শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৩

আবারও ক্ষমতায় আসার জন্য লজ্জাকর দৌড়


মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই রাজনৈতিক সংকটকে আরো অনেক জটিল করে তুলেছেন ক্ষমতাসীনরা। সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার এবং ১৮ দলীয় জোটকে নির্বাচনের পথে নিয়ে আসার যে চমৎকার সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল তাও নস্যাৎ হয়ে গেছে। প্রতিটি বিষয়ে উদ্যোগী ভূমিকা রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমন মন্তব্য অত্যন্ত গুরুতর বলেই দু-একটি তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। তথ্যগুলোর প্রাধান্যে রয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার বঙ্গভবনে যাওয়া। গত ১৯ নবেম্বর সন্ধ্যায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ১৮ দলীয় জোটের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেটের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বৈঠক করেছেন। তার কাছে চলমান রাজনৈতিক সংকট এবং সমাধানের উপায় সম্পর্কে বক্তব্য তুলে ধরেছেন। অনুরোধ জানিয়েছেন, ‘রাষ্ট্রের অভিভাবক’ হিসেবে রাষ্ট্রপতি যাতে অবিলম্বে সংঘাত, হানাহানি ও হিংস্রতার পথ পরিহার করে সংলাপের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য সরকারকে তাগিদ দেন। সরকার যাতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ একটি সরকারের অধীনে এবং সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে সমঝোতার পথে অগ্রসর হয় তার জন্যও উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। রাষ্ট্রপতির কাছে দেয়া ১৮ দলীয় জোটের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়েছে, বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রশ্নে একের পর এক ছাড় দেয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় আসার লক্ষ্যে অনমনীয়ভাবে এগিয়ে চলেছেন। শুধু তা-ই নয়, ক্রমাগত উস্কানি দেয়ার এবং আক্রমণাত্মক বক্তব্য রাখার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনরা সংলাপ অনুষ্ঠানের এবং সমঝোতা প্রতিষ্ঠার সব চেষ্টাকেও ব্যর্থ করে দিচ্ছেন। জাতীয় জীবনের এ ক্রান্তিলগ্নে ‘রাষ্ট্রের অভিভাবক’ ও ‘জাতীয় ঐক্যের প্রতীক’ হিসেবে রাষ্ট্রপতিই কেবল সরকারকে নিবৃত্ত করতে এবং সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার ব্যাপারেও ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারেন বলে আশা প্রকাশ করেছিল ১৮ দলীয় জোট। অন্যদিকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে তাদের বক্তব্য শুনলেও রাষ্ট্রপতি নিজের সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, জোটের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভূমিকা পালন করতে না পারলেও তাদের বক্তব্য ও দাবিগুলো তিনি সরকারের কাছে পৌঁছে দেবেন।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বঙ্গভবনে যাওয়ার এবং রাষ্ট্রপতির কাছে দাবি ও বক্তব্য তুলে ধরার মধ্য দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া আরো একবার শুধু সদিচ্ছারই প্রমাণ দেননি, দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রীর ভূমিকাও পালন করেছেন। কারণ, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার হুবহু পুনর্বহালের দাবি পরিত্যাগ করার পাশাপাশি অনেক আগেই তিনি অন্য এমন সব বিষয়ে ছাড় দিয়েছেনÑ যেগুলোকে অজুহাত বানিয়ে ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক সংকটের সমাধানকে অসম্ভব করতে এবং বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপাতে পারতেন। খালেদা জিয়া শুধু নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের প্রশ্নে অনড় থেকেছেন। এ সরকারের রূপরেখায় তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী বা সরকার প্রধানের পদে শেখ হাসিনাকে রাখা চলবে না। বিষয়টি নিয়ে সংসদের ভেতরে-বাইরে যে কোনোস্থানে সংলাপে বসার ব্যাপারেও সম্মতি জানিয়ে রেখেছেন তিনি। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী এগিয়েছেন তার একতরফা নির্বাচনের নীলনকশা অনুযায়ী। প্রধানমন্ত্রী এমনকি টেলিফোন সংলাপ নিয়েও নাটক সাজিয়েছেন। একযোগে সর্বাত্মকভাবে দিয়েছেন উস্কানিও। বিদেশীদের পরামর্শ ও আহ্বানের জবাবেও প্রধানমন্ত্রী অনড় অবস্থানেই থেকেছেন, যার সর্বশেষ প্রমাণ পাওয়া গেছে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালের সাম্প্রতিক সফরকালে। মুখে সংলাপ ও সমঝোতার কথা বললেও মার্কিন মন্ত্রীর ঢাকা অবস্থানকালেই প্রধানমন্ত্রী ‘সর্বদলীয়’ সরকারের নামে আওয়ামী মহাজোট সরকারের সম্প্রসারণ করেছেন। যথারীতি উস্কানিমূলক বক্তব্যও রেখেছেন বেগম খালেদা জিয়ার। তিনি এমনকি ১৯ নবেম্বরও দক্ষিণাঞ্চলের এক জনসভায় বলেছেন, খালেদা জিয়া নাকি নির্বাচন নিয়ে খেলতে চাচ্ছেন এবং তাকে এই খেলাটা খেলতে দেবেন না তারা। তথ্যটি উল্লেখের কারণ হলো, প্রধানমন্ত্রী এমন এক সময়ে এই আক্রমণ করেছেন, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের নেতারা যখন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বঙ্গভবনে যাচ্ছিলেন। অথচ সমঝোতার এবং বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনার ব্যাপারে উদ্দেশ্যে ন্যূনতম সততা থাকলেও কারো পক্ষে ঠিক ওই সময়ে এভাবে উস্কানি দেয়াটা স্বাভাবিক হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে এর মধ্য দিয়েও প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি আসলে চান না, বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নিক। এর অর্থ, তারা একতরফা নির্বাচনই করতে চান।
ঘটনাপ্রবাহে অন্য দুটি বিষয়ও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে সামনে এসেছে। প্রথমটি তথাকথিত ‘সর্বদলীয়’ সরকার এবং দ্বিতীয়টি হঠাৎ করে নবম সংসদের সমাপ্তি ঘটানো। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের নেতারা বঙ্গভবনে যাওয়ার এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে দাবি ও বক্তব্য পেশ করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই গত ২০ নবেম্বর নবম সংসদের আকস্মিক সমাপ্তি ঘটিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমন এক সময়ে প্রধানমন্ত্রী সংসদের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন যখন বঙ্গভবনে যাওয়ার মাধ্যমে শুধু নয়, অন্য কিছু পন্থায়ও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সমঝোতার লক্ষ্যে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছিল। মাত্র ক’দিন আগেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে চিঠি লিখেছেন, তার কাছে উপর্যুপরি টেলিফোন করেছেন। কিন্তু সৈয়দ আশরাফ চিঠির জবাব যেমন দেননি তেমনি  ফিরতি টেলিফোন করার সৌজন্যও দেখাননি। বাঝাই যাচ্ছে, সৈয়দ আশরাফকে প্রধানমন্ত্রীই বারণ করেছিলেন। এরপরই এসেছে সংসদের সমাপ্তি ঘটানোর পালা। এ ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রী প্রশ্নসাপেক্ষ বক্তব্য রেখেছেন। যেমন তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রপতি নাকি তাকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার ‘অনুমতি’ দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শ করেই তিনি নাকি মন্ত্রিসভার আকার ছোট করেছেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচন তার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। প্রশ্ন উঠেছে এজন্য যে, সংবিধানের যে অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে এই সমাপ্তি ঘটানো হয়েছে সে অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গত ২৭ অক্টোবরই নবম সংসদের শেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা সংসদকে শুধু টেনে বাড়িয়েই এনেছেন। সে কারণে ধারণা করা হয়েছিল, তারা সম্ভবত বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানোর এবং নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে সংবিধানে নতুন একটি বিধান যুক্ত করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সে জন্যই সম্ভবত দফায় দফায় অধিবেশন মুলতবি করা হচ্ছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, তেমন কিছু সত্যি করা হলে রাজনৈতিক সংকট যেমন কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতো, তেমনি নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করা  যেতো।
কিন্তু সব সম্ভাবনাই নস্যাৎ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। নিজের নীল নকশা অনুযায়ী এগোতে গিয়ে রাষ্ট্রপতির ‘অনুমতি’ নেয়ার কথা জানালেও প্রধানমন্ত্রী জানাননি, এই ‘অনুমতি’ তিনি কবে পেয়েছেনÑ সেটা কি খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের আগে না পরে? প্রশ্ন ওঠার কারণ হলো, প্রকাশিত কোনো খবরেই বলা হয়নি যে, রাষ্ট্রপতি ও খালেদা জিয়ার মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেছেন কিংবা টেলিফোনে কথা বলেছেন। তাছাড়া সংবিধান অনুযায়ী তো বটেই, সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রথা অনুসারেও প্রধানমন্ত্রীকে ‘অনুমতি’ দেয়া সংক্রান্ত ঘোষণাটা বঙ্গভবন থেকে লিখিত আকারে আসার কথা। তেমন কোনো ঘোষণা বঙ্গভবন থেকে আসেনি। সে কারণে ধরে নেয়া যায়, প্রধানমন্ত্রী বললেও বাস্তবে রাষ্ট্রপতি তাকে অন্তত ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের আগে কথিত ওই ‘অনুমতি’টুকু দেননি। তিনি অবশ্য কিছুদিন আগে অন্য কোনো উপলক্ষে কথায় কথায় ‘অনুমতি’ দিয়ে থাকতে পারেন। সম্ভবত তার ভিত্তিতেই রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে মিথ্যাচার করা হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে তথাকথিত ‘সর্বদলীয়’, ‘নির্বাচনকালীন’ এবং ‘অন্তর্বর্তী’ মন্ত্রিসভার দিকেও দৃষ্টি ফেরানো দরকার। বেগম খালেদা জিয়া সমঝোতা ও সংলাপের দরজা উন্মুক্ত রাখলেও প্রধানমন্ত্রী সাড়া দেয়ার  পরিবর্তে ১৯ নবেম্বর তথাকথিত ‘সর্বদলীয়’ সরকার গঠনের নামে মন্ত্রিসভাকে পুনর্গঠিত করেছেন। ছয়জনকে মন্ত্রী, দু’জনকে প্রতিমন্ত্রী এবং একজনকে উপদেষ্টা পদে নিযুক্তি দিয়েছেন তিনি। এ নয়জনের মধ্যে ছয়জনই গেছেন আওয়ামী মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান দল জাতীয় পার্টি থেকে। মেয়াদের একেবারে শেষ সময়ে এসে ভাগ্য খুলে গেছে আওয়ামী লীগের দুই প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদের। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ‘কমরেড’ রাশেদ খান মেননও নির্লজ্জের মতো গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। বৃদ্ধ বয়সে শেখ হাসিনার অধীনে মন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছেন এরশাদ আমলের ‘ফার্স্টলেডি’ রওশন এরশাদও। এরশাদ নিজেও জবরই দেখিয়েছেন। হঠাৎ করে সেদিন সকালেই তিনি আওয়ামী মহাজোট থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছেন, যাতে বোঝানো যায়, আসলেও এটা ‘সর্বদলীয়’ সরকার! অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলো এ সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। বলেছে, এটা শুধু নতুন মোড়কে মহাজোট সরকার নয়, নির্বাচনে কারচুপি ও ভোট ডাকাতি করার উদ্দেশ্য নিয়েই নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের নিযুক্তি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কথাটা অস্বীকার করা যায় না। কারণ, মহাজোটের বাইরের অন্য কোনো দল থেকেই কোনো মন্ত্রী নেয়া হয়নি। নতুন আর পুরনো মিলিয়ে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন মাত্র চারটি দলের লোকজনÑ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদ (ই) এবং ওয়ার্কার্স পার্টি। সে হিসাবে একে বড়জোর চারদলীয় সরকার বলা যেতে পারে।
ঘটনাপ্রবাহে সবচেয়ে নিন্দনীয় ভূমিকা পালন করেছেন এককালের স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। কয়েকদিন ধরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বেহেশতেও যাবেন না এবং বিএনপি না এলে একতরফা নির্বাচনে অংশ নেবেন না ধরনের নানা ঘোষণার কারণে আলোচিত এরশাদ রাতারাতি ভোল পাল্টে সোজা ঢুকে পড়েছেন কথিত সর্বদলীয় মন্ত্রিসভায়। আট মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে তিনি একাই পেয়েছেন পাঁচখানা পদ। যে একজনকে মাত্র উপদেষ্টা করেছেন প্রধানমন্ত্রী তিনিও গেছেন জাতীয় পার্টি থেকেই (পরে অবশ্য আনোয়ার হোসেন মঞ্জুও উপদেষ্টার পদ পেয়েছেন)। এরশাদের ভাই জিএম কাদেরও মন্ত্রীর পদে বহাল রয়েছেন। ফলে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, কত বেশিজনকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী করা হবে তা নিয়েই এতদিন দরকষাকষি করেছেন এরশাদ। শেখ হাসিনাও যথেষ্ট লম্বা মুলাই ঝুলিয়েছেন তার সামনে। সেজন্যই বেহেশতের কথা ভুলে বঙ্গভবনে গিয়ে হাজির হয়েছেন এরশাদ। দোহাই দিয়েছেন গণতন্ত্র রক্ষার এবং সংবিধানকে সমুন্নত রাখার!
এরশাদের এই ডিগবাজি নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা চললেও আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যকার সম্পর্ক কিন্তু বহু বছরের। এই সম্পর্ক বন্ধুত্বের এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার। ১৯৮২ সালের মার্চে সেনা প্রধান হিসেবে জেনারেল এরশাদ যখন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তখন আওয়ামী লীগ তাকে সমর্থন যুগিয়েছিল। বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ এরশাদের অবৈধ অভুত্থানকে সমর্থন জানিয়েছিল। ক্ষমতা থেকে বিএনপির বিদায়ে উল্লসিত হয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিনি ‘আনহ্যাপি’ নন। শেখ সেলিম সম্পাদিত দলটির মুখপত্র দৈনিক ‘বাংলার বাণী’ প্রথম পৃষ্ঠায় বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল (২৫ মার্চ, ১৯৮২)। অবৈধ সামরিক শাসনের পরবর্তী নয় বছরে নানা কৌশলে এরশাদকে রক্ষাও করেছিল আওয়ামী লীগ। বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে এটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, ২১ মার্চ গভীর রাতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার একদিন আগেও শেখ হাসিনা বলেছিলেন, পাঁচ দফার ভিত্তিতে চলমান আন্দোলনকে পাশ কাটিয়ে যারা স্বৈরাচারীর নির্বাচনে অংশ নেবে, তাদের ‘জাতীয় বেঈমান’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। কিন্তু নিজেই নিজের সে ঘোষণার উল্টো কাজ করেছিলেন শেখ হাসিনা। সেবার সংসদে ৭৬টি আসনসহ প্রথমবারের মতো সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী হয়ে শেখ হাসিনা এরশাদের অবৈধ শাসনকে বৈধতা দিতে সাহায্য করেছিলেন। ১৯৯১-৯৬ সময়কালে জাপা ও আওয়ামী লীগ একযোগে আন্দোলন করেছে, ২০০১ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে এরশাদ চার দলীয় জোটের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভূমিকা পালন করেছেন। লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাস থেকে ডিজিটাল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারেও এরশাদ খুবই ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন।
পাঠকদের মনে পড়তে পারে, দল দুটির মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতা হয়েছিল ২০০৮ সালের জুলাই মাসে। ঘটনাস্থল ছিল লন্ডন। সে সময় গুঞ্জনে শোনা গিয়েছিল, শেখ হাসিনার সঙ্গে লন্ডনে এরশাদের বৈঠক হয়েছে। সেবার ঢাকায় ফিরে এরশাদ বলেছিলেন, শেখ হাসিনাকে তিনি ‘বোন’ ডেকেছেন। সুতরাং ‘বোনের’ সঙ্গে ‘ভাইয়ের’ বৈঠক হয়ে থাকলে তাতে ‘দোষের’ কিছু থাকতে পারে না। এরশাদ আরো বলেছিলেন, জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোটে ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এরশাদ একই সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, মহাজোট বিজয়ী হলে তিনিই দেশের প্রেসিডেন্ট হবেন। এরশাদ তখন আরো বলেছিলেন, এ শুধু তার ইচ্ছা নয়, শেখ হাসিনাও তাকে প্রেসিডেন্ট পদে মেনে নিতে রাজি হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট বানানোর শর্তেই জাতীয় পার্টি মহাজোটে থাকবে বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন এরশাদ। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে হাসতে হাসতে এরশাদ বলেছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হতে ‘প্রস্তুত’ আছেন!  নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তুলে ধরাসহ এরশাদের বিভিন্ন বক্তব্য ও ঘোষণা সে সময় ১৪ দলীয় জোটে তীব্র টানাপোড়েনের সৃষ্টি করেছিল। বাম দলগুলো এ কথা পর্যন্ত বলেছিল যে, তারা আর ১৪ দলে থাকবে কি না তা নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ, তাদের বিচারে জাতীয় পার্টি একটি ‘অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক দল’ এবং এরশাদ একজন ‘স্বৈরশাসক’। অন্যদিকে ‘ভগিনীর’ দল আওয়ামী লীগ প্রথম থেকেই কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও পরবর্তীকালের রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, এরশাদকে ‘কোনোক্রমেই’ বাদ দেয়া সম্ভব নয়। জিল¬ুর রহমান শুধু এটুকু বলাই বাকি রেখেছিলেন যে, প্রয়োজনে ১৪ দলের সবাই চলে যেতে পারে, কিন্তু এরশাদের জাতীয় পার্টিকে ছাড়া আওয়ামী লীগের চলবে না।
সেই থেকেই জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের সুসম্পর্ক ক্রমাগত কেবল সুদৃঢ়ই হয়েছে। ঘটনাপ্রবাহে অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা, জনপ্রিয়তা ও উদ্দেশ্যসহ নানাদিক নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, এখনো হচ্ছে। কারণ, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ‘বড় দল’ আওয়ামী লীগ খুব সহজে কারো সঙ্গে হাত মেলায়নি। চার দলীয় জোট সরকারের শেষ দিকে এসে সে দলটিই যখন আগ বাড়িয়ে নাম সর্বস্ব কয়েকটি দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল তখন আর বুঝতে বাকি থাকেনি যে, জোট না করে আওয়ামী লীগের কোনো উপায় ছিল না। কারণ, ২০০১ সালের নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর থেকে চারদলীয় জোট সরকারকে ‘ফেলে’ দেয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে দেখেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু জনগণ তার সমর্থনে এক পা-ও এগিয়ে যায়নি। এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব অর্জন করেছিল এরশাদের জাতীয় পার্টি। এর কারণ নির্বাচনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গী অন্য দলগুলোর তুলনায় জাতীয় পার্টি ছিল সম্ভাবনাময় একটি দল। অষ্টম সংসদেও জাতীয় পার্টির ১৪ জন এমপি ছিলেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ যে দলগুলোকে নিয়ে ১৪ দলীয় জোট করেছিল সে দলগুলো সবাই মিলেও জাতীয় পার্টির কাছাকাছি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এসব দলের প্রধান নেতারাও কখনো নির্বাচিত হয়ে সংসদে যেতে পারেননি। এজন্যই আওয়ামী লীগ এরশাদের দিকে হাত বাড়িয়েছিল। এরশাদও সুযোগ নিতে ছাড়েননি, যদিও শেষ পর্যন্ত তাকে প্রবীণ নেতা জিল্লুর রহমানের কাছে পরাস্ত হতে হয়েছিল। ‘প্রস্তুত’ থাকলেও ‘ভগিনী’ শেখ হাসিনা লন্ডনের সমঝোতা অনুযায়ী এরশাদকে রাষ্ট্রপতি বানাননি।
সেই দুঃখে মাঝে-মধ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও এবং সবশেষে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বেহেশতে যেতে অসম্মতি জানালেও এরশাদই আবারও শেখ হাসিনার জন্য ‘সেভিয়ার’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। একই কারণে আওয়ামী লীগের দুরবস্থাই আবারও প্রাধান্যে এসেছে। কারণ, সীমা ছাড়ানো দুর্নীতি, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার, রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যক্কারজনক দলীয়করণ, পুলিশ ও র‌্যাবকে দিয়ে বিরোধী দলের ওপর নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতন, দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে গুম-খুন, গণমাধ্যমের টুঁটি টিপে ধরা এবং ভারতের স্বার্থ উদ্ধার করার মতো বিভিন্ন কর্মকা-ের অভিযোগে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন এতটাই নিচে নেমে এসেছে যে, তাকে ওপরের দিকে তুলে আনা সম্ভব নয়। অর্থাৎ নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেও শেখ হাসিনার পক্ষে আবারও ক্ষমতায় আসার শখ পূরণ করা সম্ভব হবে না। এজন্যই শেখ হাসিনা এরশাদের দিকে হাত বাড়িয়েছেন। এরশাদও কড়ায় গন্ডায় আদায় করে নিয়েছেন। তাই বলে পর্যবেক্ষকরা অবশ্য মনে করেন না যে, ডিগবাজি এবং বিশ্বাসঘাতকতার জন্য কুখ্যাত হয়ে ওঠা এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে গ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা আবারও ক্ষমতায় আসতে পারবেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads