সিরাজুর রহমান
‘কালো হুতার’ গল্পটি আপনাদের কারো কারো মনে
থাকার কথা। আগেও দু-একবার লিখেছিলাম। মেয়েটি সন্ধ্যেবেলা কালো সুতা চেয়েছিল। মা
দিতে পারেনি। বাড়িতে ছিল না। ‘কালা হুতা দে’ বলে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল মেয়েটি। সকালবেলা ঘুম ভেঙে সে
আবার কান্না জুড়ে দিলো, কালা হুতা দে। সারা রাতের ঘুম
সত্ত্বেও কালো সুতার জন্য বিলাপ সে ভুলে যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হয়েছে সে অবস্থা। হরতাল প্রত্যাহার করুনÑ এই হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী, সরকার ও আওয়ামী লীগের সর্বশেষ স্লোগান। হরতালের আঘাত এখন যে তাদের আঁতে গিয়ে আঘাত করছে এই হচ্ছে তার প্রমাণ। খালেদা জিয়া ২৫ অক্টোবরের বিশাল জনসভায় ঘোষণা দিলেন, সে দিন এবং পরের দিনের মধ্যে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে সংলাপে রাজি না হলে ১৮ দল ২৭ অক্টোবর থেকে তিন দিনের হরতাল শুরু করবে। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা সে দিন টেলিফোন করলেন না। সেটি তার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। পরদিন বিকেলে তার দফতর থেকে জানানো হলো দুপুরে প্রধানমন্ত্রী বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোটের নেত্রী খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি।
ব্রিটিশ আর ডেনিশ নৌবাহিনীর মধ্যে ঐতিহাসিক এক যুদ্ধ হয়েছিল ১৮০১ সালে নরওয়ের অদূরে ব্যাটল অব কোপেনহেগেন নামে বর্ণিত এ যুদ্ধে ব্রিটিশ আক্রমণের ভার ছিল অ্যাডমিরাল নেলসনের ওপর, তবে প্রধান সেনাপতি ছিলেন অ্যাডমিরাল স্যার হাইড পারকার। অ্যাডমিরাল পারকার হিসাব-নিকাশ করে মনে করলেন তার নৌবহর হেরে যাবে। তিনি অ্যাডমিরাল নেলসনকে পিছু হটার সিগন্যাল দেন। কিন্তু পরিস্থিতিদৃষ্টে নেলসন স্থির করলেন অবিলম্বে আক্রমণ করাই বিজয়ের সুযোগ। তিনি ডান চোখে দূরবীণ দিয়ে সিগন্যাল দেখার ভান করলেন আর তার জাহাজগুলোকে আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। তার জাহাজের নাবিকেরা বুঝতেও পারলেন না যে নেলসন তার প্রধান সেনাপতির নির্দেশ অমান্য করছেন, কেননা নেলসনের ডান চোখ ছিল অন্ধ। সে যুদ্ধে ব্রিটিশ বহরের বিরাট জয় হয়েছিল।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীও সে রকমের একটি কাণ্ড করলেন ২৬ অক্টোবর। তিনি দাবি করলেন যে তিনি লাল ফোনে বিরোধী দলের নেতাকে ফোন করেছিলেন কিন্তু কেউ ফোন ধরেননি। কিন্তু ল্যান্ডলাইন অথবা মুঠোফোনে কথা বলার কথা নাকি তার মনে হয়নি। অথচ অন্য অনেকেই বেগম জিয়ার সাথে সংযোগ করতে পারেন। মাত্র কয়েক দিন আগে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুনও নিউ ইয়র্ক থেকে ফোন করে বিরোধী দলের নেতার সাথে দীর্ঘ আলাপ করেছিলেন। রহস্য এই যে খালেদা জিয়ার লাল ফোন বছরখানেক ধরেই অচল। সেটি সচল করার জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগে বারবার অনুরোধ করেও লাভ হয়নি। এখন প্রশ্ন উঠতে বাধ্যÑ লাল ফোন যে অচল ছিল সে খবর শেখ হাসিনা জানতেন কি না। দ্বিতীয়ত, বিরোধী দলের নেতার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা কতটা আন্তরিক ছিল।
প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বেগম জিয়ার অফিসে জানানো হয় যে, ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টায় শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতাকে ফোন করবেন। খালেদা জিয়াকে বসিয়ে রেখে আধঘণ্টা পরে টেলিফোন করেন শেখ হাসিনা। অসৌজন্য দেখানোর একটা অভিপ্রায় এখানে অবশ্যই ছিল। এখন জানা যাচ্ছে, শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শেখ হাসিনা যখন ল্যান্ডলাইনে বেগম জিয়াকে ফোন করেন তখন প্রধানমন্ত্রীর পাশে কয়েকজন মন্ত্রী ছাড়াও টেলিভিশন ক্যামেরা ছিল।
টেলিফোন সংলাপ নিয়ে মিথ্যার বেসাতি
তাদের ৩৭ মিনিটের সংলাপের পুরো বিবরণ বাংলাদেশের মিডিয়ার একাংশে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী বারবার খালেদা জিয়াকে প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন, উল্টো বেকায়দায় পড়েছেন তিনি। বাংলাদেশী মিডিয়ার সরকার নিয়ন্ত্রিত অংশ প্রকাশ করেছে একটি সম্পাদিত বিবরণ, যাতে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে যে হাসিনাই খালেদা জিয়াকে বেকায়দায় ফেলেছেন। ভারতীয় মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছে এই শেষোক্ত সম্পাদিত বিবরণটি। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার মন্তব্য প্রতিবেদন থেকেও সেটি পরিষ্কার হয়ে যায়। এবং অবশ্যই ভারতীয় মিডিয়া হাসিনা ও আওয়ামী লীগের অনুকূলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিকূল মন্তব্য করেছে।
ভারতীয় মিডিয়া সম্বন্ধে আমার কৈশোরের একটি স্মৃতি। ১৯৪৬ সালের কথা। ভারতবর্ষ অবিভক্ত থাকবে, না বিভক্ত হয়ে একটি স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হবে, সে সম্বন্ধে গণভোট আসন্ন। হিন্দু মালিকানাধীন পত্রিকাগুলো প্রস্তাবিত পাকিস্তানের ইমেজ নষ্ট করার কোনো চেষ্টারই ত্রুটি রাখেনি। মুসলিমপন্থী পত্রিকাগুলোর খবর অনুযায়ী সারা ভারতবর্ষের মুসলমানই পাকিস্তান চায়। এমনকি যেসব এলাকার পাকিস্তানে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই তারাও। এই নিরেট সত্যকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য কংগ্রেসি পত্রিকাগুলো আহার-নিদ্রা হারাম করে লেগে গিয়েছিল। রাতারাতি তারা জাতীয়তাবাদী মুসলিম দল ও গোষ্ঠী আবিষ্কার করছিল, তাদের কাল্পনিক সভাসমিতির বহু উৎপাদিত সংবাদ প্রকাশ করছিল।
এ রকম পরিস্থিতিতে একদিন কলকাতার যুগান্তর পত্রিকা খবর ছাপল, অমুক স্থানে অমুক তারিখে জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের এক বিশাল সভা হয়। সভাপতিত্ব করেন মাওলানা অলাদুজ-জেনা (ধর্ষণজাত সন্তান)। সভায় বক্তৃতা করেন মাওলানা জাহেল ও মাওলানা মরদুদ প্রমুখ। পরদিন দৈনিক আজাদ কোনো রকম মন্তব্য ছাড়াই শব্দার্থসহ খবরটি পুরোপুরি ছেপে দেয়। কলকাতার মুসলিম মহলে সে দিন হাসির হুল্লোড় পড়ে গিয়েছিল। দৈনিক আজাদ কালোবাজারে বিক্রি হয়েছিল বলেও শুনেছি। কোনো মুসলমানের কাছে যুগান্তর নিশ্চয়ই কিছু ভারিক্কি মুসলিম নাম চেয়েছিল। সে ব্যক্তি যুগান্তরকে ফাঁসিয়ে দিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছে। হঠাৎ করে দেখা যাচ্ছে ভারতীয় মিডিয়ার সে ট্র্যাডিশন এখনো সমানেই চলছে। খবর উৎপাদন ও তথ্য বিকৃতির বদ অভ্যেস কোনো কোনো ভারতীয় মিডিয়া কিছুতেই ছাড়তে পারছে না।
ভারতের একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তাদের বদ অভ্যেস ছাড়তেও দেবে না। রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং ‘র’ নামক প্রতিষ্ঠানটি সরকারিভাবে সাউথ ব্লকের (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) একটি শাখা হলেও আসলে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ঘাড়ে আঁটালি পোকার মতো ভর করে আছে ‘র’। ‘র’ যে দিকে নিয়ে যেতে চায় সে দিকে না গিয়ে সাউথ ব্লকের গত্যন্তর নেই। ভারতের বিভিন্ন কেন্দ্রে নির্বাচিত কয়েকটি পত্রিকায় ‘র’-এর স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী ‘খবর’ ও ‘তথ্য’ উৎপাদনের জন্য সেল আছে। সার্বক্ষণিক সাংবাদিকেরা ‘র’-এর নির্দেশ অনুযায়ী সেখানে খবর, মন্তব্য ও প্রতিবেদন প্রভৃতি তৈরি করে থাকেন।
অবরুদ্ধ দুর্গে অবরুদ্ধ প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশে নির্বাচন আসন্ন। পুরো দেশ এখন শেখ হাসিনার সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা এখন পুলিশ পরিবেষ্টিত না হয়ে নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় যেতে সাহস পান না। পুলিশও এখন সদলবলে ছাড়া বহু এলাকায় যেতে নিরাপদ বোধ করে না। লক্ষণীয় যে এই বাস্তবতার সাথে বিএনপি, জামায়াত কিংবা বিরোধী দলের কোনো সম্পর্ক নেই। দেশের মানুষ এই সরকারকে চোর, গুমকারী আর খুনি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না। এই সরকার আর শাসকদলের মুখ তারা আর দেখতে চায় না। ভাঙা নৌকায় তারা আর চড়বে না।
রাজধানী ঢাকা যেন মধ্যযুগীয় কোনো অবরুদ্ধ দুর্গ। দেশের অবশিষ্টাংশ থেকে বিচ্ছিন্ন এই রাজধানী শহর। তার ভেতরেও আশপাশের সড়কগুলো বন্ধ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এবং কারো কারো মতে ‘র’-এর চরদের) দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে গৃহবন্দী জীবন যাপন করছেন। বিরোধী জোট হরতাল ডাকলে সরকারের এবং প্রধানমন্ত্রীর হৃদয়ের আতঙ্ক বেড়ে যায়। তারা র্যাব পুলিশ আর বিজিবি এবং সে সাথে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের ময়দানে ছেড়ে দেয়। এরা বোমাবাজি খুনোখুনি রক্তারক্তি ঘটায়, সংখ্যালঘু এলাকায় গিয়ে চাঁদাবাজি করে, চাঁদা না পেলে মন্দির ভাঙচুর করে, ঘরবাড়িতে আগুন লাগায়। ভারতের আওয়ামী লীগ সমর্থক মিডিয়া ফলাও করে সেসব খবর ছাপে, যথাসম্ভব খালেদা জিয়া ও বিএনপি-জামায়াতের ওপর দোষারোপ করে। আওয়ামী লীগ ও তাদের ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকেরা গাছেরটাও খাচ্ছে তলারটাও কুড়াচ্ছে।
‘র’-এর গৃহপোষ্য লেখক ও সাংবাদিকেরা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ওভারটাইম খাটছেন এখন। নিত্যনতুন চাঞ্চল্যকর খবর উৎপাদিত হচ্ছে। স্বেচ্ছায় না হলেও অনিচ্ছায় ভারতীয় মিডিয়া সেসব তৈরি খবর ফলাও করে প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচনে শেখ হাসিনার জয় ভারতের জন্য কেন অত্যাবশ্যকীয় সে সম্বন্ধে বহু বিশ্লেষণ ও অভিমত ছাপা হচ্ছে। হাসিনাকে বিদায় করা কেন বাংলাদেশীদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সে কথা ভারত বলছে না। কী মুশকিল দেখুন তো! হাসিনাকে দিল্লির প্রভুদের প্রয়োজন। তাকে তারা আবারো দিল্লি নিয়ে গেলেই পারেন। বাংলাদেশের মানুষ তাই বলে দিল্লি হুকুমে ভোট দেবে, সেটি কী ধরনের কথা হলো? ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার সিন্ধে শেখ হাসিনাকে ভারতের আপনজন এবং পশ্চিমবঙ্গের মেয়ের মতো বলে বিবৃতি দিয়েছেন। সীমান্তের ওপারের ওরা এটুকুও বুঝতে পারছে না যে তারা যতই শেখ হাসিনাকে আপনজন বলবেন, আত্মস্থ করে নেবেন, হাসিনা ততই বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাবেন। ভারতের স্বার্থকে মানুষ বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতি সাংঘর্ষিক মনে করে।
অপপ্রচারেরও সীমা থাকা দরকার
উৎপাদিত খবর আর ‘র’-এর প্রচারণা এখন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এরা বাংলাদেশের মানুষকে বোঝাতে চায় বাংলাদেশে এখন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের চরে ভরে গেছে। এ কথা বোধ হয় কেউ হলফ করে বলতে পারে না কোনো দেশের চর বাংলাদেশে নেই। বস্তুত বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটে বাংলাদেশের অবস্থা হয়েছে মরা গরুর ভাগাড়ের মতো। কাক-শকুনি শেয়াল-কুকুর সবাই উপস্থিত। কামড়া কামড়ির উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে তাদের জন্য। কিন্তু সেই যে কথায় বলে, ‘চালুনি সূচকে বলে, তোর লেজে ফুটো’। অনেক দিন ধরেই ‘র’-এর চরেরা বাংলাদেশে গিজ গিজ করছে। প্রাপ্ত একটি আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে ‘র’-এর চর আছে ছয় লাখ তিন হাজার। শাহবাগে কিছুকাল ধরে যে হুজ্জত চলল, দিনের পর দিন পোলাও-কোর্মা বিরিয়ানির জিয়াফত হলো, সেটি কারা করেছিল?
এক চোর আরেক চোরকে চোর বলে গালি দেয়! হাস্যকর নয়কি? ‘র’-এর বর্তমান প্রচারণার ধারা, তারেক রহমানের সাথে নাকি আইএসআইয়ের চরদের যোগাযোগ আছে। আরে ব্যাটা, তাতে তোর কী? আওয়ামী লীগের নেতাদের আশপাশে যদি সদাসর্বদা ‘র’-এর চরদের উপস্থিতি থাকে, তাহলে তারেক রহমানকে নিয়ে তোদের চোখ টাটায় কেন? ‘র’-এর প্রণীত আরেকটা চ্যাঞ্চল্যকর খবর হচ্ছে, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ নাকি ঘটিয়েছিল আইএসআইয়ের চরেরা।
সাড়ে চার বছর ধরে দেশের এবং বিদেশের মানুষ বিশ্বাস করে আসছে বিডিআর বিদ্রোহ আসলে ঘটিয়েছিল ‘র’। অন্তত এ কথা ঠিক যে সে বিদ্রোহে পুরোপুরি লাভবান হয়েছে ভারত। ২০০১ সালে বিএসএফের লোকেরা রংপুরের রৌমারীতে বাংলাদেশের সীমানার অনেক ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। বিডিআরের সতর্কতায় এরা আর প্রাণ নিয়ে ফেরত যেতে পারেনি। এ রকম ঘটনা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে আরো ঘটেছিল। ফেনসিডিল আর ইয়াবাসহ অবৈধ ভারতীয় পণ্য বিডিআরের আমলে বাংলাদেশে ঢুকতে পেরেছে অবাধে? বিডিআরের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ ভারত অবশ্যই খুঁজছিল। তা ছাড়া ১৯৭১ সালে ভারত তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে যে সাত দফা চুক্তিতে সই করিয়ে নিয়েছিল, তাতে স্পষ্ট করে বিডিআরকে ভেঙে দিয়ে ‘বিএসএফের তত্ত্বাবধানে’ একই বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজেবি) বাহিনী গঠনের কথা ছিল। এ কথাও ছিল যে স্বাধীন হলে বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাকবে না। শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হয়ে সে চুক্তি বাতিল করেছিলেন। এমনকি ইন্দিরা গান্ধীও তার মত পরিবর্তন করতে পারেননি।
পিলখানা বিদ্রোহ লাভ হয়েছে কার?
বিডিআর বিদ্রোহের ‘বিচার’ সাঙ্গ হয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে ছয় শ’র বেশি বিডিআর সদস্যকে। শুধু ফাঁসির দণ্ডই দেয়া হয়েছে ১৫২ জনকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ন্যুরেমবার্গে জার্মান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরে এমন পাইকারি প্রাণদণ্ড আর কোথাও দেয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এই বিচার, এই রায় নিয়ে বিশ্বজোড়া সমালোচনা হচ্ছে। সমালোচনা জাতিসঙ্ঘও করেছে। বস্তুত তথাকথিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে সরকারের বিরোধী কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার বিচার ও দণ্ড এবং বিডিআর বিদ্রোহের তথাকথিত বিচার ও রায়ের পর বাংলাদেশের আইন ও বিচারব্যবস্থা সম্বন্ধে বিশ্বব্যাপী কোথাও আর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধও অবশিষ্ট রইল না।
বিচারাধীন অবস্থায় ৭০ জন বিডিআর সদস্য মারা গেছেন। বিশ্ব মিডিয়া সাফ সাফ বলে দিচ্ছে যে, তাদের কয়েদখানায় হত্যা করা হয়েছে। অথচ এ বিদ্রোহ কী কারণে এবং কারা ঘটিয়েছিল বাংলাদেশে এবং বিদেশে কেউ জানতে পারল না। বিদ্রোহের আগে নানক, আজম, তাপস প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতার সাথে কী কারণে মুঠোফোনে পিলখানার ভেতর থেকে কলকুঞ্জন হচ্ছিল, হত্যাযজ্ঞের মাঝামাঝি সময়ে খুনিরা গণভবনে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কী নিয়ে আলোচনা করছিলেন, সেনাবাহিনী যখন বিদ্রোহ দমন করতে পিলখানার দিকে আসছিল তখন প্রধানমন্ত্রী কেন তাদের গতিরোধ করেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় পিলখানা সফর করার পর কেন নতুন করে হত্যাকাণ্ড শুরু হয়, হত্যাযজ্ঞের আগে হঠাৎ করে কেন মাথায় রুমাল বাঁধা কিছুসংখ্যক অপরিচিত লোকের আবির্ভাব হলো এবং হত্যাকাণ্ডের পরে হঠাৎ তারা কী করে হওয়ায় মিলিয়ে গেলÑ এসব প্রশ্ন হয়েই রইল, জবাব পাওয়া গেল না। সাড়ে চার বছর পরে ‘র’ এখন আইএসআইয়ের ওপর এ বিদ্রোহের জন্য দোষারোপ করছে। পরিস্থিতি ঘোলাটে হলেও এত ঘোলা নয় যে সীমান্তের ওপারের খেলায় বাংলাদেশের মানুষ বিভ্রান্ত হবে।
‘সে ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়’
প্রকারান্তরে বাংলাদেশীদের ভারতের বিশাল সামরিক শক্তির ভয়ও দেখাতে শুরু করেছেন সীমান্তের ওপারের কোনো কোনো সাংবাদিক। টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকায় সুবীর ভৌমিকের একটি প্রতিবেদন ব্যাপক আলোচিত ও সমালোচিত হচ্ছে। সুবীর ভৌমিক প্রকারান্তরে শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে জয়ী করানোর জন্য ভারতকে বাংলাদেশে সেনা পাঠানোর ওকালতি করেছেন। সুবীর লিখেছেন, ১৯৭১ সালে ভারত আমেরিকার হুমকিকে ভয় পায়নি, এখন কেন ভয় পাবে। সুবীর ভৌমিক যথেষ্ট গবেষণা না করেই এ প্রতিবেদন লিখেছেন। নইলে তার মনে হতো যে একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষ দু’বাহু বাড়িয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আমন্ত্রণ করেছিল, সব রকমের সহযোগতিা দিয়েছিল তাদের। কিন্তু এখন সীমান্ত পেরিয়ে এলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থা হবে একান্তরের পাকিস্তানিদের মতো।
একটি কথা এখানে বলে দেয়া অত্যাবশ্যকীয়। এ কথা সত্যি যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী বিশাল এবং সুসজ্জিত। কিন্তু প্রায় পাঁচ দশক ধরে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত বোন নামে পরিচিত সাতটি রাজ্যের স্বাধীনতাকামীদের মুক্তিযুদ্ধ তারা অবদমিত করতে পারেনি। হাসিনাকে গদিতে রাখার জন্য ভারতীয় বাহিনী যদি বাংলাদেশে ঢোকে তাহলে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ ওই সাতটি রাজ্যের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে হাত মেলাবে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আরো যেসব বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ চলছে তারাও তাহলে উৎসাহ পাবে, নতুন উদ্যমে তারা তৎপর হয়ে উঠবে। অর্থাৎ বর্তমান আকারে ভারতের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ স্বাধীন করে প্রতিরক্ষা খাতে ভারত যে অপরিমেয় অর্থের ব্যয় কমিয়েছিল তার চেয়েও বেশি অর্থ তাকে প্রতিরক্ষা বাবদ ব্যয় করতে হবে।
আসাম থেকে প্রকাশিত নব বার্তা এবং ভারতের আরো কোনো কোনো পত্রিকা খবর দিয়েছে যে বাংলাদেশের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করার জন্য ভারত এক হাজার কোটি রুপি ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতীয় নেতারা মাঝে মধ্যেই বলেন ভারত বাংলাদেশের মানুষের সাথেই বন্ধুত্ব করতে চায়, বিশেষ কোনো দলের সাথে নয়। ঢাকায় বিজয়ার অনুষ্ঠানে ভারতের অস্থায়ী হাইকমিশনার সন্দ্বীপ চক্রবর্তীও বলেছেন সে কথা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার সাথে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও বলেছেন সে কথা। কিন্তু ভারতের কথা এবং কাজ যে কতটা সাংঘর্ষিক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য এই বিপুল অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা তারই প্রমাণ দেয়। তাতে আরো প্রমাণ হয় যে শেখ হাসিনা গদি পেলে ভারত সব কিছুই পায়, বাংলাদেশ পায় শুধু মিথ্যা কথা আর মিথ্যা আশ্বাস। এবং অবশ্যই প্রমাণ হয় হাসিনা আবারো গদি পেলে ভারত আরো অনেক বেশি পাওয়ার আশা রাখে। নইলে এক হাজার কোটি রুপি তারা লগ্নি করতে যাবে কেন?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হয়েছে সে অবস্থা। হরতাল প্রত্যাহার করুনÑ এই হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী, সরকার ও আওয়ামী লীগের সর্বশেষ স্লোগান। হরতালের আঘাত এখন যে তাদের আঁতে গিয়ে আঘাত করছে এই হচ্ছে তার প্রমাণ। খালেদা জিয়া ২৫ অক্টোবরের বিশাল জনসভায় ঘোষণা দিলেন, সে দিন এবং পরের দিনের মধ্যে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে সংলাপে রাজি না হলে ১৮ দল ২৭ অক্টোবর থেকে তিন দিনের হরতাল শুরু করবে। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা সে দিন টেলিফোন করলেন না। সেটি তার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। পরদিন বিকেলে তার দফতর থেকে জানানো হলো দুপুরে প্রধানমন্ত্রী বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোটের নেত্রী খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি।
ব্রিটিশ আর ডেনিশ নৌবাহিনীর মধ্যে ঐতিহাসিক এক যুদ্ধ হয়েছিল ১৮০১ সালে নরওয়ের অদূরে ব্যাটল অব কোপেনহেগেন নামে বর্ণিত এ যুদ্ধে ব্রিটিশ আক্রমণের ভার ছিল অ্যাডমিরাল নেলসনের ওপর, তবে প্রধান সেনাপতি ছিলেন অ্যাডমিরাল স্যার হাইড পারকার। অ্যাডমিরাল পারকার হিসাব-নিকাশ করে মনে করলেন তার নৌবহর হেরে যাবে। তিনি অ্যাডমিরাল নেলসনকে পিছু হটার সিগন্যাল দেন। কিন্তু পরিস্থিতিদৃষ্টে নেলসন স্থির করলেন অবিলম্বে আক্রমণ করাই বিজয়ের সুযোগ। তিনি ডান চোখে দূরবীণ দিয়ে সিগন্যাল দেখার ভান করলেন আর তার জাহাজগুলোকে আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। তার জাহাজের নাবিকেরা বুঝতেও পারলেন না যে নেলসন তার প্রধান সেনাপতির নির্দেশ অমান্য করছেন, কেননা নেলসনের ডান চোখ ছিল অন্ধ। সে যুদ্ধে ব্রিটিশ বহরের বিরাট জয় হয়েছিল।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীও সে রকমের একটি কাণ্ড করলেন ২৬ অক্টোবর। তিনি দাবি করলেন যে তিনি লাল ফোনে বিরোধী দলের নেতাকে ফোন করেছিলেন কিন্তু কেউ ফোন ধরেননি। কিন্তু ল্যান্ডলাইন অথবা মুঠোফোনে কথা বলার কথা নাকি তার মনে হয়নি। অথচ অন্য অনেকেই বেগম জিয়ার সাথে সংযোগ করতে পারেন। মাত্র কয়েক দিন আগে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুনও নিউ ইয়র্ক থেকে ফোন করে বিরোধী দলের নেতার সাথে দীর্ঘ আলাপ করেছিলেন। রহস্য এই যে খালেদা জিয়ার লাল ফোন বছরখানেক ধরেই অচল। সেটি সচল করার জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগে বারবার অনুরোধ করেও লাভ হয়নি। এখন প্রশ্ন উঠতে বাধ্যÑ লাল ফোন যে অচল ছিল সে খবর শেখ হাসিনা জানতেন কি না। দ্বিতীয়ত, বিরোধী দলের নেতার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা কতটা আন্তরিক ছিল।
প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বেগম জিয়ার অফিসে জানানো হয় যে, ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টায় শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতাকে ফোন করবেন। খালেদা জিয়াকে বসিয়ে রেখে আধঘণ্টা পরে টেলিফোন করেন শেখ হাসিনা। অসৌজন্য দেখানোর একটা অভিপ্রায় এখানে অবশ্যই ছিল। এখন জানা যাচ্ছে, শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শেখ হাসিনা যখন ল্যান্ডলাইনে বেগম জিয়াকে ফোন করেন তখন প্রধানমন্ত্রীর পাশে কয়েকজন মন্ত্রী ছাড়াও টেলিভিশন ক্যামেরা ছিল।
টেলিফোন সংলাপ নিয়ে মিথ্যার বেসাতি
তাদের ৩৭ মিনিটের সংলাপের পুরো বিবরণ বাংলাদেশের মিডিয়ার একাংশে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী বারবার খালেদা জিয়াকে প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন, উল্টো বেকায়দায় পড়েছেন তিনি। বাংলাদেশী মিডিয়ার সরকার নিয়ন্ত্রিত অংশ প্রকাশ করেছে একটি সম্পাদিত বিবরণ, যাতে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে যে হাসিনাই খালেদা জিয়াকে বেকায়দায় ফেলেছেন। ভারতীয় মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছে এই শেষোক্ত সম্পাদিত বিবরণটি। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার মন্তব্য প্রতিবেদন থেকেও সেটি পরিষ্কার হয়ে যায়। এবং অবশ্যই ভারতীয় মিডিয়া হাসিনা ও আওয়ামী লীগের অনুকূলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিকূল মন্তব্য করেছে।
ভারতীয় মিডিয়া সম্বন্ধে আমার কৈশোরের একটি স্মৃতি। ১৯৪৬ সালের কথা। ভারতবর্ষ অবিভক্ত থাকবে, না বিভক্ত হয়ে একটি স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হবে, সে সম্বন্ধে গণভোট আসন্ন। হিন্দু মালিকানাধীন পত্রিকাগুলো প্রস্তাবিত পাকিস্তানের ইমেজ নষ্ট করার কোনো চেষ্টারই ত্রুটি রাখেনি। মুসলিমপন্থী পত্রিকাগুলোর খবর অনুযায়ী সারা ভারতবর্ষের মুসলমানই পাকিস্তান চায়। এমনকি যেসব এলাকার পাকিস্তানে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই তারাও। এই নিরেট সত্যকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য কংগ্রেসি পত্রিকাগুলো আহার-নিদ্রা হারাম করে লেগে গিয়েছিল। রাতারাতি তারা জাতীয়তাবাদী মুসলিম দল ও গোষ্ঠী আবিষ্কার করছিল, তাদের কাল্পনিক সভাসমিতির বহু উৎপাদিত সংবাদ প্রকাশ করছিল।
এ রকম পরিস্থিতিতে একদিন কলকাতার যুগান্তর পত্রিকা খবর ছাপল, অমুক স্থানে অমুক তারিখে জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের এক বিশাল সভা হয়। সভাপতিত্ব করেন মাওলানা অলাদুজ-জেনা (ধর্ষণজাত সন্তান)। সভায় বক্তৃতা করেন মাওলানা জাহেল ও মাওলানা মরদুদ প্রমুখ। পরদিন দৈনিক আজাদ কোনো রকম মন্তব্য ছাড়াই শব্দার্থসহ খবরটি পুরোপুরি ছেপে দেয়। কলকাতার মুসলিম মহলে সে দিন হাসির হুল্লোড় পড়ে গিয়েছিল। দৈনিক আজাদ কালোবাজারে বিক্রি হয়েছিল বলেও শুনেছি। কোনো মুসলমানের কাছে যুগান্তর নিশ্চয়ই কিছু ভারিক্কি মুসলিম নাম চেয়েছিল। সে ব্যক্তি যুগান্তরকে ফাঁসিয়ে দিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছে। হঠাৎ করে দেখা যাচ্ছে ভারতীয় মিডিয়ার সে ট্র্যাডিশন এখনো সমানেই চলছে। খবর উৎপাদন ও তথ্য বিকৃতির বদ অভ্যেস কোনো কোনো ভারতীয় মিডিয়া কিছুতেই ছাড়তে পারছে না।
ভারতের একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তাদের বদ অভ্যেস ছাড়তেও দেবে না। রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং ‘র’ নামক প্রতিষ্ঠানটি সরকারিভাবে সাউথ ব্লকের (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) একটি শাখা হলেও আসলে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ঘাড়ে আঁটালি পোকার মতো ভর করে আছে ‘র’। ‘র’ যে দিকে নিয়ে যেতে চায় সে দিকে না গিয়ে সাউথ ব্লকের গত্যন্তর নেই। ভারতের বিভিন্ন কেন্দ্রে নির্বাচিত কয়েকটি পত্রিকায় ‘র’-এর স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী ‘খবর’ ও ‘তথ্য’ উৎপাদনের জন্য সেল আছে। সার্বক্ষণিক সাংবাদিকেরা ‘র’-এর নির্দেশ অনুযায়ী সেখানে খবর, মন্তব্য ও প্রতিবেদন প্রভৃতি তৈরি করে থাকেন।
অবরুদ্ধ দুর্গে অবরুদ্ধ প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশে নির্বাচন আসন্ন। পুরো দেশ এখন শেখ হাসিনার সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা এখন পুলিশ পরিবেষ্টিত না হয়ে নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় যেতে সাহস পান না। পুলিশও এখন সদলবলে ছাড়া বহু এলাকায় যেতে নিরাপদ বোধ করে না। লক্ষণীয় যে এই বাস্তবতার সাথে বিএনপি, জামায়াত কিংবা বিরোধী দলের কোনো সম্পর্ক নেই। দেশের মানুষ এই সরকারকে চোর, গুমকারী আর খুনি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না। এই সরকার আর শাসকদলের মুখ তারা আর দেখতে চায় না। ভাঙা নৌকায় তারা আর চড়বে না।
রাজধানী ঢাকা যেন মধ্যযুগীয় কোনো অবরুদ্ধ দুর্গ। দেশের অবশিষ্টাংশ থেকে বিচ্ছিন্ন এই রাজধানী শহর। তার ভেতরেও আশপাশের সড়কগুলো বন্ধ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এবং কারো কারো মতে ‘র’-এর চরদের) দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে গৃহবন্দী জীবন যাপন করছেন। বিরোধী জোট হরতাল ডাকলে সরকারের এবং প্রধানমন্ত্রীর হৃদয়ের আতঙ্ক বেড়ে যায়। তারা র্যাব পুলিশ আর বিজিবি এবং সে সাথে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের ময়দানে ছেড়ে দেয়। এরা বোমাবাজি খুনোখুনি রক্তারক্তি ঘটায়, সংখ্যালঘু এলাকায় গিয়ে চাঁদাবাজি করে, চাঁদা না পেলে মন্দির ভাঙচুর করে, ঘরবাড়িতে আগুন লাগায়। ভারতের আওয়ামী লীগ সমর্থক মিডিয়া ফলাও করে সেসব খবর ছাপে, যথাসম্ভব খালেদা জিয়া ও বিএনপি-জামায়াতের ওপর দোষারোপ করে। আওয়ামী লীগ ও তাদের ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকেরা গাছেরটাও খাচ্ছে তলারটাও কুড়াচ্ছে।
‘র’-এর গৃহপোষ্য লেখক ও সাংবাদিকেরা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ওভারটাইম খাটছেন এখন। নিত্যনতুন চাঞ্চল্যকর খবর উৎপাদিত হচ্ছে। স্বেচ্ছায় না হলেও অনিচ্ছায় ভারতীয় মিডিয়া সেসব তৈরি খবর ফলাও করে প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচনে শেখ হাসিনার জয় ভারতের জন্য কেন অত্যাবশ্যকীয় সে সম্বন্ধে বহু বিশ্লেষণ ও অভিমত ছাপা হচ্ছে। হাসিনাকে বিদায় করা কেন বাংলাদেশীদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সে কথা ভারত বলছে না। কী মুশকিল দেখুন তো! হাসিনাকে দিল্লির প্রভুদের প্রয়োজন। তাকে তারা আবারো দিল্লি নিয়ে গেলেই পারেন। বাংলাদেশের মানুষ তাই বলে দিল্লি হুকুমে ভোট দেবে, সেটি কী ধরনের কথা হলো? ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার সিন্ধে শেখ হাসিনাকে ভারতের আপনজন এবং পশ্চিমবঙ্গের মেয়ের মতো বলে বিবৃতি দিয়েছেন। সীমান্তের ওপারের ওরা এটুকুও বুঝতে পারছে না যে তারা যতই শেখ হাসিনাকে আপনজন বলবেন, আত্মস্থ করে নেবেন, হাসিনা ততই বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাবেন। ভারতের স্বার্থকে মানুষ বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতি সাংঘর্ষিক মনে করে।
অপপ্রচারেরও সীমা থাকা দরকার
উৎপাদিত খবর আর ‘র’-এর প্রচারণা এখন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এরা বাংলাদেশের মানুষকে বোঝাতে চায় বাংলাদেশে এখন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের চরে ভরে গেছে। এ কথা বোধ হয় কেউ হলফ করে বলতে পারে না কোনো দেশের চর বাংলাদেশে নেই। বস্তুত বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটে বাংলাদেশের অবস্থা হয়েছে মরা গরুর ভাগাড়ের মতো। কাক-শকুনি শেয়াল-কুকুর সবাই উপস্থিত। কামড়া কামড়ির উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে তাদের জন্য। কিন্তু সেই যে কথায় বলে, ‘চালুনি সূচকে বলে, তোর লেজে ফুটো’। অনেক দিন ধরেই ‘র’-এর চরেরা বাংলাদেশে গিজ গিজ করছে। প্রাপ্ত একটি আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে ‘র’-এর চর আছে ছয় লাখ তিন হাজার। শাহবাগে কিছুকাল ধরে যে হুজ্জত চলল, দিনের পর দিন পোলাও-কোর্মা বিরিয়ানির জিয়াফত হলো, সেটি কারা করেছিল?
এক চোর আরেক চোরকে চোর বলে গালি দেয়! হাস্যকর নয়কি? ‘র’-এর বর্তমান প্রচারণার ধারা, তারেক রহমানের সাথে নাকি আইএসআইয়ের চরদের যোগাযোগ আছে। আরে ব্যাটা, তাতে তোর কী? আওয়ামী লীগের নেতাদের আশপাশে যদি সদাসর্বদা ‘র’-এর চরদের উপস্থিতি থাকে, তাহলে তারেক রহমানকে নিয়ে তোদের চোখ টাটায় কেন? ‘র’-এর প্রণীত আরেকটা চ্যাঞ্চল্যকর খবর হচ্ছে, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ নাকি ঘটিয়েছিল আইএসআইয়ের চরেরা।
সাড়ে চার বছর ধরে দেশের এবং বিদেশের মানুষ বিশ্বাস করে আসছে বিডিআর বিদ্রোহ আসলে ঘটিয়েছিল ‘র’। অন্তত এ কথা ঠিক যে সে বিদ্রোহে পুরোপুরি লাভবান হয়েছে ভারত। ২০০১ সালে বিএসএফের লোকেরা রংপুরের রৌমারীতে বাংলাদেশের সীমানার অনেক ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। বিডিআরের সতর্কতায় এরা আর প্রাণ নিয়ে ফেরত যেতে পারেনি। এ রকম ঘটনা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে আরো ঘটেছিল। ফেনসিডিল আর ইয়াবাসহ অবৈধ ভারতীয় পণ্য বিডিআরের আমলে বাংলাদেশে ঢুকতে পেরেছে অবাধে? বিডিআরের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ ভারত অবশ্যই খুঁজছিল। তা ছাড়া ১৯৭১ সালে ভারত তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে যে সাত দফা চুক্তিতে সই করিয়ে নিয়েছিল, তাতে স্পষ্ট করে বিডিআরকে ভেঙে দিয়ে ‘বিএসএফের তত্ত্বাবধানে’ একই বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজেবি) বাহিনী গঠনের কথা ছিল। এ কথাও ছিল যে স্বাধীন হলে বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাকবে না। শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হয়ে সে চুক্তি বাতিল করেছিলেন। এমনকি ইন্দিরা গান্ধীও তার মত পরিবর্তন করতে পারেননি।
পিলখানা বিদ্রোহ লাভ হয়েছে কার?
বিডিআর বিদ্রোহের ‘বিচার’ সাঙ্গ হয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে ছয় শ’র বেশি বিডিআর সদস্যকে। শুধু ফাঁসির দণ্ডই দেয়া হয়েছে ১৫২ জনকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ন্যুরেমবার্গে জার্মান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরে এমন পাইকারি প্রাণদণ্ড আর কোথাও দেয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এই বিচার, এই রায় নিয়ে বিশ্বজোড়া সমালোচনা হচ্ছে। সমালোচনা জাতিসঙ্ঘও করেছে। বস্তুত তথাকথিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে সরকারের বিরোধী কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার বিচার ও দণ্ড এবং বিডিআর বিদ্রোহের তথাকথিত বিচার ও রায়ের পর বাংলাদেশের আইন ও বিচারব্যবস্থা সম্বন্ধে বিশ্বব্যাপী কোথাও আর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধও অবশিষ্ট রইল না।
বিচারাধীন অবস্থায় ৭০ জন বিডিআর সদস্য মারা গেছেন। বিশ্ব মিডিয়া সাফ সাফ বলে দিচ্ছে যে, তাদের কয়েদখানায় হত্যা করা হয়েছে। অথচ এ বিদ্রোহ কী কারণে এবং কারা ঘটিয়েছিল বাংলাদেশে এবং বিদেশে কেউ জানতে পারল না। বিদ্রোহের আগে নানক, আজম, তাপস প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতার সাথে কী কারণে মুঠোফোনে পিলখানার ভেতর থেকে কলকুঞ্জন হচ্ছিল, হত্যাযজ্ঞের মাঝামাঝি সময়ে খুনিরা গণভবনে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কী নিয়ে আলোচনা করছিলেন, সেনাবাহিনী যখন বিদ্রোহ দমন করতে পিলখানার দিকে আসছিল তখন প্রধানমন্ত্রী কেন তাদের গতিরোধ করেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় পিলখানা সফর করার পর কেন নতুন করে হত্যাকাণ্ড শুরু হয়, হত্যাযজ্ঞের আগে হঠাৎ করে কেন মাথায় রুমাল বাঁধা কিছুসংখ্যক অপরিচিত লোকের আবির্ভাব হলো এবং হত্যাকাণ্ডের পরে হঠাৎ তারা কী করে হওয়ায় মিলিয়ে গেলÑ এসব প্রশ্ন হয়েই রইল, জবাব পাওয়া গেল না। সাড়ে চার বছর পরে ‘র’ এখন আইএসআইয়ের ওপর এ বিদ্রোহের জন্য দোষারোপ করছে। পরিস্থিতি ঘোলাটে হলেও এত ঘোলা নয় যে সীমান্তের ওপারের খেলায় বাংলাদেশের মানুষ বিভ্রান্ত হবে।
‘সে ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়’
প্রকারান্তরে বাংলাদেশীদের ভারতের বিশাল সামরিক শক্তির ভয়ও দেখাতে শুরু করেছেন সীমান্তের ওপারের কোনো কোনো সাংবাদিক। টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকায় সুবীর ভৌমিকের একটি প্রতিবেদন ব্যাপক আলোচিত ও সমালোচিত হচ্ছে। সুবীর ভৌমিক প্রকারান্তরে শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে জয়ী করানোর জন্য ভারতকে বাংলাদেশে সেনা পাঠানোর ওকালতি করেছেন। সুবীর লিখেছেন, ১৯৭১ সালে ভারত আমেরিকার হুমকিকে ভয় পায়নি, এখন কেন ভয় পাবে। সুবীর ভৌমিক যথেষ্ট গবেষণা না করেই এ প্রতিবেদন লিখেছেন। নইলে তার মনে হতো যে একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষ দু’বাহু বাড়িয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আমন্ত্রণ করেছিল, সব রকমের সহযোগতিা দিয়েছিল তাদের। কিন্তু এখন সীমান্ত পেরিয়ে এলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থা হবে একান্তরের পাকিস্তানিদের মতো।
একটি কথা এখানে বলে দেয়া অত্যাবশ্যকীয়। এ কথা সত্যি যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী বিশাল এবং সুসজ্জিত। কিন্তু প্রায় পাঁচ দশক ধরে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত বোন নামে পরিচিত সাতটি রাজ্যের স্বাধীনতাকামীদের মুক্তিযুদ্ধ তারা অবদমিত করতে পারেনি। হাসিনাকে গদিতে রাখার জন্য ভারতীয় বাহিনী যদি বাংলাদেশে ঢোকে তাহলে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ ওই সাতটি রাজ্যের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে হাত মেলাবে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আরো যেসব বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ চলছে তারাও তাহলে উৎসাহ পাবে, নতুন উদ্যমে তারা তৎপর হয়ে উঠবে। অর্থাৎ বর্তমান আকারে ভারতের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ স্বাধীন করে প্রতিরক্ষা খাতে ভারত যে অপরিমেয় অর্থের ব্যয় কমিয়েছিল তার চেয়েও বেশি অর্থ তাকে প্রতিরক্ষা বাবদ ব্যয় করতে হবে।
আসাম থেকে প্রকাশিত নব বার্তা এবং ভারতের আরো কোনো কোনো পত্রিকা খবর দিয়েছে যে বাংলাদেশের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করার জন্য ভারত এক হাজার কোটি রুপি ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতীয় নেতারা মাঝে মধ্যেই বলেন ভারত বাংলাদেশের মানুষের সাথেই বন্ধুত্ব করতে চায়, বিশেষ কোনো দলের সাথে নয়। ঢাকায় বিজয়ার অনুষ্ঠানে ভারতের অস্থায়ী হাইকমিশনার সন্দ্বীপ চক্রবর্তীও বলেছেন সে কথা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার সাথে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও বলেছেন সে কথা। কিন্তু ভারতের কথা এবং কাজ যে কতটা সাংঘর্ষিক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য এই বিপুল অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা তারই প্রমাণ দেয়। তাতে আরো প্রমাণ হয় যে শেখ হাসিনা গদি পেলে ভারত সব কিছুই পায়, বাংলাদেশ পায় শুধু মিথ্যা কথা আর মিথ্যা আশ্বাস। এবং অবশ্যই প্রমাণ হয় হাসিনা আবারো গদি পেলে ভারত আরো অনেক বেশি পাওয়ার আশা রাখে। নইলে এক হাজার কোটি রুপি তারা লগ্নি করতে যাবে কেন?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন