২০০৫ সাল থেকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সভা-সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভার সদস্য ও তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা বলে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের বিএনপি সরকার এক কোটি ২৩ লাখ অবৈধ ভোটার তৈরি করেছে। গত ১৩ নভেম্বর বাগেরহাটের জনসভায় শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বিরোধী দলের নেত্রীকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘তিনি ক্ষমতায় যেতে চেয়েছেন এক কোটি ২৩ লাখ অবৈধ ভোটার তৈরি করে। হাইকোর্টে আওয়ামী আইনজীবীরা রিট করেছিলেন এ অবৈধ ভোটার বাদ দেয়ার জন্য। সে সময় রাজপথে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন হিসেবে জ্বালাও-পোড়াও করে দেশকে জ্বালিয়ে তুলছিল। আরো কত কী বিবৃতি! তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা তো সভা সেমিনার করে কমিশন ও সরকারের সততার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করেছিল।
প্রধানমন্ত্রীর সাথে সুর মিলিয়ে কিছু দিন আগে সিনিয়র আইনজীবী সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম এক টকশোতে অনেক কথাই বলেছেন। এ দিকে স্বঘোষিত তথ্যপ্রযুক্তির সবজান্তা ড. মুহাম্মদ আরাফাত বলে যাচ্ছেনÑ বিএনপি নাকি এক কোটি ২৩ লাখ অবৈধ ভোট তৈরি করেছে ২০০৭ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। আসলে কি তাই? একজন নাগরিক হিসেবে অনেক অনুসন্ধান করে পাওয়া গেছে, তাদের এসব তথ্য মোটেই সঠিক নয়। তাদের এ প্রতারণাকে চ্যালেঞ্জ করে অনেকেই কথা বলেছেন, কিন্তু এ ব্যাপারে বিএনপির পক্ষ থেকে তেমন জোরালো ভাষায় কোনো জবাব দেয়া হচ্ছে না। বিএনপি হয়তো আওয়ামী লীগের এ ধরনের হাজারো নোংরা মিথ্যা তথ্যের জবাব দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক রুচি নষ্ট করতে চায় না। আওয়ামী লীগ প্রতিনিয়ত অসত্য তথ্য দিয়ে দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ সঠিক বিষয়টি বুঝতে ভুল করছেন না। এ কারণেই সময় সুযোগমতো এরা এদের রায় অতীতে দিয়েছেন এবং আগামীতেও দেবেন। বিগত দিনের ভোটার তালিকা সম্পর্কে এবং আমাদের নির্বাচন পদ্ধতি ও ভোটারসংখ্যা নিয়ে সুজনের মহাসচিব বদিউল আলম মজুমদার কয়েক দিন আগে এক টকশোতে বলেছেন, ‘১/১১ সরকারের সময় সেনাবাহিনী ডিজিটাল ভোটার আইডি বা ন্যাশনাল আইডি করার সময় প্রবাসে থাকা ৭০ থেকে ৯০ লাখ ভোটার বাদ পড়েছে।’ তা ছাড়া অনেকের মতে, স্বাধীনতার পর থেকে ডিজিটাল ভোটার আইডি করার আগে পর্যন্ত ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে যারা বসবাস করেন তারাও প্রায় ৩০-৪০ লাখ গ্রামে ও শহরে আলাদা আলাদা (ডুয়েল) ভোটার ছিলেন। পাশাপাশি সারা দেশে ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও পৌরসভা, সিটি করপোরেশন এলাকায় কমিশনার, মেম্বার, চেয়ারম্যানেরা তাদের নিজ স্বার্থে ১৫ থেকে ১৭ বছরের কিশোর-কিশোরীদের এবং ছাত্রছাত্রীদের ভোটার লিস্টে নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এ কারণেই সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ন্যাশনাল ও ভোটার আইডি করার সময় এক কোটি ২৩ লাখ ভোটার কমে গেছে। আওয়ামী লীগ এই বাস্তব চিত্রটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে বারবার সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। বিএনপির আমলে অবৈধ ভোটার সংযুক্তির মিথ্যা কাহিনী প্রচার করে যাচ্ছে। এটি সাধারণ মানুষ বুঝতে ভুল করেনি বলেই আওয়ামী লীগের মিথ্যা প্রচারণায় বিশ্বাস করে না। সাম্প্রতিক কালে অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীকে জনগণ বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছেন। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়েছে। যদি বাদ পড়া এক কোটি ২৩ লাখ ভোট বিএনপির হতো তাহলে তাদের মনোনীত প্রার্থী পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারত না।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাদের অধীনে ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনে মোট ছয় হাজার ৮৭৪টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও তার সব মন্ত্রী-এমপি-নেতারা বলে বেড়াচ্ছেন, অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো নিরপেক্ষ হয়েছে। তারা দাবি করতে চাচ্ছেন সে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সন্ত্রাসমুক্ত হয়েছে। বর্তমানে নাকি ছবিসহ ভোটার লিস্ট কেউ চুরি করতে পারবে না। এ সরকারের আমলে রাজশাহী বিভাগে পৌরসভা নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হলো তখন ৬৫ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা জয়লাভ করছিলেন। এরপর বরিশাল ও খুলনা বিভাগে বিএনপির প্রার্থী ও তাদের এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে যেতে দেয়া হয়নি। ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কেন্দ্র দখলের মহা উৎসবে মেতে উঠেছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় বরিশাল ও খুলনায় ৮৫ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশ আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিজয় দেখানো হলো। সিলেট বিভাগে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর তৃণমূল সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে ৮৫ শতাংশ আসনে বিএনপির প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করেন, এ কারণে সরকার ুব্ধ হয়ে ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে। ঢাকা বিভাগে সন্ত্রাস-কারচুপির পরও প্রায় ৫০ শতাংশ বিরোধী দলসহ বিএনপির প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন।
৯৪ সালের জাতীয় সংসদের মাগুরা উপনির্বাচনকে সামনে এনে কারচুপির উদাহরণ টেনে আওয়ামী লীগ ৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মহা কারচুপির ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে চায়। সে সময় বিরোধী দলের জাসদ প্রধান মেজর জলিল, রশিদ ইঞ্জিনিয়ার, অলি আহাদের মতো বর্ষীয়ান নেতাদের পরাজিত করার জন্য শুধু কারচুপিই করা হয়নি, আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিজয়ী করার জন্য হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় ভোট বাক্স এনে কারচুপির অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করা হয়েছিল। এ সরকারের সময় ২০১০ এপ্রিল ভোলায় জাতীয় সংসদ উপনির্বাচনে সন্ত্রাসী শাওনকে বিজয়ী করে আনা হলো। বিএনপি প্রার্থী সাবেক মন্ত্রী মেজর (অব:) হাফিজ উদ্দিন বীরবিক্রম ও তার এজেন্টদের পর্যন্ত ভোটকেন্দ্রে দাঁড়াতে দেয়নি। বর্তমান প্রেসিডেন্টের ছেলেকে উপনির্বাচনে কিশোরগঞ্জ থেকে বিজয়ী করে আনার জন্য একই দলের বিদ্রোহকে কিভাবে হারিয়ে দেয়া হয়েছে তা সেই প্রার্থীই সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তার দলের এজেন্টদের সকাল ১০টার মধ্যে ভোটকেন্দ্র থেকে সরকারদলীয় সন্ত্রাসী, পুলিশ ও র্যাবের মাধ্যমে জোর করে অস্ত্রের মুখে বের করে দিয়ে একতরফা নির্বাচন করেছে। নির্বাচনের সময় পরাজিত প্রার্থী দুপুর ১২টায় নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তিনি বলেছেন, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ঠুর ভূমিকার কারণে ভোটকেন্দ্রে তার এজেন্ট ও ভোটারদের যেতে দেয়া হয়নি। তার প্রশ্ন ছিলÑ এ নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নেয়নি, তার পরও এত কারচুপি ও সন্ত্রাস কেন? ফলে তার এই বক্তব্যে অনেকেই বিশ্বাস করেন, একতরফা কারচুপির ইতিহাস আওয়ামী লীগেরই ১৯৭৩, ’৯৬, ’৯৯ ও বর্তমান ২০০৯-২০১৩ পর্যন্ত। টাঙ্গাইলের সুখীপুর-বাসাইল জাতীয় সংসদ উপনির্বাচনে ১৯৯৯ সালের ১৫ নভেম্বর আওয়ামী লীগ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও তার এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে দাঁড়াতে দেয়নি। তখনকার পত্রপত্রিকায় এই নির্বাচনের ভোট ডাকাতির খবর প্রকাশিত হয়। সুখ্যাত সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী এ নির্বাচনকে ‘ভোটের মৃত্যু’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। যার কারণে কৃষক, শ্রমিক জনতা লীগ প্রতি বছর ১৫ নভেম্বর ভোট ডাকাতির কলঙ্কজনক দিবস পালন করে। ছবিসহ ভোটার তালিকা থাকার পরও আওয়ামী লীগ স্থানীয় সরকার, উপনির্বাচনে সন্ত্রাস ও ডিজিটাল কারচুপি করেছে। একই কারণে বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করতে পারে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।
১২ নভেম্বর সরকার ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জনের উৎসব উপলক্ষে হাতির ঝিলে আলোকসজ্জা ও আতশবাজি করেছে। এ উপলক্ষে সরকার যেভাবে তথ্যগত প্রতারণা করেছে, এভাবে সম্প্রতি বিশ্বের কোনো সরকার করেছে এমন উদাহরণ কোথাও নেই। সে দিন সন্ধ্যায় খোদ পিডিবির ওয়েবসাইটের হিসাব মতে, দেশে উৎপাদন হয়েছে মাত্র পাঁচ হাজার ৭৫০ মেগাওয়াট। এ ব্যাপারে সাবেক বিএনপি সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর মতে, ‘বর্তমান সরকারের হিসাবের মধ্যেই তথ্যের গরমিল রয়েছে। সরকার এ পর্যন্ত প্রাইভেট কোম্পানিকে ৭০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র কুইক রেন্টাল করার অনুমতি দিয়েছে। এখান থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার কথা। কিন্তু ৩০টির মতো রেন্টাল উৎপাদন করছে মাত্র এক হাজার মেগাওয়াট। বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার সময় রেখে এসেছে তিন হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। তার পরে এক হাজার মেগাওয়াট যোগ হয়ে চার হাজার ৮০০ মেগাওয়াটে রূপ নেয়। সিরাজগঞ্জে বিএনপি সরকারের সময় নেয়া প্রকল্প ১৫০ মেগাওয়াট ও বর্তমানে ভারত থেকে আমদানি ২০০ মেগাওয়াট মিলিয়ে সর্বমোট পাঁচ হাজার ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঠিক চিত্র রয়েছে। সরকার বেসরকারি খাত থেকে এক হাজার মেগাওয়াট, সিরাজগঞ্জ ১৫০ ও ভারত থেকে আমদানি ২০০ মেগাওয়াট সর্বমোট এক হাজার ৩৫০ মেগাওয়াটই তাদের মূল উৎপাদন। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর যে টাকা অবচয় ও দুর্নীতি করেছে তা দিয়ে বড় ধরনের প্লান্ট তৈরি করে তিন-চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত।’ সাবেক এ মন্ত্রী আরো বলেন, ‘সরকার শতাব্দীর সেরা মিথ্যাচার করেছে। মিথ্যাচারের জনক গোয়েবলস বেঁচে থাকলে তিনি নিজেও বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ডে লজ্জা পেতেন। আসলে সরকারের এ মিথ্যাচার ও ভাঁওতাভাজি নির্বাচনে ভোট নেয়ার ক্ষেত্রে অপকৌশল মাত্র। তা ছাড়া বর্তমান শীত মওসুমে লোডশেডিং হচ্ছে, সেচ ও গরমের সময়ে আসল চিত্র থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।
তেল-গ্যাস, খনিজ-সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ জাতীয় প্রেস কাবের সামনে ১৩ নভেম্বর জাতীয় কমিটির সমাবেশে বলেছেন, ‘এখন দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। অথচ ১০ হাজার মেগাওয়াট গল্প শোনানো হচ্ছে। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ অনেক কম খরচেই উৎপাদন করা যেত। সেটি না করে জনগণের কাঁধে বোঝা চাপিয়ে বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে কুইক রেন্টাল ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করা হয়েছে।’ এ খাতে সরকার পৌনে পাঁচ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ করেছে প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা, ভর্তুকি দিয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সাতবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম ৭০ শতাংশ থেকে ২০০ শতাংশ বাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বচ্ছভাবে দীর্ঘমেয়াদি প্লান করে একই টাকা দিয়ে তিন-চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারত। অথচ জনগণের অর্থ লোপাট করার জন্য তারা কুইক রেন্টাল পথে গেছে। এ টাকা দিয়ে তারা উৎপাদন করেছে মাত্র এক হাজার ৩৫০ মেগাওয়াট। বিদ্যুতের সাথে সংশ্লিষ্টদের দাবি, সরকারের মিথ্যা দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য পিডিবি বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি দেখাচ্ছে। পিডিপির তথ্য যদি সত্য মনে করা হয় তবে বর্তমান বৃদ্ধি করেছে মাত্র দুই হাজার মেগাওয়াট। অথচ প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই দাবি করেছেন, তারা সাত হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন বাড়িয়েছেন। দেশের জনগণ মনে করে শুধু বিদ্যুৎ খাত থেকে দুর্নীতি করেছে ৩৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে। গত পাঁচ বছরে জনগণ মহাজোট সরকারের মিথ্যা জালিয়াতি ও প্রতারণায় বিশ্বাস করে না।
পরিশেষে এটাই বলা যায়, নিকট-অতীতে আওয়ামী লীগ ডিজিটাল সন্ত্রাস ও কারচুপির নির্বাচন, উন্নয়নের মিথ্যাচার, বিরোধী দলের ওপর হামলা-মামলা, হত্যা, গুম, নির্যাতনের রেকর্ড সৃষ্টি। শেয়ার মার্কেট, ব্যাংক সেক্টর, পদ্মা সেতু, গ্যাস কোম্পানি শেভরন, ভিওআইপি টেলিফোন কল, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় রেলের কালো বিড়ালসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিসহ ও কুইক রেন্টালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দুর্নীতি সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। তাই তারা আবার ক্ষমতায় আসার জন্য উন্নয়নের মিথ্যা কাল্পনিক তথ্য দিয়ে দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করে চলছে। তাদের মিথ্যা ও কাল্পনিক তথ্যে প্রচারের জবাব দেয়ার এখনই সময়। তাই সাধু সাবধান!
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাদের অধীনে ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনে মোট ছয় হাজার ৮৭৪টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও তার সব মন্ত্রী-এমপি-নেতারা বলে বেড়াচ্ছেন, অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো নিরপেক্ষ হয়েছে। তারা দাবি করতে চাচ্ছেন সে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সন্ত্রাসমুক্ত হয়েছে। বর্তমানে নাকি ছবিসহ ভোটার লিস্ট কেউ চুরি করতে পারবে না। এ সরকারের আমলে রাজশাহী বিভাগে পৌরসভা নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হলো তখন ৬৫ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা জয়লাভ করছিলেন। এরপর বরিশাল ও খুলনা বিভাগে বিএনপির প্রার্থী ও তাদের এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে যেতে দেয়া হয়নি। ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কেন্দ্র দখলের মহা উৎসবে মেতে উঠেছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় বরিশাল ও খুলনায় ৮৫ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশ আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিজয় দেখানো হলো। সিলেট বিভাগে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর তৃণমূল সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে ৮৫ শতাংশ আসনে বিএনপির প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করেন, এ কারণে সরকার ুব্ধ হয়ে ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে। ঢাকা বিভাগে সন্ত্রাস-কারচুপির পরও প্রায় ৫০ শতাংশ বিরোধী দলসহ বিএনপির প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন।
৯৪ সালের জাতীয় সংসদের মাগুরা উপনির্বাচনকে সামনে এনে কারচুপির উদাহরণ টেনে আওয়ামী লীগ ৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মহা কারচুপির ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে চায়। সে সময় বিরোধী দলের জাসদ প্রধান মেজর জলিল, রশিদ ইঞ্জিনিয়ার, অলি আহাদের মতো বর্ষীয়ান নেতাদের পরাজিত করার জন্য শুধু কারচুপিই করা হয়নি, আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিজয়ী করার জন্য হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় ভোট বাক্স এনে কারচুপির অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করা হয়েছিল। এ সরকারের সময় ২০১০ এপ্রিল ভোলায় জাতীয় সংসদ উপনির্বাচনে সন্ত্রাসী শাওনকে বিজয়ী করে আনা হলো। বিএনপি প্রার্থী সাবেক মন্ত্রী মেজর (অব:) হাফিজ উদ্দিন বীরবিক্রম ও তার এজেন্টদের পর্যন্ত ভোটকেন্দ্রে দাঁড়াতে দেয়নি। বর্তমান প্রেসিডেন্টের ছেলেকে উপনির্বাচনে কিশোরগঞ্জ থেকে বিজয়ী করে আনার জন্য একই দলের বিদ্রোহকে কিভাবে হারিয়ে দেয়া হয়েছে তা সেই প্রার্থীই সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তার দলের এজেন্টদের সকাল ১০টার মধ্যে ভোটকেন্দ্র থেকে সরকারদলীয় সন্ত্রাসী, পুলিশ ও র্যাবের মাধ্যমে জোর করে অস্ত্রের মুখে বের করে দিয়ে একতরফা নির্বাচন করেছে। নির্বাচনের সময় পরাজিত প্রার্থী দুপুর ১২টায় নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তিনি বলেছেন, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ঠুর ভূমিকার কারণে ভোটকেন্দ্রে তার এজেন্ট ও ভোটারদের যেতে দেয়া হয়নি। তার প্রশ্ন ছিলÑ এ নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নেয়নি, তার পরও এত কারচুপি ও সন্ত্রাস কেন? ফলে তার এই বক্তব্যে অনেকেই বিশ্বাস করেন, একতরফা কারচুপির ইতিহাস আওয়ামী লীগেরই ১৯৭৩, ’৯৬, ’৯৯ ও বর্তমান ২০০৯-২০১৩ পর্যন্ত। টাঙ্গাইলের সুখীপুর-বাসাইল জাতীয় সংসদ উপনির্বাচনে ১৯৯৯ সালের ১৫ নভেম্বর আওয়ামী লীগ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও তার এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে দাঁড়াতে দেয়নি। তখনকার পত্রপত্রিকায় এই নির্বাচনের ভোট ডাকাতির খবর প্রকাশিত হয়। সুখ্যাত সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী এ নির্বাচনকে ‘ভোটের মৃত্যু’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। যার কারণে কৃষক, শ্রমিক জনতা লীগ প্রতি বছর ১৫ নভেম্বর ভোট ডাকাতির কলঙ্কজনক দিবস পালন করে। ছবিসহ ভোটার তালিকা থাকার পরও আওয়ামী লীগ স্থানীয় সরকার, উপনির্বাচনে সন্ত্রাস ও ডিজিটাল কারচুপি করেছে। একই কারণে বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করতে পারে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।
১২ নভেম্বর সরকার ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জনের উৎসব উপলক্ষে হাতির ঝিলে আলোকসজ্জা ও আতশবাজি করেছে। এ উপলক্ষে সরকার যেভাবে তথ্যগত প্রতারণা করেছে, এভাবে সম্প্রতি বিশ্বের কোনো সরকার করেছে এমন উদাহরণ কোথাও নেই। সে দিন সন্ধ্যায় খোদ পিডিবির ওয়েবসাইটের হিসাব মতে, দেশে উৎপাদন হয়েছে মাত্র পাঁচ হাজার ৭৫০ মেগাওয়াট। এ ব্যাপারে সাবেক বিএনপি সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর মতে, ‘বর্তমান সরকারের হিসাবের মধ্যেই তথ্যের গরমিল রয়েছে। সরকার এ পর্যন্ত প্রাইভেট কোম্পানিকে ৭০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র কুইক রেন্টাল করার অনুমতি দিয়েছে। এখান থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার কথা। কিন্তু ৩০টির মতো রেন্টাল উৎপাদন করছে মাত্র এক হাজার মেগাওয়াট। বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার সময় রেখে এসেছে তিন হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। তার পরে এক হাজার মেগাওয়াট যোগ হয়ে চার হাজার ৮০০ মেগাওয়াটে রূপ নেয়। সিরাজগঞ্জে বিএনপি সরকারের সময় নেয়া প্রকল্প ১৫০ মেগাওয়াট ও বর্তমানে ভারত থেকে আমদানি ২০০ মেগাওয়াট মিলিয়ে সর্বমোট পাঁচ হাজার ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঠিক চিত্র রয়েছে। সরকার বেসরকারি খাত থেকে এক হাজার মেগাওয়াট, সিরাজগঞ্জ ১৫০ ও ভারত থেকে আমদানি ২০০ মেগাওয়াট সর্বমোট এক হাজার ৩৫০ মেগাওয়াটই তাদের মূল উৎপাদন। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর যে টাকা অবচয় ও দুর্নীতি করেছে তা দিয়ে বড় ধরনের প্লান্ট তৈরি করে তিন-চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত।’ সাবেক এ মন্ত্রী আরো বলেন, ‘সরকার শতাব্দীর সেরা মিথ্যাচার করেছে। মিথ্যাচারের জনক গোয়েবলস বেঁচে থাকলে তিনি নিজেও বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ডে লজ্জা পেতেন। আসলে সরকারের এ মিথ্যাচার ও ভাঁওতাভাজি নির্বাচনে ভোট নেয়ার ক্ষেত্রে অপকৌশল মাত্র। তা ছাড়া বর্তমান শীত মওসুমে লোডশেডিং হচ্ছে, সেচ ও গরমের সময়ে আসল চিত্র থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।
তেল-গ্যাস, খনিজ-সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ জাতীয় প্রেস কাবের সামনে ১৩ নভেম্বর জাতীয় কমিটির সমাবেশে বলেছেন, ‘এখন দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। অথচ ১০ হাজার মেগাওয়াট গল্প শোনানো হচ্ছে। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ অনেক কম খরচেই উৎপাদন করা যেত। সেটি না করে জনগণের কাঁধে বোঝা চাপিয়ে বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে কুইক রেন্টাল ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করা হয়েছে।’ এ খাতে সরকার পৌনে পাঁচ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ করেছে প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা, ভর্তুকি দিয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সাতবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম ৭০ শতাংশ থেকে ২০০ শতাংশ বাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বচ্ছভাবে দীর্ঘমেয়াদি প্লান করে একই টাকা দিয়ে তিন-চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারত। অথচ জনগণের অর্থ লোপাট করার জন্য তারা কুইক রেন্টাল পথে গেছে। এ টাকা দিয়ে তারা উৎপাদন করেছে মাত্র এক হাজার ৩৫০ মেগাওয়াট। বিদ্যুতের সাথে সংশ্লিষ্টদের দাবি, সরকারের মিথ্যা দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য পিডিবি বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি দেখাচ্ছে। পিডিপির তথ্য যদি সত্য মনে করা হয় তবে বর্তমান বৃদ্ধি করেছে মাত্র দুই হাজার মেগাওয়াট। অথচ প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই দাবি করেছেন, তারা সাত হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন বাড়িয়েছেন। দেশের জনগণ মনে করে শুধু বিদ্যুৎ খাত থেকে দুর্নীতি করেছে ৩৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে। গত পাঁচ বছরে জনগণ মহাজোট সরকারের মিথ্যা জালিয়াতি ও প্রতারণায় বিশ্বাস করে না।
পরিশেষে এটাই বলা যায়, নিকট-অতীতে আওয়ামী লীগ ডিজিটাল সন্ত্রাস ও কারচুপির নির্বাচন, উন্নয়নের মিথ্যাচার, বিরোধী দলের ওপর হামলা-মামলা, হত্যা, গুম, নির্যাতনের রেকর্ড সৃষ্টি। শেয়ার মার্কেট, ব্যাংক সেক্টর, পদ্মা সেতু, গ্যাস কোম্পানি শেভরন, ভিওআইপি টেলিফোন কল, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় রেলের কালো বিড়ালসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিসহ ও কুইক রেন্টালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দুর্নীতি সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। তাই তারা আবার ক্ষমতায় আসার জন্য উন্নয়নের মিথ্যা কাল্পনিক তথ্য দিয়ে দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করে চলছে। তাদের মিথ্যা ও কাল্পনিক তথ্যে প্রচারের জবাব দেয়ার এখনই সময়। তাই সাধু সাবধান!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন