নবম জাতীয় সংসদের ১৯তম অধিবেশন শেষ হলো ২০ নভেম্বর ২০১৩ প্রধানমন্ত্রী তার সমাপনী বক্তব্যে বলেছেন, সংবিধান মোতাবেক সংসদের মেয়াদপূর্ণ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। সেই নির্বাচনও আমাদের সামনে চলে এসেছে। ইতোমধ্যে আমি সংসদনেতা ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করে নির্বাচনে আমরা প্রস্তুত সে কথাটা জানিয়েছি। তিনি বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান সে রকম প্রতিটি দেশে যেভাবে রাষ্ট্রপ্রধানকে জানানোর প্রয়োজন হয়, ঠিক সেভাবে আমি তাকে (রাষ্ট্রপতি) জানিয়ে এসেছি। তিনি আমাকে অনুমতি দিয়েছেন নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনা অব্যাহত রাখতে। তার সাথে পরামর্শ করে বর্তমান যে সরকারের পরিধি সেটা ছোট করি। আমাদের সংসদে যাদের প্রতিনিধি রয়েছে সেসব রাজনৈতিক দলের সংসদ সদস্যদের নিয়ে আমরা একটি মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেছি। তিনি বলেন, এই সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে নির্বাচনকালীন সরকার থাকবে, সেখানে কোনো মৌলিক বিষয়ে কোনোরকম সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না। শুধু রুটিন কাজগুলো করবে এবং নির্বাচন কমিশন থেকে যে নির্দেশনাগুলো দেয়া আছে নির্বাচনের সময় যারা সরকারে থাকবে মেনে চলতে বাধ্য থাকবে। তিনি আরো বলেন, ‘আমি মহামান্য রাষ্ট্রপ্রতিকে অনুরোধ করেছি নির্বাচনের ব্যবস্থা নিতে। তিনি ব্যবস্থা নেবেন। কমিশন তারিখ ঘোষণা করবে এবং ইনশাআল্লাহ বাংলার মাটিতে নির্বাচন হবে।’ (বাংলাদেশের আর বাংলার মধ্যে আয়তন এবং জনসংখ্যার দিক থেকে আমি বিস্তর ফারাক খুঁজে পাই। ‘বাংলা’ নামে কোনো স্বাধীন দেশের অস্তিত্ব আছে কি?)
প্রধানমন্ত্রী ১৯তম অধিবেশনকে নবম সংসদের সমাপনী অধিবেশন হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, দেশে ইমারজেন্সি না হলে, কোনো যুদ্ধপরিস্থিতি না হলে সংসদ অধিবেশন আর বসবে না। উল্লেখ্য, ২৫ জানুয়ারি ২০০৯ প্রথম অধিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া নবম জাতীয় সংসদ ৪১৮ কার্যদিবস চলে। প্রধানমন্ত্রীর উপরিউক্ত বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার, তিনি ক্ষমতায় থেকে তার অনুগত মন্ত্রীদের ক্ষমতায় রেখে বিরোধী জোটকে নির্বাচনের বাইরে রেখে একপক্ষীয় সাজানো-পাতানো একটি নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে চান। অনেকটা নিজের সাজানো বাগানে ফুল তোলার মতো।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকটা গায়ের জোরে আদালতকে ব্যবহার করে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাসের মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এরপর থেকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা সংবিধানে পুনঃস্থাপনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। সে দাবি পূরণ না হলে বিএনপিসহ বিরোধী জোট এবং অন্য কিছু রাজনৈতিক সংগঠন সাজানো-পাতানো নির্বাচনে যেতে কিছুতেই সম্মত নয়। একপক্ষীয় কোনো ধরনের নির্বাচনে বিরোধী দল শুধু অংশ না নেয়ার স্থির সিদ্ধান্তেই অটল থাকেনি, এ ধরনের কোনো নির্বাচন দেশের মাটিতে হতে না দেয়ার ব্যাপারেও দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী তার নেতৃত্বে গঠিত যে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় মন্ত্রিসভার কথা বলছেন, ইতোমধ্যে যা তিনি গঠনও করে ফেরেছেন তা মূলত মহাজোটীয় মন্ত্রিসভা। এখন তিনি দাবি করছেন সেটা অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা। ২০০৮-এর নির্বাচনের বর্তমান মন্ত্রীদের দলগুলোকে নিয়েই হয়েছিল মহাজোট। নতুন বোতলে পুরনো মদ ঢেলে প্রধানমন্ত্রীর জাতিকে বেয়াকুব বানানোর এ নতুন চমক, এক কথায় হাস্যকর। ‘জাসদ’ থেকে মন্ত্রিত্ব গ্রহণকারীরা গত নির্বাচনে নিজেদের নির্বাচনী প্রতীক ‘মশাল’ ফেলে দিয়ে ‘নৌকা’ মার্কাকে নিজেদের প্রতীক করেছিল। ‘ওয়ার্কার্স পার্টি’ও হাতুড়ি কাস্তে বিসর্জন দিয়ে ‘নৌকা’র যাত্রী হয়েছিল। আর জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিন্দার ঝড় বইছে। পল্লীবন্ধু এরশাদ এখন নাম কামিয়েছেন ‘থুতুবাবা’ হিসেবে। তার ভাই কাদের এবং তার প্রথমা স্ত্রী বৃদ্ধা রওশন হয়েছেন অন্তর্বর্তী মন্ত্রী। এসব প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী আবার নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য মনোনয়নপত্রও খরিদ করেছেন। ক্ষমতা ব্যবহার করে নির্বাচনেও লড়বেন।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সম্পর্কে বেশি কিছু লেখা বাতুলতামাত্র। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গদিনসীন হওয়ার পর তাকে তার মন্ত্রিসভা কেমন হবে সাংবাদিকেরা জানতে চেয়েছিলেন। কৌতুকপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী বেশ মজা করে উত্তরে বলেছিলেন, ‘রসগোল্লার মতো’। এরশাদ সম্পর্কে বলতে হয়, ‘রসিক জানে রসের মজা।’ তার তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী বিদিশার একটা বই বাজারে পাওয়া যায়। নাম ‘শত্রুর সঙ্গে বসবাস’। আগ্রহী পাঠকেরা সে বই থেকে এরশাদকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে সক্ষম হবেন বলে আমার ধারণা।
কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েও রোগী রোগের কথা না বললে উপশমের কোনো রাস্তাই চিকিৎসক খুঁজে পান না। সরকারের মন্ত্রী-যন্ত্রীদের কাছে দেশে কোনো সঙ্কটের অস্তিত্ব নেই। তারা খেয়েপরে গায়েগতরে বেশ আছেন। চাণক্যকে গুরু মেনে নিজেদের গদি রক্ষায় কৌটিল্যের কূটচালে রাজনীতিকে নাগিণীর বিষাক্ত নিঃশ্বাসে রূপান্তরিত করেছেন। দেশের মুখ্যসুখ্য মানুষগুলো এখন রাজনীতিকেই ঘৃণা করতে শুরু করেছে। বর্তমান ক্ষমতাসীনেরাই জামায়াতের ব্রেইন চাইল্ড ‘কেয়ারটেকার’ সরকারের দাবিতে আন্দোলন, বিক্ষোভ, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও করে ’৯৬-এর বেগম জিয়ার সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। বিরোধী দলগুলো ও তাদের দাবি অগ্রাহ্য করে তৎকালীন সরকার ফেব্রুয়ারিতে স্বল্পসংখ্যক ভোটার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন করেছিল। বেগম জিয়া সেই নির্বাচনে গঠিত সংসদেই বিরোধী দলের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ব্যবস্থা সংবিধানে সন্নিবেশ করে একই সালের জুন মাসে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের ব্যবস্থা নেন। বর্তমানে মহাজোটের সরকারও বিরোধী দলের দাবি অগ্রাহ্য করে দশম সংসদের নির্বাচনের দিকে ‘একলা চলো’ নীতিতে অগ্রসরমান। অনেক বিশ্লেষক বর্তমান নির্বাচনী সঙ্কটকে ’৯৬-এর সঙ্কটের সাথে তুলনা করছেন। আসলে সে সময় বিএনপি সরকার ফেব্রুয়ারির নির্বাচন করেছিল শাসনতন্ত্রে বিরোধী দলের দাবিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যÑ সদিচ্ছার বশবর্তী হয়ে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য নয়। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থাকে বাতিল করে জাতির সাথে যেমন বেঈমানি করেছে, নিজেদের সাথে করেছে চরম বিশ্বাসঘাতকতা। অনুষ্ঠিতব্য সাজানো পাতানো নির্বাচনের আয়োজন কোনো সদিচ্ছা উৎসারিত নয়, ২০২১ সাল পর্যন্ত দলকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার উদগ্র বাসনার বশবর্তী হয়ে।
’৯৬ চেয়ে বরং ২০০৭ সালের নির্বাচনী সঙ্কটের সাথে বর্তমান সঙ্কট অধিকতর তুলনীয়। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান মরহুম ড. ইয়াজউদ্দিন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছিলেন। ক্ষমতাসীন বিএনপির পক্ষ থেকে সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট তখন কে এম হাসানের বিরুদ্ধে বিএনপি সমর্থক বলে অভিযোগ তোলে, একসময়ের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতা ড. ইয়াজউদ্দিনকেও বিএনপির অনুগত বলা হতে থাকে। নির্বাচন কমিশনকে চিত্রিত করা হয় বিএনপির বংশবদ হিসেবে। তার পরও মহাজোট নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য মনোয়নপত্র দাখিল করেছিল নির্বাচন কমিশনে। হঠাৎ জাপা প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে আদালত কর্তৃক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য ঘোষণার সাথে সাথে আওয়ামী লীগসহ সব বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করে তীব্র আন্দোলনে নির্বাচন ভণ্ডুল করে দেয়। ঘটে ওয়ান ইলেভেন। তার পরের ইতিহাস সবারই জানা। মইন-ফখরউদ্দীনেরা বিএনপিকে ভাঙতে চেয়েছিল, খালেদা জিয়াকে মাইনাস করতে চেয়েছিল। ২০০৮-এর নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বিএনপির ডাকসাইটে সিনিয়র অনেক নেতাকেই কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল, মামলার পর মামলা দিয়ে ঘর ছাড়া করা হয়েছিল। ইঙ্গ-মার্কিন-ভারতীয় নীলনকশার নির্বাচনে যে পদ্ধতিতে বিএনপিকে হারিয়ে দেয়া হয়েছিল, সেই নীলনকশার অবাস্তবায়িত অংশটুকুই বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে মইন-ফখরের উত্তরাধিকারী বর্তমান সরকার। হামলা-মামলা-গুমের শিকার বিরোধী নেতারা। বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের দিয়ে জেলাখানাগুলো ভরাট করা হয়েছে। ঢাকা শহরে মিটিং মিছিলের ওপর দেয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। তফসিল ঘোষণার আগেই সরকারি দল নৌকায় ভোট চেয়ে সারা দেশ চষে বেড়াচ্ছে। মনোনয়নপত্র বিক্রি শেষ করেছে। বিলবোর্ড প্রচারণায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনা বাধায় ব্যবহার করা হচ্ছে। বংশবদ নির্বাচন কমিশন বলছে, তফসিল ঘোষণার আগে তাদের কিছুই করার নেই। কী চমৎকার লেভেল প্লেইং ফিল্ড! তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচনী যুদ্ধের মাঠকে পুরোপুরি অসমতল করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে না এলে নির্বাচনে প্রতিপক্ষ কারা? এ প্রশ্ন বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার অশুভ খেলায় মত্ত ওই সব নব্য রাজাকারের কাছে, যারা খোঁড়া যুক্তি দিয়ে মানুষকে সংবিধানের দাস হতে উপদেশ দিতে গিয়ে মুখে ফেনা তুলছেন। মানুষ বুকের রক্ত ঢেলে রাজপথ রঞ্জিত করছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য। আরেকটি সংশোধনী যদি রক্তপাত বন্ধ করতে, দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হয় তাহলে তা করতে সরকারের আপত্তি কোথায়? জনগণের রক্তের হোলিখেলা খেলে ইতঃপূর্বে অনেক শাসকই ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেছেন এ দেশের মাটিতে, কেউই সফল হননি। ‘গণতন্ত্র মেইড ইন বাংলাদেশ’ নিয়ে এখন বিদেশী পত্রিকাগুলো সমালোচনামুখর, বিদেশী রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রদূতেরা রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে উদ্বিগ্ন, আমেরিকান কংগ্রেশনাল কমিটির শুনানিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টের প্রস্তাবেও আমাদের নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস উদ্বিগ্ন, জাতিসঙ্ঘ সঙ্কট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপের তাগিদ দিচ্ছে, ওআইসিভুক্ত মুসলিম দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতেরা লা জওয়াব। দেশের আপামর জনগোষ্ঠী রাজনীতির আকাশে ঘনীভূত কালো মেঘের ছায়ায় শঙ্কিত, আতঙ্কিত। যারা যেসব দল নির্বাচন করবেন তারা তাদের সুবিধাভোগীরা ভালো করেই জানার কথা বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনের ফলাফল দেশে-বিদেশে কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এ পথ সঙ্ঘাতের, রক্ত ঝরানোর।
প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত প্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণের পলিটিক্স কবিতার চারটি চরণ এখানে উদ্ধৃত করছি : ‘পলিটিক্স নয় স্বতঃস্ফূর্ত অধ্যয়নহীন কলা,/স্বজ্ঞানলব্ধ যৌনক্রিয়া, তারও শাস্ত্র আছে।/পড়াশোনা করো বাহে,/রাষ্ট্রশাসন করা শেখো,/বিজ্ঞানসম্মত যা তাহাই দীর্ঘদিন বাঁচে।’
আমিও রাজনীতিবিদদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়ন করার অনুরোধ রাখছি। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দেশের আপামর জনগণকে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় সদাজাগ্রত থাকার অনুরোধ করছি।
প্রধানমন্ত্রী ১৯তম অধিবেশনকে নবম সংসদের সমাপনী অধিবেশন হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, দেশে ইমারজেন্সি না হলে, কোনো যুদ্ধপরিস্থিতি না হলে সংসদ অধিবেশন আর বসবে না। উল্লেখ্য, ২৫ জানুয়ারি ২০০৯ প্রথম অধিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া নবম জাতীয় সংসদ ৪১৮ কার্যদিবস চলে। প্রধানমন্ত্রীর উপরিউক্ত বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার, তিনি ক্ষমতায় থেকে তার অনুগত মন্ত্রীদের ক্ষমতায় রেখে বিরোধী জোটকে নির্বাচনের বাইরে রেখে একপক্ষীয় সাজানো-পাতানো একটি নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে চান। অনেকটা নিজের সাজানো বাগানে ফুল তোলার মতো।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকটা গায়ের জোরে আদালতকে ব্যবহার করে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাসের মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এরপর থেকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা সংবিধানে পুনঃস্থাপনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। সে দাবি পূরণ না হলে বিএনপিসহ বিরোধী জোট এবং অন্য কিছু রাজনৈতিক সংগঠন সাজানো-পাতানো নির্বাচনে যেতে কিছুতেই সম্মত নয়। একপক্ষীয় কোনো ধরনের নির্বাচনে বিরোধী দল শুধু অংশ না নেয়ার স্থির সিদ্ধান্তেই অটল থাকেনি, এ ধরনের কোনো নির্বাচন দেশের মাটিতে হতে না দেয়ার ব্যাপারেও দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী তার নেতৃত্বে গঠিত যে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় মন্ত্রিসভার কথা বলছেন, ইতোমধ্যে যা তিনি গঠনও করে ফেরেছেন তা মূলত মহাজোটীয় মন্ত্রিসভা। এখন তিনি দাবি করছেন সেটা অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা। ২০০৮-এর নির্বাচনের বর্তমান মন্ত্রীদের দলগুলোকে নিয়েই হয়েছিল মহাজোট। নতুন বোতলে পুরনো মদ ঢেলে প্রধানমন্ত্রীর জাতিকে বেয়াকুব বানানোর এ নতুন চমক, এক কথায় হাস্যকর। ‘জাসদ’ থেকে মন্ত্রিত্ব গ্রহণকারীরা গত নির্বাচনে নিজেদের নির্বাচনী প্রতীক ‘মশাল’ ফেলে দিয়ে ‘নৌকা’ মার্কাকে নিজেদের প্রতীক করেছিল। ‘ওয়ার্কার্স পার্টি’ও হাতুড়ি কাস্তে বিসর্জন দিয়ে ‘নৌকা’র যাত্রী হয়েছিল। আর জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিন্দার ঝড় বইছে। পল্লীবন্ধু এরশাদ এখন নাম কামিয়েছেন ‘থুতুবাবা’ হিসেবে। তার ভাই কাদের এবং তার প্রথমা স্ত্রী বৃদ্ধা রওশন হয়েছেন অন্তর্বর্তী মন্ত্রী। এসব প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী আবার নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য মনোনয়নপত্রও খরিদ করেছেন। ক্ষমতা ব্যবহার করে নির্বাচনেও লড়বেন।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সম্পর্কে বেশি কিছু লেখা বাতুলতামাত্র। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গদিনসীন হওয়ার পর তাকে তার মন্ত্রিসভা কেমন হবে সাংবাদিকেরা জানতে চেয়েছিলেন। কৌতুকপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী বেশ মজা করে উত্তরে বলেছিলেন, ‘রসগোল্লার মতো’। এরশাদ সম্পর্কে বলতে হয়, ‘রসিক জানে রসের মজা।’ তার তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী বিদিশার একটা বই বাজারে পাওয়া যায়। নাম ‘শত্রুর সঙ্গে বসবাস’। আগ্রহী পাঠকেরা সে বই থেকে এরশাদকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে সক্ষম হবেন বলে আমার ধারণা।
কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েও রোগী রোগের কথা না বললে উপশমের কোনো রাস্তাই চিকিৎসক খুঁজে পান না। সরকারের মন্ত্রী-যন্ত্রীদের কাছে দেশে কোনো সঙ্কটের অস্তিত্ব নেই। তারা খেয়েপরে গায়েগতরে বেশ আছেন। চাণক্যকে গুরু মেনে নিজেদের গদি রক্ষায় কৌটিল্যের কূটচালে রাজনীতিকে নাগিণীর বিষাক্ত নিঃশ্বাসে রূপান্তরিত করেছেন। দেশের মুখ্যসুখ্য মানুষগুলো এখন রাজনীতিকেই ঘৃণা করতে শুরু করেছে। বর্তমান ক্ষমতাসীনেরাই জামায়াতের ব্রেইন চাইল্ড ‘কেয়ারটেকার’ সরকারের দাবিতে আন্দোলন, বিক্ষোভ, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও করে ’৯৬-এর বেগম জিয়ার সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। বিরোধী দলগুলো ও তাদের দাবি অগ্রাহ্য করে তৎকালীন সরকার ফেব্রুয়ারিতে স্বল্পসংখ্যক ভোটার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন করেছিল। বেগম জিয়া সেই নির্বাচনে গঠিত সংসদেই বিরোধী দলের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ব্যবস্থা সংবিধানে সন্নিবেশ করে একই সালের জুন মাসে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের ব্যবস্থা নেন। বর্তমানে মহাজোটের সরকারও বিরোধী দলের দাবি অগ্রাহ্য করে দশম সংসদের নির্বাচনের দিকে ‘একলা চলো’ নীতিতে অগ্রসরমান। অনেক বিশ্লেষক বর্তমান নির্বাচনী সঙ্কটকে ’৯৬-এর সঙ্কটের সাথে তুলনা করছেন। আসলে সে সময় বিএনপি সরকার ফেব্রুয়ারির নির্বাচন করেছিল শাসনতন্ত্রে বিরোধী দলের দাবিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যÑ সদিচ্ছার বশবর্তী হয়ে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য নয়। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থাকে বাতিল করে জাতির সাথে যেমন বেঈমানি করেছে, নিজেদের সাথে করেছে চরম বিশ্বাসঘাতকতা। অনুষ্ঠিতব্য সাজানো পাতানো নির্বাচনের আয়োজন কোনো সদিচ্ছা উৎসারিত নয়, ২০২১ সাল পর্যন্ত দলকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার উদগ্র বাসনার বশবর্তী হয়ে।
’৯৬ চেয়ে বরং ২০০৭ সালের নির্বাচনী সঙ্কটের সাথে বর্তমান সঙ্কট অধিকতর তুলনীয়। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান মরহুম ড. ইয়াজউদ্দিন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছিলেন। ক্ষমতাসীন বিএনপির পক্ষ থেকে সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট তখন কে এম হাসানের বিরুদ্ধে বিএনপি সমর্থক বলে অভিযোগ তোলে, একসময়ের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতা ড. ইয়াজউদ্দিনকেও বিএনপির অনুগত বলা হতে থাকে। নির্বাচন কমিশনকে চিত্রিত করা হয় বিএনপির বংশবদ হিসেবে। তার পরও মহাজোট নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য মনোয়নপত্র দাখিল করেছিল নির্বাচন কমিশনে। হঠাৎ জাপা প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে আদালত কর্তৃক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য ঘোষণার সাথে সাথে আওয়ামী লীগসহ সব বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করে তীব্র আন্দোলনে নির্বাচন ভণ্ডুল করে দেয়। ঘটে ওয়ান ইলেভেন। তার পরের ইতিহাস সবারই জানা। মইন-ফখরউদ্দীনেরা বিএনপিকে ভাঙতে চেয়েছিল, খালেদা জিয়াকে মাইনাস করতে চেয়েছিল। ২০০৮-এর নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বিএনপির ডাকসাইটে সিনিয়র অনেক নেতাকেই কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল, মামলার পর মামলা দিয়ে ঘর ছাড়া করা হয়েছিল। ইঙ্গ-মার্কিন-ভারতীয় নীলনকশার নির্বাচনে যে পদ্ধতিতে বিএনপিকে হারিয়ে দেয়া হয়েছিল, সেই নীলনকশার অবাস্তবায়িত অংশটুকুই বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে মইন-ফখরের উত্তরাধিকারী বর্তমান সরকার। হামলা-মামলা-গুমের শিকার বিরোধী নেতারা। বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের দিয়ে জেলাখানাগুলো ভরাট করা হয়েছে। ঢাকা শহরে মিটিং মিছিলের ওপর দেয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। তফসিল ঘোষণার আগেই সরকারি দল নৌকায় ভোট চেয়ে সারা দেশ চষে বেড়াচ্ছে। মনোনয়নপত্র বিক্রি শেষ করেছে। বিলবোর্ড প্রচারণায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনা বাধায় ব্যবহার করা হচ্ছে। বংশবদ নির্বাচন কমিশন বলছে, তফসিল ঘোষণার আগে তাদের কিছুই করার নেই। কী চমৎকার লেভেল প্লেইং ফিল্ড! তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচনী যুদ্ধের মাঠকে পুরোপুরি অসমতল করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে না এলে নির্বাচনে প্রতিপক্ষ কারা? এ প্রশ্ন বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার অশুভ খেলায় মত্ত ওই সব নব্য রাজাকারের কাছে, যারা খোঁড়া যুক্তি দিয়ে মানুষকে সংবিধানের দাস হতে উপদেশ দিতে গিয়ে মুখে ফেনা তুলছেন। মানুষ বুকের রক্ত ঢেলে রাজপথ রঞ্জিত করছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য। আরেকটি সংশোধনী যদি রক্তপাত বন্ধ করতে, দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হয় তাহলে তা করতে সরকারের আপত্তি কোথায়? জনগণের রক্তের হোলিখেলা খেলে ইতঃপূর্বে অনেক শাসকই ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেছেন এ দেশের মাটিতে, কেউই সফল হননি। ‘গণতন্ত্র মেইড ইন বাংলাদেশ’ নিয়ে এখন বিদেশী পত্রিকাগুলো সমালোচনামুখর, বিদেশী রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রদূতেরা রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে উদ্বিগ্ন, আমেরিকান কংগ্রেশনাল কমিটির শুনানিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টের প্রস্তাবেও আমাদের নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস উদ্বিগ্ন, জাতিসঙ্ঘ সঙ্কট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপের তাগিদ দিচ্ছে, ওআইসিভুক্ত মুসলিম দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতেরা লা জওয়াব। দেশের আপামর জনগোষ্ঠী রাজনীতির আকাশে ঘনীভূত কালো মেঘের ছায়ায় শঙ্কিত, আতঙ্কিত। যারা যেসব দল নির্বাচন করবেন তারা তাদের সুবিধাভোগীরা ভালো করেই জানার কথা বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনের ফলাফল দেশে-বিদেশে কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এ পথ সঙ্ঘাতের, রক্ত ঝরানোর।
প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত প্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণের পলিটিক্স কবিতার চারটি চরণ এখানে উদ্ধৃত করছি : ‘পলিটিক্স নয় স্বতঃস্ফূর্ত অধ্যয়নহীন কলা,/স্বজ্ঞানলব্ধ যৌনক্রিয়া, তারও শাস্ত্র আছে।/পড়াশোনা করো বাহে,/রাষ্ট্রশাসন করা শেখো,/বিজ্ঞানসম্মত যা তাহাই দীর্ঘদিন বাঁচে।’
আমিও রাজনীতিবিদদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়ন করার অনুরোধ রাখছি। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দেশের আপামর জনগণকে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় সদাজাগ্রত থাকার অনুরোধ করছি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন