ফরহাদ মজহার
এ লেখা যখন লিখছি তখন বিরোধী দলের ওপর নতুন করে দমনপীড়ন শুরু
হয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ,
এম কে আনোয়ার ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার
করেছে। গভীর রাতে খালেদা জিয়ার বাসা থেকে বেরিয়ে যাবার সময় গ্রেফতার হয়েছেন
ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল মিন্টু ও বিএনপির চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শিমূল বিশ্বাস।
কী অভিযোগে তাঁদের গ্রেফতার করা হোল পুলিশ জানায় নি।
এ ছাড়া রাতে সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক, যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ঢাকা জেলা বিএনপি সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল মান্নান, ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন অসীমসহ বিএনপির অসংখ্য নেতার বাসায় গ্রেফতার অভিযান চালিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। গ্রেফতার অভিযান শেষ হয় নি। চলছে। এই পরিস্থিতিতে খালেদা কী করবেন। তিনি আরো কঠোর কর্মসূচি দিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর সামনে আর কোন পথ খোলা নাই।
এই ধরপাকড় ও দমনপীড়ন রাজনীতিকে আরো সংঘাতসংকুল করে তুলবে, এতে সন্দেহ নাই। যেসকল শ্রেণী, শক্তি বা গোষ্ঠি বাংলাদেশকে দীর্ঘকাল শাসন করছে তারা আজ অবধি একটি স্থিতিশীল নির্বাচনকেন্দ্রিক উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে পারে নি। এখন যারা মতায় আছে তাদের ভূমিকা মুমূর্ষু ব্যবস্থাকে কফিনে পুরে দেওয়া। সেই কাজ করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও হিংস্রতার যে-চেহারা আমরা দেখছি তা নতুন কিছু নয়। মতাসীন শক্তির এখনকার চেহারা নতুন কোন অভিজ্ঞতা নয়। কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র। অশুভ শক্তিকে মোকাবিলা করবার সঠিক পথ কী হবে?
অনেকে তর্ক করতে পারেন যে মতাসীন থাকার সময় বিএনপিও বিরোধী রাজনৈতিক পরে দাবিদাওয়া এভাবেই দমনপীড়ন করে স্তব্ধ করে দিয়েছে। এই তর্কের সত্যাসত্য বিচার হতেই পারে। কিন্তু যাঁরা এই তর্ক তুলছেন তারা আসলে বলতে চান, বিএনপি যেহেতু এভাবেই মতাসীন থাকার সময় দমনপীড়ন করেছে, অতএব মহাজোট সেই একই ভাবে এখন বিএনপিকে দমন করবে, সম্ভব হলে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেবে। মহাজোট মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে, এটাই এখন স্পষ্ট হচ্ছে। আওয়ামী লীগকে সংগ্রাম করেই তত্ত্বাবধায়কের দাবি আদায় করতে হয়েছে, অতএব এখন আঠারো দলীয় জোটকেও তার চেয়েও শতগুণ বেশী রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের পছন্দের নির্বাচনকালীন সরকার আদায় করে নিতে হবে। নির্বাচনসর্বস্ব উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল বহাল রাখার দায় দুই পরে কেউই নিতে চায় না। এর আরো সরল অর্থ হচ্ছে, রাজনীতির দুই প্রধান প্রতিপরে কেউই সাংবিধানিক রাজনীতির চর্চা করে না, এবং করতেও চায় না। যদি প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাংবিধানিক, নিয়মতান্ত্রিক বা আইনী রাজনীতির চর্চা করার েেত্র অনীহা থাকে তাহলে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের নিরসন অসম্ভব।
এই সহজ সত্য চোখের সামনে হাজির থাকার পরও ঢাকার সুশীল নাগরিকদের কথাবার্তা অর্থহীন কোলাহল ছাড়া আর কোনই অর্থ বহন করে না। যেখানে নিরপে ভাবে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা বিচার করা দরকার সেখানে স্বল্প দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সুশীল সমাজের প্রায় সকলেরই অবস্থান মতাসীনদের প।ে তারা সকলে প্রকাশ্যে মতাসীনদের পে বলছেন সেকথা বলছি না, কিন্তু এখনও তারা সংলাপের কথা বলছেন, এখনও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান সংকট মীমাংসার আশা করছেন। এমন এক পরিস্থিতিতে যখন বিরোধী জোটের পে মতাসীনদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা নাই। যেখানে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির কোন পরিসর নাই বললেই চলে এবং প্রথাগত উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের কিছুই কার্যত অবশিষ্ট নাই সেই েেত্র শান্তিপূর্ণ ভাবে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আশা ও অনুরোধ করা মূলত নির্লজ্জ ভাবে মতাসীনদের পে দাঁড়ানো। বিদ্যমান অগণতান্ত্রিক ও গণবিরোধী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ন্যায্যতা দান এবং শেখ হাসিনার অন্যায় অবস্থানকে শক্তিশালী করা।
আঠারোদলীয় জোটের দিক থেকে কড়া কর্মসূচি দেওয়া ছাড়া আর কোন পথ নাই। দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে হবে এখন। প্রস্তুতি হিসাবে আঠারো দলীয় জোটকে দ্রুত তাদের সংগ্রাম কমিটিগুলো গড়ে তোলার েেত্র সক্রিয় হতে হবে। কিছু জেলায় এই কমিটিগুলো গঠিত হয়েছে ও কাজ করছে বলে শোনা যাচ্ছে। প্রায় সবকটি গণমাধ্যম মতাসীন মহাজোটের পে সক্রিয়। সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারের েেত্র যে প্রকট অসাম্য রয়েছে তার গুনাহগারি ভোগ করতে হবে মহাজোটকে। ফলে ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতে কী হচ্ছে তার পূর্ণ চিত্র আমরা পাচ্ছি না।
আমি সবসময়ই শুধু নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির ভিত্তিতে বিরোধী দলের আন্দোলনকে সমালোচনা করেছি। উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল যখন কাজ করে সেই কাঠামোর মধ্যে এই ধরণের দাবির উপযোগিতা একান্তই নির্বাচনের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশের বিদ্যমান রাষ্ট্র ও মতাসীন সরকারের চরিত্র হিসাবে নিলে আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া এই দাবিও আদায় করা অসম্ভব। সেই েেত্র এই দাবির সীমিত ও সংকীর্ণ চরিত্র গণমানুষকে আন্দোলন সংগ্রামে কতটা আগ্রহান্বিত করবে সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে মতাসীনরা পরিস্থিতিকে যেখানে ঠেলে দিয়েছে তার ফলে জনগণ এখন অনেক বেশী বিুব্ধ। মতাসীনরা তাদের ভাবমূর্তি উদ্ধারের যতোই চেষ্টা করুক, বারবার তারা তাদের হিংস্র চেহারাকেই সামনে নিয়ে আসছে। ফলে সাধারণ ভাবে বাংলাদেশে আন্দোলন-সংগ্রামের একটি পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আঠারো দলীয় জোট একে ঠিকভাবে গুছিয়ে, জনগণের ইচ্ছা ও আকাক্সাকে দাবিদাওয়া হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে একে বেগবান করতে পারবে কি না, সেটা অচিরেই আমরা দেখব।
ইতোমধ্যে আন্দোলনকে নস্যাৎ করবার জন্য অমুসলিম ধর্মালম্বীদের বাড়িঘরে হামলা হয়েছে। পরিকল্পিত ভাবে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে। এ চেষ্টা এখনও অব্যাহত আছে। আঠারো দলীয় জোটের প থেকে এই েেত্র সতর্ক হুঁশিয়ারি দান করা হয়েছে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে ইসলামপন্থী দল ও বাংলাদেশের আলেম-ওলামাদের প থেকে এই ধরণের অপচেষ্টার বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা হয়েছে। ল্য করবার বিষয়, বাংলাদেশের প্রধান প্রধান গণমাধ্যম আলেম-ওলেমা ও ইসলামপন্থী দলগুলোর সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী অবস্থানের খবর দেয় নি বললেই চলে। সাম্প্রদায়িকতার জন্য শুধু ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও আলেম-ওলেমাদের দায়ী করবার প্রথাগত অভ্যাস বা ইসলাম-বিদ্বেষই একমাত্র কারণ নয়। আসলে পরিকল্পিত ভাবে বাংলাদেশে দাঙ্গা লাগাবার েেত্র কয়েকটি গণমাধ্যম সক্রিয় ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। যার দায় তারা ইসলামপন্থি দলগুলোর ওপরই চাপাবে। বাংলা পত্রিকার ভূমিকা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও একটি প্রথম সারির ইংরাজি পত্রিকার ভূমিকা এই েেত্র ভয়ানক বিপজ্জনক। এই পত্রিকাটিই মূলত ঢাকার কূটনৈতিক চিন্তাকে প্রভাবিত করে এবং আন্তর্জাতিক ভাবে বাংলাদেশের প্রতি পাশ্চাত্য দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গী নির্ণয়ে নির্ধারক ভূমিকা রাখে। ইসলামপন্থী ‘মৌলবাদী’রাই সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরি করছে এটা প্রমাণে তারা আন্তর্জাতিক মহলে নিরন্তর প্রচার করে যাচ্ছে।
বিরোধীদলীয় কর্মসূচিতে জনগণের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা বাড়াতে হলে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার দাবি ছাড়াও আঠারোদলীয় জোটকে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে অবস্থান ব্যক্ত করতে হবে। স্থানীয় কমিটিগুলোকে কার্যকর করবার পথ হচ্ছে এ স্থানীয় ইস্যুগুলোও সরকার পতনের দাবির পাশাপাশি উত্থাপন করা এবং গণসমর্থনের ভিত্তি দ্রুত তৈরি করা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতির প্রশমন খুব সহজে হবে না।
সম্ভবত আঠারোদলীয় জোটও বর্তমান পরিস্থিতির মূল্যায়ন ভিন্ন ভাবে করছে না। অর্থাৎ কঠোর অবস্থান নেওয়া ছাড়া আর তাদের সামনে আর কোন বিকল্প শেখ হাসিনা রাখেন নি। এটা তাদের কাছে স্পষ্ট। কিন্তু তিনি আদৌ কখনো রাখতে চেয়েছেন কি না, সেটাও একটি প্রশ্ন। এই েেত্র আমার সবসময়ই মনে হয়েছে শেখ হাসিনা কখনই সংলাপ হোক এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান বের হয়ে আসুক সেটা কখনই চান নি। যে কারণে পরিস্থিতি আজ এখানে এসে ঠেকেছে।
আঠারো দল তাদের এ যাবতকালের আন্দোলন ও কর্মসূচীর ফলাফল কিভাবে মূল্যায়ন করে তার ওপর তাদের পরবর্তী কর্মসূচির সাফল্য নির্ভর করবে। গণমাধ্যমের ভূমিকাও কর্মসূচির সাফল্যের েেত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু গণমাধ্যমের বড় অংশই সরকার পীয়। তাদের খবর ও বিশ্লেষণ খুবই একদেশদর্শী। সরকার-বিরোধী সংবাদপত্র ও টেলিভিশন অবৈধ ভাবে বন্ধ করে রাখায় সংবাদ প্রচারে ও ব্যাখ্যায় যে অসাম্য সৃষ্টি হয়েছে বলাবাহুল্য তা আঠারো দলীয় জোটের বিপইে যাবে। বিশেষত বিরোধী দলের কঠোর কর্মসূচিতে কিভাবে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে ও মানুষ তিগ্রস্ত হয়েছে সেই প্রচার চলবে। সেটা চলছেও সারাণ। মতাসীনরা যথারীতি এর দায় আঠারোদলীয় জোটের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। যদিও তা বিশ্বাস করানো কঠিন, কিন্তু এই অপবাদের প্রচারমূল্য কম না। যদি অঘটনের গোড়ার দিকে তাকাই তাহলে বলতেই হয় বর্তমান পরিস্থিতির জন্য পঞ্চদশ সংশোধনী প্রধানত দায়ী। মতাসীনরা একতরফা তাদের সুবিধা মতো সংবিধান বদলিয়ে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন করতে চাইছে। বিরোধী দল তাদের স্বার্থহানি হয় বলে সেটা মানছে না। মানবার কোন যুক্তি নাই।
শেখ হাসিনা কোন সংলাপ বা দুইপরে সম্মতির ভিত্তিতে সংকটের নিরসন ঘটুক সেটা কখনই চান নি। নির্বাচনকালীন সরকার সম্বন্ধে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান বের হোক সেটা কখনই চান নি। এটা এর আগে অনুমান গণ্য করতাম। কিন্তু এখন নিশ্চিত ভাবেই সেটা বলা যায়। ভারতীয় পত্রপত্রিকা ও নীতিনির্ধারকদের সাম্প্রতিক কথাবার্তায় এখন স্পষ্ট দিল্লী শেখ হাসিনাকেই মতায় রাখতে চায়। কিন্তু একটি নির্দলীয় ও নিরপে সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনাকে মতায় রাখা রীতিমত অসম্ভব। দিল্লীর এই অবস্থান স্পষ্ট হওয়ায় এখন বোঝা যাচ্ছে দিল্লীর কথা মতো শেখ হাসিনা আসলে আগাগোড়াই খালেদা জিয়াকে নির্বাচনের বাইরে রাখবার কৌশলই অনুসরণ করছিলেন। মতাসীনদের আশা তাঁর দল থেকে একটি অংশ ভেঙে বেরিয়ে আসবে আর শেখ হাসিনাকে মতায় রেখে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। এটা আসলেই একটি সম্ভাবনা। ঘটে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নাই।
অর্থাৎ পরিস্থিতি আরো অস্থির, সহিংস ও রক্তপাতে পিচ্ছিল হবার সম্ভাবনা প্রচুর। আঠারো দলীয় জোট এই ধরণের পরিস্থিতি কতটা এড়াতে সম হবে বলা মুশকিল। কিন্তু মতাসীনরা দায় চাপাবে তাদের ওপর। দল হিসাবে বিএনপি বা আঠারোদলীয় জোটের সাংগঠনিক মতা বা নেতৃত্বের শক্তি এখন গুরুত্বপূর্ণ বা বিচার্য নয়। বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতি মোটেও কম শক্তিশালী নয়। দিল্লীর আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদ বিরোধী এই ধারা আদর্শিক ও সাংগঠনিক এই উভয় দিক থেকেই দুর্বল হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে দিল্লীর পপাত এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে প্রকাশ হয়ে পড়ায় সাধারণ মানুষ এই আন্দোলন-সংগ্রামকে দিল্লীর আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই হিসাবে বুঝবার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
এটা ঠিক দিল্লীর আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার েেত্র বিএনপির ওপর জনগণের ভরসা কম। বিএনপি ও আঠারোদলীয় জোটের মধ্যেও দিল্লীর প্রতি প্রীতি ও মহব্বতের বিশেষ কমতি নাই। আওয়ামী লীগের চেয়েও সেটা কম নয়। কিন্তু যে কোন কারণে হোক বিএনপির অপদার্থ রাজনৈতিক ভূমিকাকেই জনগণ এই েেত্র দায়ী করে। সম্ভবত খালেদা জিয়ার ওপর এই েেত্র জনগণের আস্থা রয়েছে। তাঁর দিল্লী সফরের মধ্যে দিল্লীকে তুষ্ট করবার চিহ্ন দেখে জনগণ বিুব্ধ হলেও তারা মনে করে আঠারো দলীয় জোটের সম্মিলিত অবস্থান দিল্লীর আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটা ঢাল হতে পারে।
আগেই বলেছি, বিএনপি দুর্বল হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতি মোটেও কম শক্তিশালী নয়। এদের সমর্থকের সংখ্যা গণমাধ্যমের জরিপে আসে না। জরিপ হয় বিএনপির ওপর, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে সচেতন নাগরিকদের ওপর নয়। সেইসব বিপুল সংখ্যক নাগরিক যারা ভারতীয় জনগণকে মিত্র গণ্য করলেও দিল্লীর ভূমিকাকে আগ্রাসী মনে করে। এরা শুধু বিএনপি বা আঠারোদলীয় জোটের অন্য কোন শরিকের রাজনীতি করে এটা ভাবা ভুল। কারণ এই ধরণের নাগরিক আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে এমন ব্যক্তিরাও আছেন, যাদের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ দিল্লীর স্বার্থের চেয়ে বড়।
এই রাজনীতিকে বিএনপি শক্তিশালী রূপ দিতে পারছে না কেন? বিএনপির ভুল নীতি ও কৌশল এর একমাত্র কারণ নয়। বিএনপি যে শ্রেণির ওপর তার মতার ভিত্তি দাঁড় করাতে চায়, সেই শ্রেণি এই রাজনীতির আন্তরিক ধারক ও বাহক নয়। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় তারা উপকারভোগী হতে পারে, কিন্তু এ রাজনীতিকে বিকশিত করবার শ্রেণিগত মতা তাদের নাই। এর ধারক ও বাহক মূলত শহর ও গ্রামের সেই সব মানুষ, যারা গরিব ও মজলুমÑ ইসলাম যাদের আত্ম-পরিচয় নির্মাণের উপাদান। কিন্তু বিএনপি এ শ্রেণির স্বার্থ রার দল নয়। এই শ্রেণিকে পুরাপুরি আস্থায় নিতে বিএনপি শ্রেণিগত কারণেই ব্যর্থ হতে বাধ্য। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণ ভিন্ন ভাবে ভাবলেও ভাবতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বারবার মনে করিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়কের দাবি ছাড়া বিদ্যমান সংবিধানকে কিভাবে গণতান্ত্রিক সংবিধানে রূপান্তর ঘটানো সম্ভব সে সম্পর্কে কিছুই আজ অবধি বলে নি। আঠারো দলীয় জোটেও বিদ্যমান সংবিধানের সংস্কার কিম্বা রূপান্তর নিয়ে কোন কথা শোনা যায় নি। বিএনপি বা আঠারোদলীয় জোট আদৌ কোন সংস্কার করবে কিনা, তারও কোন সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি জনগণ পায় নি। তা ছাড়া সার্বভৌমত্ব, জাতীয় প্রতিরা, আর্থ-সামাজিক ইসু্যু, প্রাণ ও পরিবেশ, খাদ্য ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আঠারোদলীয় জোটের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোন কিছুই জানা যায় নি। এখনও এই সকল েেত্র বিএনপির কোন অবস্থান কারো জানা নাই। শুধু নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য জনগণ আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাবে সে আশা করা ঠিক না। পুলিশের গুলি খেয়ে নিহত বা আহত হবে সেটাও আশা করা ঠিক না। নির্বাচনী রাজনীতির জন্য সেটা চললেও আন্দোলন-সংগ্রামকে বিজয়ের দিকে নিতে হলে বাস্তব ও কার্যকর করা সম্ভব কিছু কংক্রিট প্রতিশ্রুতি জনগণকে আঠারো দলীয় জোটের দিতেই হবে। স্রেফ হাওয়ার ওপর আন্দোলন দাঁড়াতে পারে না।
আঠারোদলীয় জোট যদি বিপর্যয় এড়াতে চায় তাহলে এদিকে মনোনিবেশ করা উচিত। সরকার পীয়রা এখন এ প্রচার করতে সম যে খালেদা জিয়ার কঠোর অবস্থান ব্যর্থ হয়েছে, তাঁর উচিত শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে বসা। যদিও এ কথা মোটেও ঠিক নয়। আঠারো দলের মধ্যে নির্বাচনপন্থীরা আরো চাপ তৈরি করবে, শেখ হাসিনাকে রেখে নির্বাচন করবার জন্য তারা অনেকেই তৈরী। খালেদা জিয়া সংলাপ ও আন্দোলনের যে কৌশল গ্রহণ করেছেন সেটা সঠিক অবস্থান। কিন্তু জনগণকে বিপুল ভাবে সম্পৃক্ত করবার কোন নীতি তিনি গ্রহণ করেন নি। এটা তার জন্য মারাত্মক বিপর্যয় তৈরি করতে পারে।
জেলায় জেলায় সংগ্রাম কমিটিগুলো যেভাবে গড়ে উঠেছে জনগণের প্রত্যাশার দিকে নজর রেখে তাদের সঠিক গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি দিতে পারলে ও জেলায় জেলায় প্রচার করলে আন্দোলন অবশ্যই বেগবান হবে এ ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নাই। এই রাষ্ট ব্যবস্থা আমাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করেছে। খোদ রাষ্ট্রই ‘সন্ত্রাস’ করে। আমাদের কণ্ঠরোধ করে। পত্রিকা ও টেলিভিশান স্টেশান বন্ধ করে দেয়। জনগণ এই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে মুক্তি চায়।
খালেদা জিয়া এই ব্যবস্থাকে বহাল রাখবেন নাকি বদলাবেন সে ব্যাপারে জনগণ এখনও অন্ধকারে রয়েছে। তাঁর উচিত সেটা অবিলম্বে স্পষ্ট করা।
এ ছাড়া রাতে সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক, যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ঢাকা জেলা বিএনপি সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল মান্নান, ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন অসীমসহ বিএনপির অসংখ্য নেতার বাসায় গ্রেফতার অভিযান চালিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। গ্রেফতার অভিযান শেষ হয় নি। চলছে। এই পরিস্থিতিতে খালেদা কী করবেন। তিনি আরো কঠোর কর্মসূচি দিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর সামনে আর কোন পথ খোলা নাই।
এই ধরপাকড় ও দমনপীড়ন রাজনীতিকে আরো সংঘাতসংকুল করে তুলবে, এতে সন্দেহ নাই। যেসকল শ্রেণী, শক্তি বা গোষ্ঠি বাংলাদেশকে দীর্ঘকাল শাসন করছে তারা আজ অবধি একটি স্থিতিশীল নির্বাচনকেন্দ্রিক উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে পারে নি। এখন যারা মতায় আছে তাদের ভূমিকা মুমূর্ষু ব্যবস্থাকে কফিনে পুরে দেওয়া। সেই কাজ করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও হিংস্রতার যে-চেহারা আমরা দেখছি তা নতুন কিছু নয়। মতাসীন শক্তির এখনকার চেহারা নতুন কোন অভিজ্ঞতা নয়। কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র। অশুভ শক্তিকে মোকাবিলা করবার সঠিক পথ কী হবে?
অনেকে তর্ক করতে পারেন যে মতাসীন থাকার সময় বিএনপিও বিরোধী রাজনৈতিক পরে দাবিদাওয়া এভাবেই দমনপীড়ন করে স্তব্ধ করে দিয়েছে। এই তর্কের সত্যাসত্য বিচার হতেই পারে। কিন্তু যাঁরা এই তর্ক তুলছেন তারা আসলে বলতে চান, বিএনপি যেহেতু এভাবেই মতাসীন থাকার সময় দমনপীড়ন করেছে, অতএব মহাজোট সেই একই ভাবে এখন বিএনপিকে দমন করবে, সম্ভব হলে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেবে। মহাজোট মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে, এটাই এখন স্পষ্ট হচ্ছে। আওয়ামী লীগকে সংগ্রাম করেই তত্ত্বাবধায়কের দাবি আদায় করতে হয়েছে, অতএব এখন আঠারো দলীয় জোটকেও তার চেয়েও শতগুণ বেশী রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের পছন্দের নির্বাচনকালীন সরকার আদায় করে নিতে হবে। নির্বাচনসর্বস্ব উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল বহাল রাখার দায় দুই পরে কেউই নিতে চায় না। এর আরো সরল অর্থ হচ্ছে, রাজনীতির দুই প্রধান প্রতিপরে কেউই সাংবিধানিক রাজনীতির চর্চা করে না, এবং করতেও চায় না। যদি প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাংবিধানিক, নিয়মতান্ত্রিক বা আইনী রাজনীতির চর্চা করার েেত্র অনীহা থাকে তাহলে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের নিরসন অসম্ভব।
এই সহজ সত্য চোখের সামনে হাজির থাকার পরও ঢাকার সুশীল নাগরিকদের কথাবার্তা অর্থহীন কোলাহল ছাড়া আর কোনই অর্থ বহন করে না। যেখানে নিরপে ভাবে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা বিচার করা দরকার সেখানে স্বল্প দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সুশীল সমাজের প্রায় সকলেরই অবস্থান মতাসীনদের প।ে তারা সকলে প্রকাশ্যে মতাসীনদের পে বলছেন সেকথা বলছি না, কিন্তু এখনও তারা সংলাপের কথা বলছেন, এখনও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান সংকট মীমাংসার আশা করছেন। এমন এক পরিস্থিতিতে যখন বিরোধী জোটের পে মতাসীনদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা নাই। যেখানে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির কোন পরিসর নাই বললেই চলে এবং প্রথাগত উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের কিছুই কার্যত অবশিষ্ট নাই সেই েেত্র শান্তিপূর্ণ ভাবে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আশা ও অনুরোধ করা মূলত নির্লজ্জ ভাবে মতাসীনদের পে দাঁড়ানো। বিদ্যমান অগণতান্ত্রিক ও গণবিরোধী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ন্যায্যতা দান এবং শেখ হাসিনার অন্যায় অবস্থানকে শক্তিশালী করা।
আঠারোদলীয় জোটের দিক থেকে কড়া কর্মসূচি দেওয়া ছাড়া আর কোন পথ নাই। দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে হবে এখন। প্রস্তুতি হিসাবে আঠারো দলীয় জোটকে দ্রুত তাদের সংগ্রাম কমিটিগুলো গড়ে তোলার েেত্র সক্রিয় হতে হবে। কিছু জেলায় এই কমিটিগুলো গঠিত হয়েছে ও কাজ করছে বলে শোনা যাচ্ছে। প্রায় সবকটি গণমাধ্যম মতাসীন মহাজোটের পে সক্রিয়। সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারের েেত্র যে প্রকট অসাম্য রয়েছে তার গুনাহগারি ভোগ করতে হবে মহাজোটকে। ফলে ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতে কী হচ্ছে তার পূর্ণ চিত্র আমরা পাচ্ছি না।
আমি সবসময়ই শুধু নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির ভিত্তিতে বিরোধী দলের আন্দোলনকে সমালোচনা করেছি। উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল যখন কাজ করে সেই কাঠামোর মধ্যে এই ধরণের দাবির উপযোগিতা একান্তই নির্বাচনের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশের বিদ্যমান রাষ্ট্র ও মতাসীন সরকারের চরিত্র হিসাবে নিলে আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া এই দাবিও আদায় করা অসম্ভব। সেই েেত্র এই দাবির সীমিত ও সংকীর্ণ চরিত্র গণমানুষকে আন্দোলন সংগ্রামে কতটা আগ্রহান্বিত করবে সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে মতাসীনরা পরিস্থিতিকে যেখানে ঠেলে দিয়েছে তার ফলে জনগণ এখন অনেক বেশী বিুব্ধ। মতাসীনরা তাদের ভাবমূর্তি উদ্ধারের যতোই চেষ্টা করুক, বারবার তারা তাদের হিংস্র চেহারাকেই সামনে নিয়ে আসছে। ফলে সাধারণ ভাবে বাংলাদেশে আন্দোলন-সংগ্রামের একটি পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আঠারো দলীয় জোট একে ঠিকভাবে গুছিয়ে, জনগণের ইচ্ছা ও আকাক্সাকে দাবিদাওয়া হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে একে বেগবান করতে পারবে কি না, সেটা অচিরেই আমরা দেখব।
ইতোমধ্যে আন্দোলনকে নস্যাৎ করবার জন্য অমুসলিম ধর্মালম্বীদের বাড়িঘরে হামলা হয়েছে। পরিকল্পিত ভাবে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে। এ চেষ্টা এখনও অব্যাহত আছে। আঠারো দলীয় জোটের প থেকে এই েেত্র সতর্ক হুঁশিয়ারি দান করা হয়েছে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে ইসলামপন্থী দল ও বাংলাদেশের আলেম-ওলামাদের প থেকে এই ধরণের অপচেষ্টার বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা হয়েছে। ল্য করবার বিষয়, বাংলাদেশের প্রধান প্রধান গণমাধ্যম আলেম-ওলেমা ও ইসলামপন্থী দলগুলোর সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী অবস্থানের খবর দেয় নি বললেই চলে। সাম্প্রদায়িকতার জন্য শুধু ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও আলেম-ওলেমাদের দায়ী করবার প্রথাগত অভ্যাস বা ইসলাম-বিদ্বেষই একমাত্র কারণ নয়। আসলে পরিকল্পিত ভাবে বাংলাদেশে দাঙ্গা লাগাবার েেত্র কয়েকটি গণমাধ্যম সক্রিয় ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। যার দায় তারা ইসলামপন্থি দলগুলোর ওপরই চাপাবে। বাংলা পত্রিকার ভূমিকা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও একটি প্রথম সারির ইংরাজি পত্রিকার ভূমিকা এই েেত্র ভয়ানক বিপজ্জনক। এই পত্রিকাটিই মূলত ঢাকার কূটনৈতিক চিন্তাকে প্রভাবিত করে এবং আন্তর্জাতিক ভাবে বাংলাদেশের প্রতি পাশ্চাত্য দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গী নির্ণয়ে নির্ধারক ভূমিকা রাখে। ইসলামপন্থী ‘মৌলবাদী’রাই সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরি করছে এটা প্রমাণে তারা আন্তর্জাতিক মহলে নিরন্তর প্রচার করে যাচ্ছে।
বিরোধীদলীয় কর্মসূচিতে জনগণের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা বাড়াতে হলে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার দাবি ছাড়াও আঠারোদলীয় জোটকে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে অবস্থান ব্যক্ত করতে হবে। স্থানীয় কমিটিগুলোকে কার্যকর করবার পথ হচ্ছে এ স্থানীয় ইস্যুগুলোও সরকার পতনের দাবির পাশাপাশি উত্থাপন করা এবং গণসমর্থনের ভিত্তি দ্রুত তৈরি করা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতির প্রশমন খুব সহজে হবে না।
সম্ভবত আঠারোদলীয় জোটও বর্তমান পরিস্থিতির মূল্যায়ন ভিন্ন ভাবে করছে না। অর্থাৎ কঠোর অবস্থান নেওয়া ছাড়া আর তাদের সামনে আর কোন বিকল্প শেখ হাসিনা রাখেন নি। এটা তাদের কাছে স্পষ্ট। কিন্তু তিনি আদৌ কখনো রাখতে চেয়েছেন কি না, সেটাও একটি প্রশ্ন। এই েেত্র আমার সবসময়ই মনে হয়েছে শেখ হাসিনা কখনই সংলাপ হোক এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান বের হয়ে আসুক সেটা কখনই চান নি। যে কারণে পরিস্থিতি আজ এখানে এসে ঠেকেছে।
আঠারো দল তাদের এ যাবতকালের আন্দোলন ও কর্মসূচীর ফলাফল কিভাবে মূল্যায়ন করে তার ওপর তাদের পরবর্তী কর্মসূচির সাফল্য নির্ভর করবে। গণমাধ্যমের ভূমিকাও কর্মসূচির সাফল্যের েেত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু গণমাধ্যমের বড় অংশই সরকার পীয়। তাদের খবর ও বিশ্লেষণ খুবই একদেশদর্শী। সরকার-বিরোধী সংবাদপত্র ও টেলিভিশন অবৈধ ভাবে বন্ধ করে রাখায় সংবাদ প্রচারে ও ব্যাখ্যায় যে অসাম্য সৃষ্টি হয়েছে বলাবাহুল্য তা আঠারো দলীয় জোটের বিপইে যাবে। বিশেষত বিরোধী দলের কঠোর কর্মসূচিতে কিভাবে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে ও মানুষ তিগ্রস্ত হয়েছে সেই প্রচার চলবে। সেটা চলছেও সারাণ। মতাসীনরা যথারীতি এর দায় আঠারোদলীয় জোটের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। যদিও তা বিশ্বাস করানো কঠিন, কিন্তু এই অপবাদের প্রচারমূল্য কম না। যদি অঘটনের গোড়ার দিকে তাকাই তাহলে বলতেই হয় বর্তমান পরিস্থিতির জন্য পঞ্চদশ সংশোধনী প্রধানত দায়ী। মতাসীনরা একতরফা তাদের সুবিধা মতো সংবিধান বদলিয়ে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন করতে চাইছে। বিরোধী দল তাদের স্বার্থহানি হয় বলে সেটা মানছে না। মানবার কোন যুক্তি নাই।
শেখ হাসিনা কোন সংলাপ বা দুইপরে সম্মতির ভিত্তিতে সংকটের নিরসন ঘটুক সেটা কখনই চান নি। নির্বাচনকালীন সরকার সম্বন্ধে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান বের হোক সেটা কখনই চান নি। এটা এর আগে অনুমান গণ্য করতাম। কিন্তু এখন নিশ্চিত ভাবেই সেটা বলা যায়। ভারতীয় পত্রপত্রিকা ও নীতিনির্ধারকদের সাম্প্রতিক কথাবার্তায় এখন স্পষ্ট দিল্লী শেখ হাসিনাকেই মতায় রাখতে চায়। কিন্তু একটি নির্দলীয় ও নিরপে সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনাকে মতায় রাখা রীতিমত অসম্ভব। দিল্লীর এই অবস্থান স্পষ্ট হওয়ায় এখন বোঝা যাচ্ছে দিল্লীর কথা মতো শেখ হাসিনা আসলে আগাগোড়াই খালেদা জিয়াকে নির্বাচনের বাইরে রাখবার কৌশলই অনুসরণ করছিলেন। মতাসীনদের আশা তাঁর দল থেকে একটি অংশ ভেঙে বেরিয়ে আসবে আর শেখ হাসিনাকে মতায় রেখে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। এটা আসলেই একটি সম্ভাবনা। ঘটে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নাই।
অর্থাৎ পরিস্থিতি আরো অস্থির, সহিংস ও রক্তপাতে পিচ্ছিল হবার সম্ভাবনা প্রচুর। আঠারো দলীয় জোট এই ধরণের পরিস্থিতি কতটা এড়াতে সম হবে বলা মুশকিল। কিন্তু মতাসীনরা দায় চাপাবে তাদের ওপর। দল হিসাবে বিএনপি বা আঠারোদলীয় জোটের সাংগঠনিক মতা বা নেতৃত্বের শক্তি এখন গুরুত্বপূর্ণ বা বিচার্য নয়। বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতি মোটেও কম শক্তিশালী নয়। দিল্লীর আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদ বিরোধী এই ধারা আদর্শিক ও সাংগঠনিক এই উভয় দিক থেকেই দুর্বল হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে দিল্লীর পপাত এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে প্রকাশ হয়ে পড়ায় সাধারণ মানুষ এই আন্দোলন-সংগ্রামকে দিল্লীর আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই হিসাবে বুঝবার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
এটা ঠিক দিল্লীর আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার েেত্র বিএনপির ওপর জনগণের ভরসা কম। বিএনপি ও আঠারোদলীয় জোটের মধ্যেও দিল্লীর প্রতি প্রীতি ও মহব্বতের বিশেষ কমতি নাই। আওয়ামী লীগের চেয়েও সেটা কম নয়। কিন্তু যে কোন কারণে হোক বিএনপির অপদার্থ রাজনৈতিক ভূমিকাকেই জনগণ এই েেত্র দায়ী করে। সম্ভবত খালেদা জিয়ার ওপর এই েেত্র জনগণের আস্থা রয়েছে। তাঁর দিল্লী সফরের মধ্যে দিল্লীকে তুষ্ট করবার চিহ্ন দেখে জনগণ বিুব্ধ হলেও তারা মনে করে আঠারো দলীয় জোটের সম্মিলিত অবস্থান দিল্লীর আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটা ঢাল হতে পারে।
আগেই বলেছি, বিএনপি দুর্বল হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতি মোটেও কম শক্তিশালী নয়। এদের সমর্থকের সংখ্যা গণমাধ্যমের জরিপে আসে না। জরিপ হয় বিএনপির ওপর, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে সচেতন নাগরিকদের ওপর নয়। সেইসব বিপুল সংখ্যক নাগরিক যারা ভারতীয় জনগণকে মিত্র গণ্য করলেও দিল্লীর ভূমিকাকে আগ্রাসী মনে করে। এরা শুধু বিএনপি বা আঠারোদলীয় জোটের অন্য কোন শরিকের রাজনীতি করে এটা ভাবা ভুল। কারণ এই ধরণের নাগরিক আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে এমন ব্যক্তিরাও আছেন, যাদের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ দিল্লীর স্বার্থের চেয়ে বড়।
এই রাজনীতিকে বিএনপি শক্তিশালী রূপ দিতে পারছে না কেন? বিএনপির ভুল নীতি ও কৌশল এর একমাত্র কারণ নয়। বিএনপি যে শ্রেণির ওপর তার মতার ভিত্তি দাঁড় করাতে চায়, সেই শ্রেণি এই রাজনীতির আন্তরিক ধারক ও বাহক নয়। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় তারা উপকারভোগী হতে পারে, কিন্তু এ রাজনীতিকে বিকশিত করবার শ্রেণিগত মতা তাদের নাই। এর ধারক ও বাহক মূলত শহর ও গ্রামের সেই সব মানুষ, যারা গরিব ও মজলুমÑ ইসলাম যাদের আত্ম-পরিচয় নির্মাণের উপাদান। কিন্তু বিএনপি এ শ্রেণির স্বার্থ রার দল নয়। এই শ্রেণিকে পুরাপুরি আস্থায় নিতে বিএনপি শ্রেণিগত কারণেই ব্যর্থ হতে বাধ্য। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণ ভিন্ন ভাবে ভাবলেও ভাবতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বারবার মনে করিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়কের দাবি ছাড়া বিদ্যমান সংবিধানকে কিভাবে গণতান্ত্রিক সংবিধানে রূপান্তর ঘটানো সম্ভব সে সম্পর্কে কিছুই আজ অবধি বলে নি। আঠারো দলীয় জোটেও বিদ্যমান সংবিধানের সংস্কার কিম্বা রূপান্তর নিয়ে কোন কথা শোনা যায় নি। বিএনপি বা আঠারোদলীয় জোট আদৌ কোন সংস্কার করবে কিনা, তারও কোন সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি জনগণ পায় নি। তা ছাড়া সার্বভৌমত্ব, জাতীয় প্রতিরা, আর্থ-সামাজিক ইসু্যু, প্রাণ ও পরিবেশ, খাদ্য ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আঠারোদলীয় জোটের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোন কিছুই জানা যায় নি। এখনও এই সকল েেত্র বিএনপির কোন অবস্থান কারো জানা নাই। শুধু নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য জনগণ আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাবে সে আশা করা ঠিক না। পুলিশের গুলি খেয়ে নিহত বা আহত হবে সেটাও আশা করা ঠিক না। নির্বাচনী রাজনীতির জন্য সেটা চললেও আন্দোলন-সংগ্রামকে বিজয়ের দিকে নিতে হলে বাস্তব ও কার্যকর করা সম্ভব কিছু কংক্রিট প্রতিশ্রুতি জনগণকে আঠারো দলীয় জোটের দিতেই হবে। স্রেফ হাওয়ার ওপর আন্দোলন দাঁড়াতে পারে না।
আঠারোদলীয় জোট যদি বিপর্যয় এড়াতে চায় তাহলে এদিকে মনোনিবেশ করা উচিত। সরকার পীয়রা এখন এ প্রচার করতে সম যে খালেদা জিয়ার কঠোর অবস্থান ব্যর্থ হয়েছে, তাঁর উচিত শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে বসা। যদিও এ কথা মোটেও ঠিক নয়। আঠারো দলের মধ্যে নির্বাচনপন্থীরা আরো চাপ তৈরি করবে, শেখ হাসিনাকে রেখে নির্বাচন করবার জন্য তারা অনেকেই তৈরী। খালেদা জিয়া সংলাপ ও আন্দোলনের যে কৌশল গ্রহণ করেছেন সেটা সঠিক অবস্থান। কিন্তু জনগণকে বিপুল ভাবে সম্পৃক্ত করবার কোন নীতি তিনি গ্রহণ করেন নি। এটা তার জন্য মারাত্মক বিপর্যয় তৈরি করতে পারে।
জেলায় জেলায় সংগ্রাম কমিটিগুলো যেভাবে গড়ে উঠেছে জনগণের প্রত্যাশার দিকে নজর রেখে তাদের সঠিক গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি দিতে পারলে ও জেলায় জেলায় প্রচার করলে আন্দোলন অবশ্যই বেগবান হবে এ ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নাই। এই রাষ্ট ব্যবস্থা আমাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করেছে। খোদ রাষ্ট্রই ‘সন্ত্রাস’ করে। আমাদের কণ্ঠরোধ করে। পত্রিকা ও টেলিভিশান স্টেশান বন্ধ করে দেয়। জনগণ এই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে মুক্তি চায়।
খালেদা জিয়া এই ব্যবস্থাকে বহাল রাখবেন নাকি বদলাবেন সে ব্যাপারে জনগণ এখনও অন্ধকারে রয়েছে। তাঁর উচিত সেটা অবিলম্বে স্পষ্ট করা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন