প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকার কর্তৃক কথিত ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন উপলক্ষে গতকাল আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় বিদ্যুৎ সপ্তাহ এক আলোক উৎসবের উদ্বোধন করেছেন। সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই উৎসব পালিত হয়। বলাবাহুল্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মন্ত্রণালয়ের সার্বিক দায়িত্ব পালন করছেন এবং একজন প্রতিমন্ত্রী ও একজন উপদেষ্টা এক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই উৎসব উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা ঝলমল করে উঠে। পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী লাল, সবুজ, সোনালী, রূপালী আতসবাজির সঙ্গে লেজার শো আকাশকে রঙিন করে তোলে। সরকারের পূর্বঘোষণা ও আয়োজন অনুযায়ী হাতিরঝিলের আড়ং সংলগ্ন সেতুর কাছে উৎসবের উৎসস্থল সন্ধ্যার মধ্যেই লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে এবং ৭টা ২৭ মিনিটে শুরু হয় আতসবাজি। এরপর শুরু হয় লেজার শো। সব মিলিয়ে ১৩ মিনিট পর্যন্ত চলে এই প্রদশর্নী। এই পুরো সময়টা জুড়ে জ্বলেছিল ১০,০০০ লেখা একটি প্রতিকৃতি সময়ের সাথে সাথে তা রং বদলাচ্ছিল। জানা গেছে, যে আলো ঝলমল এই অনুষ্ঠান হাতিরঝিল এলাকার বেশকিছু বাসিন্দা এবং সমাগত অতিথিদের যেমন মনোরঞ্জন করেছে তেমনি আতসবাজির অব্যাহত বিকট শব্দ শিশু, বৃদ্ধ এবং এলাকার অসুস্থ রোগীদের জন্য আতঙ্কেরও সৃষ্টি করেছে। আমরা মনে করি, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের কথিত সাফল্য ও রেকর্ড উৎপাদন সরকারের শেষ সময়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করার মতো কোনও বিষয় নয়। সরকার যদি এক্ষেত্রে সফল হয়ে থাকেন তাহলে মানুষ অবশ্যই তা দেখবে, অনুভব করবে এবং সরকারকে পুরস্কৃত করবে। আতসবাজি পুড়িয়ে ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি করে সাফল্যের প্রচার কাম্য হতে পারে না। আবার দেশের সরকারপ্রধান তথা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক আতসবাজি অনুষ্ঠান উদ্বোধন এদেশে সম্ভবত এই প্রথম। একটি মুসলিম দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের ধর্মবিশ্বাস ও চেতনার সাথে এটা খাপ খায় না।
এখানে স্মর্তব্য যে, আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ২০১৩ সালের মধ্যে ৭ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু দেশের মানুষ জানে যে তাতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। গত ৫ বছরে দেশের হাজার হাজার শিল্প ইউনিট বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারেনি। গ্যাস- বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় সাধারণ নাগরিক ও ডেভেলপারদের তৈরি বাড়ি-ঘর, ফ্ল্যাট-এপার্টমেন্ট বসবাস উপযোগী না হওয়ায় বিক্রি, হস্তান্তর অথবা ভাড়া দেয়া যাচ্ছে না। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ লোডশেডিং-এ অতিষ্ঠ ছিলেন। এখন শীতকাল শুরু হয়েছে। বাসা বাড়ি, অফিস-আদালত ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বৈদ্যুতিক পাখা ও এসির ব্যবহার ব্যাপক হারে কমে গেছে। এই অবস্থায় এসে সরকার প্রথমে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ও পরে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাফল্য উদযাপন করছেন। এটা একদিকে যেমন হাস্যস্পদ অন্যদিকে জনগণের সাথে প্রতারণা বলে আমরা মনে করি। শীতকালে বিদ্যুৎ চাহিদা কম থাকায় সরকারি দাবির যথার্থতা নির্ণয় করা কঠিন বলেই তারা মিথ্যাচারের জন্য এই সময়টি বেছে নিয়েছেন।
এখানে সরকারি দলিলপত্র বিশেষ করে ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় পরিবেশিত পরিসংখ্যানকে আমরা প্রণিধানযোগ্য বলে মনে করি। এতে দেখা যায় যে, ২০১৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে ৬৩৫০ মেগাওয়াট। জানুয়ারির পর থেকে নবেম্বর পর্যন্ত উভয় খাতে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহের (সবগুলো যদি নির্ধারিত সময়ে চালু হয়) স্থাপিতব্য উৎপাদন ক্ষমতার সবটাই যদি উৎপাদন ধরা হয়, তাহলে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৫১ মেগাওয়াট। ৬৩৫০ মেগাওয়াটের সাথে ৯৫১ মেগাওয়াট ও ভারত থেকে আমদানিকৃত ৫০০ মেগাওয়াট যোগ করলে মোট উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৭৮১ মেগাওয়াট। এটাও আবার নির্ভরযোগ্য উৎপাদন নয়। এই অবস্থায় মানুষের সাথে অসত্য তথ্য পরিবেশন ও বায়বীয় সাফল্যগাঁথা প্রচার না করার জন্যই আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন