বুধবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৩

আওয়ামী লীগ : তত্ত্বাবধায়ক সরকার : গণতন্ত্র


জনগণ বহু দিন ধরেই এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কালাতিপাত করছে। সমাজের সব ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতি ও সরকারের নজিরবিহীন ব্যর্থতায় মানুষ আজ জর্জরিত। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস-বিদ্যুতের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি, হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ইত্যাদির কারণে জনমানুষের আস্থা সরকারের প্রতি ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এই অবস্থার মধ্যেই সংসদ নির্বাচনের কাউন্ট ডাউনশুরু হয়েছে। নির্বাচনকে ঘিরেই জনমনে উদ্বেগ ও আতঙ্ক। উচ্চ আদালতের একটি রায়ের অংশবিশেষকে অবলম্বন করে সরকার এককভাবে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী এনে চরম অস্বস্তিকর অবস্থায় দেশবাসীকে ফেলে দিয়েছে বলে সবাই মনে করে। প্রধানমন্ত্রী বারবারই বলছেন, তিনি সংবিধানের ভেতরে থেকেই আগামী নির্বাচন করবেন এবং একচুলও নড়বেন না। অন্য দিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে যাতে জিততে পারে, সেই কারণেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনেছে। নিরপেক্ষ নিদর্লীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনকালে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে না এবং বিরোধী দল কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। প্রশ্নবিদ্ধ পঞ্চদশ সংশোধনী আওয়ামী লীগ কেন এনেছে কারণ খুঁজতে গেলে অতীতের কিছু ঘটনা উল্লেখ করতে হবে। ৭ মার্চ ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান। ওই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির আশ্রয় গ্রহণ করা হয় বলে অভিযোগ আছে। অনেক নেতাকেই কারচুপির মাধ্যমে পরাজিত করা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন আলীম আল রাজী, অলি আহাদ, রাশেদ খান মেনন, শাজাহান সিরাজ, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব:) এম এ জলিলসহ আরো অনেকে। কুমিল্লার দাউদকান্দি আসনে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয় জাসদের ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রশীদকে। কিন্তু পরে হেলিকপ্টারে কিছু ব্যালট পেপার ঢাকায় এনে সিল দিয়ে জয়ীঘোষণা করা হয় আওয়ামী লীগের খন্দকার মোশতাক আহমদকে। ভোলার লালমোহনে বর্তমানে বিএনপির অন্যতম সহসভাপতি মেজর (অব:) হাফিজউদ্দিনের বাবা ডা: আজহার উদ্দিনকে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার আগে অপহরণ করে আটক রাখা হয়। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময়সীমা পার হওয়ার পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। এভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ। নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়নির্বাচত হন কামরুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জিল্লুর রহমান প্রমুখ। আওয়ামী লীগ সে দিন কারচুপির আশ্রয় ছাড়াই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেত বলে সবার ধারণা ছিল। তবুও জোর খাটিয়ে নির্বাচন করায় দলের ইমেজ ুণœ হয়। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে সংসদীয় গণতন্ত্র রক্ষা পেত। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত বাংলাদেশ চলছিল অস্থিতিশীল অবস্থার ম্যধ দিয়ে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশ ছিল চরম সঙ্কটে। রাস্তাঘাটে লাশ হয়ে পড়ে থাকত মানুষ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল নাজুক। হত্যা, গুম, চুরি ও ডাকাতি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এই অবস্থার মধ্যে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশালচালু করা হলো। সব দল নিষিদ্ধ, জনগণের মৌলিক অধিকার স্থগিত, চারটি বাদে সব সংবাদপত্র বন্ধ এবং বিচারব্যবস্থাকে নির্বাহী কর্তৃত্বের আওতায় আনয়ন করা হলো। চলমান জাতীয় সংসদের মেয়াদ দুই বছর বৃদ্ধি করা হয় কোনো নির্বাচন ছাড়াই। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠনের সময় থেকেই প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলায় অরাজকতা বিরাজ করতে থাকে। ১৯৭৪ সালে কয়েক লাখ লোক দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণ করেছিল। সরকার পাঁচ হাজার ৮৬২টি লঙ্গরখানা খোলে। লজ্জা নিবারণের জন্য বাসন্তীর জাল পরে থাকার চিত্র ছাপা হয় পত্রিকায়। কাফনের কাপড়ের অভাবে কলাপাতা মুড়ে লাশ দাফন হতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন এবং তারই মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হন। মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যও মুজিব মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। তখন বিএনপি নামে কোনো দলের অস্তিত্বই ছিল না। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনীর আরেকটি অংশ ১৫ আগস্টের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটায় এবং মেজর জেনারেল জিয়াকে আটক করে। ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার বিপ্লবে জিয়া মুক্ত এবং কিছু পরে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান নির্বাচিত হন রাষ্ট্রপতি। তিনি সংবিধানে একাধিক সংশোধনী এনে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনর্বহাল করেন। আওয়ামী লীগ ও অন্য দলগুলোকে আবার রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। খন্দকার মোশতাক জারিকৃত সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জাস্টিস আবদুস সাত্তারকে সরিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল এবং সামরিক আইন জারি করেন। এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর শেখ হাসিনা মন্তব্য করেন আমি অখুশি নই। ৭ মে ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে এরশাদবিরোধী সব দল নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়; কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত শেষ মুহূর্তে এ নির্বাচনে অংশ নেয়। ১৯৯০ সালের অক্টোবর সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য পরিষদ গঠিত হয়। নভেম্বরের মধ্যে এই পরিষদের প্রচেষ্টায় বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোট, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৮ দলীয় জোট ও ৫ দলীয় বামপন্থী জোট এক ঘোষণার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং তিন জোটের সাথে জামায়াতে ইসলামীও ওই সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করে। এরশাদ তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জাস্টিস সাহাবুদ্দীনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন। তার নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনতার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সংসদীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করেন। বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠনে জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন দিলে আওয়ামী লীগ ুব্ধ হয়। ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি মাঠে নামে এবং বিএনপি সরকার গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে। ফলে জামায়াতের সাথে বিএনপির দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ২০ মার্চ ১৯৯৪ সালে মাগুরায় উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। সে দাবিতে ১৭৩ দিন হরতাল হয়েছিল, ঢাকা-চট্টগ্রাম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং চট্টগ্রাম বন্দর সাময়িকভাবে অচল ছিল। বিরোধী জোট বিএনপি সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দেয় এবং সংসদ বর্জন শুরু করে। একপর্যায়ে তারা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করে। ওই রূপরেখার প্রধান বিষয় ছিল, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করবেন এবং সংসদের সব সদস্যের সাথে আলোচনা করে রাষ্ট্রপতি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন। তিনি সংবিধানে ৫৫ ধারা অনুযায়ী প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন তিনি ও তার মন্ত্রিসভার কেউ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না এবং কোনো দলের সদস্য হতে পারবেন না। উল্লেখযোগ্য, পঞ্চম সংসদে জামায়াতে ইসলামী সংসদীয় নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি দিবসে সব সংসদীয় নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানসংক্রান্ত একটি বিল উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি ১৯৯৩ সালে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত বিল পৃথকভাবে সংসদে জমা দেয়। নভেম্বর ১৯৯৫ সালে বিরোধী দল পরপর ছয় দিন লাগাতার হরতালও পালন করে। ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর ১৫৩ জন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য একযোগে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। এই সময়ে কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেল ঢাকায় সফরে এলে দুই পক্ষের কাছে আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসার জন্য মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিলে উভয় পক্ষই রাজি হন এবং সেক্রেটারি জেনারেল তার প্রতিনিধি হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ান স্টিফেনকে ঢাকায় পাঠান। নিনিয়ান ঢাকায় সব পক্ষের সাথে আলোচনা করে সমাধানের নিমিত্তে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব দেন। একটি প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১১ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়। মন্ত্রিসভায় সরকার ও বিরোধী দল থেকে সমান প্রতিনিধিত্ব রাখার ব্যবস্থা রেখে বলা হয়, একজন নির্দলীয় ব্যক্তি মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হবেন যিনি স্বরাষ্ট্র, তথ্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকবেন। বিএনপি ওই প্রস্তাব মেনে নিলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দল তিনটি প্রস্তাবের কোনোটাতেই রাজি না হয়ে প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার পদত্যাগের দাবিতে অনড় থাকে। এর পরেও সমস্যার নিরসনে ১১টি উদ্যোগ নেয়া ছাড়াও ২১টি বিভিন্ন ফর্মুলা পেশ করা হয়। খালেদা জিয়ার পদত্যাগের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের অনড় অবস্থার কারণে সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর বেগম জিয়ার অনুরোধে রাষ্ট্রপতি ১৯৯৫ সালের ২৫ নভেম্বর অর্থাৎ মেয়াদ শেষ হওয়ার চার মাস আগে পঞ্চম সংসদ ভেঙে দেন। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিধান রেখে একটি বিল আনার মানসে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সব বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করে। বিএনপি সরকার ভবিষ্যতে সব সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার ব্যবস্থা রেখে সংশোধনী এনে একটি বিল আনে। ১৯৯৬ সালের ২১ মার্চ ভোরে সেটি পাস হয়। এটিই ত্রয়োদশ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত। ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ বেগম জিয়া পদত্যাগ করেন এবং জাস্টিস মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান নির্দলীয় সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নেন। আওয়ামী লীগ ষষ্ঠ সংসদকে অবৈধ ঘোষণা করেছিল। তবে সেই সংসদ প্রণীত আইন মোতাবেক, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনেই তারা নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকার গঠন করে। তাদের এই মেয়াদকালে অর্থাৎ ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ একটিবারও জামায়াত নেতাদের সম্পর্কে যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী অপরাধসংক্রান্ত কোনো কথা বলেনি। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবে, এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। জাস্টিস কে এম হাসানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার কথা থাকলেও তিনি এক সময় বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন’, এই অজুহাত তুলে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে আবারো প্রচণ্ড ঝড় তোলে। ২৮ অক্টোবর ২০০৬ সালে আওয়ামী কর্মীরা লগি-বৈঠা নিয়ে রাজপথে নামে এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়। তখন ছয়জন জামায়াত কর্মী মৃত্যুবরণ করেন। রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বিএনপির রাজনীতির সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে যদি জাস্টিস কে এম হাসান নির্বাচনকালীন সময়ের সরকারপ্রধান হতে আপত্তি থাকে, তাহলে এখন একজন দলীয় প্রধান অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সভাপতির অধীনে নির্বাচনে অন্যান্য দলের আপত্তি থাকার অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। সুপ্রিম কোর্টের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ১০ মে ২০১১ সালে (৪-৩) সংক্ষিপ্ত ও বিভক্ত রায়ে (৪-৩) সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করেন। তবে সাথে দুটি অভিমত ব্যক্ত করা হয়। প্রথমত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে সংসদের দুটি নির্বাচন হতে পারে। তারা উল্লেখ করেন যে, আইনের বহু পুরনো নীতি হচ্ছে, কোনো কিছু বেআইনি হলেও প্রয়োজনের তাগিদে তা আইনসম্মত। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তাই হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। দ্বিতীয়ত, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের প্রধান উপদেষ্টার পদে নিয়োগের বিধান সংশোধনের স্বাধীনতা সংসদের রয়েছে। মাননীয় আদালত আরো পর্যবেক্ষণ দেন যে, নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। তবে সংসদ এ সময়সীমা ৩০ দিন কমানো বা ৬০ দিন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য জাতীয় সংসদে ২১ জুলাই ২০১০ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারপারসন ও মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কো-চেয়ারপারসন করে মহাজোটের আরো ১৫ সংসদ সদস্যবিশিষ্ট বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ২৭টি বৈঠক করে এবং তিনজন প্রধান বিচারপতি, ১০ জন আইনজীবী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও লে. জেনারেল (অব:) এরশাদসহ ছয়টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, ১৮ জন বুদ্ধিজীবী, ১৮ জন সম্পাদক এবং সেক্টর কমান্ডার ফোরাম সদস্যদের মতামত গ্রহণ করা হয়। বিশেষ কমিটির ২৯ মার্চ ২০১১ তারিখের ১৪তম সভায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অপরিবর্তিত রাখার বিষয়ে ঐকমত্য হয়। ১০ মে ২০১১ সালে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের রায় বের হওয়ার পর সংবিধান সংশোধন কমিটি একটি লিখিত সুপারিশে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার অন্য কোনো রাষ্ট্রের সাথে কিংবা দেশী-বিদেশী চুক্তি সম্পাদন না করার এবং ইতঃপূর্বে সম্পাদিত কোনো চুক্তির মেয়াদ নবায়ন করতে পারবে বলে উল্লেখ করে। পরবর্তী সংসদে এটি অনুমোদনের বিধান রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে বহাল রাখার পক্ষে কমিটি সর্বসম্মতভাবে সুপারিশ করেছিল। জাতির জন্য চরম বিপর্যয়ের ব্যাপার হলো, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পক্ষে সুপারিশের পরদিনই অর্থাৎ ৩০ মে কমিটি সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন; কিন্তু চরম বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বৈঠকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। এটা ছিল প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্ত। ৩০ জুন সংসদে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস হয় যার মাধ্যমে দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলোপ হয়ে যায়। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গণতন্ত্র রক্ষার একটি কার্যকর পদ্ধতি। এর প্রতি দেশবাসীরও ব্যাপক সমর্থন আছে। অনেকে বলেছেন যে, রায়ের বাইরে যেসব পর্যবেক্ষণ থাকে সেগুলো অবশ্য পালনীয় নয়। অর্থাৎ তারা বলতে চান রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা বিবেচ্য বিষয়ই নয়। প্রশ্ন হলোÑ অবশ্য পালনীয় না হলে মাননীয় বিচারপতিরা তাদের আদেশে পর্যবেক্ষণ বা মতামত দেন কেন? সাবেক প্রধান বিচারপতি জাস্টিস খায়রুল হকও এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘যদি আমাদের দেয়া পর্যবেক্ষণগুলো বিবেচনা করা হয়, তাহলে আমাদের রায়ের মধ্যেই সব সমস্যার সমাধান দেয়া আছে। আমরা যদি আমাদের রায়ে সমস্যা সমাধানের কোনো প্রক্রিয়া উল্লেখ না করতাম, তাহলে এটা বলা যেত যে, আমরা সমস্যা থেকে দূরে সরে গেছি।’ (ঢাকা ট্রিবিউন, ১৮ মে ২০১৩) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে বলতে হয়, জনগণের মনের প্রতিফলনই দেশের সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকে। তাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালের ২১ মার্চ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সবার অংশগ্রহণের ব্যবস্থার নিশ্চয়তা রেখে দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। সম্প্রতি দৈনিক ডেইলি স্টার ও এশিয়া ফাউন্ডেশনের যৌথ জরিপে দেখা যায়, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষই মনে করে নির্বাচন হওয়া উচিত দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। মহাজোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে এক মহাজটের সৃষ্টি করেছে। যেহেতু তারা সরকারে, সেহেতু তাদেরই এ মহাজট খোলার দায়িত্ব অনেক বেশি। মনে রাখতে হবে, আদালত দেশ চালায় না। আদালত আইনের ব্যাখ্যা দেয়। আর এই সংবিধান সংশোধনযোগ্য। দেশ ও জনগণের স্বার্থেই সময়ে সময়ে সংবিধান সংশোধিত হয়। জনগণের স্বার্থেই প্রয়োজন আগামী নির্বাচন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা। সে জন্য যদি আবার সংবিধান সংশোধন করতে হয়, তা অবশ্যই করতে হবে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে আহ্বান জানাব, দেশনেত্রী বেগম জিয়ার নেতৃত্বে যে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম শুরু হয়েছে, জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে আসুন, সেই সংগ্রামকে সাফল্যমণ্ডিত এবং নির্বাচনকে অর্থবহ করে তুলি। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads