বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৩

সবার চোখ এখন বঙ্গভবনের দিকে


বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ১৮ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধে সবদিক থেকেই অচল হয়ে পড়েছে সারা দেশ। এর কারণ আসলে ক্ষমতাসীনরাই তৈরি করেছেন। তারা যদি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মেনে নিতেন এবং বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার আগেই প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে দিয়ে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না করাতেন তাহলে পরিস্থিতির এত দ্রুত অবনতি ঘটতো না। তফসিল ঘোষণার পাশাপাশি উস্কানি ও হামলাও এসেছে সরকারের পক্ষ থেকেই। সরকার একই সঙ্গে যথেচ্ছভাবে সংবিধানবিরোধী কর্মকা-ও চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি নেতা আ স ম হান্নান শাহকে গ্রেফতার এবং বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর এতদিনকার মতো এমনভাবে দমন-নির্যাতন চালানো হচ্ছে যা দেখে বোঝার উপায় নেই যে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাহী সকল ক্ষমতা এখন সরকারের হাতে নয় বরং নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকার কথা। আপত্তির কারণ হলো, পদে পদে নিজেরা সংবিধান লংঘন করলেও ক্ষমতাসীনরা আবার একই সংবিধানের দোহাই দিয়ে বেড়াচ্ছেন। সব মিলিয়েই পরিষ্কার হয়ে গেছে, ক্ষমতাসীনরা মানুষের প্রাণবিনাশী কর্মকা-েই তৎপর থাকবেন, তারা গণতন্ত্রসম্মত পথে পা বাড়ানোর নাম করবেন না। ওদিকে নির্বাচন কমিশন বশংবদের মতো তফসিল ঘোষণা করায় এবং মাঝখানে সময় খুবই কম থাকায় সমঝোতার পথও বন্ধ হয়ে গেছে বলা যায়। একই কারণে একদিকে আন্দোলন যেমন আরো প্রচ- হয়ে উঠছে অন্যদিকে দেশী-বিদেশী সব মহলে উদ্বেগ-আতংকও ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিক্রিয়ার প্রকাশও ঘটাচ্ছেন অনেকে। এভাবে রাজনৈতিক সংকট বিপজ্জনক হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতেই সবার চোখ এখন বঙ্গভবনের দিকে নিবদ্ধ হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রধান ‘অভিভাবক’ হিসেবে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেট সংকট কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করবেন বলেও জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে তার কাছে এরই মধ্যে অনুরোধও জানানো হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের নেতারা বঙ্গভবনে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সংঘাত ও হিংস্রতার পথ পরিহার করে সরকার যাতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ একটি সরকারের অধীনে এবং সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্দেশে সমঝোতার পথে অগ্রসর হয় সে লক্ষ্যে উদ্যোগ নেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির প্রতি আহবান জানিয়েছেন জোটের নেতারা। তারা বলেছেন, জাতীয় জীবনের এই ক্রান্তিলগ্নে মহামান্য রাষ্ট্রপতিই কেবল সরকারকে নিবৃত্ত করতে পারেন। তিনি সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার ব্যাপারেও ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি তেমন ভূমিকাই পালন করবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন ১৮ দলীয় জোটের নেতারা। এর পরপরই সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিক রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তারাও রাষ্ট্রপতিকে বলেছেন, দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকা হত্যা ও সহিংসতাকে প্রতিহত না করা গেলে এবং প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা চালানো হলে গণতন্ত্র বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। ভয়াবহ সে পরিণতির কবল থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষার উদ্দেশে সচেষ্ট হওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা।
অন্যদিকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে তাদের বক্তব্য শুনলেও রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেট নিজের সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেছেন। বলেছেন, তার পক্ষে ১৮ দলীয় জোট এবং বিশিষ্টজনদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভূমিকা পালন করা বা তাদের দাবি পূরণ করা সম্ভব নয়। তবে তাদের বক্তব্য ও দাবিগুলোকে তিনি সরকারের কাছে পৌঁছে দেবেন। রাষ্ট্রপতির এই যুক্তি ও বক্তব্য কিন্তু জনগণকে নিরাশ করেছে। কারণ, সংবিধানেই বলা আছে , রাষ্ট্রপতি যে কোনো বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারকে ‘পরামর্শ’ দিতে পারবেন। এর ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি যেহেতু ‘মহামান্য’ সেহেতু তার ‘পরামর্শ’ই নৈতিক দিক থেকে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের জন্য ‘নির্দেশ’ হয়ে উঠতে পারে। সেটাই হওয়া উচিতও। ব্যাখ্যার এই দৃষ্টিকোণ থেকে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে রাষ্ট্রপতি সরকারের ওপর এমনকি নৈতিক চাপও সৃষ্টি করতে পারেন। তাছাড়া মন্ত্রিসভার বা সংসদের যে কোনো সিদ্ধান্ত বা আইনে অনুমোদন দেয়ার আগে সেটা পুনর্বিবেচনার জন্য তিনবার পর্যন্ত ফেরৎ পাঠানোর ক্ষমতাও সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে রেখেছে। এর ব্যাখ্যায়ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার দিকটিই প্রাধান্যে আসে। সুতরাং একথা ঢালাওভাবে বলার অবকাশ থাকতে পারে না যে, রাষ্ট্রপতির হাত-পা বাঁধা এবং তার কোনো ক্ষমতা নেই। ব্যাখ্যার আলোকে বরং বলা যায়, তিনি ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি’ বলেই বেগম খালেদা জিয়া ও ড. কামাল হোসেনসহ বিশিষ্টজনেরা বুঝে-শুনেই তার কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। সদিচ্ছা থাকলে রাষ্ট্রপতি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রথম বিএনপি সরকারের রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের উদাহরণও অনুসরণ করতে পারেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রশ্নে ১৯৯৫-৯৬ সালে যখন রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস তখন বিচারপতি, সিনিয়র আইনজীবী, অধ্যাপক ও সাংবাদিকসহ নাগরিক সমাজের অনেক বিশিষ্টজনের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। তাদের অভিমতের ভিত্তিতেই তিনি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ‘পরামর্শ’ দিয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রপতির সে ‘পরামর্শ’ অনুযায়ীই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান যুক্ত করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করেছিলেন। এর পর ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন খালেদা জিয়া। বর্তমান পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেট যদি সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের উদাহরণ অনুসরণ করেন তাহলে সংকট কাটিয়ে ওঠা সময়ের বিষয়ে পরিণত হতে পারে। গণতন্ত্র রক্ষাসহ বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই রাষ্ট্রপতির উচিত প্রধানমন্ত্রীকে এমনভাবে ‘পরামর্শ’ দেয়া, যাতে তিনিও বেগম খালেদা জিয়ার মতো প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং ১৮ দলীয় জোটের দাবি অনুযায়ী সংবিধানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের বিধান যুক্ত করেন। সংসদ এখনও বহাল থাকায় রাষ্ট্রপতি যে কোনো সময় অধিবেশন আহ্বান করতে এবং সেই অধিবেশনে নতুন বিধানটি যুক্ত করানোর উদ্যোগ নিতে পারেন। দেশ ও জাতির সংকটকালে সেটাই হবে অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতির যথার্থ ভূমিকা। তারও আগে ঘোষিত তফসিল অবশ্যই বাতিল করতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads