সোমবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৩

হুঁশিয়ার বাংলাদেশ

ফরহাদ মজহার
এ লেখা যখন লিখছি, তখন আঠারোদলীয় জোটের ডাকা হরতাল চলছে। হেফাজতে ইসলামও তাদের দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য কর্মসূচি দিয়েছে। সংলাপের মাধ্যমে অর্থাৎ উদার বা লিবারেল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের কোনো সুযোগ আদৌ ছিল কি না তা নিয়ে এখন কূটতর্ক হতে পারে, কিন্তু তার কোনো উপযোগিতা আর নাই। হরতাল শুরু হয়ে যাবার পর রাজনীতির গতিমুখ বোঝা যাবে আগামি কয়েক দিনেই। আগামি ৭ তারিখের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ৭ তারিখ থেকে হেফাজতে ইসলামের ১৫ তারিখের সমাবেশ অবধি কী ঘটে তার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ লেখা হয়ে যাবে। তাতে কোনো সন্দেহ নাই। 
আমি এই লেখা লিখছি চরম উদ্বিগ্নতা থেকে। এই উদ্বিগ্নতা ও উৎকণ্ঠার অনেকগুলো দিক আছে। প্রথম দিক হচ্ছে আদর্শিক, দ্বিতীয় নৈতিক, তৃতীয় বর্তমান রাজনীতির অভিমুখ নির্ণয়ের দিক এবং চতুর্থত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার দিক। আদর্শিক দিক হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা। সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা ছাড়া কোনো গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন অসম্ভব। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এই দেশে প্রত্যেকেই নাগরিক। নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করার প্রধান বা মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এরপর নাগরিকদের। কিন্তু আমরা দেখেছি, রামুতে বৌদ্ধ জনপদ ও উপাসনালয়ে যখন হামলা হয়েছিল, মতাসীনেরা তা বন্ধ করতে পারে নি। কিম্বা করে নি। নাগরিকেরা তীব্র ভাবে তার প্রতিবাদ করেছেন। দল-মত নির্বিশেষে সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যে শক্তি আমরা দেখেছি, তা কম নয়। কিন্তু দলীয় ও মতাদর্শিক বিভাজনের কারণে তাকে সংঘবদ্ধ সামাজিক শক্তি হিসাবে আমরা হাজির করতে পারি নি। তার পরও সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে যারা যেখানে লড়েছেন, তাদের আমরা অভিনন্দন না জানিয়ে পারি না। 
কিছু দিন থেকে অমুসলিম নাগরিকদের ওপর যে হামলা শুরু হয়েছে তা খুবই বিপজ্জনক। সাঁথিয়ায় যে ঘটনা ঘটেছে তার সঙ্গে রামুর ঘটনার আশ্চর্য মিল আছে। এটা পরিষ্কার যে কোনো-না-কোনো অশুভ শক্তি বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে চায়। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তা খুবই বিপজ্জনক। ইতোমধ্যে অনেকে ঘরে বসে না থেকে রাস্তায় প্রতিবাদ করছেন, জনগণকে অশুভ বিপদ সম্পর্কে সচেতন করছেন। তাঁরা আমাদের ধন্যবাদের পাত্র। তাঁদের প্রতি সকলের পূর্ণ সমর্থন ও সংহতি জানানো উচিত। এই বিপজ্জনক মুহূর্তে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক পকে দায়ী করা হবে খুবই ভুল নীতি। কারণ সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রশ্নে সমাজকে যেকোনো মূল্যে ঐক্যবদ্ধ রাখাই আমাদের কাজ। নইলে যারা ঘোলা জলে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছে আমরা তাদের রাজনীতিত ক্রীড়নকে পরিণত হবো। 
আমি দাবি করছি না যে সুনির্দিষ্ট ভাবে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে, বা হাতেনাতে কোনো প্রমাণ থাকলে আমরা তাদের দোষী করব না। অবশ্যই করব। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা শুধু ইসলামি দলগুলোই করে এই বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক মানসিকতা থেকেও আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের চন্দন কুমার চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘এটি একটি ষড়যন্ত্র বলে আমাদের ধারণা। প্রথম আলো মনে করে তার কথাকে আমলে নেয়া দরকার। আমরা সম্পূর্ণ একমত। 
আমাদের বরং অবস্থান হবে সরকারকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেওয়া এবং বিরোধী জোটকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে বাধ্য করা। সাধারণ নাগরিকদের প থেকে আমরা বিরোধী জোটকে হুঁশিয়ার করে দিতে চাই যে, এখন যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেষ্টা হচ্ছে তার ল্য বিরোধীদলীয় আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেওয়া। অতএব তাদের অবশ্যই উচিত অবিলম্বে জেলায় জেলায় তাদের সংগ্রাম কমিটিগুলোকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সক্রিয় করে তোলা। এই েেত্র ব্যর্থ হলে তাদের আন্দোলন-সংগ্রামও ব্যর্থ হতে বাধ্য। মনে রাখা দরকার, সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, বিরোধী দল মতায় এলে এ দেশে একটি হিন্দুও থাকবে না। তার এই অভিযোগকে হালকা ভাবে নেবার কোনো সুযোগ নাই। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভাবে বিরোধীদলীয় জোটের বিরুদ্ধে প্রচারণার এটা একটা প্রধান দিক। এই একটি মাত্র দোষে বিরোধীদলীয় রাজনীতি বাংলাদেশে সম্পূর্ণ পরাস্ত ও পর্যুদস্ত হতে পারে। কারণ আন্তর্জাতিক মহলের কাছে যে কারণেই হোক, বিরোধী জোট যেসব পয়েন্টে এখনো আস্থা অর্জন করতে পারে নি, এর একটা হলো যে তারা মতায় এলে অমুসলিম নাগরিকেরা নিরাপদ থাকবে। তাদের এই রিডিং ভুল বা ঠিক যা-ই হোক বিরোধী জোটকে তাদের দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। 
অতএব সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে বিপজ্জনক গণ্য করে তা মোকাবেলার রাজনৈতিক ও সাংঠনিক উপযুক্ত প্রস্তুতি নিতে হবে। তা না নিয়ে শুধু কুচক্রী মহলের বিভেদ সৃষ্টির পাঁয়তারা বলে দায়সারা গোছের মন্তব্য কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। বিরোধীদলীয় জোট এই েেত্র কিভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা মোকাবিলা করবে, আমরা নাগরিকেরা তা স্পষ্ট ভাবে জানতে চাই। 
সরকারি দমন-নিপীড়নের মুখে তারা আছেন আমরা জানি। তার পরও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া, প্রতিবাদ-বিােভ জানানো এবং জেলায় জেলায় কর্মীদের হুঁশিয়ার থাকার জন্য সতর্ক করে দেওয়া প্রাথমিক কাজ। তারপর স্থানীয় ভাবে কারা এই ধরনের ঘৃণিত কাজ করছে তাদের খুঁজে বার করা ও তথ্য-প্রমাণ হাতে রাখার জন্য এলাকার সমর্থকদের নির্দেশ দেওয়াও দরকারি কাজ। সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ করার সংকল্প ও সাফল্যের ওপর বিরোধী জোটের রাজনৈতিক সাফল্য নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। 
সবচেয়ে বেশি হুঁশিয়ার হতে হবে ইসলামপন্থীদের। ঘটনা যারাই ঘটাক পুরা দোষ তাদের ওপর চাপানোর চেষ্টা চলবেই। ইতোমধ্যে তা শুরুও হয়ে গিয়েছে। জামায়াত-শিবিরের ওপর দোষ চাপানো সাধারণ ফর্মুলা। তবে এবার মূল আঘাত আসবে হেফাজতে ইসলামের ওপর। 
এতে উৎকণ্ঠিত হবার সমূহ কারণ রয়েছে। হেফাজতে ইসলাম জামায়াতে ইসলামীর মতো সংঘবদ্ধ দল নয়। গ্রামে তাদের অনুসারী ও সমর্থকও প্রচুর। যেকোনো ঘটনায় গ্রামের যেকোনো লোককে ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে হেফাজতি প্রমাণ করা সহজ। হেফাজতে ইসলাম এই পরিপ্রেেিত কিভাবে সাংগঠনিক ভাবে সাম্প্রদায়িক হামলা বা দাঙ্গা প্রতিরোধ করবে, সেটা তাদের অবিলম্বে ভেবে দেখতে হবে। এই েেত্র তাদের প থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি জানানো এবং অবিলম্বে একে মোকাবিলার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ খুবই জরুরি। 
হেফাজতে ইসলাম এ ব্যাপারে সচেতন রয়েছে বলে মনে হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফি সম্প্রতি বলেছেন, ‘ইসলাম ধর্মে সংখ্যালঘুদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। তাই হেফাজতে ইসলাম কখনোই সংখ্যালঘুদের প্রতি কোনো নির্যাতন করেনি। হাটহাজারী মাদরাসার কাছেই দেড় শবছরের পুরোনো মন্দির রয়েছে। সেখানে কখনো কেউ হাত দেয়নি।অমুসলিম ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশ করে তিনি আরো বলেন, ‘আপনাদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। যারা আমাদের সম্পর্কে আপনাদের নিকট মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে, তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকুন।এগুলো নিঃসন্দেহে আশার কথা। হেফাজতের কর্মীদের এখন উচিত তাঁর ঘোষণা ও নির্দেশকে বাস্তব রূপ দেওয়া। অতএব জেলায় জেলায় অমুসলিম নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার জন্য তাঁদের উচিত হবে সুস্পষ্ট পদপে ও কর্মসূচি গ্রহণ করা। 
আমি আবারো বলছি, বর্তমান রাজনৈতিক সংঘাত থেকে ফায়দা তোলার জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা তৈরির আশংকা মোটেও অমূলক কিছু নয়। আমি আশা করব সরকার তার দায়দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক প ও ধর্মীয় আন্দোলনকেও প্রমাণ করতে হবে এই একটি প্রশ্নেÑ বাংলাদেশে অমুসলিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার প্রশ্নেÑ তারা উপমহাদেশে আদর্শ স্থাপন করতে সংকল্পবদ্ধ। 
নইলে এই একটি অজুহাতই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের কারণ হবে। আফগানিস্তানে ছুতা ছিল নারী, বাংলাদেশে ছুতা হবে অমুসলিম জনগোষ্ঠি। 
হুঁশিয়ার বাংলাদেশ। হুঁশিয়ার এ দেশের কৃষক শ্রমিক সাধারণ মানুষ, হুঁশিয়ার বাংলাদেশের প্রগতিশীল তরুণসমাজ, হুঁশিয়ার ইসলামের ইমান-আকিদায় বিশ্বাসী অসাম্প্রদায়িক ধর্মপ্রাণ মানুষ, হুঁশিয়ার ইসলামি রাজনীতিতে বিশ্বাসী সেইসব মানুষÑ যারা জানেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর নিরাপত্তা, মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই ইসলাম নিজেকে ইনসাফ কায়েমের ধর্ম হিসাবে প্রমাণ করতে পারে। অন্য কোনো ভাবে নয়। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads