সিরাজুর রহমান
পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর হামলা হয়
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে। সে খবর লন্ডনে এসে পৌঁছায় পরদিন দুপুরে। ফিট স্ট্রিটের
সাংবাদিকেরা এবং লন্ডনে নিযুক্ত কয়েকজন ভিনদেশী সাংবাদিক খবরের সত্যতা যাচাই এবং
বিস্তারিত বিবরণ সংগ্রহের আশায় বিবিসি বাংলা বিভাগে আমার সাথে যোগাযোগ করেন।
কয়েকজন সশরীরেও এসেছিলেন আমার আফিসে। বিবিসি বাংলা বিভাগ তখন পূর্ব পাকিস্তান
সম্বন্ধে খবরের নির্ভরযোগ্য উৎস বলে সম্মানিত ছিল। তা ছাড়া ১৯৭০ সালের নভেম্বরের
সাইকোনের সময় থেকে পূর্ব পাকিস্তান সম্বন্ধে নির্ভরযোগ্য খবরের জন্য আমার ওপর
নির্ভর করতে শিখেছিলেন এই সাংবাদিকেরা।
তাদের প্রায় সবার একটি প্রশ্নে আমরা খুবই বিব্রত বোধ করছিলাম। পাকিস্তান থেকে প্রচার করা হচ্ছিল যে, শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানে এসেছেন। এ প্রচারণা দিয়ে তারা ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা করছিল যে, মুজিব মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন না। এ ধারণার মোকাবেলা আমাদের জন্য একটা বড় ভাবনা ছিল। ঢাকা থেকে সদ্য লন্ডনে আসা দু’জন পরিচিত লোক দাবি করেছিলেন যে, মুজিব পূর্ব পাকিস্তানেই পলাতক আছেন এবং তারা তার সাথে দেখা করে এসেছেন। বিবিসি থেকে তাদের দু’জনেরই সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়। সাংবাদিকেরা আমাদের কথা শুনছিলেন কিন্তু ষোলো আনা বিশ্বাস করেছিলেন বলে মনে হয় না।
বিশ্বাসযোগ্য খবর আমরা পেলাম চার কিংবা পাঁচ দিনের মধ্যেই। শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে কালুর ঘাট রিলে স্টেশন থেকে মেজর জিয়াউর রহমান যে ঘোষণা প্রচার করেন, ফরাসি রেডিও তার একটি রেকর্ডিং ঘুরপথে সংগ্রহ করে প্রচার করেছিল। তার পর থেকে আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ন্যায্যতা এবং সে যুদ্ধে দেশবাসীর সর্বাত্মক সমর্থন সম্বন্ধে সাংবাদিকদের বিশ্বাস করাতে কোনো সমস্যা হয়নি।
মেজর জিয়াউর রহমানের নাম আমি সেই প্রথম শুনেছিলাম। আরো পরে মুক্তিযুদ্ধে তার শৌর্যবীর্যের আর তার সংগঠনী প্রতিভার খবর ধীরে ধীরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে আসতে থাকে। বায়াত্তরের ফেব্রুয়ারিতে আমি প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশে যাই। দেশের বিভিন্ন শহর-নগরে গেছি তখন। সর্বত্রই একটি নাম শুনেছি কিংবদন্তির মতোÑ মেজর জিয়া, আর তার জেড ফোর্স। কিশোর ছেলেরা বিশেষ এক ধাঁচে চুল ছেঁটে বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াতÑ আমি জেড ফোর্স।
অনেক পরে, তার মর্মান্তিক হত্যারও পরে, মূলত ভারতঘেঁষা কেউ কেউ পঁচাত্তরের সেনাবিদ্রোহ ও শেখ মুজিবের হত্যার সাথে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নাম জড়িত করার হাস্যকর প্রয়াস পেয়েছেন। বিশেষ করে প্রায় ছয় বছর দিল্লি থাকার পর জিয়াউর রহমানের চেষ্টায় দেশে ফিরে এসেই শেখ হাসিনা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে খুনি বলে কুৎসা রটনা করতে থাকেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ইতিহাসের পক্ষপাতদুষ্ট ভারতীয় সংস্করণই দেখেছেন, সঠিক ইতিহাস নয়। সুতরাং এজাতীয় দাবি তার পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। তা ছাড়া দিল্লিতে থাকা অবস্থায় দিল্লির নাগরিক সমাজের সাথেও তাদের মেলামেশার সুযোগ ছিল না।
এসব যোগাযোগ উপেক্ষণীয় নয়
জেনারেল এরশাদ ইন্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণের সময় র-এর উপমহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাসদেও সিংয়ের সাথে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে আবার বৈধ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. কামাল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাককে দিল্লি পাঠিয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া স্বর্ণ ও হীরক অলঙ্কারসহ (টিয়ারাসহ) তখনকার অঙ্কে ৩৩ কোটি টাকার সম্পত্তি হাসিনাকে বুঝিয়ে দেন। শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেন ১৭ মে ১৯৮১ সালে। তার ১৩ দিনের মাথায় ৩০ মে এক সামরিক ষড়যন্ত্রে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন এবং মনে রাখতে হবে যে, জাতীয়তাবাদী জিয়াকে ভারত মোটেই পছন্দ করেনি। যোগাযোগগুলো উপেক্ষা করার মতো নয়।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ১৫ বার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৮৬ সালে বিবিসি থেকে ১২ পর্বের একটি অনুষ্ঠানমালা আমি প্রচার করেছিলাম। সে অনুষ্ঠানের অনুলিপি ঢাকার ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছিল। সে অনুষ্ঠানগুলোর জন্য আমি সংশ্লিষ্ট অনেকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। ১৯৮৩ সালের ১৫ নভেম্বর (রানী এলিজাবেথের বাংলাদেশ সফরের সময়) গুলশানের একটি বাড়িতে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে আমার সাক্ষাৎকারও অনুষ্ঠানমালায় সংযোজিত হয়েছিল।
বাকশাল সরকারের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের ঘাতকদের নেতা কর্নেল ফারুক রহমান একাধিকবার লন্ডনে টেলিফোন করে আমাকে সাক্ষাৎকার দিতে চেয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালে জেনারেল এরশাদ তার ভোটারবিহীন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কর্নেল ফারুককে নির্বাচন করার সুযোগ দেন। ফারুক তখন আবারো আমাকে ঢাকায় সাক্ষাৎকারদানের এবং তার সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তার আমন্ত্রণ রাখার প্রবৃত্তি আমার হয়নি। কিন্তু আমার সহকর্মী নিক ন্যুজেন্ট আমার হয়ে কর্নেল ফারুকের সাক্ষাৎকার নেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অশান্তির ব্যাপারে বিদেশী হস্তক্ষেপের কথা ফারুক তখন নিক ন্যুজেন্টকে বলেছিলেন।
কর্নেল ফারুক বলেছিলেন, ‘ডিস্ট্যাবিলাইজেশনের পেছনে মূলত বিদেশী দেশগুলো আছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতার জন্য বারবার মিলিটারি আসছে; বাইরে থেকে যদি এজেন্ট (পাঠানো এবং) উসকানি দেয়া বন্ধ করে দিত, আর যদি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা যেত, সিভিল-মিলিটারি এক করা যেত, ঔপনিবেশিক পদ্ধতি হটানো যেত, তাহলে বাংলাদেশে কোনো রকমের এই ক্যু-টু বা অসুবিধা হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।’
মোশতাক কিভাবে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন
ছিয়াশি সালে আমি ঢাকায় সাবেক প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মোশতাক আহমদেরও একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। মোশতাক সাহেব বিস্তারিত আলোচনায় তখনকার সশস্ত্রবাহিনীগুলোর বহু কর্মকর্তার নামোল্লেখ করেছেন, কিন্তু একবারও কোথাও জেনারেল জিয়াউর রহমানের নাম আলোচনায় আসেনি। যেমনÑ ১৫ আগস্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সকালবেলা ৮টার সময় আমাকে আমার বাসা ৫৪ নম্বর আগামসি লেন থেকে কর্নেল রশিদ সাহেব এবং তার অন্যান্য সহকর্মী রেডিও স্টেশনে নিয়ে যান। সেখানে আমি সর্বপ্রথম ফারুক সাহেবকে দেখি। তার পরে সাড়ে ৮টা থেকে ১০টা-১১টা পর্যন্ত আলাপ-আলোচনা করি।... রশিদ সাহেবকে বললাম যে, আপনারা কারা এসব করেছেন? আবার আমাকে বলছেন দায়িত্ব নিতে। তিনি বললেন, বাংলাদেশে আপনি একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। আপনাকে দায়িত্বভার নিতে হবে। আমি বললাম, ঠিক আছে, কিন্তু আপনাদের সকলকে আমি চিনি না। বাহিনীগুলোর প্রধানদের আমি চিনতাম। তারা কোথায়?
জবাবে রশিদ সাহেব আমাকে বললেন যে, আপনি যদি তাদের চান তাদের ১৫ মিনিটের মধ্যে আমরা নিয়ে আসব। সে দিনের সামরিক বাহিনীর প্রধান সফিউল্লাহ সাহেব (যিনি ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবকে পেছনের দরোজা দিয়ে পালিয়ে যেতে বলেছিলেন), নেভির প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এইচ খান, বিমানবাহিনীর প্রধান এ কে খন্দকার, বিডিআরের প্রধান জেনারেল খলিলুর রহমান, তার পরে বোধ হয় পুলিশপ্রধানও এলেন। ... রক্ষীবাহিনীর যে দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন (প্রধান ব্যক্তি বোধ হয় সেদিন দেশে ছিলেন না) তিনিও এসে আনুগত্য জানান।’
খোন্দকার মোশতাক দিল্লির প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন না। অন্য দিকে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ভারতপন্থী বলে ধারণা প্রচলিত ছিল। অন্তত তার অভ্যুত্থানের দিন (৩ নভেম্বর ১৯৭৫) দিল্লির সাউথ ব্লকে (পররাষ্ট্র দফতর) সেদিন মিষ্টান্ন বিতরণ করা হয়েছিল। এ অভ্যুত্থান সম্বন্ধে খোন্দকার মোশতাক আমাকে বলেন, ২ নভেম্বর তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে ৫০ দিনের মধ্যেই সংসদের নির্বাচন হবে। সে নির্বাচন সম্বন্ধে তিনি সেদিন রাত দেড়টা পর্যন্ত স্পিকার আবদুল মালেক উকিল, মন্ত্রিসভার সদস্য ডক্টর মেজাফফর চৌধুরী, মনোরঞ্জন ধর, জেনারেল ওসমানী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর প্রমুখের সঙ্গে আলোচনা করেন। তারপর তিনি শুতে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই কিছু অস্বাভাবিক শব্দ শুনে তিনি অন্য একটি কামরা থেকে কর্নেল রশিদকে ডেকে পাঠান, কেননা তার টেলিফোন বিচ্ছিন্ন ছিল। রশিদের কাছ থেকেই তিনি খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের খবর জানতে পারেন।
পরদিন সকালে মিলিটারি সেক্রেটারির কামরায় গিয়ে তিনি খালেদ মোশাররফের টেলিফোন কল রিসিভ করেন। ‘সেখানে খালেদ মোশাররফ আমার সাথে কথা বলে। খালেদ মোশাররফের পর আমি যাকে এয়ারফোর্সের প্রধান নিযুক্ত করেছিলামÑ তোয়াবÑ সেও কথা বলল। সে বলল, আমি এখানে আছি। এই এদেরে আর্মস সারেন্ডার করতে বলেন। খালেদ মোশাররফও সেই কথাই বলেছে। ... তা না হলে বঙ্গভবনেই বোমা ফেলা হবে।’
ভারতপন্থী সামরিক অভ্যুত্থান
খোন্দকার মোশতাক বিমানবাহিনীর মতো সেনাবাহিনীর নেতৃত্বেও রদবদল আনেন। তিনি সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে জেনারেল সফিউল্লাহর স্থলে চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত করেন। খালেদ মোশাররফ ও তার প্রতি অনুগত অফিসাররা ২-৩ নভেম্বর রাতে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দফতরে অবস্থান নিয়ে তাদের অভ্যুত্থানের ঘোষণা দেন। মনিরুল ইসলাম চৌধুরী তখন চতুর্থ বেঙ্গলে ক্যাপ্টেন ছিলেন। পরে জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকারের সময় তিনি তার জনসংযোগ কর্মকর্তা হন এবং কর্নেল মুনির নামে পরিচিত ছিলেন।
’৮৬ সালে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি আমাকে ১৫ আগস্ট থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের ঘটনাবলির বিশদ বিবরণ দেন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট মোশতাকের কাছে খালেদ মোশাররফ ও তার সাথীরা যেসব দাবি জানান তার মধ্যে বিশেষ করে ছিল, যেসব অফিসার বঙ্গভবনে এবং রেসকোর্সে নিজেদের ট্যাংক রেজিমেন্ট দিয়ে বেষ্টিত করে রেখেছিলেন, ওদেরকে ক্যান্টনমেন্টে ফেরত আসতে হবে; তারপর প্রেসিডেন্ট সাহেবকে সেনাবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর প্রধানদেরকে (জেনারেল জিয়া এবং এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব) চাকরি থেকে সরাতে হবে। তারপরে প্রেসিডেন্ট সাহেবকে প্রেসিডেন্ট হিসেবেই রাখার প্রস্তাব দিয়েছেলেন খালেদ মোশাররফ। লক্ষণীয় যে, কর্নেল মুনিরও ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড কিংবা পরবর্তী সামরিক অভ্যুত্থানে জেনারেল জিয়াউর রহমানের কোনো ভূমিকা থাকার কথা উল্লেখ করেননি। তবে ২ নভেম্বর রাতে জিয়াকে গৃহবন্দী করার প্রসঙ্গ তিনি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।
বাংলাদেশ ও ভারতে রানী এলেজাবেথের রাষ্ট্রীয় সফরে সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের সাথে আমিও ছিলাম। ১৪ নভেম্বর (১৯৮৩) আমরা ঢাকা পৌঁছি। কথা ছিল পরদিন আমি রানীর স্বামী প্রিন্স ফিলিপের সাথে শ্রীমঙ্গল যাব। কিন্তু অতি ভোরে জনৈক ক্যাপ্টেন হায়দার শেরাটন হোটেলে এসে আমার ঘুম ভাঙালেন। তিনি বললেন, মাননীয় রাষ্ট্রপতি আমাকে প্রাতঃরাশের নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন, এখনি আমাকে তৈরি হয়ে তার সাথে যেতে হবে। কর্নফেকস থেকে পরোটা আর ভাজা কিডনি পর্যন্ত বহু পর্বের প্রাতঃরাশ খেতে খেতে জেনারেল এরশাদ আমাকে তার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের একটা বর্ণনা দিলেন। তারপর তিনি বলেন যে, প্রধান দু’টি দলের নেত্রীদের কেউ যদি একটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য তাকে মনোনয়ন না দেন তাহলে তিনি নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করতে বাধ্য হবেন। নেত্রীদের মতামত যাচাইয়ের দায়িত্ব তিনি চাপিয়ে দিলেন আমার ওপর।
শ্রীমঙ্গল সফর বাতিল করে আমি প্রথমেই গেলাম ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে। অনেক ঘুরিয়ে তিনি যা বললেন তার সার কথা হচ্ছে, জেনারেল এরশাদ কী কী শর্তে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান, না জেনে কোনো জবাব দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না। বেগম খালেদা জিয়ার কাছে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশে বিবিসির সংবাদদাতা আতাউস সামাদ। তিনি আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন যে, আমি জেনারেল এরশাদের সঙ্গে দেখা করে এসেছি। এরশাদের নাম শুনেই বেগম জিয়া এমনই ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন যে, আমি আর এরশাদের প্রস্তাবের প্রসঙ্গ তোলার সাহসই পাইনি। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললাম যে, ’৭৫ খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান ও তার স্বামীকে গৃহবন্দী করা এবং ’৮১তে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যা সম্বন্ধে তার স্মৃতি রেকর্ড করে নিয়ে যেতেই এসেছি আমি।
মোশাররফের অভ্যুত্থান : বেগম জিয়ার স্মৃতি
খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে বেগম জিয়া বলেন, ‘দুই তারিখ রাত্রে আমরা বাইরে গিয়েছিলামÑ ডিনার ছিল একটা। রাত প্রায় ১২টার দিকে আমরা ফিরে এসে শুয়ে পড়েছি। রাত্রিবেলা হঠাৎ দুটার দিকে কলিং বেল বাজল। তখন স্বাভাবিকভাবেই বাসায় কেউ ছিল না। আমার স্বামী নিজেই দরজা খুলল। আমি দেখতে গেলাম কী হয়েছে। সামনের দরজায় গিয়ে বেশ কিছু লোকজন দেখলাম। আর্মি অফিসার আছে দু-চারজন, আরো লোকজন দেখলাম। দেখলাম আমার স্বামী তাদের সঙ্গে বাইরে বারান্দায় বসেই কথাবার্তা বলছে। কী হচ্ছে ব্যাপারটা আমি ঠিক তখনো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
‘ভোরের দিকে যখন আলো হলো, তখন দেখলাম সে তাদেরকে নিয়ে ঘরের ভেতরে ড্রইং রুমে এসে বসল। খুবই নর্মাল ব্যবহার করছিল সে। বলল, এদেরকে চা দাও, নাশতা দাও। ... সকাল হবার পরে আমি বুঝতে পারলাম যে ব্যাপারটা অন্য রকম। আমার (বাসার) গেট-টেট বন্ধ। কেউ বাইরে যেতে পারছে না, কেউ বাইরে যাচ্ছে না। এর মধ্যে আসলেন, আমার পাশের বাসায় ছিলেন, এখন তিনি জেনারেল হয়েছেন, জেনারেল মইন (জেনারেল মইনুল ইসলাম চৌধুরী?)। তিনি একটু আলাপ-সালাপ করলেন। তিনি আমাকে বললেন, বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাবেন না।’
৭ মার্চের ঘটনাবলি সম্বন্ধে বেগম জিয়া বলেন, “সাত তারিখে রাত্রিবেলা, রাত্রি ১২টার সময় থেকে একটু একটু গোলাগুলির শব্দ হচ্ছে। আমরা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে। কিছুক্ষণ গোলাগুলি চলার পরে শুনলাম যে কতগুলো স্লোগান হচ্ছে। ‘নারায়ে তকবিরÑ আল্লাহ আকবর’Ñ এ রকম স্লোগান হচ্ছে। আস্তে আস্তে ওটা বাড়তে লাগল। একপর্যায়ে দেখলাম সকলে এদিকে আসছে, আমাদের বাসার দিকে আসছে। আমার গেট বন্ধ ছিল। সে গেটটা একদম ভেঙে ফেলার মতো অবস্থা। শেষ পর্যন্ত গেটটা ভেঙেই ফেলল। আমার সামনের দরজা ভেঙে সব হুড়মুড় করে বাসায় ঢুকে বলল, স্যার কোথায়? আমার স্বামী তখন বেরিয়ে এলেন, ওদের সঙ্গে কথা বললেন। তারপর তারা তাকে কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। তার নামে স্লোগান দিচ্ছিল।”
[প্রসঙ্গত, ঢাকা ছাড়ার আগে দুই নেত্রীর প্রতিক্রিয়ার খবর প্রেসিডেন্ট এরশাদকে শুনিয়েছিলাম। ২৬ নভেম্বর দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে কমনওয়েলথ সরকারপ্রধান সম্মেলনে আমরা ক’জন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে কথা বলছিলাম। ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খোন্দকার আমাকে ডেকে জেনারেল এরশাদের কাছে নিয়ে গেলেন। এরশাদ আমাকে বললেন যে, অবশেষে তিনি নিজের একটা রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে জনদল নাম রাখার প্রস্তাব হয়েছে।]
জেনারেল জিয়াউর রহমানের খুব সম্ভবত চারটি সাক্ষাৎকার নিয়েছি আমি। সমকালীন বিষয়াদি নিয়েই সেগুলোতে মূলত আলোচনা হয়েছে। তবে আমার মনে হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং দিকনির্দেশক ছিল ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি দীর্ঘ বৈঠক ও আলাপচারিতাÑ সাক্ষাৎকার নয়। আগে থেকেই সাক্ষাৎকারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট স্থির ছিল। সে অনুযায়ী সেদিন সকালের ফাইটে আমি রাজশাহী থেকে ঢাকা ফিরে আসি। তখন বিমানবন্দর ছিল তেজগাঁওয়ে। বেরুবার মুখে পরিচিত এক ব্যক্তির সাথে দেখা। কুশলাদি বিনিময়ের পর তিনি বললেন, সিএমএল-এর (প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক) ইন্টারভিউ নিতে ঢাকায় ফিরেছেন বুঝি। আমি হ্যাঁ-সূচক জবাব দিলাম। তিনি বললেন, ইন্টারভিউ আজ হবে না। জেনারেল জিয়া কিছুক্ষণ পরেই চাটগাঁ যাচ্ছেন।
আমাকে তথ্য দিতে পেরে তিনি বেশ গর্বিত মনে হচ্ছিল। বললেন, পতেঙ্গা ক্যান্টনমেন্টে গোলমাল চলছে। একজন সার্জেন্ট জনৈক মেজরকে স্যালুট করতে অস্বীকার করায় মেজর তার হাতে গুলি করেছিলেন। খুব টেনশন চলছে সেখানে। জওয়ানরা আবার ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, অফিসারের কল্লা চাই’ বলে স্লোগান দিচ্ছে। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে জেনারেল জিয়া বিকেলে সেখানে যাচ্ছেন। আমার কৌতূহল হলো। ভাবলাম ভদ্রলোককে বাজিয়ে দেখি। তিনি হতাশ করেননি। বললেন, এ জাতীয় ঘটনা আরো কোনো কোনো ক্যান্টনমেন্টেও ঘটেছে। চেন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে জিয়া এনসিও-দের এখান থেকে সেখানে আর সেখান থেকে অন্যখানে বদলি করছেন।
সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলার অভাব সম্বন্ধে আমি আগেই বিস্তারিত জেনেছিলাম। আমার বড় ভাই এয়ার কমডোর এ বি এম মাহবুবুর রহমান ক্যান্টনমেন্টে জেনারেল জিয়ার বাড়ির কাছেই থাকতেন। তিনি কাছের এক অফিসারের খালি বাড়িতে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে বাড়ির দেয়ালে অন্তত এক হাজার বুলেটের গর্তি ছিল। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের চার দিনে সেনাবাহিনীর ভেতরে অনুরূপ হিংস্রতা আরো বহু হয়েছে বলে বড় ভাই আমাকে বলেছিলেন। বলেছিলেন মিছিল করে সিপাহিদের স্লোগান দানের কথাও। বিমানবন্দরে ভদ্রলোক মোটামুটি একই রকম বিবরণ দিয়েছিলেন আমাকে।
একটি ঐতিহাসিক আলাপচারিতা
শেরাটন হোটেলে ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই সিএমএল-এর অপিস থেকে টেলিফোন এলো। জেনারেল আমার সাথে সময় নিয়ে গল্প করতে চান। সেদিন তার হাতে বেশি সময় নেই। পরের দিন তার অপিসে যেতে আমার কী খুব বেশি অসুবিধা হবে? গরজ আমারই, সুতরাং বলতেই হলো যে, কোনো অসুবিধা হবে না। আমার হাতে তখনকার ভারী টেপ রেকর্ডার এবং আমার ক্যামেরা ছিল। জেনারেল জিয়া আমাকে অভ্যর্থনা করতে নিজেই এগিয়ে এলেন। হাত থেকে ক্যামেরা আর টেপ রেকর্ডার নিয়ে তার পিএস কর্নেল অলির হাতে দিলেন। ইংরেজিতে বললেন, অলি, এগুলো প্রাণপণে রক্ষা করবে। তোমার-আমার কাছে রাইফেল যেমন গুরুত্বপূর্ণ মি. রহমানের কাছে টেপ রেডর্কারও সে রকম। আমাকে ভেতরে তার অপিস কামরায় নিয়ে গেলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান।
আমার স্যুটের জ্যাকেট খুলে নিজের হাতে কামরার একেবারে শেষ মাথায় জ্যাকেটে রাখলেন। বললেন, কী আবার স্যুট-ট্যুট পরে এসেছেন! আমি বললাম, স্যার স্যুট আমার প্রয়োজনে নয়। শীতের দেশে থাকি, বাংলাদেশের ফেব্রুয়ারি আমার জন্য খুবই আরামদায়ক। স্যুট পরেছি আপনার সম্মানে এবং আশ্বাস দিচ্ছি পকেটে রিভলবার কিংবা মাইক্রোফোন লুকোনো নেই। হো-হো করে হাসলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। আড়ষ্টতা কেটে একটা সহজ-স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি হলো। তারপর আর আমাদের আলোচনায় কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি।
জেনারেল জিয়া তার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সমস্যাগুলোর একটা তালিকা দিলেন আমাকে। দেশ ছোট, সম্পদ কম, কিন্তু জনসংখ্যা বিশাল। সবচেয়ে বড় সমস্যা দেশের বিশাল শিক্ষিত বেকারের সমস্যা। এদের গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা না গেলে এরাই দেশের সর্বনাশ ডেকে আনবে। তিনি বলেন, এ লক্ষ্যে তিনি একটা কর্মসূচি তৈরি করছেন। ওদিকে বাংলাদেশের মানুষ মনেপ্রাণে গণতন্ত্র চায়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চায়। অথচ শেখ মুজিবুর রহমান দুটোরই পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। জিয়া বলেন, এ অবস্থা মানুষ কিছুতেই বেশি দিন সহ্য করবে না। তিনি সংবাদপত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে নিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলো এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞাও শিগগির প্রত্যাহার করা হবে। সে লক্ষ্যে তিনি বিশেষজ্ঞ ও চিন্তানায়কদের সাথে আলোচনা ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছেন। জিয়া আরো বলেন, ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানের পতনের একটা বড় কারণ। দেশের দরিদ্রতম জনসাধারণকে কিভাবে খাদ্য দেয়া যায় সে চিন্তাও করছেন তিনি।
স্বাধীনতার যুুদ্ধের যারা বিরোধিতা করেছেন তিনি কেন তাদের সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চান, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি আবার দেশের সমস্যাগুলোর উল্লেখ করে বলেন, গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ এবং সংহত করা না গেলে এমন দুরূহ সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে না। তিনি আরো বলেন, তা ছাড়া এই লোকগুলো তো বাংলাদেশেরই সন্তান। অন্য কোনো দেশ তো আর ওদের নেবে না। কিছুটা হালকা সুরে তিনি বলেন, মি. রহমান, আপনি তো বিলেতে থাকেন, ওদের বলে দেখুন না এই লোকগুলোকে নেবে কি না। তারপর আবার সিরিয়াস হয়ে গেলেন তিনি। বললেন, ওদের দেশে থাকতে দেব অথচ একঘরে করে রাখব, তাহলে তো প্রতি মুহূর্ত পিঠে চুরি মারার ভয়ে আমাকে পিঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে; দেশের কাজ করার সুযোগ পাব কখন? আপনিই বলুন, এই লোকগুলোকে নিয়ে আমি কী করি? তাদের কি আমি বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিয়ে আসব?
সেনাবাহিনী নিয়ে জটিল সমস্যা
আগের দিন তিনি কেন চাটগাঁ গিয়েছিলেন জানতে চাইলাম আমি। তিনি বললেন, সেটাও শুনেছেন? তা হলে শুনুন, আমিও জানি যে আজ সন্ধ্যায় আপনিও চাটগাঁ যাচ্ছেন। খোঁজখবর নিয়ে জেনে নিন না। আমি তাকে সেনাবাহিনীর চেন-অব-কমান্ড সম্বন্ধে প্রশ্ন করি। তিনি বলেন, চেন-অব-কমান্ড অবশ্যই ফিরিয়ে আনতে হবে, সেনাবাহিনীর অস্তিত্বের প্রয়োজনে। জেনারেল জিয়া বলেন, সেনাবাহিনীর ভেতরে সমস্যা খুব বেশি নয়, কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি করছে বাইরের কোনো কোনো মহল। বাইরের এই মহলগুলো দেশের ভেতরের কিংবা দেশের বাইরের সে প্রশ্ন তখন আমার মনে আসেনি। এসেছিল কর্নেল ফারুক রহমানের সঙ্গে নিক ন্যুজেন্টের সাক্ষাৎকার শুনে। সেটা ১৯৮৮ সালের কথা। জেনারেল জিয়া তার অনেক আগেই শহীদ হয়েছেন।
আমি বিলেত ফিরে আসার কিছুকাল পরেই জেনারেল জিয়ার ১৯ দফা কর্মসূচির খবর আসে। আমার তখন আমাদের সে আলাপচারিতার কথা মনে হলো। দরিদ্রতম জনসাধারণের খাদ্য সংস্থানের লক্ষ্যে তিনি কাজের বিনিময়ে খাদ্য এবং খাল খনন ও নদী সংস্কারের কর্মসূচি শুরু করেন। মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর বিনিময়ে পরিবারকে খাদ্য দেবার রীতিও তিনিই প্রথম চালু করেন। পরবর্তী কালে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই কর্মসূচির প্রসার ও বিবর্তন করেন। বাংলাদেশের মেয়েরা এখন সামান্য ব্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিতে পারছে তার কৃতিত্ব রাষ্ট্রপতি জিয়া এবং প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার। প্রেসিডেন্ট জিয়ার খাল খনন ও নদী সংস্কারের কর্মসূচিতে দেশজোড়া অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে গিয়েছিল। বেকার ও পেশাজীবী সব শ্রেণীর মানুষ সে কর্মসূচিতে সাড়া দিয়েছিলেন। আমার সহকর্মী (স্যার) মার্ক টালি ময়মনসিংহ জেলায় ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের ভাঙন ঠেকানোর জন্য এ রকম মাটি কাটার প্রকল্পের খুবই সুন্দর একটা শব্দচিত্র পাঠিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “নদী দ্রুততর পাড় ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে নতুন একটা পাটকল আর একটা রেলসেতু ভেসে যাবে। নদীর গতি পরিবর্তনের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে দুই মাইল লম্বা একটা খাল খননের পরিকল্পনা করা হলো। সে জন্য হাতে ধরে ৬০ লাখ ঘনফুট মাটি কাটতে হবে। প্রথম দিকে ৫০ হাজারেরও বেশি লোক হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে, সেনাবাহিনী আর পুলিশের লোক, কলকারখানা আর সরকারি অফিস থেকেও লোক এসেছিল। আমার জন্য সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল যে, বেশ কিছু মহিলাও এসেছিলেন। মহিলাদের একটি দলের নেত্রী ছিলেন ময়মনসিংয়ের মহিলা সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান। ... প্রথম ঝুড়ি মাটি কাটলেন জেনারেল জিয়া স্বয়ং। জনতা তখন ধ্বনি তুলছিলÑ ‘জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ’।”
মার্ক টালি আমার চেয়েও বেশি বার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তাকে তিনি ভালোভাবেই চিনতেন। জিয়ার হত্যার খবর পেয়ে মার্ক মন্তব্য করেছিলেন, ‘লোকটা তার প্রাণের সেনাবাহিনীকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন। সে জন্যই তাকে প্রাণ দিতে হলো।’
তাদের প্রায় সবার একটি প্রশ্নে আমরা খুবই বিব্রত বোধ করছিলাম। পাকিস্তান থেকে প্রচার করা হচ্ছিল যে, শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানে এসেছেন। এ প্রচারণা দিয়ে তারা ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা করছিল যে, মুজিব মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন না। এ ধারণার মোকাবেলা আমাদের জন্য একটা বড় ভাবনা ছিল। ঢাকা থেকে সদ্য লন্ডনে আসা দু’জন পরিচিত লোক দাবি করেছিলেন যে, মুজিব পূর্ব পাকিস্তানেই পলাতক আছেন এবং তারা তার সাথে দেখা করে এসেছেন। বিবিসি থেকে তাদের দু’জনেরই সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়। সাংবাদিকেরা আমাদের কথা শুনছিলেন কিন্তু ষোলো আনা বিশ্বাস করেছিলেন বলে মনে হয় না।
বিশ্বাসযোগ্য খবর আমরা পেলাম চার কিংবা পাঁচ দিনের মধ্যেই। শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে কালুর ঘাট রিলে স্টেশন থেকে মেজর জিয়াউর রহমান যে ঘোষণা প্রচার করেন, ফরাসি রেডিও তার একটি রেকর্ডিং ঘুরপথে সংগ্রহ করে প্রচার করেছিল। তার পর থেকে আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ন্যায্যতা এবং সে যুদ্ধে দেশবাসীর সর্বাত্মক সমর্থন সম্বন্ধে সাংবাদিকদের বিশ্বাস করাতে কোনো সমস্যা হয়নি।
মেজর জিয়াউর রহমানের নাম আমি সেই প্রথম শুনেছিলাম। আরো পরে মুক্তিযুদ্ধে তার শৌর্যবীর্যের আর তার সংগঠনী প্রতিভার খবর ধীরে ধীরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে আসতে থাকে। বায়াত্তরের ফেব্রুয়ারিতে আমি প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশে যাই। দেশের বিভিন্ন শহর-নগরে গেছি তখন। সর্বত্রই একটি নাম শুনেছি কিংবদন্তির মতোÑ মেজর জিয়া, আর তার জেড ফোর্স। কিশোর ছেলেরা বিশেষ এক ধাঁচে চুল ছেঁটে বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াতÑ আমি জেড ফোর্স।
অনেক পরে, তার মর্মান্তিক হত্যারও পরে, মূলত ভারতঘেঁষা কেউ কেউ পঁচাত্তরের সেনাবিদ্রোহ ও শেখ মুজিবের হত্যার সাথে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নাম জড়িত করার হাস্যকর প্রয়াস পেয়েছেন। বিশেষ করে প্রায় ছয় বছর দিল্লি থাকার পর জিয়াউর রহমানের চেষ্টায় দেশে ফিরে এসেই শেখ হাসিনা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে খুনি বলে কুৎসা রটনা করতে থাকেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ইতিহাসের পক্ষপাতদুষ্ট ভারতীয় সংস্করণই দেখেছেন, সঠিক ইতিহাস নয়। সুতরাং এজাতীয় দাবি তার পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। তা ছাড়া দিল্লিতে থাকা অবস্থায় দিল্লির নাগরিক সমাজের সাথেও তাদের মেলামেশার সুযোগ ছিল না।
এসব যোগাযোগ উপেক্ষণীয় নয়
জেনারেল এরশাদ ইন্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণের সময় র-এর উপমহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাসদেও সিংয়ের সাথে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে আবার বৈধ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. কামাল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাককে দিল্লি পাঠিয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া স্বর্ণ ও হীরক অলঙ্কারসহ (টিয়ারাসহ) তখনকার অঙ্কে ৩৩ কোটি টাকার সম্পত্তি হাসিনাকে বুঝিয়ে দেন। শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেন ১৭ মে ১৯৮১ সালে। তার ১৩ দিনের মাথায় ৩০ মে এক সামরিক ষড়যন্ত্রে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন এবং মনে রাখতে হবে যে, জাতীয়তাবাদী জিয়াকে ভারত মোটেই পছন্দ করেনি। যোগাযোগগুলো উপেক্ষা করার মতো নয়।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ১৫ বার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৮৬ সালে বিবিসি থেকে ১২ পর্বের একটি অনুষ্ঠানমালা আমি প্রচার করেছিলাম। সে অনুষ্ঠানের অনুলিপি ঢাকার ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছিল। সে অনুষ্ঠানগুলোর জন্য আমি সংশ্লিষ্ট অনেকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। ১৯৮৩ সালের ১৫ নভেম্বর (রানী এলিজাবেথের বাংলাদেশ সফরের সময়) গুলশানের একটি বাড়িতে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে আমার সাক্ষাৎকারও অনুষ্ঠানমালায় সংযোজিত হয়েছিল।
বাকশাল সরকারের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের ঘাতকদের নেতা কর্নেল ফারুক রহমান একাধিকবার লন্ডনে টেলিফোন করে আমাকে সাক্ষাৎকার দিতে চেয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালে জেনারেল এরশাদ তার ভোটারবিহীন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কর্নেল ফারুককে নির্বাচন করার সুযোগ দেন। ফারুক তখন আবারো আমাকে ঢাকায় সাক্ষাৎকারদানের এবং তার সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তার আমন্ত্রণ রাখার প্রবৃত্তি আমার হয়নি। কিন্তু আমার সহকর্মী নিক ন্যুজেন্ট আমার হয়ে কর্নেল ফারুকের সাক্ষাৎকার নেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অশান্তির ব্যাপারে বিদেশী হস্তক্ষেপের কথা ফারুক তখন নিক ন্যুজেন্টকে বলেছিলেন।
কর্নেল ফারুক বলেছিলেন, ‘ডিস্ট্যাবিলাইজেশনের পেছনে মূলত বিদেশী দেশগুলো আছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতার জন্য বারবার মিলিটারি আসছে; বাইরে থেকে যদি এজেন্ট (পাঠানো এবং) উসকানি দেয়া বন্ধ করে দিত, আর যদি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা যেত, সিভিল-মিলিটারি এক করা যেত, ঔপনিবেশিক পদ্ধতি হটানো যেত, তাহলে বাংলাদেশে কোনো রকমের এই ক্যু-টু বা অসুবিধা হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।’
মোশতাক কিভাবে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন
ছিয়াশি সালে আমি ঢাকায় সাবেক প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মোশতাক আহমদেরও একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। মোশতাক সাহেব বিস্তারিত আলোচনায় তখনকার সশস্ত্রবাহিনীগুলোর বহু কর্মকর্তার নামোল্লেখ করেছেন, কিন্তু একবারও কোথাও জেনারেল জিয়াউর রহমানের নাম আলোচনায় আসেনি। যেমনÑ ১৫ আগস্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সকালবেলা ৮টার সময় আমাকে আমার বাসা ৫৪ নম্বর আগামসি লেন থেকে কর্নেল রশিদ সাহেব এবং তার অন্যান্য সহকর্মী রেডিও স্টেশনে নিয়ে যান। সেখানে আমি সর্বপ্রথম ফারুক সাহেবকে দেখি। তার পরে সাড়ে ৮টা থেকে ১০টা-১১টা পর্যন্ত আলাপ-আলোচনা করি।... রশিদ সাহেবকে বললাম যে, আপনারা কারা এসব করেছেন? আবার আমাকে বলছেন দায়িত্ব নিতে। তিনি বললেন, বাংলাদেশে আপনি একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। আপনাকে দায়িত্বভার নিতে হবে। আমি বললাম, ঠিক আছে, কিন্তু আপনাদের সকলকে আমি চিনি না। বাহিনীগুলোর প্রধানদের আমি চিনতাম। তারা কোথায়?
জবাবে রশিদ সাহেব আমাকে বললেন যে, আপনি যদি তাদের চান তাদের ১৫ মিনিটের মধ্যে আমরা নিয়ে আসব। সে দিনের সামরিক বাহিনীর প্রধান সফিউল্লাহ সাহেব (যিনি ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবকে পেছনের দরোজা দিয়ে পালিয়ে যেতে বলেছিলেন), নেভির প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এইচ খান, বিমানবাহিনীর প্রধান এ কে খন্দকার, বিডিআরের প্রধান জেনারেল খলিলুর রহমান, তার পরে বোধ হয় পুলিশপ্রধানও এলেন। ... রক্ষীবাহিনীর যে দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন (প্রধান ব্যক্তি বোধ হয় সেদিন দেশে ছিলেন না) তিনিও এসে আনুগত্য জানান।’
খোন্দকার মোশতাক দিল্লির প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন না। অন্য দিকে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ভারতপন্থী বলে ধারণা প্রচলিত ছিল। অন্তত তার অভ্যুত্থানের দিন (৩ নভেম্বর ১৯৭৫) দিল্লির সাউথ ব্লকে (পররাষ্ট্র দফতর) সেদিন মিষ্টান্ন বিতরণ করা হয়েছিল। এ অভ্যুত্থান সম্বন্ধে খোন্দকার মোশতাক আমাকে বলেন, ২ নভেম্বর তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে ৫০ দিনের মধ্যেই সংসদের নির্বাচন হবে। সে নির্বাচন সম্বন্ধে তিনি সেদিন রাত দেড়টা পর্যন্ত স্পিকার আবদুল মালেক উকিল, মন্ত্রিসভার সদস্য ডক্টর মেজাফফর চৌধুরী, মনোরঞ্জন ধর, জেনারেল ওসমানী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর প্রমুখের সঙ্গে আলোচনা করেন। তারপর তিনি শুতে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই কিছু অস্বাভাবিক শব্দ শুনে তিনি অন্য একটি কামরা থেকে কর্নেল রশিদকে ডেকে পাঠান, কেননা তার টেলিফোন বিচ্ছিন্ন ছিল। রশিদের কাছ থেকেই তিনি খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের খবর জানতে পারেন।
পরদিন সকালে মিলিটারি সেক্রেটারির কামরায় গিয়ে তিনি খালেদ মোশাররফের টেলিফোন কল রিসিভ করেন। ‘সেখানে খালেদ মোশাররফ আমার সাথে কথা বলে। খালেদ মোশাররফের পর আমি যাকে এয়ারফোর্সের প্রধান নিযুক্ত করেছিলামÑ তোয়াবÑ সেও কথা বলল। সে বলল, আমি এখানে আছি। এই এদেরে আর্মস সারেন্ডার করতে বলেন। খালেদ মোশাররফও সেই কথাই বলেছে। ... তা না হলে বঙ্গভবনেই বোমা ফেলা হবে।’
ভারতপন্থী সামরিক অভ্যুত্থান
খোন্দকার মোশতাক বিমানবাহিনীর মতো সেনাবাহিনীর নেতৃত্বেও রদবদল আনেন। তিনি সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে জেনারেল সফিউল্লাহর স্থলে চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত করেন। খালেদ মোশাররফ ও তার প্রতি অনুগত অফিসাররা ২-৩ নভেম্বর রাতে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দফতরে অবস্থান নিয়ে তাদের অভ্যুত্থানের ঘোষণা দেন। মনিরুল ইসলাম চৌধুরী তখন চতুর্থ বেঙ্গলে ক্যাপ্টেন ছিলেন। পরে জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকারের সময় তিনি তার জনসংযোগ কর্মকর্তা হন এবং কর্নেল মুনির নামে পরিচিত ছিলেন।
’৮৬ সালে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি আমাকে ১৫ আগস্ট থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের ঘটনাবলির বিশদ বিবরণ দেন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট মোশতাকের কাছে খালেদ মোশাররফ ও তার সাথীরা যেসব দাবি জানান তার মধ্যে বিশেষ করে ছিল, যেসব অফিসার বঙ্গভবনে এবং রেসকোর্সে নিজেদের ট্যাংক রেজিমেন্ট দিয়ে বেষ্টিত করে রেখেছিলেন, ওদেরকে ক্যান্টনমেন্টে ফেরত আসতে হবে; তারপর প্রেসিডেন্ট সাহেবকে সেনাবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর প্রধানদেরকে (জেনারেল জিয়া এবং এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব) চাকরি থেকে সরাতে হবে। তারপরে প্রেসিডেন্ট সাহেবকে প্রেসিডেন্ট হিসেবেই রাখার প্রস্তাব দিয়েছেলেন খালেদ মোশাররফ। লক্ষণীয় যে, কর্নেল মুনিরও ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড কিংবা পরবর্তী সামরিক অভ্যুত্থানে জেনারেল জিয়াউর রহমানের কোনো ভূমিকা থাকার কথা উল্লেখ করেননি। তবে ২ নভেম্বর রাতে জিয়াকে গৃহবন্দী করার প্রসঙ্গ তিনি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।
বাংলাদেশ ও ভারতে রানী এলেজাবেথের রাষ্ট্রীয় সফরে সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের সাথে আমিও ছিলাম। ১৪ নভেম্বর (১৯৮৩) আমরা ঢাকা পৌঁছি। কথা ছিল পরদিন আমি রানীর স্বামী প্রিন্স ফিলিপের সাথে শ্রীমঙ্গল যাব। কিন্তু অতি ভোরে জনৈক ক্যাপ্টেন হায়দার শেরাটন হোটেলে এসে আমার ঘুম ভাঙালেন। তিনি বললেন, মাননীয় রাষ্ট্রপতি আমাকে প্রাতঃরাশের নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন, এখনি আমাকে তৈরি হয়ে তার সাথে যেতে হবে। কর্নফেকস থেকে পরোটা আর ভাজা কিডনি পর্যন্ত বহু পর্বের প্রাতঃরাশ খেতে খেতে জেনারেল এরশাদ আমাকে তার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের একটা বর্ণনা দিলেন। তারপর তিনি বলেন যে, প্রধান দু’টি দলের নেত্রীদের কেউ যদি একটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য তাকে মনোনয়ন না দেন তাহলে তিনি নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করতে বাধ্য হবেন। নেত্রীদের মতামত যাচাইয়ের দায়িত্ব তিনি চাপিয়ে দিলেন আমার ওপর।
শ্রীমঙ্গল সফর বাতিল করে আমি প্রথমেই গেলাম ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে। অনেক ঘুরিয়ে তিনি যা বললেন তার সার কথা হচ্ছে, জেনারেল এরশাদ কী কী শর্তে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান, না জেনে কোনো জবাব দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না। বেগম খালেদা জিয়ার কাছে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশে বিবিসির সংবাদদাতা আতাউস সামাদ। তিনি আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন যে, আমি জেনারেল এরশাদের সঙ্গে দেখা করে এসেছি। এরশাদের নাম শুনেই বেগম জিয়া এমনই ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন যে, আমি আর এরশাদের প্রস্তাবের প্রসঙ্গ তোলার সাহসই পাইনি। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললাম যে, ’৭৫ খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান ও তার স্বামীকে গৃহবন্দী করা এবং ’৮১তে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যা সম্বন্ধে তার স্মৃতি রেকর্ড করে নিয়ে যেতেই এসেছি আমি।
মোশাররফের অভ্যুত্থান : বেগম জিয়ার স্মৃতি
খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে বেগম জিয়া বলেন, ‘দুই তারিখ রাত্রে আমরা বাইরে গিয়েছিলামÑ ডিনার ছিল একটা। রাত প্রায় ১২টার দিকে আমরা ফিরে এসে শুয়ে পড়েছি। রাত্রিবেলা হঠাৎ দুটার দিকে কলিং বেল বাজল। তখন স্বাভাবিকভাবেই বাসায় কেউ ছিল না। আমার স্বামী নিজেই দরজা খুলল। আমি দেখতে গেলাম কী হয়েছে। সামনের দরজায় গিয়ে বেশ কিছু লোকজন দেখলাম। আর্মি অফিসার আছে দু-চারজন, আরো লোকজন দেখলাম। দেখলাম আমার স্বামী তাদের সঙ্গে বাইরে বারান্দায় বসেই কথাবার্তা বলছে। কী হচ্ছে ব্যাপারটা আমি ঠিক তখনো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
‘ভোরের দিকে যখন আলো হলো, তখন দেখলাম সে তাদেরকে নিয়ে ঘরের ভেতরে ড্রইং রুমে এসে বসল। খুবই নর্মাল ব্যবহার করছিল সে। বলল, এদেরকে চা দাও, নাশতা দাও। ... সকাল হবার পরে আমি বুঝতে পারলাম যে ব্যাপারটা অন্য রকম। আমার (বাসার) গেট-টেট বন্ধ। কেউ বাইরে যেতে পারছে না, কেউ বাইরে যাচ্ছে না। এর মধ্যে আসলেন, আমার পাশের বাসায় ছিলেন, এখন তিনি জেনারেল হয়েছেন, জেনারেল মইন (জেনারেল মইনুল ইসলাম চৌধুরী?)। তিনি একটু আলাপ-সালাপ করলেন। তিনি আমাকে বললেন, বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাবেন না।’
৭ মার্চের ঘটনাবলি সম্বন্ধে বেগম জিয়া বলেন, “সাত তারিখে রাত্রিবেলা, রাত্রি ১২টার সময় থেকে একটু একটু গোলাগুলির শব্দ হচ্ছে। আমরা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে। কিছুক্ষণ গোলাগুলি চলার পরে শুনলাম যে কতগুলো স্লোগান হচ্ছে। ‘নারায়ে তকবিরÑ আল্লাহ আকবর’Ñ এ রকম স্লোগান হচ্ছে। আস্তে আস্তে ওটা বাড়তে লাগল। একপর্যায়ে দেখলাম সকলে এদিকে আসছে, আমাদের বাসার দিকে আসছে। আমার গেট বন্ধ ছিল। সে গেটটা একদম ভেঙে ফেলার মতো অবস্থা। শেষ পর্যন্ত গেটটা ভেঙেই ফেলল। আমার সামনের দরজা ভেঙে সব হুড়মুড় করে বাসায় ঢুকে বলল, স্যার কোথায়? আমার স্বামী তখন বেরিয়ে এলেন, ওদের সঙ্গে কথা বললেন। তারপর তারা তাকে কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। তার নামে স্লোগান দিচ্ছিল।”
[প্রসঙ্গত, ঢাকা ছাড়ার আগে দুই নেত্রীর প্রতিক্রিয়ার খবর প্রেসিডেন্ট এরশাদকে শুনিয়েছিলাম। ২৬ নভেম্বর দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে কমনওয়েলথ সরকারপ্রধান সম্মেলনে আমরা ক’জন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে কথা বলছিলাম। ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খোন্দকার আমাকে ডেকে জেনারেল এরশাদের কাছে নিয়ে গেলেন। এরশাদ আমাকে বললেন যে, অবশেষে তিনি নিজের একটা রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে জনদল নাম রাখার প্রস্তাব হয়েছে।]
জেনারেল জিয়াউর রহমানের খুব সম্ভবত চারটি সাক্ষাৎকার নিয়েছি আমি। সমকালীন বিষয়াদি নিয়েই সেগুলোতে মূলত আলোচনা হয়েছে। তবে আমার মনে হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং দিকনির্দেশক ছিল ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি দীর্ঘ বৈঠক ও আলাপচারিতাÑ সাক্ষাৎকার নয়। আগে থেকেই সাক্ষাৎকারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট স্থির ছিল। সে অনুযায়ী সেদিন সকালের ফাইটে আমি রাজশাহী থেকে ঢাকা ফিরে আসি। তখন বিমানবন্দর ছিল তেজগাঁওয়ে। বেরুবার মুখে পরিচিত এক ব্যক্তির সাথে দেখা। কুশলাদি বিনিময়ের পর তিনি বললেন, সিএমএল-এর (প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক) ইন্টারভিউ নিতে ঢাকায় ফিরেছেন বুঝি। আমি হ্যাঁ-সূচক জবাব দিলাম। তিনি বললেন, ইন্টারভিউ আজ হবে না। জেনারেল জিয়া কিছুক্ষণ পরেই চাটগাঁ যাচ্ছেন।
আমাকে তথ্য দিতে পেরে তিনি বেশ গর্বিত মনে হচ্ছিল। বললেন, পতেঙ্গা ক্যান্টনমেন্টে গোলমাল চলছে। একজন সার্জেন্ট জনৈক মেজরকে স্যালুট করতে অস্বীকার করায় মেজর তার হাতে গুলি করেছিলেন। খুব টেনশন চলছে সেখানে। জওয়ানরা আবার ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, অফিসারের কল্লা চাই’ বলে স্লোগান দিচ্ছে। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে জেনারেল জিয়া বিকেলে সেখানে যাচ্ছেন। আমার কৌতূহল হলো। ভাবলাম ভদ্রলোককে বাজিয়ে দেখি। তিনি হতাশ করেননি। বললেন, এ জাতীয় ঘটনা আরো কোনো কোনো ক্যান্টনমেন্টেও ঘটেছে। চেন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে জিয়া এনসিও-দের এখান থেকে সেখানে আর সেখান থেকে অন্যখানে বদলি করছেন।
সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলার অভাব সম্বন্ধে আমি আগেই বিস্তারিত জেনেছিলাম। আমার বড় ভাই এয়ার কমডোর এ বি এম মাহবুবুর রহমান ক্যান্টনমেন্টে জেনারেল জিয়ার বাড়ির কাছেই থাকতেন। তিনি কাছের এক অফিসারের খালি বাড়িতে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে বাড়ির দেয়ালে অন্তত এক হাজার বুলেটের গর্তি ছিল। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের চার দিনে সেনাবাহিনীর ভেতরে অনুরূপ হিংস্রতা আরো বহু হয়েছে বলে বড় ভাই আমাকে বলেছিলেন। বলেছিলেন মিছিল করে সিপাহিদের স্লোগান দানের কথাও। বিমানবন্দরে ভদ্রলোক মোটামুটি একই রকম বিবরণ দিয়েছিলেন আমাকে।
একটি ঐতিহাসিক আলাপচারিতা
শেরাটন হোটেলে ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই সিএমএল-এর অপিস থেকে টেলিফোন এলো। জেনারেল আমার সাথে সময় নিয়ে গল্প করতে চান। সেদিন তার হাতে বেশি সময় নেই। পরের দিন তার অপিসে যেতে আমার কী খুব বেশি অসুবিধা হবে? গরজ আমারই, সুতরাং বলতেই হলো যে, কোনো অসুবিধা হবে না। আমার হাতে তখনকার ভারী টেপ রেকর্ডার এবং আমার ক্যামেরা ছিল। জেনারেল জিয়া আমাকে অভ্যর্থনা করতে নিজেই এগিয়ে এলেন। হাত থেকে ক্যামেরা আর টেপ রেকর্ডার নিয়ে তার পিএস কর্নেল অলির হাতে দিলেন। ইংরেজিতে বললেন, অলি, এগুলো প্রাণপণে রক্ষা করবে। তোমার-আমার কাছে রাইফেল যেমন গুরুত্বপূর্ণ মি. রহমানের কাছে টেপ রেডর্কারও সে রকম। আমাকে ভেতরে তার অপিস কামরায় নিয়ে গেলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান।
আমার স্যুটের জ্যাকেট খুলে নিজের হাতে কামরার একেবারে শেষ মাথায় জ্যাকেটে রাখলেন। বললেন, কী আবার স্যুট-ট্যুট পরে এসেছেন! আমি বললাম, স্যার স্যুট আমার প্রয়োজনে নয়। শীতের দেশে থাকি, বাংলাদেশের ফেব্রুয়ারি আমার জন্য খুবই আরামদায়ক। স্যুট পরেছি আপনার সম্মানে এবং আশ্বাস দিচ্ছি পকেটে রিভলবার কিংবা মাইক্রোফোন লুকোনো নেই। হো-হো করে হাসলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। আড়ষ্টতা কেটে একটা সহজ-স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি হলো। তারপর আর আমাদের আলোচনায় কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি।
জেনারেল জিয়া তার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সমস্যাগুলোর একটা তালিকা দিলেন আমাকে। দেশ ছোট, সম্পদ কম, কিন্তু জনসংখ্যা বিশাল। সবচেয়ে বড় সমস্যা দেশের বিশাল শিক্ষিত বেকারের সমস্যা। এদের গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা না গেলে এরাই দেশের সর্বনাশ ডেকে আনবে। তিনি বলেন, এ লক্ষ্যে তিনি একটা কর্মসূচি তৈরি করছেন। ওদিকে বাংলাদেশের মানুষ মনেপ্রাণে গণতন্ত্র চায়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চায়। অথচ শেখ মুজিবুর রহমান দুটোরই পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। জিয়া বলেন, এ অবস্থা মানুষ কিছুতেই বেশি দিন সহ্য করবে না। তিনি সংবাদপত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে নিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলো এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞাও শিগগির প্রত্যাহার করা হবে। সে লক্ষ্যে তিনি বিশেষজ্ঞ ও চিন্তানায়কদের সাথে আলোচনা ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছেন। জিয়া আরো বলেন, ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানের পতনের একটা বড় কারণ। দেশের দরিদ্রতম জনসাধারণকে কিভাবে খাদ্য দেয়া যায় সে চিন্তাও করছেন তিনি।
স্বাধীনতার যুুদ্ধের যারা বিরোধিতা করেছেন তিনি কেন তাদের সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চান, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি আবার দেশের সমস্যাগুলোর উল্লেখ করে বলেন, গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ এবং সংহত করা না গেলে এমন দুরূহ সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে না। তিনি আরো বলেন, তা ছাড়া এই লোকগুলো তো বাংলাদেশেরই সন্তান। অন্য কোনো দেশ তো আর ওদের নেবে না। কিছুটা হালকা সুরে তিনি বলেন, মি. রহমান, আপনি তো বিলেতে থাকেন, ওদের বলে দেখুন না এই লোকগুলোকে নেবে কি না। তারপর আবার সিরিয়াস হয়ে গেলেন তিনি। বললেন, ওদের দেশে থাকতে দেব অথচ একঘরে করে রাখব, তাহলে তো প্রতি মুহূর্ত পিঠে চুরি মারার ভয়ে আমাকে পিঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে; দেশের কাজ করার সুযোগ পাব কখন? আপনিই বলুন, এই লোকগুলোকে নিয়ে আমি কী করি? তাদের কি আমি বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিয়ে আসব?
সেনাবাহিনী নিয়ে জটিল সমস্যা
আগের দিন তিনি কেন চাটগাঁ গিয়েছিলেন জানতে চাইলাম আমি। তিনি বললেন, সেটাও শুনেছেন? তা হলে শুনুন, আমিও জানি যে আজ সন্ধ্যায় আপনিও চাটগাঁ যাচ্ছেন। খোঁজখবর নিয়ে জেনে নিন না। আমি তাকে সেনাবাহিনীর চেন-অব-কমান্ড সম্বন্ধে প্রশ্ন করি। তিনি বলেন, চেন-অব-কমান্ড অবশ্যই ফিরিয়ে আনতে হবে, সেনাবাহিনীর অস্তিত্বের প্রয়োজনে। জেনারেল জিয়া বলেন, সেনাবাহিনীর ভেতরে সমস্যা খুব বেশি নয়, কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি করছে বাইরের কোনো কোনো মহল। বাইরের এই মহলগুলো দেশের ভেতরের কিংবা দেশের বাইরের সে প্রশ্ন তখন আমার মনে আসেনি। এসেছিল কর্নেল ফারুক রহমানের সঙ্গে নিক ন্যুজেন্টের সাক্ষাৎকার শুনে। সেটা ১৯৮৮ সালের কথা। জেনারেল জিয়া তার অনেক আগেই শহীদ হয়েছেন।
আমি বিলেত ফিরে আসার কিছুকাল পরেই জেনারেল জিয়ার ১৯ দফা কর্মসূচির খবর আসে। আমার তখন আমাদের সে আলাপচারিতার কথা মনে হলো। দরিদ্রতম জনসাধারণের খাদ্য সংস্থানের লক্ষ্যে তিনি কাজের বিনিময়ে খাদ্য এবং খাল খনন ও নদী সংস্কারের কর্মসূচি শুরু করেন। মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর বিনিময়ে পরিবারকে খাদ্য দেবার রীতিও তিনিই প্রথম চালু করেন। পরবর্তী কালে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই কর্মসূচির প্রসার ও বিবর্তন করেন। বাংলাদেশের মেয়েরা এখন সামান্য ব্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিতে পারছে তার কৃতিত্ব রাষ্ট্রপতি জিয়া এবং প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার। প্রেসিডেন্ট জিয়ার খাল খনন ও নদী সংস্কারের কর্মসূচিতে দেশজোড়া অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে গিয়েছিল। বেকার ও পেশাজীবী সব শ্রেণীর মানুষ সে কর্মসূচিতে সাড়া দিয়েছিলেন। আমার সহকর্মী (স্যার) মার্ক টালি ময়মনসিংহ জেলায় ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের ভাঙন ঠেকানোর জন্য এ রকম মাটি কাটার প্রকল্পের খুবই সুন্দর একটা শব্দচিত্র পাঠিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “নদী দ্রুততর পাড় ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে নতুন একটা পাটকল আর একটা রেলসেতু ভেসে যাবে। নদীর গতি পরিবর্তনের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে দুই মাইল লম্বা একটা খাল খননের পরিকল্পনা করা হলো। সে জন্য হাতে ধরে ৬০ লাখ ঘনফুট মাটি কাটতে হবে। প্রথম দিকে ৫০ হাজারেরও বেশি লোক হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে, সেনাবাহিনী আর পুলিশের লোক, কলকারখানা আর সরকারি অফিস থেকেও লোক এসেছিল। আমার জন্য সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল যে, বেশ কিছু মহিলাও এসেছিলেন। মহিলাদের একটি দলের নেত্রী ছিলেন ময়মনসিংয়ের মহিলা সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান। ... প্রথম ঝুড়ি মাটি কাটলেন জেনারেল জিয়া স্বয়ং। জনতা তখন ধ্বনি তুলছিলÑ ‘জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ’।”
মার্ক টালি আমার চেয়েও বেশি বার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তাকে তিনি ভালোভাবেই চিনতেন। জিয়ার হত্যার খবর পেয়ে মার্ক মন্তব্য করেছিলেন, ‘লোকটা তার প্রাণের সেনাবাহিনীকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন। সে জন্যই তাকে প্রাণ দিতে হলো।’
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন