সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৩

সংলাপের বাঁশি স্তব্ধ হতে চলেছে


সাদেক খান
শেষ পর্যন্ত পঞ্চদশ সংশোধনী অবলম্বনে নবম সংসদ থেকে ‘সর্বদলীয় নির্বাচনকালীন সরকার’ গঠনের নামে ১৮ নভেম্বর মতাসীন মহাজোটেরই রূপান্তরিত মন্ত্রিসভা বহাল করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংসদীয় বিরোধী বেঞ্চের কোনো দলীয় সদস্য দূরে থাক (বিএনপি, জামায়াত, এলডিপি বা বিজেপি), একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্যেরও জায়গা হয়নি এই তথাকথিত সর্বদলীয় নয়া বাকশালী সরকারে। ১৮ দলীয় জোট নেতৃত্ব তাদের ‘নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপে সরকার’ গঠনের দাবিতে অনড় থেকে রাষ্ট্রপতির সাথে সাাৎ করেছেন। এ জন্য সরকারকে সংলাপে সম্মত করার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানিয়েছেন। এই দাবিতে সংলাপপ্রচেষ্টার পাশাপাশি বিরতি দিয়ে দেশব্যাপী বিােভ, সমাবেশ, হরতাল ও অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছেন প্রায় বছরের শুরু থেকেই। অক্টোবরের শেষ থেকে সেটা ধাপে ধাপে ক্রমবর্ধমান টানা হরতালের আকার ধারণ করেছিল। তবে কূটনৈতিক সৌজন্য, সংলাপপ্রচেষ্টার আরেক দফা চিঠি চালাচালি, রাষ্ট্রপতির সাথে বিরোধী ১৮ দলীয় জোটের সাাৎ ও স্মারকলিপি পেশ, দুই প্রধান দলের মহাসচিবপর্যায়ে ফোনালাপ জাতীয় উদ্যোগের পরিবেশ রার অজুহাতে ১৩ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে সপ্তাহাধিক কাল একরকম আন্দোলন-বিরতি উপভোগ করছেন বিরোধী জোটের নেতৃবৃন্দ। মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নরমগরম এসব হাঁসফাঁস উপো করে মহাজোটের ভেতর থেকেই গৃহপালিত বিরোধী দল গঠনে এরশাদকে নিযুক্ত করে কার্যত একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ‘বহুদলীয় বাকশালতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। এই এজেন্ডায় মহাজোটসর্বস্ব সর্বদলীয় সরকার গঠনের সরব প্রতিক্রিয়াÑ
১৮ নভেম্বর সারা দেশে ১৮ দলের কালো পতাকা মিছিল করে বিরোধীদলীয় বক্তারা বলেছেন, জাতির সাথে বেঈমানি করে যারা সর্বদলীয় সরকারের শপথ নিয়ে স্বৈরশাসনকে দীর্ঘায়িত করতে সহযোগিতা করছে তারা গণদুশমন। এলাকায় এলাকায় তাদের অবাঞ্ছিত করা হবে। প্রমাণ হবে জনগণ শক্তিশালী, নাকি ষড়যন্ত্রকারীরা। বিশ্বাসঘাতকদের পায়ের নিচে মাটি থাকে না। অবৈধ সরকারের মন্ত্রীরা যেখানেই যাবেন সেখানেই তাদের প্রতিরোধ করা হবে।
হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ, দেশের দুই শ’ শীর্ষ আলেম-ওলামা ও মুফতি, বাংলাদেশ নেজামে ইসলামী পার্টি, কওমি মাদরাসা শিকবৃন্দ গয়রহ পৃথক পৃথক বিবৃতিতে বলেছেন, আরো এক দফা ডিগবাজির মাধ্যমে তথাকথিত সর্বদলীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে দেশের লাখ লাখ আলেম-ওলামার সাথে প্রতারণা এবং শহীদের রক্তের সাথে বেঈমানি করেছেন এইচ এম এরশাদ। এরশাদ আবারো প্রমাণ করলেন তাকে নিয়ে কোনো ‘পূর্বধারণা’ সম্ভব নয় এবং তিনি নাস্তিকতাবাদী অপশক্তির মতায় যাওয়ার সিঁড়ি হয়েই আছেন। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযোজনের কৃতিত্ব দাবি, শাপলা চত্বরে শহীদদের জন্য মায়াকান্না এবং লাখ লাখ মুসল্লিকে শরবত পান করানো থেকে শুরু করে দেশের শীর্ষ আলেম আল্লামা শাহ্ আহমদ শফীর কাছ থেকে দোয়া নিতে আসা পর্যন্ত তার সাম্প্রতিক সব আচরণ ছিল ভাঁওতাবাজি। তিনি আওয়ামী লীগের গৃহপালিত বিরোধী দল হওয়ার খায়েশে আবার তাদেরকে মতায় আনার প্রহসনের একতরফা নির্বাচনের পথ সুগম করতে তৎপর হয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি দেশের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হলেন। দেশপ্রেমিক মুসলমানেরা যেকোনো মূল্যে হাসিনা-এরশাদের এই জোটকে সর্বাত্মকভাবে প্রতিহত করবে। যে সরকার সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস তুলে দিয়েছে, যারা আগামীতে মতায় এলে ধর্মের ছায়াটুকু মুছে ফেলার হুঙ্কার দিচ্ছে, যারা আল্লাহ, রাসূল সা:, কুরআন এবং শরিয়তের ফরজ বিধান পর্দাকে কটা করে, তাদের সাথে আঁতাত করে এরশাদ জাতীয় বেঈমানে পরিণত হয়েছেন।
আগের সব কিছু বাদ দিলেও গত ১৪ নভেম্বর জাতীয় ছাত্রসমাজের অনুষ্ঠানে এরশাদ বলেছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, এবার আমরা কারো মতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হবো না। সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে যাবো না।’ একটি জাতীয় দৈনিককে দেয়া সাম্প্রতিক সাাৎকারে এরশাদ বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের সাথে বেহেশতেও যেতে চান না তিনি। এখন বলছেনÑ ‘নির্বাচন করছি মতায় যাওয়ার জন্য। কাউকে মতায় বসানোর জন্য নয়।’
ফেসবুকে এই থুতুতত্ত্বের প্রলাপ যে ধিক্কারের কলধ্বনি তুলেছে, তার তিনটি মাত্র নমুনা উদ্ধৃত করছিÑ তারেক সালমান : ‘আসুন আমরা গণথুথু নিপে কর্মসূচি পালন করি। আমাদের দেশের সংস্কৃতি হচ্ছে মুরব্বিদের সম্মান করা ও তাদের আদেশ নিষেধ মেনে চলা। আমাদের সাবেক রাজা হুমু এরশাদ আমাদের মুরব্বি শ্রেণীর প্রাণী। তার মনোবাসনা পূরণ করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। কয়েক দিন আগে আমাদের মুরব্বি হুমু জাতির উদ্দেশে বয়ান দিয়েছেন, বিরোধী দল ছাড়া আমরা নির্বাচনে যাব না। বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচনে গেলে দেশের জনগণ আমাদের বেঈমান বলবে। জনগণ আমাকে থুথু দেবে। এখন আমাদের হুমু তো বিরোধী দল বা বিএনপিকে ছাড়াই সরকারে গেলেন। নির্বাচনেও যাচ্ছেন। তাই হুমু মুরব্বির বয়ান অনুযায়ী এখন আমাদের সামনে একটি পবিত্র দায়িত্ব। এক জায়গায় জমায়েত হয়ে আসুন আমরা হুমুর প্রতি গণ থুথু নিপে করি।’
জয়নাল আবদিন রুবো : ‘বিশ্ববেহায়া কমিটির অন্যতম সংগঠক ও ভারপ্রাপ্ত আমির মুহম্মদ এরশাদ হোসেন ওরফে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কিছু দিন ধরে রাজনীতির কর্দমাক্ত মাঠে রাজনীতির বল খেলতে গিয়ে বর্তমান টালমাটাল ও ভীতিকর পরিস্থিতিতে দেশের অভাগা মানুষদের কিঞ্চিৎ বিনোদন দেয়ার ল্েয হরেক রকম স্টাইলে আছাড় খাচ্ছেন। আজকে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ফাইনাল আছাড় খাওয়ার পর্ব।’
রুনি শাহ : ‘দেশবাসীর হয়তো জানা হয়ে গেছে, দেশের সবচেয়ে বড় বেঈমানটির নাম এরশাদ। এখন শুধু সময়ের ব্যাপার তার গায়ে থুথু দেয়ার। সে নিজেই বলেছে, সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। যদি যায়, তাহলে মানুষ তাকে বেঈমান বলবে এবং থুথু দেবে। এখন মহাজোটের নেতারা তাকে চুমু দেবে, আর অন্যরা তাকে থুথু দেবে।’
অন্য দিকে অনলাইন সংবাদে মতার মূল দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর উত্তরাধিকারীদের বিড়ম্বনা বা সম্ভাব্য বিড়ম্বনারও যে ‘দিনবদলের পালা’ বিলণ শুরু হয়েছে, তা নিয়ে টিকাটিপ্পনি শুরু হয়েছে। গ্রহের ফেরে তারেক জিয়া ‘মানিলন্ডারিং’-এর মামলায় বেকসুর খালাসের রায় পেলেন ১৭ নভেম্বর। ওই দিনই একটি অনলাইনে প্রকাশ : যুক্তরাষ্ট্র সরকার শেখ হাসিনার পুত্র জয়ের সম্পদের খোঁজ পেয়েছে। যা মার্কিন আইআরএস, মানিলন্ডারিং এজেন্সি, এফবিআই ও ফরেন রিলেশন্স কমিটির নজরে রয়েছে। এর আগে কানাডা পুলিশ লাভালিনের কাছ থেকে নেয়া পদ্মা সেতু ঘুষ কেলেঙ্কারির তথ্য জানতে চায়। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার সাথে সজীব ওয়াজেদ জয়ের মধ্যে কি নিয়ে আলোচনা হয় তাও অনেক কানা মুন্সীর জন্ম দিয়েছে।
এভাবে ডিজিটাল সমাজ, সুশীলসমাজ, মিডিয়া তাত্ত্বিক, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিবিদ মহারথিরা যখন নানা সরস বা সভায় জল্পনাকল্পনা আর সংলাপ সংলাপ নাট্যাভিনয়ে মশগুল, তখন সারা দেশের জনসমাজ নিরাপত্তাহীনতা, পুলিশ সন্ত্রাস, মাফিয়ারাজের হাঙ্গামা আর অর্থনৈতিক অচলাবস্থার ঘোরচক্রে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় উপনীত হয়েছে। রাজধানীতে কিছুটা শান্তভাবে বজায় থাকলেও চোরাগোপ্তা মিছিল, বিােভ, সংঘর্ষ ঘটছে সভা-সমাবেশের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে। রাজধানীর বাইরে সারা দেশেই মফঃস্বল এলাকাজুড়ে জ্বলছে প্রতিবাদ প্রতিরোধের আগুন। সংলাপের বাঁশি বেসুরো বাজিয়ে চলেছে মতার লড়াইয়ের দুই প্রতিপ। অবশ্য নোটিশ এসেছে বিরোধী ১৮ দলীয় জোটের তরফে। আগামীকাল রোববার ২৪ নভেম্বর তাদের সংলাপের বংশীবাদক ছুটিতে যাবে, আবার বেজে উঠবে আন্দোলনের রণদামামা ২৫ নভেম্বর থেকে সর্বশেষ কায়দায় তিন দিন করে টানা হরতাল দিয়ে। অবশ্য সংলাপ সংলাপ খেলায় স্টেডিয়ামে ঢুকে বিরোধীদলীয় জাতীয় নেতারা প্রায় ১০ দিন ‘রাজনৈতিক আন্দোলন’-বিরতি উপভোগ করলেও ‘গণবিােভের আন্দোলন’ থেমে থাকেনি। পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে সীতাকুণ্ডে থেকে অবরোধ-সংঘর্ষ কার্যত দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান বন্দর চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ঢাকার আশপাশে আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর আর কাঁচপুর নারায়ণগঞ্জে পোশাকশ্রমিকের বিােভ আর পুলিশি সংঘর্ষে হতাহত ভাঙচুরের ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে নভেম্বরের ১০ তারিখ থেকে। এসব দ্রোহলণের কোনোটাই সংলাপের বাঁশি দিয়ে নিবারণ করা যায়নি। এখন সেই বাঁশিও স্তব্ধ হতে চলেছে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads