রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৩

জাতীয় স্বার্থেই হিন্দু-মুসলমান সঙ্ঘাত চাইতে পারি না


এবনে গোলাম সামাদ
সম্প্রতি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার নবগ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোকের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। পত্রপত্রিকার খবর পড়ে জানা গেল, রাজীব সাহা নামে কোনো এক হিন্দু যুবক ফেসবুকে ইসলাম ও ইসলামের নবী সা: সম্পর্কে কিছু কটূক্তি করার কারণেই নাকি হতে পেরেছে এই হামলার ঘটনা। প্রকৃত কারণ সম্পর্কে আমরা এখনো কিছু অবগত হতে পারিনি। কারণ যে হিন্দু যুবককে বলা হচ্ছে দোষী, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে খুঁজে পাওয়া গেলে প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে অনেক কিছুই অবগত হওয়া যেত। এর আগে কক্সবাজারের রামুতে হতে পেরেছিল বৌদ্ধ সম্প্রদায়ভুক্তদের ওপর হামলা। কোনো এক বৌদ্ধ যুবক (বড়য়া) ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম এবং হজরত মুহাম্মদ সা: সম্পর্কে কটূক্তি করায় ঘটতে পেরেছিল হাঙ্গামা। কিন্তু সেখানেও পুলিশ কটূক্তিকারীকে ধরতে পানেনি। অর্থাৎ ইসলামবিরোধী প্রচারণায় পাওয়া যাচ্ছে একটা বিশেষ প্যাটার্ন। পাবনাতে যা ঘটেছে, তাকে মনে করা যায় একটা বিশেষ ধরনের ষড়যন্ত্রেরই ফল। সম্প্রতি ফরহাদ মজহার নয়া দিগন্তে লিখেছেন (৫ নভেম্বর ২০১৩), বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান সঙ্ঘাত সৃষ্টি করে ভারত চাচ্ছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের সুযোগ পেতে। এ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আমি তার অনুরূপ অভিমত পোষণ করি। 
ভারতের পণ্ডিতেরা ইসলাম সম্পর্কে নানা অপপ্রচার করে চলেছেন। তাই অনুভব করছি ইসলাম সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন। ইসলামে জিহাদের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেই সাথে আবার বলা হয়েছে, আল্লাহ আক্রমণকারীকে পছন্দ করেন না (সূরা-২ : ১৯০)। কুরআন শরিফে বলা হয়েছে ন্যায়পরায়ণ হতে; কারণ আল্লাহ ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিদের ভালোবাসেন। কুরআন শরিফে বলা হয়েছে, যে তোমাকে গৃহহীন করতে চায় না, তাকে তুমি যেওনা গৃহহীন করতে (সূরা-৬০ : ৮)। সর্বোপরি, কুরআন শরিফে মুসলমানদের বলা হয়েছে মধ্যপন্থী হতে, চরমপন্থী হতে নয় (সূরা-২ : ১৪৩)। ইসলামে কেবল বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে; অন্যথায় নয়। ইসলাম একটি মধ্যপন্থী ধর্ম। আপসরফা ও খাপখাইয়ে চলার সুযোগ রাখা হয়েছে এতে। কিন্তু ভারতের হিন্দু পণ্ডিতেরা প্রচার করছেন, ইসলামে কেবলই বলা হয়েছে অমুসলমানদের কতল করতে; যা আদৌ সত্য নয়। বাংলাদেশে আমাদের চলতে হবে ইসলামের মূলনীতি অনুসরণ করে। কারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি কেবল দেশরক্ষক নন, বিশ্বাসেরও রক্ষক (Defender of faith)বহু মুসলিম অধ্যুষিত দেশেই আছে রাষ্ট্রধর্ম। যেমনÑ আমাদের অদূরে মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম থাকাকে মনে করা চলে না একটা নজিরবিহীন ঘটনা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, অমুসলমানদের ওপর ইসলামকে জোর করে চাপিয়ে দেয়ার বিধান আছে বাংলাদেশের সংবিধানে। ইউরোপের বহু দেশে রাষ্ট্রধর্ম আছে। ইংল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্কের আছে রাষ্ট্রধর্ম। কিন্তু এসব দেশে আছে উদার গণতন্ত্র। আছে অন্যান্য ধর্মচর্চা করার অধিকার। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে ১৮৩০ সালের আগে কোনো ক্যাথলিক খ্রিষ্টান পার্লামেন্টে সদস্য হতে পারতেন না। কোনো ইহুদি ১৮৫৮ সালের আগে পারতেন না পার্লামেন্টের সদস্য হতে। নাস্তিকেরা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সদস্য হওয়ার অধিকার লাভ করেন ১৮৮৬ সালে। অর্থাৎ এখন ইউরোপে অনেক দেশেই রাষ্ট্রধর্ম থাকলেও অন্য ধর্মে আস্থাবানদের আছে স্বাধীনতা। এমনকি স্বাধীনতা আছে নাস্তিকদেরও। বাংলাদেশ হতে চাচ্ছে একটি উদার গণতন্ত্রের দেশ। এখানে তাই ধর্মীয় গোঁড়ামি ক্রমেই কমে আসতে থাকবে। কিন্তু ভারত যেন চাচ্ছে এ দেশে ধর্মীয় বিরোধকে উসকে দিয়ে বাংলাদেশের ঘরোয়া রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি করতে। আমার মনে পড়ে ১৯৭১ সালের কথা। এ সময় আমি ছিলাম কলকাতায়। তখন একজন সাংবাদিক আমাকে বলেন, ‘তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে হিন্দুরা ভারতে আসছেন। ভারত এর ফলে পেতে পারবে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সৈন্য পাঠানোর সুযোগ।আমার মনে হচ্ছে তেমনি কোনো সুযোগ পাওয়ার চেষ্টা ভারত করতে পারে আবার। ভারতে এবার উত্তর প্রদেশে হয়েছে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলছেন, এই দাঙ্গার জন্য উত্তর প্রদেশের মুজাফফরপুর শহরের মুসলমানেরাই দায়ী। মুসলমানেরা নাকি এ দাঙ্গা শুরু করেছেন পাকিস্তানের গোয়েন্দা চক্র আইএসআইয়ের নির্দেশে। পশ্চিমবাংলার বহুল পঠিত আনন্দবাজার পত্রিকায় বলা হয়েছেÑ বিএনপি নাকি পরিচালিত হচ্ছে আইএসআইয়ের দ্বারা। এই প্রচারকে মনে করা চলে খুবই দুরভিসন্ধিমূলক। আমাদের তাই এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। ফরহাদ মজহার নয়া দিগন্তের সংবাদ নিবন্ধে যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, সেটাকে দেয়া উচিত বিশেষ গুরুত্ব। 
১৯৭১ সালে আমি ছিলাম কলকাতায়। অনেক লোকের সাথে মিশে আমার সে সময় এ ধারণা হয়েছিল, ভারত চাচ্ছে সাবেক পাকিস্তানকে ভেঙে দিতে। আর পরে সে চাইবে কাশ্মিরের মতো ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে গ্রাস করতে। ভারতের পত্রপত্রিকার প্রচারণা থেকে আমার সেই পুরনো ধারণা আবার ফিরে আসছে মনে। ভারত ১৯৭১ সালে ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ভারতীয় সৈন্য ঢুকতে শুরু করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে। ভারত সরকার বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ৬ ডিসেম্বর; তার আগে নয়। আমরা ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে বলছি মহান মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু ভারতের কাছে এই যুদ্ধ মূলত ছিল পাকিস্তান ভেঙে দেয়ার যুদ্ধ। ১৯৮২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত ভারতবর্ষের ইতিহাস বইতে ১৯৭১-এর যুদ্ধকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। এ যুদ্ধকে বলা হয়েছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। বলা প্রয়োজন, বইটির বাংলা অনুবাদ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের এক সময়ের কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় এবং বাংলাদেশের বিশিষ্ট বাম বুদ্ধিজীবী দ্বিজেন শর্মা। আমরা বলেছি, ভারত সরকার বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করেছিল ৬ ডিসেম্বর। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে একটা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার আগে শেখ মুজিব সরকারের কাছে জানতে চায়, শেখ মুজিব সরকার পাকিস্তানের সাথে কোনো বিশেষ ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখতে চাচ্ছে কি না। শেখ মুজিব তখন বলেন, তিনি পাকিস্তানের সাথে চাচ্ছেন না কোনো বিশেষ কোনো সম্পর্ক বজায় রাখতে। কেবল তখনই সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের সাথে স্থাপন করে কূটনৈতিক সম্পর্ক। এর আগে নয়। শেখ মুজিব বাংলাদেশে ফিরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাথে ভারত সরকারের যেসব চুক্তি হয়েছিল, তার অনেক কিছুকেই দিয়েছিলেন নাকচ করে। তিনি দেশে ফিরে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের ওপর ভারতের সর্বময় ক্ষমতাকে খর্ব করতে। কিন্তু পরে যে কারণেই হোক, তিনি ঢুকে পড়তে চাইলে ভারতেরই দিকে। তবে তাজউদ্দীনের মতো অতটা নয়। আমরা এসব ইতিহাস সম্পর্কে এখনো যথেষ্ট অবগত নই। কিন্তু ১৯৭১ সালের যুদ্ধের বাস্তব চরিত্রকে অনুধাবন করার জন্য সেই সময়ের ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। জানা দরকার, কেন সোভিয়েত ইউনিয়ন দেরি করেছিল বাংলাদেশকে একটা পৃথক স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। আমার মনে হয়, ভারত একটা বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পেছনে শক্তি জোগাচ্ছে। এ বিষয়ে সচেতন হয়েই আমাদের করতে হবে দেশের রাজনীতি। আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থেই বাংলাদেশে সৃষ্টি করতে পারি না হিন্দু-মুসলিম সঙ্ঘাত। 
সব দেশেই হলুদ সাংবাদিকতা (Yellow Press) আছে। বাংলাদেশেও আছে এ ধরনের সাংবাদিকতা। হলুদ সাংবাদিকেরা ছড়িয়ে থাকেন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী সংবাদ। এরা প্রদান করেন বিভিন্ন দলের হয়ে পক্ষপাতমূলক সংবাদ। সেটা একটা দেশের রাজনীতিতে হয়ে উঠতে পারে যথেষ্ট অকল্যাণকর। ফরহাদ মজহার কোনো এক টেলিটকে করেছেন হলুদ সাংবাদিতার সমালোচনা; যা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বার্থেই আমরা এটি হওয়া উচিত মনে করি না। ফরহাদ মজহার নয়া দিগন্তে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী যে স্তম্ভ রচনা করেছেন, সেটিকে আমরা বিশেষভাবেই স্বাগত জানাই। এর প্রয়োজন ছিল ও আছে। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads