অবৈধভাবে অর্থের লেনদেনের (মানি লন্ডারিং) অভিযোগে করা মামলায় খালাস পেলেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। একই মামলায় তার বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সাত বছরের কারাদ- ও ৪০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩-এর বিচারক মোঃ মোতাহার হোসেন ১৭ নবেম্বর ২০১৩ এ রায় ঘোষণা করেছেন।
তিন দিন আগে মামুনের পক্ষে চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে বিচারক মোতাহার হোসেন রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করেন। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলার এই রায় ঘোষণা নিয়ে সবার নজর ছিল আদালতের দিকে। রায় শোনার পর সারাদেশে বিএনপি উল্লাস করেন। তাদের একই দাবি তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সকল মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর ক্যান্টনমেন্ট থানায় আসামীদের বিরুদ্ধে এ মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১০ সালের ৬ জুলাই তারেক রহমান ও মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। ২০১১ সালের ৮ আগস্ট তারেক রহমানকে পলাতক দেখিয়ে অভিযোগ গঠন করা হয়। এর আগে মানি লন্ডারিংয়ের পৃথক মামলায় আরাফাত রহমান কোকোর ছয় বছর সাজা হয়েছিল।
তারেক রহমান বিদেশে আছেন-জামিনে আছেন। এটা আদালত অবগত আছেন। তারপরও তাকে ফিরে আসার জন্য ২৬ মে ইন্টারপোলের মাধ্যমে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য বিচারক নির্দেশ দেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ওই গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও পাঠানো হয়। এরপর তারেক রহমান ফিরে আসেননি। কারণ তিনি জামিনে রয়েছেন। এখন আদালত তার অনুপস্থিতিতেই রায় দিতে যাচ্ছে।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর খালেদা জিয়া এবং তার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোসহ জিয়া পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মোট ২৭টি মামলা ও একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। যার মধ্যে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পাঁচটি, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ১৬টি ও একটি সাধারণ ডায়েরি, আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে ৫টি এবং তারেকের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় আরও একটি মামলা। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা পাঁচটি মামলার মধ্যে তিনটির কার্যক্রম আদেশের মাধ্যমে স্থগিত রেখেছেন হাইকোর্ট। কার্যক্রম চলছে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার। এ মামলাগুলোর যেকোনও একটির রায় দেওয়া হতে পারে আসন্ন নির্বাচনের আগেই।
তারেক রহমানের পিতা জিয়াউর রহমান-মাতা খালেদা জিয়ার আদরের দেয়া নাম পিনু। তিনি এমন এক পিতার সন্তান যিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে, মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় অবদান রেখে, ৭ নবেম্বর বিপ্লবের প্রাণপুরুষ হিসেবে বরিত হয়ে একটি নতুন জাতিসত্তা সৃষ্টি ও নির্মাণে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন। তিনি এমন এক মায়ের সন্তান যিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আপোসহীন নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান; তিনবার পাঁচটি করে নির্বাচনী আসনে বিজয়ী হয়ে সফল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশে-বিদেশে অফুরান ভালবাসা ও অকুণ্ঠ প্রশংসায় সিক্ত হন এবং সার্কনেত্রী হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় তাঁর অনন্য ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন। সেই পিতা-মাতার সন্তান হিসেবে তারেক রহমান ‘উন্নয়নের রাজনীতি’ দিয়েই বিপুল আবেগে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন এবং রাজনীতিতে নিয়ে আসেন এক নতুন মাত্রা। প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মুসা তার একটি লেখায় এ তরুণ নেতার বিশেষত্ব নিপুণভাবে তুলে ধরেছিলেন।
তারেক রহমানের বয়স তখন মাত্র ৭ বছর। দেশের রাজনীতির গনগনে উত্তাপ। সৈনিক পিতা যুদ্ধে গেছেন। মায়ের সঙ্গে দু’ভাই তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান। আরাফাতের ডাক নাম কোকো। ১৯৭১ সালের সেই ঝঞ্ঝামুখর দিনে পাকিস্তানীরা যখন নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো, আর আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব পিছু হটে গেল, সেই দুঃসময়ে রুখে দাঁড়ালেন মেজর জিয়া। সময়ের সাহসী সৈনিক মেজর জিয়া প্রথমে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন দখলদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। পরে কালুরঘাটস্থ রেডিওতে দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন স্বাধীনতার কথা। সাহায্য চান বিশ্ববিবেকের। সেই ঘোষণায় দিশেহারা জাতি মুহূর্তেই সচল, সজীব, আগুয়ান হয়ে ওঠে। ‘অসীম বল-ভরসা নিয়ে সকলেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাত্র সাত বছর বয়সে সেই ঘোষণার মর্ম তারেক রহমানের বুঝতে পারার কথা নয়।
১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর আবার একজন জিয়ার প্রয়োজন পড়েছিল দেশ ও জাতির। এ সময় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের শহীদ মইনুল সড়কের বাসভবনেই বন্দী দশায় নিপতিত হন সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমান। গাঢ় অন্ধকারের বুক চিরে যেভাবে সোনালী সূর্য উদ্ভাসিত হয়, তেমনিভাবেই সেদিন বন্দীদশা থেকে ক্ষমতার মঞ্চে উত্থিত হয়েছিলেন এ জাতির কান্ডারি জিয়াউর রহমান। সিপাহী-জনতার প্রাণ-অফুরান ভালবাসায় সিক্ত হয়ে দেশবাসীর নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
১৯৭৫ সালের এই ঘটনাবলী যখন চলছিল, তখন তারেকের বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। সেই বয়সে এই ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর মর্মার্থ বোঝা সহজ ছিল না। যখন বয়স হলো, তখন তিনি পিতাকে পাননি কাছে। কারণ প্রেসিডেন্ট জিয়া রাষ্ট্রীয় কাজে এতোই ব্যস্ত থাকতেন যে, পরিবারের প্রতি খুব অল্পই নজর দেয়ার সময় পেতেন; দিনে ১৮ ঘণ্টা কাজে ব্যস্ত থাকতেন তিনি।
এমন অবস্থা চলতে চলতেই ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে আততায়ীর গুলীতে শহীদ হন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। শেরেবাংলা নগরে তাঁর জানাযায় লাখ লাখ মানুষ যোগ দিয়েছিলেন। জানাযা অনুষ্ঠানে এতো বিপুল জনসমাগম কখনো কোথাও দেখা যায়নি আর। ১৮ বছরের তরুণ আজকের তারেক পিতার কফিনে হাত রেখেছিলেন। শেষ বিদায় দিতে গিয়ে তার দু’চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত, দেশ ও জাতির জন্য আমরণ যিনি কাজ করে গেলেন, সন্তানদের কাছে যিনি অজানাই থাকলেন, তাঁকে এমনভাবে বিদায় দেয়া সহজ ছিল না। পিতৃহারা দু’শিশুকে মানুষ করেন ‘মা’ দেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়া। সব সময় মায়ের কাছেই থাকেন তিনি। রাজনৈতিক কারণে কখনো বাসার বাইরে থাকলে বারবার ফোনে কথা বলে নেন মায়ের সঙ্গে।
১৯৯০ সালের ২০ নবেম্বর এক অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে শহীদ মঈনুল রোডের বাড়িতে জোর করে ঢুকে তারেককে আক্রমণ করেছিল। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর উৎফুল্ল জনতার মধ্যে তাকে দেখা গেছে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। ৯ বছরের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তির আনন্দে তাকে দেখা গেছে আবেগে অধীর, উৎফুল্ল।
জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার পরেই তারেকের অবস্থান। তরুণদের মধ্যে তারেকের জনপ্রিয়তা তুলনাহীন। সততা, নিষ্ঠা, আচার-আচরণ এবং রাজনৈতিক দর্শন দিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ছাত্র-ছাত্রী, কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে ঘুরে মানুষের সুখ-দুঃখের কথা শুনেছেন। যেখানে দুর্যোগ, দুর্বিপাক সেখানে ছুটে গেছেন তারেক। গ্রামের মানুষ তারেককে কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে যেতেন। জড়িয়ে ধরেছেন বুকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করেছেন মুরুব্বিরা। তারেক রহমানের আচার-আচরণ দেখে এবং বক্তৃতা শুনে অনেকে বলতেন, ‘এ যে আরেক জিয়া’।
যে বয়সে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এদেশের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিনন্দিত হয়েছিলেন, সে বয়সে এসে তারেক মানুষের মন জয় করতে চারণের মতো ঘুরেছেন গ্রামে-গঞ্জে। মৃদুভাষী তারেক রহমান খুব সহজেই মানুষের সঙ্গে মিশতে পারেন। সকলের মন জয় করতে পারেন। তার স্মরণশক্তির প্রশংসাও করেছেন অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তি। তার মধ্যে শহীদ জিয়ার প্রতিকৃতি দেখতে পান তারা।
অল্প দিনের মধ্যেই তারেক রহমান অর্জন করেন আকাশ-ছোঁয়া জনপ্রিয়তা। বাংলার ঘরে ঘরে জিয়া, খালেদা জিয়ার পাশাপাশি শোভা পায় তারেকের ছবি। তারেক রহমানের মতো একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, দেশপ্রেমিক ও দূরদর্শী রাজনীতিকের উত্থান দেখে বাংলাদেশের মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখতে থাকে। মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা দলে দলে রাজনীতিতে আসতে থাকে। রাজনীতির প্রতি যাদের অনীহা ছিল তারাও সমবেত হন তারেকের দলের পতাকাতলে।
তারেক রহমান ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের সোজাসাপটা বলে দিয়েছেন ‘তোমরা প্রথমে পড়ালেখা করবে এরপর রাজনীতি। রাজনীতি করবে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য। ছাত্রদলের কোনো নেতা-কর্মী টেন্ডারবাজিতে জড়াতে পারবে না, সচিবালয়ে যেতে পারবে না, অস্ত্র হাতে নিতে পারবে না।’ ছাত্রদলের নেতারা তা-ই শুনেছেন। তারা টেন্ডারবাজিতে জড়ায়নি। সচিবালয়ে যায়নি। বিএনপি পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল কিন্তু তারেক একবারের জন্যও সচিবালয়ে যায়নি। সরকারি কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করেনি। পাঁচটি বছর তিনি ব্যস্ত ছিলেন দল গোছানোর কাজে এবং জনসেবায়।
প্রচ- শীতে তারেক রহমান ছুটে গেছেন শীতার্তদের মাঝে। তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন শীতবস্ত্র। অর্থাভাবে যে মেধাবী ছাত্রটির লেখাপড়া মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেছে তারেক রহমান সে ছাত্রটিকে খুঁজে বের করে তার পড়ালেখার ভার গ্রহণ করেছেন। শহীদ জিয়ার মতো নিজ হাতে খাল কেটেছেন। কৃষকদের উন্নত বীজ দিয়ে সাহায্য করেছেন এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। দেশের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত ঘুরে ঘুরে দরিদ্রদের স্বাবলম্বী করতে তাদের মাঝে বিতরণ করেছেন হাঁস-মুরগি, ছাগল, গাছের চারা, শস্যবীজ ইত্যাদি। এসব করেছেন জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে। পাশাপাশি তিনি দুর্নীতি, বাল্যবিবাহ, যৌতুক, সন্ত্রাস, মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ করে দলের নেতা-কর্মী ও জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
কি অপরাধ তারেকের? তারেক এ দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসেন এটাই কি তার অপরাধ? তিনি বিএনপিকে একটি শক্তিশালী দলে পরিণত করেছেন এটাই কি তার দোষ? ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন তিনি। অনেক রাজনৈতিক ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সঞ্চয় করেছেন অসামান্য অভিজ্ঞতা।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার পিছনের কারিগর তারেকÑতাই কি এতসব ষড়যন্ত্র? ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতা দখলের সব ধরনের আয়োজন পাকাপোক্ত করে রাখে। কিন্তু তারেকের পলিসির কাছে পরাস্ত হয় তারা। ফলে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট দু’-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনে বিজয়ী হয়। এরপর থেকে শুরু হয় তারেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা। পরবর্তীতে তারেক দেশব্যাপী বিএনপি ও ছাত্রদলের তৃণমূল প্রতিনিধি সভার আয়োজন সহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপিকে অত্যন্ত শক্তিশালী দলে পরিণত করলে শুরু হয় নানামুখী চক্রান্ত। বিএনপির বিরোধী পক্ষ এবং কয়েকটি চিহ্নিত প্রিন্ট মিডিয়া তারেকের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করে। তারেক রহমান তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ হাজির করার আহ্বান জানান। কেউ তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। এরপরও মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে গেলে তিনি আইনের আশ্রয় নেন। বিষোদগারকারীদের নামে উকিল নোটিশ পাঠান। এরপর কিছুদিন চুপ থাকলেও ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়কের সময়ে মহলটি আবারো সোচ্চার হয়ে ওঠে। তারেকের বিরুদ্ধে সমান তালে চালানো হয় প্রোপাগান্ডা। এ মিথ্যা প্রচারণার কাছে সত্য চাপা পড়ে যায়। গোটা জাতিকে অবাক করে দিয়ে গ্রেফতার করা হয় তারেক রহমানকে। শহীদ জিয়ার আমানত তারেককে গ্রেফতারের ফলে গোটা জাতির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে।
২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিনে দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার সাথে একান্ত কথাবার্তায় তারেক বলেন, “দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করি। এজন্য যদি জেলখানায় যেতে হয়, যাব।” তিনি তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে খোলাখুলি কথা বলেন। “আমি শহীদ জিয়াউর রহমানের ছেলে। যারা বিএনপি তথা জাতীয়তাবাদী শক্তির বিরোধী, তারাই ওইসব অপপ্রচার করে। আপনি মন্ত্রী-সচিব যে কাউকে জিজ্ঞাসা করুন আমি কাউকে কোনো কাজের জন্য টেলিফোন করেছি কিনা? কেউ বলতে পারবে না আমি করেছি। আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ষড়যন্ত্রমূলক।” বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, “দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা সবাই। দেশের মানুষও তাই চায়। কিন্তু যেখানে কেবল বিএনপির ওপর দুর্নীতির ঢালাও অভিযোগ এনে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে তা কোনোভাবে এদেশের শান্তিকামী মানুষ মেনে নেবে না। কারণ বিএনপি দেশের মানুষের প্রাণের দল। এই দলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু জনগণ তার জবাব দিয়েছে।” (সূত্রঃ দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা ৯ মার্চ ২০০৭)
ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে তারেককে অচল করার ষড়যন্ত্রের বড় দুটি কারণ হলো; ২০০১ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পেছনে বড় হেতু ছিল তারেকের সুসংগঠিত ব্যবস্থাপনা, দক্ষ নির্বাচনী প্রচারণা। দ্বিতীয়, জাতীয়তাবাদী শক্তির ভবিষ্যৎ কা-ারী হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত হয়ে উঠেছিল।
২০০৭ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের উদীয়মান নেতা তারেক রহমানকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, এরেস্ট ওয়ারেন্ট-না থাকার পরও গভীর রাতে গ্রেফতার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। তারেক রহমানকে তার ক্যান্টনমেন্টস্থ মইনুল রোডের বাসা থেকে রাত সোয়া ১টায় আটক করা হয়। তারেক রহমানকে কাফরুল থানার ওসির নেতৃত্বে গ্রেফতার করা হলেও তাকে প্রথমে ক্যান্টনমেন্ট থানায় নিয়ে রাখা হয়। গ্রেফতারের সময় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দেশের কোথাও কোনো মামলা কিংবা সাধারণ ডায়েরি বা অন্য কোনো অভিযোগও ছিল না। গ্রেফতারের জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তারেক রহমানের বাসায় গেলে প্রথমে তিনি তাদের কাছ থেকে কিছুটা সময় নিয়ে ওজু সেরে দুই রাকাত নফল নামায পড়ে মহান আল্লাহর দরবারে বিশেষ মোনাজাত করেন। যাওয়ার সময় তিনি অন্যান্য বই-পুস্তকের সাথে পবিত্র কুরআন শরীফও নেন।
গ্রেফতারের আগে তিনি প্রতিদিনের মতো এশার নামায শেষে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। পাশে ছিলেন স্ত্রী ডাঃ জুবাইদা রহমান ও একমাত্র সন্তান জাইমা রহমান। পাশের রুমে ছিলেন মা খালেদা জিয়া। অন্য রুমে ছিলেন ¯েœহের ছোট ভাই আরাফাত রহমান, তার স্ত্রী ও সন্তান। পুলিশের দু’ কর্মকর্তা এসে তারেককে গ্রেফতারের কথা জানান। মা খালেদা জিয়া এবং স্ত্রী-কন্যা ও ভাই আরাফাতের কাছ থেকে পুলিশ নিয়ে যায় তারেক রহমানকে। হাসিমুখে তারেক গ্রেফতার বরণ করে নেন। এর আগে তিনি দু’জন সিনিয়র সাংবাদিক ও দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। তারেক তাদেরকে জানান যে, ‘রাজনীতি করা ছাড়া আমি কোনো অপরাধ করিনি। ইনশাআল্লাহ কেউ আমার ক্ষতি করতে পারবে না। আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন।’
ক্যান্টনমেন্ট থানা থেকে পরদিন ৮ মার্চ রাত ১০টায় তারেককে কড়া পুলিশ প্রহরায় র্যাবের জ্যাকেট ও হেলম্যাট পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। গ্রেফতারের ১৬ ঘণ্টা পর গুলশান থানায় এক কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে ব্যবসায়ী আমিন আহমেদ চৌধুরীর দায়ের করা ৩৪(৪) নং মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের আবেদন করে। গ্রেফতারের সময় তারেক শারীরিকভাবে সুস্থ ও সবল ছিলেন। গ্রেফতারের পর বিশেষ উদ্দেশ্যে দায়ের করা এ মামলায় রিমান্ড মঞ্জুর না করে তাকে মুক্তি দেয়ার জন্য শত শত আইনজীবী জোরালো প্রার্থনা জানান। আইনজীবীদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে আদালত প্রথম দফায় ৪ দিনের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড মঞ্জুরের পর তারেককে পুলিশের হেফাজতে না নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে অজ্ঞাত লোকদের হেফাজতে নিয়ে চোখ বেঁধে বর্বরোচিত কায়দায় তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। প্রথম দফা চারদিন রিমান্ড শেষে ১২ মার্চ তারেককে জেলহাজতে পাঠানো হয়। পর্যায়ক্রমে তারেকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পাশাপাশি ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ডিটেনশনও দেয়া হয়। পরে হাইকোর্ট এ ডিটেনশন আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন।২০০৭ সালের ৮ মার্চ কাফরুল থানায় জরুরি বিধি ভঙ্গের অভিযোগ এনে মামলা করা হয়। মীর আকতার হোসেন লিঃ-এর এমডি মীর জাহির হোসেন ৫৩ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগে গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা করেন। এ মামলার এজাহারে তারেকের নাম অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও পরে তাকে এতে গ্রেফতার দেখানো হয়। কাফরুল থানায় দ্রুত বিচার আইনের অধীনে ২০০৭-এর ১৭ এপ্রিল যে মামলাটি হয়, তাতে তারেককে ফাঁসাতে মরিয়া ফখরুদ্দীন সরকার দু’দিনের ব্যবধানে দু’বার আইনের সংশোধন করেছিল। কিন্তু হাইকোর্ট তা আমলে নেয়নি। বর্তমান মহাজোট সরকার তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়ের করা প্রায় দেড় হাজার মামলা তুলে নিয়েছে। বিএনপি নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে মামলাগুলো একচোখা সরকারের দৃষ্টিতে পড়েনি। তারেকের বিরুদ্ধে স্থগিত একটি মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন আইন প্রতিমন্ত্রী। আবার তা পুষিয়ে দিতে বর্তমান আমলে মানি লন্ডারিংয়ের একটি মামলায় তারেককে জড়ানো হয়েছে। অথচ সেখানেও তিনি মূল আসামী নন।
২০০৭ সালের ৯ এপ্রিল শাহবাগ থানায় গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ ১৪(৪) নং মামলাটি দায়ের করা হয়। এ মামলায়ও তারেকের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পরে এ মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০০৭ সালের ৩ জুন খালেদা জিয়া ও তারেকের বিরুদ্ধে জিয়াউর রহমান এতিমখানার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে তেজগাঁও থানায় মামলা দায়ের করা হয়। ২০০৭ সালের ৪ আগস্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ২৬ লাখ টাকা আয়কর ফাঁকির অভিযোগ এনে তারেকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর গুলশান থানায় মার্শাল ডিস্টিলারিজের এমডি হারুন ফেরদৌস বাদী হয়ে ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে ৮১ লাখ টাকার চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে ১০২ (৩) নং মামলাটি দায়ের করেন। এ মামলার এজাহারে তারেকের নাম অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও পরবর্তী সময়ে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। একই দিনে তারেক রহমানকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করে এ মামলায় ২ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়।
২০০৭ সালের ২৬ নভেম্বর এসিএল ও আরসিএলের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর সৈয়দ আবু সাহেদ সোহেল গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় ১৩(৫) নং মামলাটি দায়ের করেন। এ মামলার এজাহারে তারেক রহমানের নাম উল্লেখ না থাকলেও তাকে শ্যোন এরেস্ট দেখানো হয়। একই দিনে তারেককে এ মামলায় ৩ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়।
২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর রিমান্ডে থাকাকালে তারেকের ওপর নানা রকমের দৈহিক নির্যাতন করা হয়। এর মধ্যে একটি ছিল অনেক উপর থেকে বারবার ফেলে দেয়া। অসহ্য যন্ত্রণায় তিনি কুঁকড়ে উঠেন। কিন্তু নির্যাতন কারী অফিসারদের বিন্দুমাত্র মায়া-দয়া হয়নি। ওদের দায়িত্ব ছিল তারেককে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলা। তারপর থেকে দীর্ঘ সময় তারেক কারাগারে। কোনো ডাক্তার নেই। চিকিৎসা হয়নি। প্রতিটি দিন কেটেছে নারকীয় যন্ত্রণায়। একজন রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে, গ্রেফতার চলতে পারে। কিন্তু নির্যাতন করার, শরীরের অঙ্গ বিকল করার, মানবাধিকার পদদলিত করার অধিকার সভ্যতার কোথায় আছে?
২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন তারেক ও তার স্ত্রী এবং শাশুড়ির বিরুদ্ধে সম্পদের হিসাব গোপন করার অভিযোগ এনে ৫২(৯) নং মামলাটি দায়ের করে। এক মাস বিরতির পর একই দিনে তারেককে আবারো আদালতে হাজির করে দুদকের দায়ের করা মামলায় ১ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। ২০০৮ সালের ৯ জানুয়ারি রেজা কনস্ট্রাকশনের এমডি খান আফতাবউদ্দিন আহমদ গিয়াস উদ্দিন আল মামুনসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে এক কোটি ৩২ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করে। এ মামলায় তারেক রহমানের নাম অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও পরে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। (চলবে)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন