প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার টেলিসংলাপকে বিষয়বস্তু বানিয়ে মন্দ খেলেননি ক্ষমতাসীনরা। রাজনৈতিক অর্থের সে খেলা এখনো চলছে। কুটিল কৌশলে সাফল্যের সঙ্গেই তারা ২৭ থেকে ২৯ অক্টোবর সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পালিত ৬০ ঘণ্টার হরতালের বিরাট সাফল্যকে আড়াল করতে পেরেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রাধান্যে এসেছে নৈতিকতা, সংবিধান ও আইনের প্রশ্ন। হরতাল শুরু হওয়ার আগের সন্ধ্যায় দুই নেত্রীর মধ্যে টেলিফোনে যে আলোচনা হয়েছে (যাকে আলোচনা বা আলাপচারিতা না বলে বিতর্ক বা বাকযুদ্ধ বলাই ভালো) তা সবিস্তারে প্রকাশ ও প্রচার করাÑ বলা চলে ফাঁস করা হয়েছে। বেআইনী এবং সংবিধানবিরোধী হিসেবে বর্ণিত এই কাজটি কারা করেছেন তা নিয়ে সঙ্গত কারণেই জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়েছিল। আপত্তিও যথেষ্টই উঠেছিল। কারণ, দু’জনের কেউই হাসানুল হক ইনু এবং মেনন ও মতিয়া চৌধুরীদের মতো আওয়ামী লীগে ভেসে আসা এবং নৌকায় চড়ে বসা নেতা বা লোক নন, সাধারণ মানুষ তো ননই। এজন্যই টেলিসংলাপ ফাঁস করার বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন সচেতন সকল মহল। কষ্ট অবশ্য বেশি করতে হয়নি। ক্ষমতাসীনদের বিভিন্ন বক্তব্যের মধ্য দিয়েই জিজ্ঞাসার উত্তর বেরিয়ে এসেছে। এ ব্যাপারেও যথারীতি প্রাধান্যে এসে গেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। গত ৩০ অক্টোবর গণভবনে অনুষ্ঠিত এক দলীয় সমাবেশে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, বিএনপির তরফ থেকেই ‘অনেক কিছু’ নাকি ‘পেপারে ছাপিয়ে’ দেয়া হয়েছিল। সে কারণে প্রধানমন্ত্রী মনে করেছেন, ‘পুরোটাই মানুষের শোনা ভালোÑ আমি কি শুনলাম, উনি কি বললেন।’ শেখ হাসিনা বলেছেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তাকে নাকি অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছে। তা সত্ত্বেও ‘দেশের মানুষের কথা ভেবে’ তিনি সব অপমান সহ্য করেছেন। আল্লাহর কাছে শুধু ‘প্রার্থনা’ করেছেন, তিনি যেন তাকে ধৈর্য দেন। তার যে ঝগড়া করার বা ওই ধরনের কোনো ইচ্ছা ছিল না এবং সেজন্যই তিনি যে খালেদা জিয়ার ‘অবান্তর’ কথা সহ্য করেছেন সে কথাও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা আরো বলেছেন, তিনি নাকি সমঝোতা ও আলোচনার মাধ্যমে সংকট কাটিয়ে উঠতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ‘উনার (খালেদা জিয়ার) অনেক কথা। একবার এ কন্ডিশন, আবার ওই কন্ডিশন। একেকবার একেক কথা বলেছেন তিনি।’ দলীয় অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় ৬০ ঘণ্টার হরতালে ২০ জনের বেশি মানুষের জীবন যাওয়ার এবং অনেক মায়ের কোল খালি হওয়ার দুঃখে কাতর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে জানতে চেয়েছেন, এভাবে শুধু মানুষ খুন করবেনÑ এটাই কি তার ‘একমাত্র খেলা?’ দেশের মানুষকে নিয়ে এভাবে খেলে কি অর্জন করলেন তিনি? প্রশ্নটি তিনি দলের নেতা-কর্মীদের কাছে ‘রেখে’ দিয়েছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, শেখ হাসিনার ‘রেখে’ যাওয়া সব প্রশ্নেরই যথোচিত উত্তর রয়েছে বিরোধী দলের কাছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও সে উত্তরগুলো জানেন। তা সত্ত্বেও দলীয় নেতা-কর্মীদের সমাবেশে ‘রেখে’ গেছেন বলেই রাজনৈতিক অঙ্গনে তার সরকারের ফ্যাসিস্ট নিষ্ঠুরতার দিকটি নিয়েই বেশি কথা উঠেছে। কারণ, হরতালের মতো গণতন্ত্রসম্মত কর্মসূচি সাংবিধানিক অধিকার হলেও শেখ হাসিনার সরকার প্রথম থেকেই কঠোরভাবে দমন করার পদক্ষেপ নিয়েছে। হরতাল তো বটেই, বিরোধী দলগুলো এমনকি মিছিল-সমাবেশ ও মানববন্ধন পর্যন্ত করতে পারছে না। প্রতিটি কর্মসূচিতে পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের গু-া-সন্ত্রাসীরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ৬০ ঘণ্টার হরতাল চলাকালেও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ‘হাত-পা ভেঙে ফেলার’ হুকুম জারি করেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। শুধু অন্য নেতাদের কথাই বা বলা কেন? তারা যে ‘খুঁটির জোরে’ হুংকার ঝেড়েছেন সে প্রধানমন্ত্রী নিজেও কি কম বলেছেন? খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পরপর তিনি তার দলের নেতা-কর্মীদের রাজপথে পুলিশের ‘সঙ্গে সঙ্গে থাকার’ এবং পুলিশকে ‘সহযোগিতা করার’ হুকুম জারি করেছেন। এই ‘সহযোগিতা’ কিভাবে করা হবে এবং বাস্তবে কিভাবে অনেক আগে থেকেই করা হচ্ছে সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। একই কথা বলা যায় প্রধানমন্ত্রীর জিজ্ঞাসার জবাবেও। কারণ, ‘দেশের মানুষও’ দেখেছে, ৬০ ঘণ্টার হরতাল চলাকালে ‘অনেক মায়ের কোল’ কারা খালি করেছে। ২০ জনের বেশি মানুষের জীবন যাওয়ার পেছনেও যে র্যাব, পুলিশ এবং আওয়ামী গু-া-সন্ত্রাসীরাই ‘অবদান’ রেখেছে তাও কি মানুষকে বুঝিয়ে বলতে হবে? সুতরাং প্রধানমন্ত্রী যতোই ‘ধৈর্য’ ধরার কথা শোনাতে চান না কেন, মানুষ হত্যা আসলে কার ‘একমাত্র খেলা’ সে কথাটা ‘দেশের মানুষ’ই ভালোভাবে জেনেছে। ওদিকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনরাও ভালোভাবেই জানান দিয়ে চলেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফসহ কয়েকজন তো খালেদা জিয়াকে ‘বেঈমানি’, ‘প্রতারণা’ ও ‘মোনাফেকি’ করার জন্যও অভিযুক্ত করে বসেছেন। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া নাকি জাতির সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছেন! কথা আরো আছে। টেলিসংলাপের কোনো পর্যায়েই খালেদা জিয়া কিন্তু ‘একেকবার একেক কথা’ বলেননি, ‘কন্ডিশন’ও চৌদ্দ রকমের দেননি তিনি। বিরোধী দলের নেত্রী মূলত দুটি মাত্র কথাই বলেছেনÑ এক. ১৮ দলীয় জোটের নেতারা যেহেতু পুলিশের ধাওয়ার মুখে রয়েছেন সেহেতু একবারে শেষ মুহূর্তে, হরতালের আগের সন্ধ্যায় তার একার পক্ষে হরতাল প্রত্যাহার করে প্রধানমন্ত্রীর দাওয়াত রক্ষা করা সম্ভব নয়। এবং দুই. প্রথমে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীকে নীতিগতভাবে সম্মতি জানাতে হবে। এই সম্মতি জানালেই খালেদা জিয়া ৬০ ঘণ্টার হরতালের তথা ২৯ অক্টোবরের পর যে কোনোদিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি আছেন। এখানে কখন খালেদা জিয়া ‘একেকবার একেক কথা’ বলেছেন? ‘অবান্তর’ কথাই বা বলেছেন কখন? ‘কন্ডিশন’ও তো মাত্র একটাই দিয়েছেন তিনিÑ সেটা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নে নীতিগতভাবে সম্মতি জানানোর জন্য। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী এই ‘কন্ডিশনের’ ব্যাপারে ঠোঁটে আঙুল চেপে রেখেছেন, একটি কথাও বলেননি।
এভাবে টেলিসংলাপের যে কোনো পর্যালোচনায় দেখা যাবে, প্রধানমন্ত্রীর জন্য কথিত ‘ধৈর্য’ ধারণের কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। মূল কথাকে পাশ কাটিয়ে তিনি বারবার শুধু দাওয়াতের এবং গণভবনে যাওয়ার কথা শোনানোয় ‘ধৈর্য’ ধরার পরীক্ষা আসলে বেগম খালেদা জিয়াকেই দিতে হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে টেলিসংলাপ রেকর্ড, প্রকাশ ও প্রচার করার বিষয়টিও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে। কারণ, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু থেকে ‘কালো বিড়াল’ নামে পরিচিত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তো বটেই, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, বন ও পরিবেশ মন্ত্রী হাছান মাহমুদ এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ পর্যন্ত অনেকেই বলেছেন, দুই নেত্রীর এই টেলিসংলাপ নাকি ‘রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি’ এবং সে কারণে তা প্রকাশ ও প্রচার করা এবং জনগণকে জানতে দেয়া উচিত। সবশেষে প্রধানমন্ত্রী নিজেও ‘পুরোটাই মানুষের শোনা ভালো’ বলে একই ধরনের মন্তব্য করায় ‘থলের বিড়াল’ও বেরিয়ে পড়েছে। ‘দেশের মানুষ’ শুধু শোনেইনি, একথাও জানতে পেরেছে, সংবিধান লংঘন ও তথ্য-প্রযুক্তি আইন অমান্য করে কারা রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্র্ণ দু’জন নেত্রীর ব্যক্তিগত পর্যায়ের আলাপচারিতাকে ফাঁস করে দিয়েছেন। এভাবে ‘ফিনিশিং টাচ’ দেয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সম্ভবত ধন্যবাদ দেয়া যেতেই পারে!
টেলিসংলাপ নিয়ে এভাবে নোংরা রাজনৈতিক খেলার মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে না পারলেও ক্ষমতাসীনরা অবশ্য একটি বিষয়ে অনেকাংশে সফল হয়েছেন। পাঠকরাও লক্ষ্য করলে দেখবেন, ১৮ দলীয় জোটের ৬০ ঘণ্টার হরতালের চাইতেও অনেক বেশি আলোচিত হয়েছে দুই নেত্রীর ওই টেলিসংলাপ। বস্তুত ২৮ অক্টোবর সকাল থেকে সেই যে শুরু হয়েছে এখনো, ১ নভেম্বর পর্যন্তও টেলিসংলাপকেন্দ্রিক আলোচনা শেষ হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। প্রতিদিন বরং এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন তথ্য ও ব্যাখ্যা। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতির স্বাভাবিক নিয়মানুসারে ২৯ অক্টোবর সন্ধ্যা ছয়টায় যে ৬০ ঘণ্টার হরতাল শেষ হয়েছে সেটাই আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সে স্থানটি দখল করে নিয়েছে দুই নেত্রীর ওই টেলিসংলাপ। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তো বটেই, পথে-ঘাটে এবং পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকানে পর্যন্ত টেলিসংলাপ নিয়ে ঝড় উঠেছে। মানুষ একই সঙ্গে দুই নেত্রীকে পয়েন্টও দিয়ে চলেছে। বিচার চলছে কোন নেত্রী হেরেছেন আর কোন জন জিতেছেন তা নিয়ে। মানতেই হবে, এই একটি ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের কৌশলের বিজয় হয়েছে। জনগণকে তারা সংকটের প্রধান কারণ এবং বিরোধী দলের অসাধারণ সাফল্যের দিক থেকে সাময়িককালের জন্য হলেও সরিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন।
ক্ষমতাসীনরা তাই বলে বিরাট কোনো ‘প্লাস পয়েন্ট’ অর্জন করতে পারেননি। তারা বরং বেশি চালাকি করতে গিয়ে পদে পদে ধরা পড়ছেন। আর চালাকি যত উন্মোচিত হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের বিপদও ততই বাড়ছে। ভারী হচ্ছে নিন্দা-সমালোচনার পাল্লাও। এখানেই তাদের জন্য রয়েছে শিক্ষা নেয়ার এবং সতর্ক হওয়ার উপাদানÑ যাকে এই সময়ের ‘শেষ সুযোগ’ বলা যায়। কারণ, সুচিন্তিত প্রচারণা এবং মুখে মুখে আলোচিত হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ কিছুটা বিভ্রান্ত হতেই পারে কিন্তু এর ফলে সংকট তো কেটে যায়নি, যাচ্ছেও না। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের প্রশ্নে বিরোধী দলও ছাড় দিচ্ছে না সামান্য পরিমাণে। বিরোধী দলকে প্রধানমন্ত্রী বর্ণিত ‘সর্বদলীয়’ সরকারের ট্যাবলেটও গেলানো যাচ্ছে না। বিরোধী দল বরং হরতাল ও অবরোধসহ কঠোর নানা কর্মসূচি দেয়ার পথে পা বাড়াতে শুরু করেছে। সে কারণে শুধু নয়, ৬০ ঘণ্টার হরতালের মাধ্যমেও পরিষ্কার হয়েছে, সরকারের জনসমর্থন এরই মধ্যে কতটা নিচে নেমে গেছে। এর ওপর যদি একের পর এক হরতাল-অবরোধ ধরনের কর্মসূচি আসতে থাকে তাহলে সেগুলোর ধাক্কা সহ্য করা ও সামলে ওঠা শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। তাছাড়া প্রতিটি উপলক্ষে তিনি তো আর টেলিসংলাপের মতো অজুহাতও পাবেন না। ওদিকে এগিয়ে আসছে নির্বাচনের তারিখ। তাকে তাই সমঝোতা এবং সংঘাতের মধ্যে যে কোনো একটি পন্থা বেছে নিতে হবে। বর্তমান পর্যায়ে শুধু একটি কথাই বলে রাখা দরকার। কথাটা হলো, সব বিষয়ে সব সময় খেলতে নেই।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন