সঙ্কট আর সম্ভাবনা হাত ধরাধরি করে চলে ইতিহাসের পথে। বাংলাদেশও অযুত সম্ভাবনার দেশ কিন্তু বর্তমানে সঙ্কটের ঘূর্ণাবর্তে নিপতিত। এর জন্য কে বা কারা দায়ী, সেটা আজ আর ব্যাখ্যা করার দরকার হয় না। সে নিয়ে কুতর্কও বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। সঙ্কটের উত্তরণই সাফল্যের চিহ্নবাহী। উত্তরণেই কৃতিত্ব নির্ধারিত হয়। দেশ-সমাজ-মানুষ নানা কারণে সঙ্কট ও সমস্যায় আপতিত হতেই পারে। কৃতিত্ব হলো সেই সঙ্কটকে মোকাবিলা করা এবং সম্ভাবনায় উত্তরণ ঘটানো। এই কাজটিই এখন বাংলাদেশে অতীব জরুরি কাজ।
ইতিহাস ও সভ্যতার হাজার হাজার বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে সমস্যার সমাধানে ত্রাসের পরিণতি ও বলপ্রয়োগের পরিণাম শুভ হয়নি। হাবিল-কাবিলের ঘটনা থেকে ফেরাউন-নমরূদ বা আধুনিক কালের হিটলার-মুসোলিনি-স্ট্যালিন-ইরানের শাহ-পলপট কেউই শক্তির দাপটে টিকে থাকতে পারেনি। সঙ্কট মোকাবিলায় সক্ষম হননি। প্রতিপক্ষকে নিষিদ্ধ, নির্মূল, বঞ্চিত ও আক্রমণ করেও স্বৈরাচারীরা নিজেদেরকে শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারেনি। সোভিয়েত কমিউনিস্টরা চেয়েছিল অন্য সকল দল ও মতকে নিষিদ্ধ করে কেবল নিজেদের রাজত্ব কায়েম রাখতে। সেই স্বপ্নের সোভিয়েতের লৌহ শাসন তাসের ঘরের মতো ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। যাদেরকে তারা নিষিদ্ধ করেছিল, তারাই আজকে টিকে আছে। অতএব দল, আদর্শ, দাবি বা চিন্তাকে শক্তি বা ত্রাসের মাধ্যমে নিষিদ্ধ বা দমন করা যায় না। সাহসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পরাজিত করতে হয়। আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে হয়। যখন আলোচনা ও সমঝোতার সৎ সাহস থাকে না, তখনই ভয়ে বা বিপদের আশঙ্কায় শক্তি প্রয়োগ করে স্বৈরতন্ত্র নিজে বাঁচতে চায়। অতীতের ইতিহাসে এ রকমভাবে কেউ বাঁচেনি। ভবিষ্যতেও ইতিহাসের নিয়মের বাইরে গিয়ে কেউ বেঁচে থাকতে পারবে না।
ইতিহাসের এই সত্য জানার পরেও সবাই সেটা মেনে নেয় না। ক্ষমতার মোহে শক্তি প্রদর্শনকেই প্রিয় মনে করে। প্রতিপক্ষ নিধনকেই আনন্দপূর্ণ কাজ গণ্য করে। অথচ সত্য হলো: নিধন, নিষিদ্ধ বা হিংসা ও আক্রমণ নয়, শান্তি ও সমঝোতাই শ্রেয়তর। বাংলাদেশে এখন যে সংঘাতময় রাজনীতি চলছে তাতে সমঝোতা ও আলোচনার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কাজ আর কিছুই হতে পারে না। বাংলাদেশে এখন সমঝোতার অভাব সবচেয়ে তীব্র। এমন কি লন্ডনের ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ পত্রিকায় বাংলাদেশের বিবদমান-উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ‘দ্য ব্যাটলিং বিগামস’ বা ‘দুই যুদ্ধংদেহী বেগম’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দুই নেত্রীর মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনার ব্যাপারে ঘোরতর সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। সত্যিকার অর্থেই পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়ে এমন একটি অমীমাংসিত সঙ্কটের দিকে যাচ্ছে, সেখানে সমাধানের বদলে বেড়েই চলেছে জনশঙ্কা।
সরকারের অনড় অবস্থানের জন্য পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব হচ্ছে না বলে বিরোধীদের অভিযোগ। বিরোধী দলসমূহ আরও বলেছে, নির্দলীয় সরকারের দাবি মানা না হলে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন শুরু করা হবে। বিদেশি কূটনীতিকদের বক্তব্য হলো, দেশের এই সংঘাতময় পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের পথ বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু দেশের দুই রাজনৈতিক জোট আলোচনা, সমঝোতা ও শান্তির পথ তৈরির বদলে উত্তরোত্তর মারমুখী হয়ে উঠছে। সে কারণে জনগণ শঙ্কিত হয়ে আছে। কারণ, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার বদলে আরও উত্তপ্ত ও গোলযোগপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দলের হরতাল ও অন্যান্য কর্মসূচি এবং সরকার দলের বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে সমঝোতা ও মীমাংসার বদলে উত্তেজনার বারুদ বের হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মানবিক নিরাপত্তার চরম বিপর্যয় ঘটছে। সমঝোতার লক্ষ্যে এখনও কোনও কার্যকরী আলোচনা বা সংলাপের দেখা না পাওয়ার ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিদ্যমান সঙ্কট কমার বদলে ক্রমেই ঘনীভূত হয়ে যাচ্ছে। নানা আশঙ্কায় আকীর্ণ হচ্ছে মানুষ-সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি। এই সঙ্কুল পরিস্থিতিতে, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী জোটের সংঘাত ও বিরোধ দেশের গণতান্ত্রিক চর্চাকে ব্যাহত করতে পারে বলেও অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
দেশ-বিদেশের নানা পর্যায় থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের জন্য নেতৃবৃন্দকে এক সঙ্গে বসে মীমাংসায় উপনীত হওয়ার জন্য বার বার বলা হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রধান প্রধান দেশও বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে। কিন্তু সরকার ও বিরোধী দলের পক্ষে এখন পর্যন্ত সঙ্কট মোচনে ইতিবাচক ও সম্মিলিতভাবে কাজ করাই সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সঙ্কট সমাধানের পথ সুদূরপরাহত। সকলের মাথার উপরই সংঘাতের ফলে সৃষ্ট বিপদের হাতছানি।
এটা জানা কথা যে, ত্রাস বা বলপ্রয়োগের বদলে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিতর্ক, মতভেদ থাকা স্বাভাবিক একটি বিষয়। এমনকি ক্ষমতার প্রশ্নে শক্তির প্রতিযোগিতাও গণতন্ত্রে কখনও কখনও দেখা যায়। সরকার শেষ শক্তি দিয়ে হলেও ক্ষমতা ধরে রাখতে ও টিকে থাকতে চায়। বিরোধী দলও ক্ষমতায় যেতে পূর্ণ শক্তিতে ঝাঁপিয়ে সফল হতে চায় গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েই। কিন্তু বিশ্বের কোথাও এ কারণে গণতান্ত্রিক কাঠামো, আদর্শ ও প্রতিষ্ঠান, নিয়ম-নীতি এবং সংস্কৃতিকে একদলীয় শক্তিতে অমান্য করা হয় না। সব কাজই করা হয় গণতন্ত্রকে মেনেই। সরকারও স্বৈরাচারী হয় না; বিরোধী দলও অগণতান্ত্রিক গোপন পথ বেছে নেয় না। ক্ষমতার স্বার্থে বিশ্বের কোথাও জনগণকে জিম্মি করা হয় না। দলে দলে লড়াইয়ে সাধারণ ও নিরীহ জনগণকে অকাতরে কষ্ট ভোগ করা বাংলাদেশেই সম্ভব হচ্ছে। কারণ, দায়িত্বশীলরা যখন সঙ্কট সমাধান না করে জিইয়ে রাখে, তখন সেটার প্রতিফল গিয়ে সমাজ ও মানুষকে আক্রান্ত করে। নেতৃত্বের ব্যর্থতার কুফল ভোগ করতে হয় জনতাকে। ত্রাসের মাধ্যমে বাংলাদেশে ক্ষমতা বা রাজনৈতিক স্বার্থে খোদ গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরার মতো শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির উদ্ভব হলে কার কত লাভ বা ক্ষতি, ঠা-া মাথায় সেই হিসাবও কষছে না ক্ষমতার উদগ্র প্রতিযোগিতায় বেপরোয়া দল ও নেতারা। পরিস্থিতি অমীমাংসিত পথে যে দিকে যাচ্ছে, তাতে গণতন্ত্র ও জনগণ কোন ভয়াবহ ভবিষ্যতের সম্মুখীন হয়, সেটা কিন্তু একবারও ভাবা হচ্ছে না। মনে হয় দলগুলোর কাছে ক্ষমতা ও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করাই একমাত্র ও শেষ কথা; গণতন্ত্র ও জনগণ আদৌ কোনও বিষয়ই নয়। গণতন্ত্র ও মানুষের স্বার্থের ইস্যুগুলো প্রাধান্য পেলে হিংসা, বিদ্বেষ, প্রতিপক্ষ নিধন ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কেউই পরিস্থিতিকে অব্যাহতভাবে জটিল ও সঙ্কটাপন্ন করে জনশঙ্কা ও জন-দুর্ভোগ বাড়াতে পারত না। বাংলাদেশে এখন যা হচ্ছে, তাতে সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকা বা বিরোধী দলের ক্ষমতায় যাওয়া কতটুকু সম্ভব হবে, সেটা বলা না গেলেও এটা বলা যায় যে, চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চরমভাবে ব্যাহত হবে এবং জনগণের শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তা প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণে গণতন্ত্র ও জনগণের ক্ষতি হয়ে গেলে ক্ষমতার রাজনীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত রাজনীতিবিদগণও শেষ পর্যন্ত বিশেষ লাভবান হতে পারবেন বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। বরং তারাই তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ফলে গুয়ার্তুমি পরিহার করে শান্তি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই সকলের লাভ হবে। এই সরল সত্য কথাটি দেশের সকলেই অনুধাবন করেন। বিদেশী বন্ধুরাও এ কথাটিই বলছেন। মিডিয়া ও সুধী সমাজ থেকেও সমঝোতার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। কিন্তু যে বা যাদের মধ্যে এই বোধোদয় হলে সকলের লাভ হবে, তারাই সেটা বুঝছেন না। ত্রাসের পরিণতি ও বলপ্রয়োগের পরিণাম অপেক্ষা সমঝোতার প্রতিফল যে অনেক শুভ ফলদায়ক, এ ঐতিহাসিক সত্য কথাটি সংশ্লিষ্টরা যখন সত্যি সত্যিই অনুধাবন করতে পারবেন, তখন হয়ত সঙ্কট সমাধানের একটি সুযোগ পেলেও পাওয়া যেতে পারে। তবে সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই সে সুযোগটিকে কাজে লাগাতে হবে। তা না হলে, সমাধানহীন সঙ্কট বাড়তে বাড়তে স্বাভাবিক নিয়মেই আরও জটিল হবে; এবং সেই উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিসমাপ্তিও আরও ভয়াবহ হবে। অতএব যারা দেশ ও মানুষকে পরিচালনায় দায়িত্বশীল, তারা সঙ্কট সমাধান করে সম্ভাবনার দিকে উত্তরণ করার কথা ভাবুন এবং বাংলাদেশের বিদ্যমান সুতীব্র সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে (১) ত্রাসের পরিণতি, (২) বলপ্রয়োগের পরিণাম এবং (৩) সমঝোতার প্রতিফলÑএই তিনটির মধ্যে শেষেরটি বেছে নেয়াই হবে ক্ষমতাসীন কর্তাব্যক্তিদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক এবং রাজনীতি, সমাজ ও মানুষের জন্য মঙ্গলজনক।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন