আমরা এখন কোথায় আছি? আমাদের গন্তব্য কোথায়? ভাগ্যে কী আছে? আমাদের ভাগ্য কি আমরাই নির্ধারণ করতে পারবো, নাকি অন্য কেউ? দেশে এখন যা চলছে, যা ঘটছে তা দেখে জনগণের মনে এমন প্রশ্ন জাগছে। পত্রিকার শিরোনাম যখন হয়, ‘বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অভিন্ন’ তখন জনমনে প্রশ্ন জাগে। অন্য কোনো দেশের নির্বাচন নিয়েতো আমরা এত কথা বলি না। আমাদের রাষ্ট্রদূতরাও অন্য দেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন না, নাকও গলান না। কিন্তু আমাদের এই দুর্দশা কেন? আমাদের নির্বাচন কীভাবে হবে, কোন পদ্ধতিতে হবে তাতো আমাদেরই ঠিক করার কথা। কিন্তু আমরা তা পারলাম না। চাতুর্যের বদলে যদি গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি আমাদের শাসকদের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ থাকতো তা হলে আজ আমাদের সংঘাত ও হরতালের এই পরিবেশে বসবাস করতে হতো না। সরকারের এই ব্যর্থতা জনগণ কখনো ভুলবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান রাজ্যে গত ১০ নবেম্বর প্রবাসী বালাদেশিদের সঙ্গে নৈরশভোজের এক অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা বলেছেন, বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে চলমান সংকট দূর করতে বড় দলগুলোর মধ্যে সংলাপ জরুরি। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের বিষয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অভিন্ন। উভয় দেশই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায়। শুধু যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতই এমন ভাষায় কথা বলেন তা নয়, ভারতসহ অন্য দেশের রাষ্ট্রদূতদেরও আমরা এমন ভাষায়, এমন কি আরো আপত্তিকর ভাষায় বাংলাদেশ সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে দেখেছি। বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু আমাদের সরকার ও শীর্ষ রাজনীতিবিদরা কি দেশে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায় না, একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় না? ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতরাই এ বিষয়গুলো চায়? বাংলাদেশ বিষয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের এটাই কি অভিন্ন স্বার্থ? এসব বক্তব্যে দেশের মানুষ কষ্ট পায়, স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে লজ্জিত হয়। এমন লজ্জা আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদদের স্পর্শ করে কিনা জানি না। অবস্থা আজ এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, দেশের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দৃষ্টিকটূ কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে।
এমন কি এবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করছেন বিভিন্ন দেশের হাইকমিশন। ভারতীয় হাই কমিশনের পলিটিক্যাল কাউন্সিলর মনোজ কুমার মহাপাত্র গত ১২ নবেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনী প্রস্তুতি ও ভারতের মনোভাব জানাতে মনোজ কুমার মহাপাত্র বিকাল ৪টা থেকে সোয়া ৫টা পর্যন্ত রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এছাড়া নির্বাচনের সামগ্রিক প্রস্তুতি ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে কমিশনের অবস্থা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়। নির্বাচনী তফসিল, সম্ভাব্য ভোটের তারিখ, নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ, ইসির সক্ষমতা, সামগ্রিক নির্বাচনে ভারতের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়। একটি দেশের পলিটিক্যাল কাউন্সিলরের অপর দেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে নির্বাচন বিষয়ে এ রকম আলোচনা কতটা স্বাভাবিক ও সঙ্গত সেই প্রশ্ন আজ জনমনে প্রকট হয়ে উঠেছে। আমাদের স্বাধীনতার বয়স যত বাড়ছে, স্বাধীনতার চেতনা কি ততই বিবর্ণ হয়ে উঠছে? জনগণ সরকার, রাজনীতিবিদ ও নির্বাচন কমিশনের এমন নতজানু ভূমিকা দেখতে চায় না।
জনগণের আশা-আকঙ্খা ও জাতীয় মর্যাদাবোধ সম্পর্কে আমাদের সরকার আদৌ সচেতন আছে কিনা সেই প্রশ্ন আজ বড় হয়ে উঠেছে। জনগণকে যদি রাষ্ট্রের মালিক ভাবা হয় এবং সরকার গঠনের নিয়ামক বলে বিবেচনা করা হয়, তাহলে গণআকাক্সক্ষার অনুকূলে বর্তমান বাস্তবতায় একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বাধা কোথায়? সরকার জনগণের কাক্সিক্ষত পথে একটি স্বাভাবিক নির্বাচনের পথে না যেয়ে বরং একের পর এক চাতুর্যের পথ বেছে নিচ্ছে। আমরা মন্ত্রীদের পদত্যাগের কথা জানলাম। কিন্তু পদত্যাগের পর মন্ত্রীরা আবার গাড়িতে ফ্ল্যাগ উড়িয়ে মন্ত্রণালয়ে যান কেমন করে? ফাইলেই বা স্বাক্ষর করেন কোন বিবেচনায়? এমন ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সাংবিধানিক দিক থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার অস্তিত্ব এখন বড় প্রশ্নের মুখে পড়লো। কারণ সংবিধান অনুযায়ী কোনো মন্ত্রী পদত্যাগ করা মাত্রই তা কার্যকর হওয়ার কথা। এটা গ্রহণ করা বা নাকচ করার কোনো সুযোগ সংবিধানে রাখা হয়নি। এ প্রসঙ্গে সংবিধান বিশেষজ্ঞ জনাব মাহমুদুল ইসলামের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ভারত ও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের দেয়া দুটি রায়ের বরাত দিয়ে ‘কান্সটিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, “সংসদ সদস্যসহ সকল সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তিগণের পদত্যাগ করার একতরফা অধিকার রয়েছে। এই পদত্যাগের কার্যকারিতা কোনো কর্তৃপক্ষের গ্রহণ করার উপর নির্ভরশীল নয়।” এদিকে আইনবিদ শাহদীন মালিক বলেন, কোনো মন্ত্রী যখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন তখনই তার পদ শূন্য হবে। পদত্যাগী মন্ত্রীদের পদ এখন শূন্য বলেই মনে করেন তিনি। ফলে এখন বিরাট প্রশ্নের মুখে পড়ে গেছে বর্তমান মন্ত্রিসভা। এদিকে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. তুহিন মালিক বলেছেন, মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র কার্যকর হয়ে গেছে। এখন সংবিধানের বাইরে গিয়ে মন্ত্রীরা দায়িত্ব পালন করলে সংবিধান অনুযায়ী তারা রাষ্ট্রদ্রোহের সমতুল্য অপরাধ করছেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এজন্য একদিন হয়তো তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।
জনগণ নির্বাচন চায়। কারণ নির্বাচনের মাধ্যমেই তারা তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে। নির্বাচনের মাধ্যমেই যার যা প্রাপ্য তা তারা বুঝিয়ে দিতে চায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, গণআকাক্সক্ষার অনুকূলে অগ্রসর না হয়ে সরকার বরং নির্বাচন নিয়ে একটি ধাঁধার মধ্যে রেখে দিয়েছে জনগণকে। নির্বাচন নিয়ে জটিলতার মাত্রা দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও জনমনে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন। এখন পর্যন্ত সংসদ বহাল থাকায় তফসিল ঘোষণায় সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না নির্বাচন কমিশন। বিষয়টি সংবিধান ও আচরণ বিধির সাথে সাংঘর্ষিক। ফলে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি দলের নেতারা নির্বাচনী প্রচারণায় বাড়তি সুবিধা পাবেন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রমের আওতায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনীতে ভূমিকা, আচরণ বিধি তৈরি ও নতুন নিবন্ধিত দলের বিষয়গুলোকেও বিতর্কিত বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। এদিকে নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত আখ্যায়িত করে কমিশনারদের পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ৪টি রাজনৈতিক দলের নেতারা। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তথা সমান সুযোগ নিশ্চিত না করলে তারা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।
নির্বাচনের এই সময়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তো দূরের কথা, দেশে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, অসম চিত্র। একদিকে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, বিভিন্ন স্থানে নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশ-র্যাবের অভিযান চলছে। আর বিরোধীদলীয় নেত্রীকে নিষ্ক্রিয় ও জোটের নেতা-কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার উদ্দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন বিভাগের পক্ষ থেকে চালানো হচ্ছে নানা তৎপরতা। অপরদিকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। সেখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রার্থীরা সেজেগুজে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করছেন। তাদের সাথে যেমন রয়েছে কিছু সমর্থক, তেমনি ব্যান্ড পার্টিও। ঢাক-ঢোল বাজিয়ে আনন্দ প্রকাশের মাধ্যমে তারা যেন জানান দিতে চাচ্ছে, বাংলাদেশে এখন চলছে নির্বাচনী উৎসব। সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা এমন একটি আবহাওয়া সৃষ্টির মাধ্যমে যে খ- চিত্র অঙ্কন করতে চাইছেন, তা যে বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থার সাথে খুবই বেমানান, তা যে কোনো নাগরিক উপলব্ধি করেন।
দৈনন্দিন জীবনযাপনে দেশের নাগরিকরা এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। তার উপর নির্বাচন নিয়ে নানা শঙ্কায় তাদের অশান্তির মাত্রা আরো বেড়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় দেশের পত্র-পত্রিকায় ভারতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও পত্র-পত্রিকার যেসব বক্তব্য প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে জনমনে সৃষ্টি হচ্ছে ভিন্ন ধরনের আশঙ্কাও। সম্প্রতি পাঞ্জাবের একটি প্রকাশ্য সমাবেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ‘ভারতের আপনজন’ বলে উল্লেখ করেছেন। দু’দেশের বন্ধুত্বের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, যেন ওপার বাংলারই মেয়ে। এদিকে গতমাসে ভারতের আসাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক নববার্তা বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্ধৃতি করে ঐ রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, “শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জোটকে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে চায় ভারত। এ জন্য দিল্লী খরচ করবে একহাজার কোটি রুপি।” দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার ইতোমধ্যে এই ব্যয়ের প্রস্তাব পাস করেছে বলে নববার্তার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব বিষয় যদি সত্য হয়, তাহলে শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন প্রসঙ্গেই প্রশ্ন জাগে না, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়েও জনগণের মনে জাগে শঙ্কা। আমরা জানি, বর্তমান সরকারি দলের শেখ হাসিনা ছাড়াও অনেক প্রবীণ রাজনীতিবিদ রয়েছেন। তারা জানেন কিসে এদেশের মঙ্গল ও অমঙ্গল। আমরা আশা করবো, তারা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টিকে জাতীয় নেতার মতোই গুরুত্ব দেবেন এবং এই লক্ষ্যে বিরোধী দলের সাথে সম্মানজনক সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছবেন। জাতীয় স্বার্থে সরকার এবং সরকারি দলের নেতারা এমন উদ্যোগ নিলে তারা লাভবান হবেন বলেই আমরা মনে করি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন