়েছে তা গোপনীয়তার অধিকার দ্বারা রক্ষিত কি না? আর রক্ষিত হয়ে থাকলে ফাঁস করার পেছনে কারা? তাদের উদ্দেশ্য কী? এর দ্বারা সংবিধান ও দেশের আইনের লঙ্ঘন হয়েছে কি না? আর লঙ্ঘন হয়ে থাকলে শাস্তি কী হতে পারে?
অতীতে সরাসরি যোগাযোগের অনুপস্থিতিতে একজন অপরজনের সাথে চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ করতেন। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে বর্তমানে এ যোগাযোগ চিঠিপত্র ছাড়াও টেলিফোন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে হয়ে থাকে। উপরি উক্ত সব মাধ্যমের যোগাযোগের গোপনীয়তার অধিকার আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণভাবে স্বীকৃত।
জাতিসঙ্ঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ ১৯৪৮ সমগ্র বিশ্বের মানুষের অধিকার সমুন্নত রাখার এক অনন্য দলিল। এ দলিলটির ১২ নম্বর অনুচ্ছেদ গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারসংক্রান্ত। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ কোনো ব্যক্তির গোপনীয়তা, পরিবার, গৃহ এবং যোগাযোগের ওপর স্বেচ্ছামূলক হস্তক্ষেপ করা যাবে না। অথবা তার সম্মান ও খ্যাতির ওপর আঘাত করা যাবে না। এ ধরনের হস্তক্ষেপ ও আঘাতের বিরুদ্ধে প্রত্যেকের প্রতিকার চাওয়ার অধিকার থাকবে।
জাতিসঙ্ঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে বিবৃত এ অধিকারটি আমাদের সংবিধানের ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদে অন্যতম একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদ গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণসংক্রান্ত। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধসাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের (ক) প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক হতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকবে এবং (খ) চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে।
উপরি উক্ত মৌলিক অধিকারসহ সংবিধানে বর্ণিত অপর কোনো মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন ঘটলে তা বলবৎ করার জন্য সংবিধানের ৪৪ নম্বর অনুচ্ছেদে একই সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে মামলা রুজু করার অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।
সংবিধানের বিধিবিধানের অবজ্ঞা বা উপেক্ষায় যেকোনো ধরনের কাজ সংবিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করার শামিল। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭ক(১) (খ) সন্নিবেশনের মাধ্যমে বলা হয়Ñ কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায়Ñ এ সংবিধান বা এর কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে কিংবা উহা করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে তার এ কাজ রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে এবং ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হবে। তা ছাড়া এর উসকানিদাতা ও সহযোগীও একই অপরাধে অপরাধী হবেন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আইনগত বৈধতা ও নিরাপত্তা প্রদান এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়নকল্পে ২০০৬ খ্রি: তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ধারা নম্বর ৬৩-তে গোপনীয়তা প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও এর দণ্ডের বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে। ওই ধারায় বলা হয়েছেÑ এ আইন বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে ভিন্নরূপ কোনো কিছু না থাকলে, কোনো ব্যক্তি যদি এ আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি বা প্রবিধানের কোনো বিধানের অধীন কোনো ইলেকট্রনিক রেকর্ড, বই, রেজিস্টার, পত্র যোগাযোগ, তথ্য, দলিল বা অন্য কোনো বিষয়বস্তুতে প্রবেশাধিকারপ্রাপ্ত হয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সম্মতি ব্যতিরেকে, কোনো ইলেকট্রনিক রেকর্ড, বই, রেজিস্টার, পত্র যোগাযোগ, তথ্য, দলিল বা অন্য কোনো বিষয়বস্তু অন্য কোনো ব্যক্তির নিকট প্রকাশ করেন তাহলে তার এ কার্য হবে একটি অপরাধ, যার জন্য তিনি অনধিক দুই বছর কারাদণ্ডে বা ২ (দুই) লাখ টাকার অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে ইলেকট্রনিক রেকর্ডের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছেÑ ইলেকট্রনিক রেকর্ড অর্থ কোনো উপাত্ত, রেকর্ড বা উপাত্ত থেকে প্রস্তুতকৃত ছবি বা প্রতিচ্ছবি বা শব্দ, যা কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাস, মাইক্রোফিল্ম বা কম্পিউটারে প্রস্তুতকৃত মাইক্রোচিপে সংরক্ষিত, গৃহীত বা প্রেরিত হয়েছে।
জাতীয় দুই নেত্রীর ফোনালাপ যে সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইনের বিধিবিধান অনুযায়ী গোপনীয়তার অধিকার দ্বারা সুরক্ষিতÑ এ বিষয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। তাই জনসম্মুখে প্রকাশের ক্ষেত্রে তাদের দু’জনের যেকোনো একজনের আপত্তি বাধা হিসেবে দাঁড়ায়। সে বাস্তবতায় প্রকাশ করার বিষয়টি যে উদ্দেশ্যমূলক তা তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ যথাযথ বিবেচিত হয়।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ফোনালাপ প্রকাশ নীতিবহির্ভূত, শিষ্টাচারবিবর্জিত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মর্মে বিবৃতি দিয়েছেন। অপর দিকে সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘এটা কোনো ব্যক্তিগত ফোনালাপ নয়, রাষ্ট্রীয় সংলাপ। রাষ্ট্রীয় এ সংলাপ জনগণের সম্পত্তি এবং জনগণের তা জানার অধিকার আছে।’ আইনাঙ্গনের সাথে জড়িত অনেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সংশ্লেষে স্কাইপ কেলেঙ্কারিকে ফোনালাপ প্রকাশের সম-অপরাধ হিসেবে দেখছেন। স্কাইপ কেলেঙ্কারি আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশের অপরাধে দীর্ঘ দিন ধরে পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান কারারুদ্ধ এবং পত্রিকাটির প্রকাশও বন্ধ। তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য সঠিক ধরে নিলে সে ক্ষেত্রে স্কাইপ কেলেঙ্কারির ব্যাপারে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট হওয়া উচিত। এ বিষয়ে এখনো তদন্ত হয়নি এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ব্যবস্থা নিয়ে জাতিকে আশ্বস্ত করা না হলেও পত্রিকার সম্পাদক কারান্তরীণ। স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দেয়Ñ সংবিধানের ২৭ ও ৩১ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী মাহমুদুর রহমানের অবস্থান কি ফোনালাপ ফাঁসে জড়িতদের সাথে ভিন্ন না অভিন্ন? ভিন্ন হয়ে থাকলে তাদের রেহাই দেয়ার সুযোগ আছে। আর অভিন্ন হয়ে থাকলে কোন অধিকারে মাহমুদুর রহমানকে আটক রাখা হয়েছে?
আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেসব উপদেষ্টা ও মন্ত্রী দ্বারা পরিবেষ্টিত তাদের কিছু হয়তো ধারণা ফোনালাপ প্রকাশ তাদের নেত্রীর অবস্থান সুসংহত করা ছাড়াও জনমত ও ভোটের ফলাফলে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই প্রতীয়মান হয় এ বিষয়ে সংবিধান ও সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিবিধানের ব্যত্যয় হওয়ার বিষয়টি তা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ও পত্রিকায় প্রকাশিত ফোনালাপ অবলোকনে দেখা যায়, এতে উভয় নেত্রী নিজ নিজ অবস্থানে দৃঢ় ছিলেন। তারা উভয়ে উঁচু সম্মানের আসনে আসীন। এ ধরনের ফোনালাপ প্রকাশ উভয়ের মধ্যে কাকে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত করবে সে বিষয়টি গৌণ হলেও মুখ্য হলো এর মাধ্যমে কিছুটা হলেও উভয়ের সম্মানহানি ঘটেছে। আর দু’জনের একজন যখন ফোনালাপ জনসম্মুখে প্রকাশের ব্যাপারে অনীহ, তখন একপক্ষ থেকে প্রকাশের উদ্যোগ আইনের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে কি না তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
ফোনালাপে দুই নেত্রীর মধ্যে কার ভূমিকা আক্রমণাত্মক এবং কে নমনীয় ছিলেন, কে কার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছেন, কার যুক্তি অকাট্য ও শাণিত, কে উক্তিমাফিক প্রতিউত্তরে প্রারঙ্গম, কে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করেছেন, কে প্রত্যুৎপন্নমতিতার পরিচয় দিয়েছেন, উভয়ের অবস্থান বিবেচনায় কে কতটুকু শালীন ছিলেন, উভয়ের আলাপে নৈতিকতা ও নীতিবোধ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে, দেশের সমস্যা সমাধানে কে কতটুকু আন্তরিক, কে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন প্রভৃতির বিচারে কার অবস্থান সমুন্নত তার প্রতিফলন হয়তো আগামীতে জনমতে ঘটবে। কিন্তু তা কি সংবিধান বা আইনের লঙ্ঘন হয়ে থাকলে ফোনালাপ ফাঁসের সাথে জড়িতদের অব্যাহতির অবকাশ দেয়? আর অবকাশ না দিয়ে থাকলে ফাঁসের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে বিচারে সোপর্দ করার মধ্যে নিহিত আছে সংবিধান ও প্রচলিত আইনের সাথে সাংঘর্ষিক এ ধরনের কাজের পুনরাবৃত্তি রোধের উপায়।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেকোনো জাতীয় দুর্যোগে জাতীয় নেতৃত্বে সমাসীন ব্যক্তিবর্গকে জাতীয় স্বার্থে অভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করতে দেখা যায়। আমাদের দুই নেত্রীর ক্ষেত্রে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় এ ধরনের অভিন্ন অবস্থান একবার পরিলক্ষিত হয়েছে। অন্য সময় তাদের একজনকে অপরজনের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন দেখা গেছে। তাদের উভয়ের বৈরিতা কত তীব্র ও প্রকট তা দেশবাসী উভয়ের টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ও পত্রিকায় প্রকাশিত ফোনালাপ থেকে জানতে পেরেছে। দুই নেত্রীর ফোনালাপের ব্যাপ্তি ছিল ৩৭ মিনিট। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কম সময় এবং বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বেশি সময় কথা বলেন। ফোনালাপের একপর্যায়ে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে বলতে শোনা গেছেÑ ‘আমার এখানে ক্যামেরা-ট্যামেরা কেউ নেই। বুঝছেন। আমি নিজেই কথা বলছি। আমি বাসায় বসে কথা বলছি। অফিসে হলে আমার জন্য সুবিধা হতো, ক্যামেরা-ট্যামেরা থাকত।’ বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার ফোনালাপের উপরি উক্ত উক্তিগুলো থেকে অনুমান করা যায় ফোনালাপের গোপনীয়তা রক্ষায় তিনি সচেষ্ট ছিলেন।
এখন জাতির সামনে প্রশ্নÑ উভয়ের মধ্যে যে ফোনালাপ হয়েছে তা গোপনীয়তার অধিকার দ্বারা রক্ষিত কি না? আর রক্ষিত হয়ে থাকলে ফাঁস করার পেছনে কারা? তাদের উদ্দেশ্য কী? এর দ্বারা সংবিধান ও দেশের আইনের লঙ্ঘন হয়েছে কি না? আর লঙ্ঘন হয়ে থাকলে শাস্তি কী হতে পারে?
অতীতে সরাসরি যোগাযোগের অনুপস্থিতিতে একজন অপরজনের সাথে চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ করতেন। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে বর্তমানে এ যোগাযোগ চিঠিপত্র ছাড়াও টেলিফোন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে হয়ে থাকে। উপরি উক্ত সব মাধ্যমের যোগাযোগের গোপনীয়তার অধিকার আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণভাবে স্বীকৃত।
জাতিসঙ্ঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ ১৯৪৮ সমগ্র বিশ্বের মানুষের অধিকার সমুন্নত রাখার এক অনন্য দলিল। এ দলিলটির ১২ নম্বর অনুচ্ছেদ গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারসংক্রান্ত। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ কোনো ব্যক্তির গোপনীয়তা, পরিবার, গৃহ এবং যোগাযোগের ওপর স্বেচ্ছামূলক হস্তক্ষেপ করা যাবে না। অথবা তার সম্মান ও খ্যাতির ওপর আঘাত করা যাবে না। এ ধরনের হস্তক্ষেপ ও আঘাতের বিরুদ্ধে প্রত্যেকের প্রতিকার চাওয়ার অধিকার থাকবে।
জাতিসঙ্ঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে বিবৃত এ অধিকারটি আমাদের সংবিধানের ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদে অন্যতম একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদ গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণসংক্রান্ত। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধসাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের (ক) প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক হতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকবে এবং (খ) চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে।
উপরি উক্ত মৌলিক অধিকারসহ সংবিধানে বর্ণিত অপর কোনো মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন ঘটলে তা বলবৎ করার জন্য সংবিধানের ৪৪ নম্বর অনুচ্ছেদে একই সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে মামলা রুজু করার অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।
সংবিধানের বিধিবিধানের অবজ্ঞা বা উপেক্ষায় যেকোনো ধরনের কাজ সংবিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করার শামিল। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭ক(১) (খ) সন্নিবেশনের মাধ্যমে বলা হয়Ñ কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায়Ñ এ সংবিধান বা এর কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে কিংবা উহা করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে তার এ কাজ রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে এবং ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হবে। তা ছাড়া এর উসকানিদাতা ও সহযোগীও একই অপরাধে অপরাধী হবেন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আইনগত বৈধতা ও নিরাপত্তা প্রদান এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়নকল্পে ২০০৬ খ্রি: তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ধারা নম্বর ৬৩-তে গোপনীয়তা প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও এর দণ্ডের বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে। ওই ধারায় বলা হয়েছেÑ এ আইন বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে ভিন্নরূপ কোনো কিছু না থাকলে, কোনো ব্যক্তি যদি এ আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি বা প্রবিধানের কোনো বিধানের অধীন কোনো ইলেকট্রনিক রেকর্ড, বই, রেজিস্টার, পত্র যোগাযোগ, তথ্য, দলিল বা অন্য কোনো বিষয়বস্তুতে প্রবেশাধিকারপ্রাপ্ত হয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সম্মতি ব্যতিরেকে, কোনো ইলেকট্রনিক রেকর্ড, বই, রেজিস্টার, পত্র যোগাযোগ, তথ্য, দলিল বা অন্য কোনো বিষয়বস্তু অন্য কোনো ব্যক্তির নিকট প্রকাশ করেন তাহলে তার এ কার্য হবে একটি অপরাধ, যার জন্য তিনি অনধিক দুই বছর কারাদণ্ডে বা ২ (দুই) লাখ টাকার অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে ইলেকট্রনিক রেকর্ডের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছেÑ ইলেকট্রনিক রেকর্ড অর্থ কোনো উপাত্ত, রেকর্ড বা উপাত্ত থেকে প্রস্তুতকৃত ছবি বা প্রতিচ্ছবি বা শব্দ, যা কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাস, মাইক্রোফিল্ম বা কম্পিউটারে প্রস্তুতকৃত মাইক্রোচিপে সংরক্ষিত, গৃহীত বা প্রেরিত হয়েছে।
জাতীয় দুই নেত্রীর ফোনালাপ যে সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইনের বিধিবিধান অনুযায়ী গোপনীয়তার অধিকার দ্বারা সুরক্ষিতÑ এ বিষয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। তাই জনসম্মুখে প্রকাশের ক্ষেত্রে তাদের দু’জনের যেকোনো একজনের আপত্তি বাধা হিসেবে দাঁড়ায়। সে বাস্তবতায় প্রকাশ করার বিষয়টি যে উদ্দেশ্যমূলক তা তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ যথাযথ বিবেচিত হয়।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ফোনালাপ প্রকাশ নীতিবহির্ভূত, শিষ্টাচারবিবর্জিত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মর্মে বিবৃতি দিয়েছেন। অপর দিকে সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘এটা কোনো ব্যক্তিগত ফোনালাপ নয়, রাষ্ট্রীয় সংলাপ। রাষ্ট্রীয় এ সংলাপ জনগণের সম্পত্তি এবং জনগণের তা জানার অধিকার আছে।’ আইনাঙ্গনের সাথে জড়িত অনেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সংশ্লেষে স্কাইপ কেলেঙ্কারিকে ফোনালাপ প্রকাশের সম-অপরাধ হিসেবে দেখছেন। স্কাইপ কেলেঙ্কারি আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশের অপরাধে দীর্ঘ দিন ধরে পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান কারারুদ্ধ এবং পত্রিকাটির প্রকাশও বন্ধ। তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য সঠিক ধরে নিলে সে ক্ষেত্রে স্কাইপ কেলেঙ্কারির ব্যাপারে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট হওয়া উচিত। এ বিষয়ে এখনো তদন্ত হয়নি এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ব্যবস্থা নিয়ে জাতিকে আশ্বস্ত করা না হলেও পত্রিকার সম্পাদক কারান্তরীণ। স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দেয়Ñ সংবিধানের ২৭ ও ৩১ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী মাহমুদুর রহমানের অবস্থান কি ফোনালাপ ফাঁসে জড়িতদের সাথে ভিন্ন না অভিন্ন? ভিন্ন হয়ে থাকলে তাদের রেহাই দেয়ার সুযোগ আছে। আর অভিন্ন হয়ে থাকলে কোন অধিকারে মাহমুদুর রহমানকে আটক রাখা হয়েছে?
আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেসব উপদেষ্টা ও মন্ত্রী দ্বারা পরিবেষ্টিত তাদের কিছু হয়তো ধারণা ফোনালাপ প্রকাশ তাদের নেত্রীর অবস্থান সুসংহত করা ছাড়াও জনমত ও ভোটের ফলাফলে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই প্রতীয়মান হয় এ বিষয়ে সংবিধান ও সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিবিধানের ব্যত্যয় হওয়ার বিষয়টি তা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ও পত্রিকায় প্রকাশিত ফোনালাপ অবলোকনে দেখা যায়, এতে উভয় নেত্রী নিজ নিজ অবস্থানে দৃঢ় ছিলেন। তারা উভয়ে উঁচু সম্মানের আসনে আসীন। এ ধরনের ফোনালাপ প্রকাশ উভয়ের মধ্যে কাকে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত করবে সে বিষয়টি গৌণ হলেও মুখ্য হলো এর মাধ্যমে কিছুটা হলেও উভয়ের সম্মানহানি ঘটেছে। আর দু’জনের একজন যখন ফোনালাপ জনসম্মুখে প্রকাশের ব্যাপারে অনীহ, তখন একপক্ষ থেকে প্রকাশের উদ্যোগ আইনের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে কি না তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
ফোনালাপে দুই নেত্রীর মধ্যে কার ভূমিকা আক্রমণাত্মক এবং কে নমনীয় ছিলেন, কে কার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছেন, কার যুক্তি অকাট্য ও শাণিত, কে উক্তিমাফিক প্রতিউত্তরে প্রারঙ্গম, কে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করেছেন, কে প্রত্যুৎপন্নমতিতার পরিচয় দিয়েছেন, উভয়ের অবস্থান বিবেচনায় কে কতটুকু শালীন ছিলেন, উভয়ের আলাপে নৈতিকতা ও নীতিবোধ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে, দেশের সমস্যা সমাধানে কে কতটুকু আন্তরিক, কে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন প্রভৃতির বিচারে কার অবস্থান সমুন্নত তার প্রতিফলন হয়তো আগামীতে জনমতে ঘটবে। কিন্তু তা কি সংবিধান বা আইনের লঙ্ঘন হয়ে থাকলে ফোনালাপ ফাঁসের সাথে জড়িতদের অব্যাহতির অবকাশ দেয়? আর অবকাশ না দিয়ে থাকলে ফাঁসের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে বিচারে সোপর্দ করার মধ্যে নিহিত আছে সংবিধান ও প্রচলিত আইনের সাথে সাংঘর্ষিক এ ধরনের কাজের পুনরাবৃত্তি রোধের উপায়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন