মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৩

সংবিধান রক্ষায়’ একদলীয় নির্বাচন


সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার দোহাই দিয়ে একতরফা নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ভাষণে আমরা প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সুর শুনতে পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী যেমন বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে, কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না, প্রধান নির্বাচন কমিশনারও একই ভাষায় কথা বলেছেন। জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বেশ কঠোরভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নানা দিক তুলে ধরেছেন। প্রধান বিরোধী দলগুলোর উদ্দেশে তার কোনো আহ্বান ছিল না। আগের দিন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার কথা বললেও পরদিন তিনি একটি একতরফা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী যেমন বদ্ধপরিকর, তেমনি সিইসি তা বাস্তবায়নেও বদ্ধপরিকর।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এই তফসিল ঘোষণার আগে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার প্রয়োজন বোধ করেননি। ক্ষমতাসীন দল যেমন বিরোধী দলের সাথে সংলাপে বসতে অনীহা প্রকাশ করেছে, নির্বাচন কমিশনও বিরোধী দলকে বাইরে রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ছক কষেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ভাষণে সমঝোতা বা বিরোধী দলের প্রতি নির্বাচনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে নমনীয় কোনো বক্তব্য ছিল না। ছিল যুদ্ধের সুর। তিনি নির্বাচনী যুদ্ধের যে ডাক দিয়েছেন, তাতে সরকারি কর্মকর্তাদের ‘দেশের ঋণ শোধ করা’র ডাক এসেছে বলে শামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন; কিন্তু তার এই ডাকে দেশে শান্তির বদলে অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। নির্বাচনী কর্মকর্তারা এখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কিভাবে সিইসির এই ডাক থেকে নিজেদের দূরে রাখা যায়, তা ভাবছেন। অপর দিকে বিরোধী দলগুলো তার এই চ্যালেঞ্জ ভালোভাবেই নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
তার ভাষণের পর সারা বাংলাদেশ উত্তাল রূপ নিয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ভাষণ শেষ হওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকার সাথে কার্যত সারা দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা রাস্তায় নেমে এসেছে। সোমবার রাত ৯টায় বিরোধী দলের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার আগে বিভিন্ন মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা। এমন পরিস্থিতিতে জানুয়ারির এই নির্বাচনে সিইসি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথাও বলেছেন। অথচ এই নির্বাচন কমিশনই আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেনাবাহিনী ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠানের। তাদের তখন ‘যুক্তি’ ছিল, সেনাবাহিনী যেহেতু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নয়, সে কারণে সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন নেই। তারা আরো যুক্তি দিয়েছিলেন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা হয় না। বাংলাদেশেও দরকার নেই। এখন বিরোধী দলের বর্জন করা এই নির্বাচনে কমিশন সেনা মোতায়েনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে বিরোধী দলকে সেনাবাহিনীর ভয় দেখানো হচ্ছে। সশস্ত্রবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানোর এই চেষ্টা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সাথে সাথে যেভাবে সারা দেশে সঙ্ঘাত ছড়িয়ে পড়ছে তাতে দেশের অন্তত অর্ধেক ভোটকেন্দ্রে ভোটের বাক্স পাঠানো সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। শেষ পর্যন্ত এরশাদের ’৮৮-র নির্বাচনের মতো ঢাকা থেকে সংসদ সদস্যদের নাম ঘোষণার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় কি না তা দেখার বিষয়। তবে ৫ জানুয়ারি যদি সাংবিধানিক এই নির্বাচন হয় তখন দেশে সংসদ সদস্য হবেন ৬০০ জন। কারণ নির্বাচনের সময় সংসদ বহাল থাকবে। ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত নতুন এমপি যেমন থাকবেন, তেমনি পুরনো এমপিরাও থাকবেন। সংসদ ভেঙে দেয়া নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ক্ষমতাসীন দলকে কিছুই বলার সাহস পাননি। এর আগে রাশেদ খান মেনন নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়ার কথা বলেছিলেন। এখন অবশ্য তিনি মন্ত্রী থেকে নৌকা নিয়ে নির্বাচন করবেন।
এর আগে বিচারপতি এম এ আজিজ কিংবা বিচারপতি এম সাদেকও সংবিধান রক্ষার জন্য একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন; কিন্তু এমন অভাবনীয় সাংবিধানিক কাণ্ড কারবারের মধ্যে তাদের পড়তে হয়নি। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকীবউদ্দিন তাদের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে আছেন। ক্ষমতাসীনদের খুশি করার জন্য তিনি নিজেই তার কমিশনের ক্ষমতা কমিয়েছিলেন। প্রধান বিরোধী দলকে বেকায়দায় ফেলতে তাদের প্রতীকের কাছাকাছি প্রতীক দিয়ে বিএনএফ নামে ভুঁইফোড় এক দলকে নিবন্ধন দেয়ার চেষ্টা করেছেন। শেষ পর্যন্ত প্রবল আপত্তির মুখেও নিবন্ধন দিয়েছেন।
দেশের সঙ্ঘাতমুখর উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যে সংবিধান রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গ আর নির্বাচন কমিশন সবাই একযোগে তৎপর; কিন্তু যাদের জন্য সংবিধান, সেই জনগণ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন। এই সংবিধান যেমন ক্ষমতাসীনেরা তৈরি করেছেন, তেমনি এই সংবিধানের লঙ্ঘন ও বিচ্যুতির ঘটনাও তারাই ঘটিয়ে চলছেন।
২.
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদের সমাপনী অধিবেশনে বলেছেন, রাষ্ট্রপতি তাকে নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার অনুমতি দিয়েছেন। আরো বলেছেন, রাষ্ট্রপতির পরামর্শেই তিনি ছোট পরিসরের নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করেছেন এবং এ সরকার রুটিন কাজ করবে। নির্বাচনকালীন সরকারের এ প্রক্রিয়াটি সাংবিধানিকভাবে হয়েছে কি না, তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। এই সরকার গঠনের আগে প্রধানমন্ত্রীসহ পুরো সরকারকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রীকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতির গেজেট নোটিফিকেশনও লাগবে; কিন্তু রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে কখন, কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় এ রকম অনুমতি দিয়েছেন কিংবা পূর্ববর্তী সরকারই বা কখন পদত্যাগ করেছে, তা এখনো বলা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন বলে সংবিধানে যে সুবিধা দেয়া আছে, তা পেতে হলে এর আগে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদত্যাগপত্র বা তার পুরো সরকারের বহাল না থাকার কোনো অফিসিয়াল কাগজপত্র প্রকাশ করা হয়নি। বঙ্গভবন থেকেও এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কিছুই জানানো হয়নি।
এর আগে মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার পরও তাদের কাজ চালিয়ে যাওয়ায় সংবিধান লঙ্ঘন হয়েছে বলে সংবিধানবিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছিলেন। টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে সবাই পদত্যাগ করেছিলেন। অনেকে পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করেছিলেন। এর পরও তারা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দেয়ার সাথে সাথে সাংবিধানিকভাবে ১১ নভেম্বর থেকে মন্ত্রীদের সবার অর্থাৎ পুরো মন্ত্রিপরিষদের সবার পদ শূন্য হয়ে গেছে। তাই সংবিধান অনুযায়ী পদত্যাগ করার পর পদত্যাগী কোনো মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব পেতে হলে তাকে আবার সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের আওতায় নতুন করে শপথ নিতে হবে এবং শপথে স্বার দিতে হবে; কিন্তু তারা তা করেননি। নতুন করে শপথ না নিয়েই মন্ত্রী হিসেবে বহাল থাকেন কী করে? তাই পদত্যাগী মন্ত্রীদের নতুন করে শপথ না পড়িয়ে পুরনো ২০ জন পদত্যাগী সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর নিয়োগের বিষয়টি সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও অবৈধ বলেও সংবিধানবিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।
এ ছাড়া ‘সর্বদলীয় সরকারের’ ২৮ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর নিয়োগের বিষয়টি নিয়েও বড় ধরনের সাংবিধানিক সমস্যা রয়েছে। কেননা বিশ্বের কোনো সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশেই ‘সর্বদলীয়’ বা ‘বহুদলীয়’ সরকার গঠনের কোনো নজির নেই। সংবিধানবিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন এই সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, আমরা কেউ সংবিধান বুঝি না, শুধু একজন ব্যক্তি সংবিধান বোঝেন। একই সাথে তারা আরো বলেছেন, সংবিধানে ‘নির্বাচনী’ সরকারের যে ধারণা বিদ্যমান আছে তাতে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে স্বরাষ্ট্র, আইন, বিচার, প্রতিরা মন্ত্রণালয় রেখে অর্থাৎ সর্বশক্তিতে বলীয়ান একজনের অধীনে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নির্বাচন কমিশনের অস্তিত্বকে সরাসরি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেবে। এই নির্বাচনকালীন সরকার শুধু রুটিন কাজ করার কথা, নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার তাদের নেই; কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দুই ঘণ্টার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টিকফা চুক্তি সই হয়েছে। বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর অবশ্যই একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত; কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত এই সরকারই নিয়েছে। অর্থমন্ত্রী পে-কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। সাংবাদিকেরা তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, নির্বাচনকালীন সরকার কি এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে? তার সাফ জবাবÑ এই সরকারকে যারা নির্বাচনকালীন সরকার বলবে তারা স্টুপিড। প্রধানমন্ত্রী নিজেই সংসদে বলেছিলেন, এই সরকার নির্বাচনকালীন সরকার। এখন অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যে আমরা কী বুঝব? সত্যিই বাংলাদেশের জনগণ স্টুপিড বা নির্বোধ হয়ে গেছে। কারণ তারা এখন বুঝতে পারছে না কেমন সরকার দেশ চালাচ্ছে। দেশে এমন এক সরকার আছে, তারা যা বলবে সেটাই সংবিধান। তাদের ইচ্ছা আকাক্সাই আইন। এখানে অন্যের কিছু বলার নেই। আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনারের কিছু বলার নেই। যেকোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া যে নির্বাচনী আইনের লঙ্ঘন, তা বলার সাহস সিইসি দেখাতে পারবেন না।
এ দিকে নির্বাচনকালীন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে একের পর এক উপদেষ্টা নিয়োগ করতে হচ্ছে। যারা নতুন উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিচ্ছেন, তাদের দল নির্বাচনী সরকারে যোগ দিয়েছে। উপদেষ্টার এ সংখ্যা ১১ তে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরে পুরনো পাঁচ জনকে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে। জানুয়ারি পর্যন্ত এ সংখ্যা স্থির থাকবে, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। সবই হচ্ছে ‘সংবিধান রক্ষা’র জন্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন নির্বাচনকালীন সরকার এ ধরনের উপদেষ্টা নিয়োগ করতে পারে না; কিন্তু ক্ষমতাসীনদের কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে সংবিধান রক্ষার কথা বলে সংবিধান লঙ্ঘন হলেও কিছু যায় আসে না। কারণ আওয়ামী লীগের দাবি মতে, মহাজোট সরকারকে ‘সংবিধান রক্ষা’র জন্যই তো আবার ক্ষমতায় আসতে হবে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads