স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ ক্ষমতাসীন দলের একে-ওকে দিয়ে ‘দাওয়াত’ এবং সমঝোতা ও সংলাপ বিষয়ক কথাবার্তা শোনানো হলেও বাস্তবে সরকার যে নিজস্ব পরিকল্পনা অনুসারেই এগিয়ে চলেছে তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে গত কয়েকদিন ধরে। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট দ্বিতীয় দফায় ৬০ ঘণ্টার হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করারও আগে থেকে সারাদেশে গণগ্রেফতারের অভিযান শুরু হয়েছে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় তো বটেই, জেলার পাশাপাশি উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে পর্যন্ত বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের রীতিমতো ধাওয়া দিয়ে বেড়াচ্ছে র্যাব ও পুলিশ। সঙ্গে থাকছে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের গু-া-সন্ত্রাসীরা। থাকতেই হবে। কারণ, এ ব্যাপারে হুকুম জারি করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তিনি তার দলের নেতা-কর্মীদের রাজপথে পুলিশের ‘সঙ্গে থাকার’ এবং পুলিশকে ‘সহযোগিতা করার’ হুকুম দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীরও আগে প্রথম দফায় ৬০ ঘণ্টার হরতাল চলাকালে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ‘হাত-পা ভেঙে ফেলার’ হুকুম দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা। মূলত সে কারণেই ৬০ ঘণ্টার প্রথম হরতালের সময় অন্তত ২০ জনের মৃত্যু ঘটেছে। গুলীবিদ্ধ ও নানাভাবে আহতদের সংখ্যাও পাঁচ-সাতশ’র কম হবে না। কিন্তু এত কিছুর পরও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না ক্ষমতাসীনরা। পুলিশ ও র্যাবকে দিয়ে নতুন পর্যায়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ঢালাওভাবে গ্রেফতার করাচ্ছেন তারা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, দেশের কোনো কারাগারেই এখন আর স্থান সংকুলান হচ্ছে না। এ যেন সেই ‘ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই’ অবস্থা!
খবর শুধু এটুকুই নয়। একটি জাতীয় দৈনিকের খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, কাশিমপুরের এক নম্বর কারাগারে বহুদিন পর হঠাৎ করে নাকি মহিলা বন্দীদের সেলগুলোতে ধোয়ামোছার কাজ শুরু হয়েছে। এসবের মধ্যে মহিলাদের ভিআইপি সেলও রয়েছে। কারা কর্তৃপক্ষ জানাতে না চাইলেও রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, প্রস্তুতি চলছে নারী রাজনীতিকদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করার। সম্ভাব্য এসব নারী রাজনীতিকের মধ্যে একাধিক ভিআইপিও থাকতে পারেন। সব মিলিয়েই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতির আরও বেশি অবনতি ঘটবে। এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন নেতাদের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ও স্পষ্ট ভাষাতেই জানিয়ে দিয়েছেন। এবার বাংলাদেশে বেড়াতে এসেই তিনি ঘোষণা করেছেন, ৬০ ঘণ্টার প্রথম হরতালে ২০ জন মারা গেছে। এর পরের হরতালে মারা যাবে ৪০ জন। দেশজুড়ে গণগ্রেফতার এবং নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনের পাশাপাশি সজীব ওয়াজেদ জয়ের এ মন্তব্যকে নিশ্চয়ই হেলাফেলা করা যায় না।
বর্তমান সরকারের দিক থেকে এটা অবশ্য নতুন কোনো বিষয় নয়। কারণ, এবার প্রথম থেকেই সরকার বিরোধী আন্দোলন দমনের কর্মকা- চালাচ্ছে। দেশের কোনো এলাকাতেই বিরোধী দল কখনো বাধাহীনভাবে কোনো মিছিল-সমাবেশ করতে পারেনি। এমনকি আইন মেনে আগে থেকে লিখিত অনুমতি নেয়ার পরও বিরোধী দলের অনেক কর্মসূচিকে সরকার ভ-ুল করে দিয়েছে। গ্রেফতার এবং মিথ্যা মামলায় হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে কারাগারে ঢুকিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের তো ফাঁসীর মঞ্চে ওঠানোরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিএনপির লংমার্চ ধরনের কোনো কোনো কর্মসূচিকে নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য সরকার সারাদেশে যানবাহনের চলাচল পর্যন্ত বন্ধ করিয়েছে। এখনও সরকারের সে ফ্যাসিস্ট নীতি ও কর্মকা-ে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে নাÑ যার প্রমাণ পাওয়া গেছে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার সাম্প্রতিক আদেশে। অথচ জাতীয় সংসদের নির্বাচন এগিয়ে আসার পরিপ্রেক্ষিতে এমন সময়ে প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই অবাধে তৎপরতা চালানোর কথা। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী থেকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের সব নেতা-নেত্রী সরকারী খরচে সারাদেশ চষে বেড়ালেও বিরোধী দলগুলোকে কোথাও একটি সাধারণ সমাবেশ পর্যন্ত করতে দেয়া হচ্ছে না। এর ওপর আবার শুরু হয়েছে গণগ্রেফতার এবং প্রচ- দমন-নির্যাতন। আমরা মনে করি এবং গণতন্ত্রসম্মত ব্যাখ্যাও এটাই যে, ক্ষমতাসীনরা সত্যিই সমঝোতা ও সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় নির্বাচন চাইলে বিরোধী দলকে বাধাহীনভাবে তৎপরতা চালাতে ও কর্মসূচি পালন করতে দেয়া দরকার। অন্যদিকে সরকার গণগ্রেফতারের অভিযান চালাচ্ছে বলেই ক্ষমতাসীনদের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন