হারুন-আর-রশিদ
সংবিধান অনুযায়ী সরকারের
মেয়াদের শেষ ৯০ দিনে নির্বাচন হতে হবে। এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। ২৭ অক্টোবর
থেকে নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু। সে হিসাবে সংসদ থাকা অবস্থায় ২৭ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির
মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। সরকারের আলামত দেখে বোঝা যায় তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয়
সরকারের অধীনে এরা নির্বাচন করবেন না। যদি করতেন তা হলে ২৭ অক্টোবরের মধ্যেই
বিরোধী দলের সাথে এ ব্যাপারে সংলাপে বসতেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ৯০ দিন। বর্তমান
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তুলে দেয়া হয়েছে।
সেহেতু বর্তমান সরকারের মেয়াদ নির্বাচনের দিন পর্যন্ত আছে। নির্বাচনে বিজয়ী দলের
কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বর্তমান সরকার বিদায় নেবে। আর যদি নির্দলীয়
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হয় তাহলে সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী এনে তা
পাকাপোক্ত করতে হবে। গত ১ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম
মূসা তার নিবন্ধে লিখেছেন, সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা
গেলে ষোড়শ সংশোধনী আনা যাবে না কেন। এটাও সম্ভব। সংবিধান মানুষের কল্যাণের জন্য
তৈরি বিধিবিধান। এটা দেশ ও জনগণের স্বার্থে সংশোধন,
পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংযোজন সবই হতে
পারে। সুতরাং নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে অবশ্যই
সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব। আলোচনা-সংলাপই তার একমাত্র উত্তম পথ। ২৫ অক্টোবর ২০১৩ আওয়ামী
লীগ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেছেনÑ সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। খালেদা জিয়া সময় নির্ধারণ করার কে।
২৫ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশে খালেদা জিয়া জনপ্রশাসনকে
লক্ষ্য করে জোরালো কণ্ঠে বলেছেন অবৈধ সরকারের আদেশ মানবেন না। ২৭ অক্টোবর থেকে
লাগাতার ৬০ ঘণ্টার হরতাল ঘোষণা করেছেন। তিনি এও বলেছেন, সংলাপ ও আন্দোলন একই সাথে চলবে। পুলিশ প্রশাসনকে বর্তমান সরকারের
নির্দেশ না মানারও আহ্বান জানিয়েছেন। এ দিকে বর্তমান সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী
ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সরকার অবৈধ হলে খালেদা কি
বৈধ। এমনি এক বাকযুদ্ধে সারা দেশ অগ্নিগর্ভে নিপতিত। ২৭ অক্টোবর দিনটি
সাংবিধানিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই দিন থেকে দলীয় সরকারের আচরণ আগের মতো
হতে পারবে না। নির্বাচনকালীন সরকারের আচরণবিধি এমন হতে হবে যাতে সরকার তার আচরণে
বিধিনিষেধ আরোপে প্রস্তুতি গ্রহণ করছে; কিন্তু আজো
সরকার এমন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি, যাতে দলীয়
প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ শেখ হাসিনার অনুগত সরকার আর নির্বাচন কমিশন নিয়ন্ত্রিত সরকার
যে এক নয়, জনগণ তা অনুভব করতে পারে।
সরকার এক দিকে বলছে নির্বাচন কমিশনকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সুষ্ঠু ও
স্বচ্ছভাবে নির্বাচন পরিচালনার জন্য; কিন্তু জনগণ কী
দেখলÑ সিইসিকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে ৯০ দিনের সময়সীমা
থেকে ১২ দিন মাইনাস করল (২৭ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর)। নির্বাচন কমিশনকে না জানিয়ে
তারা আগের পাঁচ বছরের মতোই স্পিকারের সভাপতিত্বে কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক করল
এবং হঠাৎ করে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সংসদ চালানোর সিদ্ধান্ত নিলো। মহাজোট সরকারের সব
কিছুই অলৌকিক। এরাই ২০১১ সালে বিরোধী দলকে না জানিয়ে চোখের পলকে তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের বিধান সংবিধান থেকে উচ্ছেদ করল। অথচ এই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান
ছিল তাদেরই আন্দোলনের ফসল (১৯৯৪-১৯৯৬)। ভাবনার বিষয়টি হলোÑ সংবিধান নির্দেশিত ৯০ দিন গণনা শুরুর আগেই শতবাগ নির্বাচনী
প্রস্তুতি শেষ করা গেল না। সে কারণে ২৭ অক্টোবর থেকে সংবিধানের ওপর একটা বড় ধরনের
সঙ্কটের ছায়াপাত ঘটবে। প্রস্তুতি না থাকার কারণে যত দিন গড়াবে, ততই সাংবিধানিক সঙ্কটের ছায়া আরো গভীর হবে। নির্বাচনের তারিখ এখনো
অঘোষিত রয়ে গেছে। তাহলে নির্বাচনের প্রস্তুতি কিভাবে নেবে রাজনৈতিক দলগুলোর। হাতে
সময়ও বেশি নেই। ৯০ দিন সময় আস্তে আস্তে কমে আসছে। এখনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা
সর্বদলীয় সরকারের কোনো রূপরেখা জাতির উদ্দেশে উপস্থাপনে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এখন
পর্যন্ত বিরোধী দলের সাথে সরকার নির্বাচনকালীন সরকারপদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে
পারেনি। সিইসির একক ক্ষমতা নেই নির্বাচন পরিচালনার। কার নির্দেশে নির্বাচন
পরিচালনা করবে সিইসি সেটাও অন্ধকারে থেকে যাচ্ছে। সিইসিকে নিজের সম্মান রক্ষার্থে
অনতিবিলম্বে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে হবে। কারণ ২৭ অক্টোবর
থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে যেকোনো দিন নির্বাচন সম্পন্ন করা নির্বাচন কমিশনের
দায়িত্ব। অন্যথায় সাংবিধানিক সঙ্কট শুরু হবে। দুই দলের সমঝোতায় পৌঁছতে যত দেরি
হবে এ সঙ্কট ততই ঘনীভূত হবে। আর তখনই তৃতীয় শক্তি বা ওয়ান ইলেভেনের মতো সামরিক
শক্তি ক্ষমতা দখলের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সরকারপ্রধান ফোনালাপ ২৬ অক্টোবর না করে যদি
আরো দুই দিন আগে করত অর্থাৎ বিরোধীদলীয় নেতার ২৫ অক্টোবর শুক্রবার সোহরাওয়ার্দী
উদ্যানে কর্মসূচি দেয়ার আগে ফোনালাপ হলে ৬০ ঘণ্টা হরতালের ভোগান্তিতে জনগণকে পড়তে
হতো না। প্রধানমন্ত্রী যখন নির্বাহী প্রধান তখন তাকেই সঙ্কট ঘনীভূত হওয়ার আগেই
সংলাপের কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অভিমত
সরকারপ্রধান চাইছেনÑ দলীয় সরকার অথবা সর্বদলীয়
সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে এবং ওই সরকারের প্রধান হবেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা। এ জায়গাটিতেই বিরোধী দলের অস্বস্তি। সরকার এ ব্যাপারে খোলামেলাভাবে
আন্তরিকতার সাথে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসতে পারত। এ কাজ না করার কারণে এবং অযথা
সময় ক্ষেপণ করে বিরোধী দলকে আন্দোলনের পথে নামিয়ে দিয়েছে। বর্তমান সঙ্ঘাতে বিএনপি
জিতলে সব দলের অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যদিও অনেক ক্ষয়ক্ষতির
আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। একমাত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে কেউ নির্বাচনে
যেতে আগ্রহী নয়। প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় সরকারের রূপরেখা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা
করেননি। সর্বদলীয় সরকারের প্রধান কে থাকবেন, সেটাও বলা
হয়নি। মন্ত্রিসভার কতজন সরকারি দলের এবং কতজন বিরোধী দলের এবং কে কোন পদ পাবেন এসব
ব্যাপার নিয়ে সরকারি দল কোনো কথাই বলেনি। সরকারি দল সময় ক্ষেপণ করছে। এর পেছনে
ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলেও জনগণের মনে সন্দেহ দানা বেঁধে উঠছে। বর্তমান সঙ্ঘাতময়
পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ জিতলে একতরফা নির্বাচন হবে,
আর কেউ না জিতলে যে কথাটি আমি আগেই বলেছি সে ক্ষেত্রে অরাজনৈতিক
শক্তি বা সামরিক শক্তির উত্থান অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। দেশ কিন্তু সে দিকেই ধাবিত
হচ্ছে। ’৯৪-৯৬ সালে আওয়ামী লীগের
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সরকারি দল বিএনপি মেনে নিয়ে ছিল;কিন্তু বিরোধী দল বিএনপির দাবি যা ’৯৪-৯৬ সালে
আওয়ামী লীগের মূল দাবি ছিল সেটা বর্তমান সরকার আওয়ামী লীগের না মানার কারণ থেকেই
বর্তমান সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য মূলত সরকারি দলই দায়ী। নির্দলীয় সরকারের
দাবিটি মানতে নতুন করে নির্বাচনেরও প্রয়োজন নেইÑ
যেটা বিএনপি সরকারের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল সংবিধান সংশোধনের
জন্য। বর্তমান সরকারের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা সংসদে বহাল রয়েছে। তা ছাড়া উচ্চ আদালতের
দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুমোদনও ছিলÑ সেখানে সংবিধানে
ষোড়শ সংশোধনী এনে সমস্যার সমাধান করতে সময় লাগে মাত্র তিন থেকে চার মিনিট। সরকারি
দল এ কাজ না করার কারণে বর্তমান সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হয়। ২৬ থেকে ২৯ অক্টোবর চার দিনের
সঙ্ঘাতে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২০ জনের ওপর। এর শেষ পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে
সেটা সময়ই বলবে। ইতিহাসের পাতায় এর জন্য কারা কারা দায়ী থাকবেন সেটাও ইতিহাসবিদরা
গ্রন্থ আকারে লিখবেন। বর্তমান নির্দলীয় সরকারের দাবিটি শুধু বিএনপির নয়Ñ সব দলের এবং জনগণের মূল দাবি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, যা দেশের সব পত্রপত্রিকার অনলাইন জরিপে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা
হয়েছে। দুই দলের দু’টি ফর্মুলাÑ কোনোটির সাথে কোনোটির সামঞ্জস্য নেই। সরকারি দল নিজের ফর্মুলার
সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা আদৌ জাতির সামনে উপস্থাপন করেননি। বলেছেন শুধু সর্বদলীয়
সরকার; কিন্তু এর প্রধান কে থাকবেন সেটা বলেননি। আরো অনেক
কিছুই বলেননি। যেকোনো এজেন্ডার বিস্তারিত ব্যাখ্যা অবশ্যই থাকতে হবে। যেটা
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণেও এরিয়ে গেছেন। অন্য দিকে বিরোধী দলের নেত্রী নির্দলীয়
সরকারের মোটামুটি একটি ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। সরকার প্রধান হিসেবে দুই দলের
গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকেই মেনে নেয়ার কথা বেগম জিয়া বলেছেন। বিগত দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের মধ্যে যারা এখনো সুস্থভাবে জীবিত রয়েছেন তাদের মধ্যে থেকে ১০ জন লোক বাছাই
করে নেয়া খুব কষ্টসাধ্য বিষয় নয়। তা ছাড়া দুই দল মিলে ১০ জন নিরপেক্ষ ব্যক্তি
বাছাই করে নেয়াও স্বল্প সময়ের মধ্যে সম্ভব ছিল। সদুদ্দেশ্যের অভাব থাকার কারণে
সরকারি দল শুধুই সময় ক্ষেপণ করে বিারোধী দলকে সঙ্ঘাতের পথে ঠেলে দিয়েছে। দেশ এখন
একটি কঠিন অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর মাত্র ৮০ দিন বাকি আছেÑ এর মধ্যে সব দলের গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন বর্তমান ক্ষমতাসীন দল
জাতিকে উপহার দিতে পারবে কি না সে ব্যাপারে জনগণের মনে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন আদৌ আরপিও ঘোষণা করেনি। নির্বাচনের আচরণবিধি এবং তফসিল ঘোষণা করেনিÑ সব কিছুই এখনো এলোমেলো অবস্থায় থেকে যাচ্ছে। নির্বাচনের
ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে সময় দ্রুত খসে পড়ছে। আমাদের দেশের দুই নেত্রী কি বিষয়টি
সত্যিকারভাবে অনুধাবন করতে পারছেন?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন