সাংবিধানিকভাবে আগামী ২৪ জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন
অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সেই হিসেবে নির্বাচনের আর মাত্র আড়াই মাস বাকি। সর্বদলীয়
সরকার গঠনের সুযোগ দেয়ার জন্য মন্ত্রীরা ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের
পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। নির্বাচনের এই মওসুমে রাজনৈতিক দল এবং দলীয় প্রার্থী, সমর্থক, কর্মীদের সরব উপস্থিতি লক্ষ
করার কথা নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায়। শুধু আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে
মনোনয়নপত্র বিক্রির শুরুর কারণে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের শোডাউন লক্ষ করা যাচ্ছে। অন্য
রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনের ব্যাপারে তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কোথায় গেল
সেই পরিবেশ?
প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতাকর্মীরা এখন পুলিশি হয়রানি ও গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বিরোধীদলীয় নেতার বাসভবন ও অফিস এক প্রকার অবরুদ্ধই বলা যায়। নির্বাচনের উৎসবমুখর পরিবেশের বিপরীতে এখন হরতাল, জ্বালাও পোড়াও, মানুষ হত্যা, বন্দুক তাক করে পুলিশের অ্যাকশন চলছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে কোনো ধরনের সরকার থাকবে, তা নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় দেশবাসী উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে। আমরা নিশ্চিত বলতে পারছি না, দেশ কোন দিকে যাচ্ছে? এমতাবস্থায় গত ১৮ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। দেশবাসী অধীর আগ্রহ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ওই ভাষণ শোনে। আমরা আশা করেছিলাম প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে যে যোজন যোজন মতপার্থক্য রয়েছে, তার অবসানে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেবেন। দেশবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। বলা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে সে রকম সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। সংবিধানের দোহাই দিয়ে শুধু দলীয় সরকারের পরিবর্তে ‘সর্বদলীয়’ সরকারের প্রস্তাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে একটা অস্বচ্ছ বলয়ের মধ্যে ফেলে দেন।
কোনো একটা বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা না দিলে মাঝে মধ্যে তা ইতিবাচক হিসেবেও চিহ্নিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে সর্বদলীয় সরকার প্রধানের বিষয়টি অন্ধকারে রাখা এক হিসেবে ভালোই ছিল। ফলে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে অনেকেই স্বাগত জানিয়ে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট কেটে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। বিভিন্ন জন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। তবে অন্ধকার বা অস্বচ্ছ বলয় কেটে যায়, পরদিন মহাজোট সরকারের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানকে নৈশভোজে দাওয়াত করে যখন প্রকাশ করেন যে সর্বদলীয় সরকারের প্রধান হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বহাল থাকবেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের প্রেস ব্রিফিংয়ে কথা প্রকাশ হলে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ জাতিকে চরমভাবে হতাশ করে। সম্ভাবনার কথামালার সব আলোচনা থেমে যায়।
বিরোধী দল সঙ্গত কারণেই প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের বিপরীতে নতুন প্রস্তাব দেন। বিরোধীদলীয় নেতার এ প্রস্তাবে চলমান নিরসনের একটি দিকনির্দেশনা আছে। সরকারি দলের পক্ষ থেকে বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাবনা নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা হচ্ছে। দেশবাসী অবশ্য মনে করে সরকারি দল ও বিরোধী দলের এ নিয়ে দ্রুত আলোচনায় বসার বিকল্প নেই। সময় একেবারে নেই বিবেচনা করে বিরোধীদলীয় নেতা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন। বিরোধীদলীয় নেতা এখানে নির্দিষ্ট করে বলেন, সরকারি দল ও বিরোধী দল উল্লিখিত সময়ের উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করবে এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন হবেন এ সরকারের প্রধান। বর্তমানে জাতীয় সংসদের স্পিকার এক অর্থে অনির্বাচিত। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হয়ে পরাজিত হয়েছিলেন। স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন সংসদ সদস্যদের ভোটে।
প্রধানমন্ত্রীর একদল উপদেষ্টা সবাই অনির্বাচিত। সরকারি দলের নেতৃবৃন্দের কাছে এ অনির্বাচিত ব্যক্তিদের প্রীতির শেষ না থাকলেও তারা এখন সর্বত্র নির্বাচিত ব্যক্তির পক্ষে স্তুতি গাইছেন। এ জন্য বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচনকালীন তার প্রস্তাবকৃত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য মনোনীত ব্যক্তিদের প্রয়োজনে জাতীয় সংসদের সদস্যদের মাধ্যমে নির্বাচিত করার উদ্যোগ নেয়ার জন্য সরকারি দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে এখন সরকারি দল বিরোধী দলের দু’টি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দল এখানে প্রস্তাব উত্থাপন করায় আলোচনার সুযোগ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করি। কোনো দলের কোনো প্রস্তাবই পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়। দেশবাসী মনে করে দুই পক্ষের আলোচনার মধ্যেই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং টেকসই একটি ফর্মুলা বের হয়ে আসবে।
বিএনপি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার তা যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, সেই সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে মানববন্ধন, সভা, সমাবেশ, হরতাল, অবরোধ প্রভৃতি ধরনের কর্মসূচি পালন করে আসছে। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার গঠনের পর সংবিধান সংশোধন না করলে ২৪ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে বর্তমান সরকার ও জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু বিএনপি বর্তমান সরকারের ওই সংশোধনী অগ্রাহ্য করে ২৪ অক্টোবরের পর বর্তমান সরকারের কর্তৃত্ব আর মানতে চাইছে না। বিরোধী দল পাড়া, মহল্লা, এলাকায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করেছে। দলীয় নেতাকর্মীরা রাজপথে আন্দোলনে নেমে জেল, কারাগারে গেলে পরবর্তী নেতৃত্বও নির্ধারণ করে। এমনতর পরিবেশ পরিস্থিতিতে দেশবাসী যখন শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন, তখন প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে ভাষণ ছিল জনসাধারণের ইচ্ছের বিপরীত। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত সরকার চায়। সরকারের কাছে এ বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য না হলে এ ব্যাপারে গণভোট দেয়ারও আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু সরকার এ বিষয়টি বুঝতে অপারগ। ক্ষমতা ছেড়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে নেমে নির্বাচন করতে সরকারের যত ভয়, তা সবার কাছে স্পষ্ট। এ কারণে চলমান সঙ্কট উত্তরণে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ছিল অন্তঃসারশূন্য।
আমাদের মনে হয়, বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনার মনে যে ভীতিসঞ্চার করেছে, সেই নির্বাচনে করুণ পরাজয়ের সেই ভয় আওয়ামী লীগকে এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। যেভাবেই হোক ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা থেকে আওয়ামী লীগ বের হয়ে আসতে পারছে না। এ জন্য সরকারপ্রধানের পদটি শেখ হাসিনা কিছুতেই ছাড়তে চাইছেন না। ফলে প্রধানমন্ত্রীর মুখে থেকে জনদাবির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতার কোনো প্রস্তাব থাকলে তা সংসদে গিয়ে দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন। এটি একটি রাজনৈতিক কৌশল ছাড়া অন্য কিছু নয়। সংসদে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। বিরোধী দলের এ সম্পর্কিত প্রস্তাব কণ্ঠভোটেই বাতিল হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। সরকারি দল এ কৌশলটি প্রয়োগ করতে পিছপা হবে না।
তর্কের খাতিরে বিরোধী দল সরকারের এ প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে গত ২৩ অক্টোবর সংসদে যায় এবং বিএনপির সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে আলোচনার জন্য উত্থাপন করেন। এ সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক বক্তব্যে বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য এম কে আনোয়ার বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাবকৃত বিগত সময়ের দু’টি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য সম্মানিত ব্যক্তির ও নির্বাচনকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ আছে বলে জানান। বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা চলমান সঙ্কট নিরসনে সরকারি দলের আন্তরিকতা কামনা করে দ্রুত এ ব্যাপারে সংসদের বাইরে আলোচনা শুরুর আহ্বান জানান।
সরকারি দলের পক্ষ থেকে তোফায়েল আহমেদ, শেখ সেলিম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রমুখ বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাবের খুঁটিনাটি নিয়ে সমালোচনা করেন এবং এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আমরাও বলতে পারি, বিরোধী নেতার প্রস্তাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। রয়েছে সীমাবদ্ধতাও। বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাবে মনে হওয়া স্বাভাবিক, এ নির্বাচন শেষে পরবর্তী নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে, তা উল্লেখ নেই। তখনো কি একই সমস্যা সৃষ্টি হবে না? এসব প্রশ্নের উত্তর সেখানে নেই।
আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের বিপরীতে বিরোধীদলীয় নেতার এ প্রস্তাব শুধু আলোচনা শুরুর জন্য। আলোচনাতেই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং টেকসই একটি ফর্মুলা বের হয়ে আসবে। বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যগণ এমন আভাস দিয়েছেনও।
সরকারি দলের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে অনমনীয়তা ও অসহিষ্ণুতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সরকার মুখে মুখে গণতন্ত্র এবং নির্বাচিত ব্যক্তিদের প্রতি প্রীতি দেখাচ্ছে। বাস্তবে তারা বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করতে প্রজ্ঞাপন জারি করছে। ঢাকায় সভা-সমাবেশ করার ওপর সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কঠোর কর্মসূচি না দিয়ে জেলা ও থানাপর্যায়ে বিক্ষোভ করেছে। আমরা লক্ষ করছি, বিরোধী দলকে নিয়ে সরকারি দলের মধ্যে একধরনের ভীতি ও অস্থিরতায় রয়েছে। বিএনপির সভা-সমাবেশ ও শক্তির ওপর সরকার দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। সরকারি দলের নেতাকর্মীরা সরকার পতনে বিএনপির আন্দোলনের হুঙ্কারকে কাগুজে বাঘ বললেও দৃশ্যত মনে হচ্ছে বিএনপিকে নিয়ে তাদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। সভা-সমাবেশ করার মধ্য দিয়ে বিএনপি ঢাকার রাজপথ দখলে নেয়ার আশঙ্কা করছে। এ আশঙ্কা থেকেই সরকার দেশে অঘোষিত জরুরি আইন জারি করছে বলে, তা ভুল বলা হবে না। শুধু ঢাকায় নয়, বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরেও সরকার সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এক কথায় সংবিধান ও গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ গণতন্ত্রের জন্য অশনিসঙ্কেত। এ ধরনের অবস্থা দীর্ঘতর হলে জনবিক্ষোভে অনেক পরাক্রমশালী সরকারের পতন হতে আমরা দেখেছি। বাংলাদেশেও এমন ঘটনা ঘটবে না তা কে বলতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে তত্ত্বাবধায়ক জুজুর ভয় দেখিয়ে অনির্বাচিতদের কাছে আর ফিরে না যাওয়ার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। কারচুপিবিহীন ভোটারাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে দলটি আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি সংযুক্ত করার কৃতিত্ব অর্জন করেছে, সুবিধাজনক অবস্থায় থেকে সেই দলটির তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বিলোপের পক্ষে কোনো যুক্তি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সরকারের সমান্তরাল শক্তিশালী কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এখানে নির্বাচন কমিশনকে আরো অধিক শক্তিশালী করার চিন্তা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হতে পারে না। মহাজোট সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে, সুতরাং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে আর অবিশ্বাসের কিছু নেই, এমন বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। সিটি করপোরেশন নির্বাচন কিংবা উপনির্বাচন আর জাতীয় সংসদের মূল নির্বাচন এক কথা নয়। ওই সব নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে সরকার পড়ে যায় না কিংবা এর ফলে বিরোধী দল ক্ষমতায় চলে আসে না। এসব যুক্তি সুবিধাভোগী ছাড়া আর কেউ বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না। রাজনীতিবিদদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, সন্দেহ আর ভোট চুরির প্রবণতা রোধকল্পে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতির যে সূত্রপাত ঘটেছিল, সেই অবস্থার উন্নতি হয়নি। বস্তুগত উন্নতি যেমন, ত্রুটিমুক্ত ভোটার তালিকা হয়েছে, যার ভোট সে দিতে পারছে, অবৈধ বা জাল ভোট দেয়ার সুযোগ দূর হয়েছে, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স হয়েছে। তবে রাজনীতিবিদদের মানসিকতার কোনো উন্নতি হয়নি, বলা যায় অবনতি হয়েছে। এ অবস্থায় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতাকে তার প্রস্তাবিত সর্বদলীয় সরকারের যোগদানের আহ্বান জানাচ্ছেন। এ নিয়ে তিনি বিরোধীদলীয় নেতাকে ফোনও করেছেন। বহুল প্রত্যাশিত ফোনকলটি নিয়ে এখন নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে। ফোনকলের একটি প্রাইভেসি থাকে। এই প্রাইভেসি সরকার উন্মুক্ত করে দিয়ে অনৈতিক কাজ করেছে। ‘ফোনকলটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ, তা জনসাধারণের শোনার অধিকার রয়েছে’ সরকারের এ ভাষ্য সঠিক নয়। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত হতো পারত যদি বিরোধীদলীয় নেতাকে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি আগে অবহিত করতেন। কোনো অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য সরকার ফোন করার এই কৌশল অবলম্বন করছেন বলে অভিযোগ করা হলে, তা খণ্ডন করা যায় না। এই ফোন কলের মাধ্যমে এখন মনে হচ্ছে সরকার সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতার পথ থেকে সরে যাচ্ছে।
বিরোধী দলও বসে নেই। তারা নিয়মিত বিরতি দিয়ে হরতাল করছে। সরকার বিরোধী দলকে আস্থায় আনার কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে হয় না। বিএনপিকে নির্বাচনে আনার ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা প্রশ্নসাপেক্ষ। গত কয়েক দিনের কর্মকাণ্ডে বরং মনে হচ্ছে সরকার বিরোধী দলের প্রতি র্হ্ডা লাইন বেছে নিয়েছে। হরতালের নাশকতার দায় বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের ওপর চাপিয়ে তাদের গ্রেফতার করেছে। এটা যে সমঝোতার পথ নয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার বিএনপিবিহীন একদলীয় নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে, যা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে আরো দীর্ঘায়িত করবে।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতাকর্মীরা এখন পুলিশি হয়রানি ও গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বিরোধীদলীয় নেতার বাসভবন ও অফিস এক প্রকার অবরুদ্ধই বলা যায়। নির্বাচনের উৎসবমুখর পরিবেশের বিপরীতে এখন হরতাল, জ্বালাও পোড়াও, মানুষ হত্যা, বন্দুক তাক করে পুলিশের অ্যাকশন চলছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে কোনো ধরনের সরকার থাকবে, তা নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় দেশবাসী উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে। আমরা নিশ্চিত বলতে পারছি না, দেশ কোন দিকে যাচ্ছে? এমতাবস্থায় গত ১৮ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। দেশবাসী অধীর আগ্রহ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ওই ভাষণ শোনে। আমরা আশা করেছিলাম প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে যে যোজন যোজন মতপার্থক্য রয়েছে, তার অবসানে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেবেন। দেশবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। বলা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে সে রকম সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। সংবিধানের দোহাই দিয়ে শুধু দলীয় সরকারের পরিবর্তে ‘সর্বদলীয়’ সরকারের প্রস্তাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে একটা অস্বচ্ছ বলয়ের মধ্যে ফেলে দেন।
কোনো একটা বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা না দিলে মাঝে মধ্যে তা ইতিবাচক হিসেবেও চিহ্নিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে সর্বদলীয় সরকার প্রধানের বিষয়টি অন্ধকারে রাখা এক হিসেবে ভালোই ছিল। ফলে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে অনেকেই স্বাগত জানিয়ে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট কেটে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। বিভিন্ন জন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। তবে অন্ধকার বা অস্বচ্ছ বলয় কেটে যায়, পরদিন মহাজোট সরকারের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানকে নৈশভোজে দাওয়াত করে যখন প্রকাশ করেন যে সর্বদলীয় সরকারের প্রধান হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বহাল থাকবেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের প্রেস ব্রিফিংয়ে কথা প্রকাশ হলে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ জাতিকে চরমভাবে হতাশ করে। সম্ভাবনার কথামালার সব আলোচনা থেমে যায়।
বিরোধী দল সঙ্গত কারণেই প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের বিপরীতে নতুন প্রস্তাব দেন। বিরোধীদলীয় নেতার এ প্রস্তাবে চলমান নিরসনের একটি দিকনির্দেশনা আছে। সরকারি দলের পক্ষ থেকে বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাবনা নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা হচ্ছে। দেশবাসী অবশ্য মনে করে সরকারি দল ও বিরোধী দলের এ নিয়ে দ্রুত আলোচনায় বসার বিকল্প নেই। সময় একেবারে নেই বিবেচনা করে বিরোধীদলীয় নেতা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন। বিরোধীদলীয় নেতা এখানে নির্দিষ্ট করে বলেন, সরকারি দল ও বিরোধী দল উল্লিখিত সময়ের উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করবে এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন হবেন এ সরকারের প্রধান। বর্তমানে জাতীয় সংসদের স্পিকার এক অর্থে অনির্বাচিত। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হয়ে পরাজিত হয়েছিলেন। স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন সংসদ সদস্যদের ভোটে।
প্রধানমন্ত্রীর একদল উপদেষ্টা সবাই অনির্বাচিত। সরকারি দলের নেতৃবৃন্দের কাছে এ অনির্বাচিত ব্যক্তিদের প্রীতির শেষ না থাকলেও তারা এখন সর্বত্র নির্বাচিত ব্যক্তির পক্ষে স্তুতি গাইছেন। এ জন্য বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচনকালীন তার প্রস্তাবকৃত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য মনোনীত ব্যক্তিদের প্রয়োজনে জাতীয় সংসদের সদস্যদের মাধ্যমে নির্বাচিত করার উদ্যোগ নেয়ার জন্য সরকারি দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে এখন সরকারি দল বিরোধী দলের দু’টি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দল এখানে প্রস্তাব উত্থাপন করায় আলোচনার সুযোগ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করি। কোনো দলের কোনো প্রস্তাবই পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়। দেশবাসী মনে করে দুই পক্ষের আলোচনার মধ্যেই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং টেকসই একটি ফর্মুলা বের হয়ে আসবে।
বিএনপি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার তা যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, সেই সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে মানববন্ধন, সভা, সমাবেশ, হরতাল, অবরোধ প্রভৃতি ধরনের কর্মসূচি পালন করে আসছে। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার গঠনের পর সংবিধান সংশোধন না করলে ২৪ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে বর্তমান সরকার ও জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু বিএনপি বর্তমান সরকারের ওই সংশোধনী অগ্রাহ্য করে ২৪ অক্টোবরের পর বর্তমান সরকারের কর্তৃত্ব আর মানতে চাইছে না। বিরোধী দল পাড়া, মহল্লা, এলাকায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করেছে। দলীয় নেতাকর্মীরা রাজপথে আন্দোলনে নেমে জেল, কারাগারে গেলে পরবর্তী নেতৃত্বও নির্ধারণ করে। এমনতর পরিবেশ পরিস্থিতিতে দেশবাসী যখন শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন, তখন প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে ভাষণ ছিল জনসাধারণের ইচ্ছের বিপরীত। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত সরকার চায়। সরকারের কাছে এ বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য না হলে এ ব্যাপারে গণভোট দেয়ারও আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু সরকার এ বিষয়টি বুঝতে অপারগ। ক্ষমতা ছেড়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে নেমে নির্বাচন করতে সরকারের যত ভয়, তা সবার কাছে স্পষ্ট। এ কারণে চলমান সঙ্কট উত্তরণে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ছিল অন্তঃসারশূন্য।
আমাদের মনে হয়, বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনার মনে যে ভীতিসঞ্চার করেছে, সেই নির্বাচনে করুণ পরাজয়ের সেই ভয় আওয়ামী লীগকে এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। যেভাবেই হোক ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা থেকে আওয়ামী লীগ বের হয়ে আসতে পারছে না। এ জন্য সরকারপ্রধানের পদটি শেখ হাসিনা কিছুতেই ছাড়তে চাইছেন না। ফলে প্রধানমন্ত্রীর মুখে থেকে জনদাবির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতার কোনো প্রস্তাব থাকলে তা সংসদে গিয়ে দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন। এটি একটি রাজনৈতিক কৌশল ছাড়া অন্য কিছু নয়। সংসদে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। বিরোধী দলের এ সম্পর্কিত প্রস্তাব কণ্ঠভোটেই বাতিল হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। সরকারি দল এ কৌশলটি প্রয়োগ করতে পিছপা হবে না।
তর্কের খাতিরে বিরোধী দল সরকারের এ প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে গত ২৩ অক্টোবর সংসদে যায় এবং বিএনপির সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে আলোচনার জন্য উত্থাপন করেন। এ সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক বক্তব্যে বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য এম কে আনোয়ার বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাবকৃত বিগত সময়ের দু’টি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য সম্মানিত ব্যক্তির ও নির্বাচনকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ আছে বলে জানান। বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা চলমান সঙ্কট নিরসনে সরকারি দলের আন্তরিকতা কামনা করে দ্রুত এ ব্যাপারে সংসদের বাইরে আলোচনা শুরুর আহ্বান জানান।
সরকারি দলের পক্ষ থেকে তোফায়েল আহমেদ, শেখ সেলিম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রমুখ বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাবের খুঁটিনাটি নিয়ে সমালোচনা করেন এবং এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আমরাও বলতে পারি, বিরোধী নেতার প্রস্তাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। রয়েছে সীমাবদ্ধতাও। বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাবে মনে হওয়া স্বাভাবিক, এ নির্বাচন শেষে পরবর্তী নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে, তা উল্লেখ নেই। তখনো কি একই সমস্যা সৃষ্টি হবে না? এসব প্রশ্নের উত্তর সেখানে নেই।
আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের বিপরীতে বিরোধীদলীয় নেতার এ প্রস্তাব শুধু আলোচনা শুরুর জন্য। আলোচনাতেই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং টেকসই একটি ফর্মুলা বের হয়ে আসবে। বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যগণ এমন আভাস দিয়েছেনও।
সরকারি দলের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে অনমনীয়তা ও অসহিষ্ণুতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সরকার মুখে মুখে গণতন্ত্র এবং নির্বাচিত ব্যক্তিদের প্রতি প্রীতি দেখাচ্ছে। বাস্তবে তারা বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করতে প্রজ্ঞাপন জারি করছে। ঢাকায় সভা-সমাবেশ করার ওপর সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কঠোর কর্মসূচি না দিয়ে জেলা ও থানাপর্যায়ে বিক্ষোভ করেছে। আমরা লক্ষ করছি, বিরোধী দলকে নিয়ে সরকারি দলের মধ্যে একধরনের ভীতি ও অস্থিরতায় রয়েছে। বিএনপির সভা-সমাবেশ ও শক্তির ওপর সরকার দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। সরকারি দলের নেতাকর্মীরা সরকার পতনে বিএনপির আন্দোলনের হুঙ্কারকে কাগুজে বাঘ বললেও দৃশ্যত মনে হচ্ছে বিএনপিকে নিয়ে তাদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। সভা-সমাবেশ করার মধ্য দিয়ে বিএনপি ঢাকার রাজপথ দখলে নেয়ার আশঙ্কা করছে। এ আশঙ্কা থেকেই সরকার দেশে অঘোষিত জরুরি আইন জারি করছে বলে, তা ভুল বলা হবে না। শুধু ঢাকায় নয়, বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরেও সরকার সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এক কথায় সংবিধান ও গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ গণতন্ত্রের জন্য অশনিসঙ্কেত। এ ধরনের অবস্থা দীর্ঘতর হলে জনবিক্ষোভে অনেক পরাক্রমশালী সরকারের পতন হতে আমরা দেখেছি। বাংলাদেশেও এমন ঘটনা ঘটবে না তা কে বলতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে তত্ত্বাবধায়ক জুজুর ভয় দেখিয়ে অনির্বাচিতদের কাছে আর ফিরে না যাওয়ার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। কারচুপিবিহীন ভোটারাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে দলটি আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি সংযুক্ত করার কৃতিত্ব অর্জন করেছে, সুবিধাজনক অবস্থায় থেকে সেই দলটির তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বিলোপের পক্ষে কোনো যুক্তি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সরকারের সমান্তরাল শক্তিশালী কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এখানে নির্বাচন কমিশনকে আরো অধিক শক্তিশালী করার চিন্তা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হতে পারে না। মহাজোট সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে, সুতরাং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে আর অবিশ্বাসের কিছু নেই, এমন বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। সিটি করপোরেশন নির্বাচন কিংবা উপনির্বাচন আর জাতীয় সংসদের মূল নির্বাচন এক কথা নয়। ওই সব নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে সরকার পড়ে যায় না কিংবা এর ফলে বিরোধী দল ক্ষমতায় চলে আসে না। এসব যুক্তি সুবিধাভোগী ছাড়া আর কেউ বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না। রাজনীতিবিদদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, সন্দেহ আর ভোট চুরির প্রবণতা রোধকল্পে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতির যে সূত্রপাত ঘটেছিল, সেই অবস্থার উন্নতি হয়নি। বস্তুগত উন্নতি যেমন, ত্রুটিমুক্ত ভোটার তালিকা হয়েছে, যার ভোট সে দিতে পারছে, অবৈধ বা জাল ভোট দেয়ার সুযোগ দূর হয়েছে, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স হয়েছে। তবে রাজনীতিবিদদের মানসিকতার কোনো উন্নতি হয়নি, বলা যায় অবনতি হয়েছে। এ অবস্থায় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতাকে তার প্রস্তাবিত সর্বদলীয় সরকারের যোগদানের আহ্বান জানাচ্ছেন। এ নিয়ে তিনি বিরোধীদলীয় নেতাকে ফোনও করেছেন। বহুল প্রত্যাশিত ফোনকলটি নিয়ে এখন নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে। ফোনকলের একটি প্রাইভেসি থাকে। এই প্রাইভেসি সরকার উন্মুক্ত করে দিয়ে অনৈতিক কাজ করেছে। ‘ফোনকলটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ, তা জনসাধারণের শোনার অধিকার রয়েছে’ সরকারের এ ভাষ্য সঠিক নয়। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত হতো পারত যদি বিরোধীদলীয় নেতাকে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি আগে অবহিত করতেন। কোনো অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য সরকার ফোন করার এই কৌশল অবলম্বন করছেন বলে অভিযোগ করা হলে, তা খণ্ডন করা যায় না। এই ফোন কলের মাধ্যমে এখন মনে হচ্ছে সরকার সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতার পথ থেকে সরে যাচ্ছে।
বিরোধী দলও বসে নেই। তারা নিয়মিত বিরতি দিয়ে হরতাল করছে। সরকার বিরোধী দলকে আস্থায় আনার কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে হয় না। বিএনপিকে নির্বাচনে আনার ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা প্রশ্নসাপেক্ষ। গত কয়েক দিনের কর্মকাণ্ডে বরং মনে হচ্ছে সরকার বিরোধী দলের প্রতি র্হ্ডা লাইন বেছে নিয়েছে। হরতালের নাশকতার দায় বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের ওপর চাপিয়ে তাদের গ্রেফতার করেছে। এটা যে সমঝোতার পথ নয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার বিএনপিবিহীন একদলীয় নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে, যা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে আরো দীর্ঘায়িত করবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন