শুক্রবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৩

জাতীয় সংহতি ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান


৭ নভেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পাশাপাশি জাতীয় সংহতি অর্জনের ক্ষেত্রে এ দিনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সাল বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে। নানা ধরনের অপ্রীতিকর আর অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার মধ্যে দিয়ে পার হয়েছিল এ বছর। একটু পেছনে ফিরে দেখা দরকার। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। শুরু থেকেই সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে সেনাবাহিনীতে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনায়ও ছিল সমন্বয়হীনতা। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত এই চার বছর সেনাবাহিনী এমনকি সামগ্রিক বাংলাদেশে বিরাজ করছিল চরম অস্থিতিশীলতা। সেনাবাহিনীর জন্য ছিল ঘটনাবহুল সময়। এর ওপর ১৯৭৫ সালে জানুয়ারিতে বাকশাল কায়েমের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের শিশু গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করা হয়। অভ্যুত্থান ও পাল্টা-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পার হয় আগস্ট থেকে নভেম্বরের পুরো সময়টি। নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যেমে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। দৃঢ় হাতে হাল ধরেন। সেনাবাহিনীসহ সামগ্রিক দেশে সংহতিসাধনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বিষয়টি বিশ্লেষণের জন্য কিছু বিষয়ের উল্লেখ না করলেই নয়। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশকে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বানানোর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দীর্ঘ দিন ধরেই গোপন কার্যক্রম চালিয়ে এসেছিল জাসদ। রাজনৈতিক মাঠে এবং সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে যুগপৎভাবে চালিয়ে যায় সেই প্রচেষ্টা। কিন্তু রাজনৈতিক মাঠে বিপর্যস্ত ও পর্যুদস্ত হয়ে সৈনিকদের নিয়ে বিপ্লবকরার বিকল্প পদ্ধতি অবলম্বন করে। আর এসব কর্মপরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন কর্নেল তাহের। সৈনিকদের নিয়ে গড়ে তোলা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থানামে একটি গোপন সংগঠন। বিদ্যমান সামরিক আইনে এ ধরনের একটি গোপন সংগঠন গড়ে তোলা ছিল একটি বড় অপরাধ। এই সংগঠন সৈনিকদের ভিতরে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রচার শুরু করে সৈনিকদের মধ্যে এক ধরনের বিপ্লবী মনোভা তৈরি করে। এর মধ্যেই ৩ নভেম্বর ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল সাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে একটি অভুত্থান ঘটে। সেনাপ্রধানের পদ থেকে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সরানো হয় এবং তাকে গৃহবন্দী করা হয়। ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বও পর্যন্ত উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে রাজনৈতিক কার্যক্রম। এ কয়েক দিন দেশে কোন ধরনের সরকারের উপস্থিতি উপলব্ধি করেন দেশবাসী। এক দিকে প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক অন্য দিকে অভ্যুত্থানকারী খালেদ মোশাররফ। কে সরকার পরিচালনা করছেন তা জনগণের কাছে ছিল অস্পষ্ট। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনীর মধ্যে সৃষ্টি হয় একটি বিশাল বিভাগজন। এই বিভাজন এক দিকে যেমন সৈনিক-অফিসার বিভাজন, একই সাথে ছিল অফিসারদের মধ্যেও। শহীদ জিয়াকে পদচ্যুত করা সেনাবাহিনীর একটি বিরাট অংশ খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে মানসিকভাবে অবস্থান নেন। সেনাবাহিনীতে ব্যাটম্যান-প্রথার কারণে সাধারণ সৈনিকেরা কিছুটা মনোক্ষুণœ ছিল। কেননা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাটম্যানদের অসৈনিকসলুভ কাজে কিংবা পারিবারিক কাছে নিয়োজিত করা হতো। আর কর্নেল তাহেরের জাসদ সাধারণ সৈনিকদের বুঝাতে শুরু করল কেন তুমি অফিসারদের জন্য খাটবে। এ ধারণায় সাধারণ সৈনিকেরা উদ্বুদ্ধ হয়। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। যার প্রতিফলন দেখা যায় ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থারআন্দোলনের সময়। এ সময় এরা একটি স্লোগান দিয়েছিল সিপাহি-সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই। এখান থেকে বোঝা যায় সৈনিকদের মধ্যে একধরনের উগ্র-জঙ্গি মানসিকতা সৃষ্টি হয়। যা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে কর্নেল তাহেরের ভূমিকা ছিল মুখ্য। বিপ্লবের নামে একধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম শুরু করে সৈনিকেরা। কিছু সেনাকর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। তবে এটি সত্য যে, এই ধরনের বিপ্লবী চেতনায় খুব কম সৈনিকই উদ্বুদ্ধ হন। দেশপ্রেমিক সৈনিকেরা সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ডভাঙার পক্ষপাতী ছিলেন না। এরা সেনবাবাহিনীর কমান্ড দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী কর্মকর্তাদের হাতে রাখার পদক্ষেপ নেন। এ ছাড়া ক্যাপ্টেন-মেজর র‌্যাংকের অনেক অফিসার ছিলেন, যারা জেনারেল জিয়াউর রহমানের অন্ধভক্ত ছিল। তাই এরা জিয়াউর রহমানকে বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করে তাকে নেতৃত্বের আসনে পুনর্বহাল করে। একটি বিষয় উল্লেখ করার প্রয়োজন আছে। কর্নেল তাহের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কিংবা সমাজ পরিবর্তনের জন্য সৈনিক বিদ্রোহের যে পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন, তার তিনটি দুর্বলতা ছিল। প্রথমত এই বিদ্রোহ বিপ্লবের দিকে না গিয়ে সঙ্ঘাত, সংঘর্ষ আর ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের দিকে ধাবিত হয়। দ্বিতীয়ত তার এই কার্যক্রম সম্পর্কে এক দিকে যেমন জনগণ অবহিত ছিল না, তেমনি বেশির ভাগ সৈনিকও ছিলেন অসচেতন। তৃতীয়ত, সামগ্রিক বিপ্লব সম্পর্কে নেতৃত্ব দিতে জনগণ ও সৈনিকদের মধ্যে যে ধরনের পরিচিতি ও জনপ্রিয়তার প্রয়োজন ছিল, তা তার মধ্যে এবং তার দল জাসদের মধ্যে ছিল না। পক্ষান্তরে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। তা ছাড়া সৈনিকদের পাশাপাশি জনগণের কাছেও ছিল তার ব্যাপক পরিচিতি। ফলে খুব সহজেই বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে সামগ্রিক বিপ্লবের নেতৃত্ব জিয়াউর রহমান নিজের হাতে তুলে নিতে সক্ষম হন। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তার বিখ্যাত বাংলাদেশ : এ লিগ্যাসি অব ব্লাডগ্রন্থে এ বিপ্লবকে নিম্নোক্তভাবে বিশ্লেষণ করেছেনÑ ‘রাত দেড়টায় জওয়ানরা রেডিও স্টেশন দখল করে নেয়। তারা কর্মরত রাত্রিকালীন কর্মীদের জানান, জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সিপাহি বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে এবং তা চলতে থাকবে। বিস্মিত কর্মকর্তারা তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। তারা যখন বুঝতে পারল যে, সৈন্যরা এবার তাদের হুমকির কারণ নয়, তখন তারাও ওদের আনন্দে-উল্লাসে যোগ দেয়। উল্লসিত কিছু সৈনিক আর বেসামরিক লোক নিয়ে কতকগুলো ট্যাংক ঢাকা শহরের মধ্যবর্তী এলাকায় চলাচল করতে দেখা যায়। এবার ওই ট্যাংক দেখে লোকজন ভয়ে না পালিয়ে, ট্যাংকের সৈনিকদের সাথে একাত্ম হয়ে রাস্তায় নেমে আসে এবং উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। তিন দিন ধরে তারা মনে করছিল যে, খালেদ মোশাররফকে নিয়ে ভারত তাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এতক্ষণে তাদের সেই দুঃস্বপ্ন কেটে গেল। জনতা সৈনিকদের দেশের ত্রাণকর্তা বলে অভিনন্দিত করে। সর্বত্রই জওয়ান আর সাধারণ মানুষ খুশিতে একে অপরেরর সাথে কোলাকুলি শুরু করে। রাস্তায় নেমে রাতভর স্লোগান দিতে থাকে। আল্লাহু আকবর, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, সিপাহি বিপ্লব জিন্দাবাদ, জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ ইত্যাদি। অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের গণজাগরণের মতো জনগণ আবার জেড়ে উঠেছে। ওইটা ছিল সত্যই একটা স্মরণীয় রাত।শহীদ জিয়া সৈনিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন। চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান। ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে যে বিপ্লব শুরু হয়েছিল, সেটাকে তিনি অনেকটাই স্থিতিশীল পর্যায়ে ফেরত আনার উদ্যোগ নেন। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যসংখ্যা ছিল সীমিত। তারা বিপ্লবকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হন। জেনারেল জিয়ার ব্যক্তিগত পরিচিতি ও আবেদনের সমানে সৈনিক সংস্থার ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম উড়ে যায়। শহীদ জিয়া তার ব্যক্তিগত দক্ষতা, যোগ্যতা, নেতৃত্ব আর বিচক্ষণতা দিয়ে ধীরে ধীরে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। নিশ্চিত ধ্বংস থেকে রক্ষা পায় সেনাবাহিনী। রেডিওতে দেয়া এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে জেনারেল জিয়া, ৩ তারিখের অভ্যুত্থানে বন্ধ হওয়া অফিস আদালত, বিমানবন্দর, মিল-কারখানা ইত্যাদি আবার খুলে কাজ করতে অনুরোধ জানান। তার ভাষণে সর্বস্তরের জনগণের ব্যাপক সাড়া লক্ষ করা যায়। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তার বইতে এ বিষয়ে উল্লেখ করেন, ‘জিয়ার সংক্ষিপ্ত আবেগপূর্ণ এবং সময়োচিত ভাষণ সারা দেশে জাতীয়তাবাদের জোয়ার বইয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে এর আগেও একবার তিনি জনমনে আশার সঞ্চার করেছিলেন। এবারও তিনি আর একবার বাংলাদেশকে পুনঃস্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণের সুযোগ দিলেন।৭ই নভেম্বর সকালে দেশপ্রেমিক নিষ্কলুষ সৈনিকদের স্বতঃস্ফূর্ত সাহস, প্রেরণা ও সহযোগিতা জুগিয়েছিলেন ঢাকা শহরের জনগণ। হাজার হাজার জনগণ সৈনিকের সাথে রাস্তায় নেমে আসে। সৈনিক-জনগণ মিলে স্লোগান দিতে থাকে সিপাহি-জনতা ভাই ভাই। সৈনিক জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছিল বলে একে সিপাহি জনতার বিপ্লব বলা হয়। ৭ই নভেম্বরকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিজয় দিবস বললেও ভুল হবে না। বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, ফ্যাসিবাদ, পরমুখাপেক্ষিতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নাম ৭ই নভেম্বর। ৭ই নভেম্বর সৈনিক-জনতার ঐক্যের মাধ্যমে দেশ বিশৃঙ্খলা, পরনির্ভর শাসন ও ফ্যাসিবাদী গণতান্ত্রিক শাসনের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads