মাসুম খলিলী
‘আমাদের সংবিধানে একটি অদৃশ্য অনুচ্ছেদ আছে, যেখানে বলা হইয়াছে সংসদ সদস্যগণ বা মন্ত্রী যাহা ইচ্ছে তাহাই করিতে
পারিবেন (নিজেদের স্বার্থে) এবং ইহার বিরুদ্ধে কেউই কোনভাবেই সমালোচনা করিতে
পারিবেন না, করিলে ইহা অসাংবিধানিক অথবা
আইনের লঙ্ঘন বলিয়া গণ্য হইবে, এমনকি
যুদ্ধাপরাধী বা নব্য রাজাকার বলিয়া গণ্য হইবেন।’
এ মন্তব্যটি দেশের একটি শীর্ষ দৈনিকের একজন পাঠকের। এ মন্তব্যের পর
এই পাঠক বলেছেন, তার উল্লেখ করা সেই অদৃশ্য
অনুচ্ছেদের এখন যথার্থ প্রয়োগ আমরা দেখছি। পাঠক যে খবর পড়ে পত্রিকাটির ব্লগে এ
মন্তব্যটি করেছেন সেটি ছিল পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার পরও মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন
ও সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের ব্যাপারে। এ খবর নিয়ে ইতোমধ্যে দেশের গণমাধ্যমে তোলপাড়
শুরু হয়েছে।
পদত্যাগ নিয়ে নানা কথা
পদত্যাগ নিয়ে সরকারের মন্ত্রীরা একেকজন একেক কথা বলছেন। আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা পদত্যাগ করিনি। শুধু পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়েছি। রাষ্ট্রপতির কাছেও দিইনি। তাই এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না।’ অন্য দিকে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘তারা সংবিধান মেনেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দিয়েছেন। তবে সেটা রাষ্ট্রপতির কাছে যতণ না উপস্থাপন হবে এবং তিনি যতণ পর্যন্ত না সই করবেন, ততণ পর্যন্ত মন্ত্রীরা দাফতরিক ও নির্বাহী দায়িত্ব পালন করবেন। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা যদি মনে করেন তা হলে তারা আদালতের মাধ্যমে এর নিষ্পত্তি করতে পারেন।’ এই পদত্যাগ প্রশ্নেই আবার খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দিয়েছি। তিনি যদি তা গ্রহণ করে রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করেন, তা হলে সেটি কার্যকর হবে।’ সব শেষে এ নিয়ে মুখ খুলেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দিলেই তা পদত্যাগ বলে বিবেচিত হয় না। এখানে রাষ্ট্রপতির একটা ভূমিকা আছে। রাষ্ট্রপতি পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করা পর্যন্ত মন্ত্রীরা স্বপদে বহাল থাকবেন।
মন্ত্রিসভার যে বৈঠকে মন্ত্রীরা তাদের নিজ নিজ পদত্যাগপত্র দিয়েছেন সে বৈঠকে কী হয়েছে সে সম্পর্কে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেছিলেন সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। তিনি সেই দিন ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, ‘মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়া হচ্ছে না। সর্বদলীয় সরকার গঠনের ল্েয মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করা হবে। আর এই পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ার শুরুতেই মন্ত্রি-প্রতিমন্ত্রীরা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। সর্বদলীয় সরকারে যারা থাকবেন তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন না প্রধানমন্ত্রী। কাজেই তাদের আর নতুন করে শপথ নেয়ার প্রয়োজন হবে না। আর যারা সর্বদলীয় সরকারে থাকবেন না, তাদের পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে। পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করবে।’ মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, ‘বর্তমান সরকার কাঠামোয় এটাই মন্ত্রিসভার শেষ বৈঠক। প্রস্তাবিত সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা আকারে ছোট হবে। যাদের সর্বদলীয় মন্ত্রিসভায় নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, তাদের শপথ নিতে হবে। এরপর নতুন করে মন্ত্রিদের মধ্যে দফতর বণ্টন করা হবে।’ ক্যাবিনেট সচিবের বক্তব্যের এ উদ্ধৃতি ১২ জুলাইয়ের দৈনিক ইত্তেফাক থেকে নেয়া। অন্য দৈনিকগুলোতেও তার উদ্ধৃতি দিয়ে যে বক্তব্য প্রকাশ হয়েছে তা-ও একই রকম; কিন্তু এরপর আগামী রোববার সেই মন্ত্রিসভারই আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
সংবিধানে কী আছে?
মন্ত্রীদের পদত্যাগের বিষয়টি কিভাবে ঘটবে এবং তা কার্যকরই বা কিভাবে হবে এ বিষয় সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের এক দফার ‘ক’ উপদফায় বলা আছে, ‘কোনো মন্ত্রীর পদ শূন্য হবে, যদি তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন।’ এ ব্যাপারে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা হচ্ছে ‘সংসদ সদস্যসহ সকল সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তিগণের পদত্যাগ করার একতরফা অধিকার রয়েছে। এই পদত্যাগের কার্যকারিতা কোনো কর্তৃপরে গ্রহণ করার উপর নির্ভরশীল নয়।’ (মাহমুদুল ইসলাম, কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা-৪৭৭, তৃতীয় সংস্করণ, ২০১২, মল্লিক ব্রাদার্স)। এ বক্তব্যের অনুরূপ কথাই বলেছেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহমুদুর রহমান, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল হাসান আরিফ, ড. শাহদিন মালিক, ড. আসিফ নজরুল, ইকতেদার আহমদ, ড. তুহিন মালিক প্রমুখ। তাদের বক্তব্যের সার কথা হলো, কোনো মন্ত্রী যখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন, তখনই তার পদ শূন্য হবে। সেটি গ্রহণ করা না করার কোনো বিষয় এতে নেই। পদত্যাগী মন্ত্রীদের পদ এখন শূন্য। এর বিপরীত কোনো বিশেষজ্ঞ মতামত এ পর্যন্ত কেউ দেয়নি।
সরকারের মন্ত্রীরা যা বলছেন সেটি হলো সংবিধানের বিধান মেনে এটি করা হয়নি, এতে তারিখ উল্লেখ করা হয়নি, এটি রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে দেয়া হয়নি অথবা এটি আদৌ পদত্যাগপত্র ছিল না, এটি ছিল নিছক একটি আনুষ্ঠানিকতা ইত্যাদি। তাদের মধ্যে এক মন্ত্রী বলছেন সংবিধান অনুযায়ী এটি হয়নি, অন্য মন্ত্রী বলছেন সংবিধান মেনেই এটি করা হয়েছে। ক্যাবিনেট সেক্রেটারির বক্তব্য অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী যার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন তারটাই রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। প্রধানমন্ত্রী পরে যেটি বলেছেন ক্যাবিনেট সেক্রেটারির বক্তব্যে তার প্রতিফলন রয়েছে; কিন্তু প্রশ্ন হলো সেই এখতিয়ার কি সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছে?
বাংলাদেশ সংবিধান শুধু একটি েেত্র প্রধানমন্ত্রীকে কোনো মন্ত্রীর নিয়োগের অবসান ঘটাতে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেয়ার অধিকার দিয়েছে। সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের দুই দফায় বলা আছে, প্রধানমন্ত্রী যেকোনো সময় কোনো মন্ত্রীকে পদত্যাগ করার জন্য অনুরোধ করতে পারবেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ওই অনুরোধ পালনে ব্যর্থ হলে প্রধানমন্ত্রী তখন রাষ্ট্রপতিকে ওই মন্ত্রীর নিয়োগ বাতিলের পরামর্শ দিতে পারবেন। এখন দেখা যাচ্ছে, সব মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে যথাযথভাবে সাড়া দিয়েছেন। তারা কেউ সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত অনুরোধ পালনে ব্যর্থ হননি। ফলে এই পদত্যাগপত্র ৫৮ অনুচ্ছেদের এক দফার ‘ক’ উপদফার শর্ত পূরণ করেছে বলে গণ্য না হয়ে সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের দুই দফার শর্ত পূরণ করেছে বলে গণ্য হবে।
একসময় বলা হতো পরিসংখ্যানের যে যেভাবে ব্যাখ্যা করেন সেটি সে ধরনের হয়ে যায়। সংবিধানের ব্যাখ্যাও এখন হয়ে গেছে অনেকটা সে রকম। সংবিধানের ব্যাখ্যা দেয়ার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে সুপ্রিম কোর্টকে। সুপ্রিম কোর্টের কাছে কোনো মামলা গেলে আদালত এ ব্যাখ্যা দিতে পারেন। সংবিধানকে উচ্চকিত করার শপথ নিয়েই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা শপথ নেন। এ শপথের অংশ হিসেবে সংবিধানের বিপরীত বা সাংঘর্ষিক কোনো আইন প্রণয়ন করা হলে সেটাকে তারা বাতিল ঘোষণা করেন। এই এখতিয়ার সংবিধানে পরোক্ষভাবে দেয়া হয়েছে সুপ্রিম কোর্টকে। এর সূত্র ধরে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের অংশবিশেষ বাতিল করার এখতিয়ারও নিজের রয়েছে বলে উল্লেখ করে শাসনতন্ত্রের অনেক কিছুই ইতোমধ্যে বাতিল ঘোষণা করেছেন। যদিও সংবিধানে সংযোজন বিয়োজন বা পুনঃস্থাপনের এখতিয়ার ১৪২ নম্বর অনুচ্ছেদে দেয়া হয়েছে আইন সভাকে। এ ক্ষমতা অথবা এর অংশবিশেষ সুপ্রিম কোর্ট নিজস্ব ব্যাখ্যা দানের আওতায় এনে প্রয়োগ করতে পারে কি না তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদের ছোট একটি অংশ রহিত করার আদেশ দিয়েছিলেন; কিন্তু সে দেশের আইনসভা ও সরকার সে আদেশকে গ্রহণ করে সেটিকে সংবিধানের অংশ করেনি। এখনো সেটি অকার্যকর রয়ে গেছে। বাংলাদেশে অষ্টম সংশোধনী মামলার সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে প্রথম সংবিধানের কোনো অংশবিশেষ বাতিল ঘোষণা করা হয়। এরপর সংবিধানের ৫ম, ৭ম ও ১৩শ সংশোধনীসহ মৌলিক অনেক অংশ বাতিল করে পুরনো বিধান পুনরুজ্জীবনের আদেশ দেয়া হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসংবলিত ক্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়কে কেন্দ্র করে এখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠেছে। এখতিয়ারের ভেতরে বাইরে সংবিধান নিয়ে এই চর্চা দেশের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলছে।
সোহেল তাজ নিয়ে শুরু
সংবিধানের গায়ের জোরে ব্যাখ্যা দেয়া ও তা কার্যকর করার প্রথম অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে উঠেছিল স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজের পদত্যাগের সময়। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের ছেলে সোহেল তাজ প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার পদত্যাগপত্র পেশ করেছিলেন। সোহেল তাজ রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেয়ার উদ্দেশ্যেই পদত্যাগপত্র দিয়েছিলেন। সেটি তিনি একাধিকবার সংবাদপত্রে দেয়া বক্তব্যে বলেছেন; কিন্তু তার পদত্যাগপত্র দীর্ঘ দিন ঝুলিয়ে রাখা হয়। ইস্তফা দেয়ার পরও তাকে মন্ত্রী হিসেবে বহাল দেখানো হয়।
এবার মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র পেশ করার একটি খসড়াও মন্ত্রীদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয় এবং তাতে তারিখ উল্লেখ না করে শর্তসাপেে পদত্যাগপত্র প্রদানের বিষয়টি থাকে। এ খসড়া অনুযায়ী মন্ত্রীরা সর্বদলীয় সরকারের জন্য পদত্যাগের ‘অভিপ্রায়’ ব্যক্ত করলেও এর শিরোনামে পদত্যাগপত্র স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। সংবিধান বা প্রচলিত আইনে মন্ত্রীদের শর্তসাপেে পদত্যাগের সুযোগ নেই। এর আগে আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে একবার গণপদত্যাগ করেছিল। তখন দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে বলা হয়েছিল তাদের পদত্যাগপত্র স্পিকারের কাছে পৌঁছানোর সাথে সাথেই সেটি কার্যকর হয়ে গেছে। এখন বলা হচ্ছে তার উল্টোটা।
পৃথিবীর একনায়কতান্ত্রিক দেশগুলোতে নির্বাহী বিভাগ তথা শাসকদের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয় আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার পৃথকীকরণের মাধ্যমে এ তিন বিভাগের ক্ষমতার মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য আনার ব্যবস্থা করা হয়; কিন্তু নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের মধ্যে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা দেখা দিলে তখন নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে এবং তাতে সফলকামও হয়। এ ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব যদি আইন বিভাগের ওপর নিরঙ্কুশ হয়, তা হলে ক্ষমতাসীনদের রাষ্ট্রের সব বিভাগের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন সহজ হয়ে পড়ে। এ ধরনের একটি সুবিধাজনক অবস্থা রয়েছে বর্তমান শাসকদের সামনে।
সরকারের সাম্প্রতিক নানা কর্মকাণ্ডে তার প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। তা না হলে সরকারের আইনমন্ত্রী যখন পদত্যাগপত্র সংবিধান অনুসারে হয়নি বলে উল্লেখ করেন তখন তথ্যমন্ত্রী কী করে বলেন সংবিধান মেনেই তারা পদত্যাগ করেছেন। দুই মন্ত্রীর মধ্যে যার কথাই ঠিক হোক না কেন মন্ত্রীরা তাদের পদে বহাল থাকতে পারেন না।
মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি!
সংবিধানের মতো রাষ্ট্রের একটি সর্বোচ্চ দলিল নিয়ে এ ধরনের টানা-হেঁচড়া কাম্য নয়। এটি শুধু কাম্য নয় তাই নয় এ ধরনের কাজের জন্য বর্তমান সরকার সংবিধান সংশোধন করে শাস্তির ব্যবস্থাও করেছে। এ ব্যাপারে সংবিধানে ৭ক অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়েছে সর্বশেষ সংশোধনীর মাধ্যমে। এই ৭ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘(১) কোন ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায় (ক) এই সংবিধান বা ইহার কোন অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে; কিংবা (খ) এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।’
(২) ‘কোন ব্যক্তি (১) দফায় বর্ণিত (ক) কোন কার্য করিতে সহযোগিতা বা উস্কানি প্রদান করিলে; কিংবা (খ) কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে তাহার এইরূপ কার্যও একই অপরাধ হইবে। (৩) এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে।’ এই সর্বোচ্চ দণ্ড বলতে মৃত্যুদণ্ডকে বোঝানো হয়েছে।
সংবিধানের এই সংশোধিত অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে পদত্যাগ করার পরও মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান উল্লিখিত অনুচ্ছেদের অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
স্বেচ্ছাচারিতার শেষ কোথায়?
পদত্যাগ ইস্যুতে ৭ক অনুচ্ছেদের অপরাধ হলো কি হলো না তার চেয়ে বড় বিষয় হলো সরকার সংবিধানের বিধানগুলোকে নিজস্ব স্বেচ্ছাচারী ব্যাখ্যা দানের যে প্রবণতা দেখাচ্ছে, তা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।
সংবিধান অনুসারে সংসদের প্রথম অধিবেশন যে দিন বৈঠকে বসবে তার পর পাঁচ বছরপূর্তি হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর মেয়াদ পূর্তির আগে ভেঙে গেলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই বিধান অনুসারে ২৫ অক্টোবরের পর থেকে নির্বাচনকালীন সরকারের শুরু। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্তির পর এ সময়ে রাষ্ট্রপরিচালনার কথা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। আগের সরকার এ সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করলেও তা করবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে, নির্বাচিত সরকার হিসেবে নয়। তারা মৌলিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না। অথচ সংবিধানে উল্লিখিত ৯০ দিনের নির্বাচনকালীন সময় শুরু হলেও সংবিধানের এই বিধান লঙ্ঘন করে আগের সরকার দিয়ে তিন সপ্তাহ ধরে রাষ্ট্র চালানো হচ্ছে। সরকার এ ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছামতো একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে তফসিল ঘোষণার পরবর্তী সময়কে নির্বাচনকালীন সময় হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছে। এ ব্যাখ্যা ঠিক হলে এর আগে নির্বাচনের জন্য তিন মাস আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হতো না।
নির্বাচনকালীন সময়ে প্রশাসন থাকে নির্বাচন কমিশনের অধীনে। এ সময়ে প্রশাসনের সব নিয়োগ বদলি নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকে। অথচ তফসিল ঘোষণা না করার অজুহাতে এ সময়ে দিব্যি সব কিছু করে যাচ্ছে রাজনৈতিক সরকার। সর্বশেষ সংশোধিত সংবিধানে বলা হয়েছে, সংসদের দুই অধিবেশনের মধ্যবর্তী সময় ৬০ দিনের বেশি হবে না। এর একমাত্র ব্যতিক্রম হবে নির্বাচনকালীন সংসদের মেয়াদ পূর্তির পূর্ববর্তী ৯০ দিনে। এই ব্যতিক্রমের বিষয়টি সংবিধানে উল্লেখ করার কারণই হলো এ সময়ে সংসদের অধিবেশন বসবে না। অথচ কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে সংসদের অধিবেশন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না কার্য উপদেষ্টা কমিটির ক্ষমতা কোনোভাবেই সংবিধানের সুনির্দিষ্ট বিধানকে লঙ্ঘন করতে পারে না।
নির্বাচনকালীন সময়ে সরকার নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে এমন কোনো উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করতে পারে না। অথচ এখন সরকারপ্রধান প্রতিদিন ডজন ডজন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করছেন। এ ধরনের অব্যাহত সংবিধান লঙ্ঘনের বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দিয়েই হয়তো পাঠক এ মন্তব্যটি করেছিলেন, সংবিধানে একটি অদৃশ্য অনুচ্ছেদ রয়েছে যে অনুযায়ী কাজ করছে বর্তমান সরকার; কিন্তু এ ধরনের কাজের নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। ইতোমধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ নানা খবর পাওয়া যাচ্ছে। জানা গেছে, জাতিসঙ্ঘের শান্তি মিশনে পৌনে এক হাজার সদস্যের দুই ব্রিগেড সৈন্য পাঠানোর যে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন ছিল, সেটি অঘোষিতভাবে স্থগিত হয়ে গেছে। অতি সম্প্রতি আসা মিশনের সদর দফতরের এক চিঠিতে বাইরে শান্তি সেনা পাঠানোর আগে দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তির ওপর নজর রাখতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সাত বছর আগে এ ধরনের একটি চিঠি নিয়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। একের পর এক ঘটনা ঘটতে দেখা যায় এর পরে।
পদত্যাগ নিয়ে নানা কথা
পদত্যাগ নিয়ে সরকারের মন্ত্রীরা একেকজন একেক কথা বলছেন। আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা পদত্যাগ করিনি। শুধু পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়েছি। রাষ্ট্রপতির কাছেও দিইনি। তাই এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না।’ অন্য দিকে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘তারা সংবিধান মেনেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দিয়েছেন। তবে সেটা রাষ্ট্রপতির কাছে যতণ না উপস্থাপন হবে এবং তিনি যতণ পর্যন্ত না সই করবেন, ততণ পর্যন্ত মন্ত্রীরা দাফতরিক ও নির্বাহী দায়িত্ব পালন করবেন। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা যদি মনে করেন তা হলে তারা আদালতের মাধ্যমে এর নিষ্পত্তি করতে পারেন।’ এই পদত্যাগ প্রশ্নেই আবার খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দিয়েছি। তিনি যদি তা গ্রহণ করে রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করেন, তা হলে সেটি কার্যকর হবে।’ সব শেষে এ নিয়ে মুখ খুলেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দিলেই তা পদত্যাগ বলে বিবেচিত হয় না। এখানে রাষ্ট্রপতির একটা ভূমিকা আছে। রাষ্ট্রপতি পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করা পর্যন্ত মন্ত্রীরা স্বপদে বহাল থাকবেন।
মন্ত্রিসভার যে বৈঠকে মন্ত্রীরা তাদের নিজ নিজ পদত্যাগপত্র দিয়েছেন সে বৈঠকে কী হয়েছে সে সম্পর্কে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেছিলেন সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। তিনি সেই দিন ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, ‘মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়া হচ্ছে না। সর্বদলীয় সরকার গঠনের ল্েয মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করা হবে। আর এই পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ার শুরুতেই মন্ত্রি-প্রতিমন্ত্রীরা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। সর্বদলীয় সরকারে যারা থাকবেন তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন না প্রধানমন্ত্রী। কাজেই তাদের আর নতুন করে শপথ নেয়ার প্রয়োজন হবে না। আর যারা সর্বদলীয় সরকারে থাকবেন না, তাদের পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে। পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করবে।’ মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, ‘বর্তমান সরকার কাঠামোয় এটাই মন্ত্রিসভার শেষ বৈঠক। প্রস্তাবিত সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা আকারে ছোট হবে। যাদের সর্বদলীয় মন্ত্রিসভায় নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, তাদের শপথ নিতে হবে। এরপর নতুন করে মন্ত্রিদের মধ্যে দফতর বণ্টন করা হবে।’ ক্যাবিনেট সচিবের বক্তব্যের এ উদ্ধৃতি ১২ জুলাইয়ের দৈনিক ইত্তেফাক থেকে নেয়া। অন্য দৈনিকগুলোতেও তার উদ্ধৃতি দিয়ে যে বক্তব্য প্রকাশ হয়েছে তা-ও একই রকম; কিন্তু এরপর আগামী রোববার সেই মন্ত্রিসভারই আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
সংবিধানে কী আছে?
মন্ত্রীদের পদত্যাগের বিষয়টি কিভাবে ঘটবে এবং তা কার্যকরই বা কিভাবে হবে এ বিষয় সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের এক দফার ‘ক’ উপদফায় বলা আছে, ‘কোনো মন্ত্রীর পদ শূন্য হবে, যদি তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন।’ এ ব্যাপারে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা হচ্ছে ‘সংসদ সদস্যসহ সকল সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তিগণের পদত্যাগ করার একতরফা অধিকার রয়েছে। এই পদত্যাগের কার্যকারিতা কোনো কর্তৃপরে গ্রহণ করার উপর নির্ভরশীল নয়।’ (মাহমুদুল ইসলাম, কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা-৪৭৭, তৃতীয় সংস্করণ, ২০১২, মল্লিক ব্রাদার্স)। এ বক্তব্যের অনুরূপ কথাই বলেছেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহমুদুর রহমান, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল হাসান আরিফ, ড. শাহদিন মালিক, ড. আসিফ নজরুল, ইকতেদার আহমদ, ড. তুহিন মালিক প্রমুখ। তাদের বক্তব্যের সার কথা হলো, কোনো মন্ত্রী যখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন, তখনই তার পদ শূন্য হবে। সেটি গ্রহণ করা না করার কোনো বিষয় এতে নেই। পদত্যাগী মন্ত্রীদের পদ এখন শূন্য। এর বিপরীত কোনো বিশেষজ্ঞ মতামত এ পর্যন্ত কেউ দেয়নি।
সরকারের মন্ত্রীরা যা বলছেন সেটি হলো সংবিধানের বিধান মেনে এটি করা হয়নি, এতে তারিখ উল্লেখ করা হয়নি, এটি রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে দেয়া হয়নি অথবা এটি আদৌ পদত্যাগপত্র ছিল না, এটি ছিল নিছক একটি আনুষ্ঠানিকতা ইত্যাদি। তাদের মধ্যে এক মন্ত্রী বলছেন সংবিধান অনুযায়ী এটি হয়নি, অন্য মন্ত্রী বলছেন সংবিধান মেনেই এটি করা হয়েছে। ক্যাবিনেট সেক্রেটারির বক্তব্য অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী যার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন তারটাই রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। প্রধানমন্ত্রী পরে যেটি বলেছেন ক্যাবিনেট সেক্রেটারির বক্তব্যে তার প্রতিফলন রয়েছে; কিন্তু প্রশ্ন হলো সেই এখতিয়ার কি সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছে?
বাংলাদেশ সংবিধান শুধু একটি েেত্র প্রধানমন্ত্রীকে কোনো মন্ত্রীর নিয়োগের অবসান ঘটাতে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেয়ার অধিকার দিয়েছে। সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের দুই দফায় বলা আছে, প্রধানমন্ত্রী যেকোনো সময় কোনো মন্ত্রীকে পদত্যাগ করার জন্য অনুরোধ করতে পারবেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ওই অনুরোধ পালনে ব্যর্থ হলে প্রধানমন্ত্রী তখন রাষ্ট্রপতিকে ওই মন্ত্রীর নিয়োগ বাতিলের পরামর্শ দিতে পারবেন। এখন দেখা যাচ্ছে, সব মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে যথাযথভাবে সাড়া দিয়েছেন। তারা কেউ সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত অনুরোধ পালনে ব্যর্থ হননি। ফলে এই পদত্যাগপত্র ৫৮ অনুচ্ছেদের এক দফার ‘ক’ উপদফার শর্ত পূরণ করেছে বলে গণ্য না হয়ে সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের দুই দফার শর্ত পূরণ করেছে বলে গণ্য হবে।
একসময় বলা হতো পরিসংখ্যানের যে যেভাবে ব্যাখ্যা করেন সেটি সে ধরনের হয়ে যায়। সংবিধানের ব্যাখ্যাও এখন হয়ে গেছে অনেকটা সে রকম। সংবিধানের ব্যাখ্যা দেয়ার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে সুপ্রিম কোর্টকে। সুপ্রিম কোর্টের কাছে কোনো মামলা গেলে আদালত এ ব্যাখ্যা দিতে পারেন। সংবিধানকে উচ্চকিত করার শপথ নিয়েই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা শপথ নেন। এ শপথের অংশ হিসেবে সংবিধানের বিপরীত বা সাংঘর্ষিক কোনো আইন প্রণয়ন করা হলে সেটাকে তারা বাতিল ঘোষণা করেন। এই এখতিয়ার সংবিধানে পরোক্ষভাবে দেয়া হয়েছে সুপ্রিম কোর্টকে। এর সূত্র ধরে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের অংশবিশেষ বাতিল করার এখতিয়ারও নিজের রয়েছে বলে উল্লেখ করে শাসনতন্ত্রের অনেক কিছুই ইতোমধ্যে বাতিল ঘোষণা করেছেন। যদিও সংবিধানে সংযোজন বিয়োজন বা পুনঃস্থাপনের এখতিয়ার ১৪২ নম্বর অনুচ্ছেদে দেয়া হয়েছে আইন সভাকে। এ ক্ষমতা অথবা এর অংশবিশেষ সুপ্রিম কোর্ট নিজস্ব ব্যাখ্যা দানের আওতায় এনে প্রয়োগ করতে পারে কি না তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদের ছোট একটি অংশ রহিত করার আদেশ দিয়েছিলেন; কিন্তু সে দেশের আইনসভা ও সরকার সে আদেশকে গ্রহণ করে সেটিকে সংবিধানের অংশ করেনি। এখনো সেটি অকার্যকর রয়ে গেছে। বাংলাদেশে অষ্টম সংশোধনী মামলার সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে প্রথম সংবিধানের কোনো অংশবিশেষ বাতিল ঘোষণা করা হয়। এরপর সংবিধানের ৫ম, ৭ম ও ১৩শ সংশোধনীসহ মৌলিক অনেক অংশ বাতিল করে পুরনো বিধান পুনরুজ্জীবনের আদেশ দেয়া হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসংবলিত ক্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়কে কেন্দ্র করে এখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠেছে। এখতিয়ারের ভেতরে বাইরে সংবিধান নিয়ে এই চর্চা দেশের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলছে।
সোহেল তাজ নিয়ে শুরু
সংবিধানের গায়ের জোরে ব্যাখ্যা দেয়া ও তা কার্যকর করার প্রথম অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে উঠেছিল স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজের পদত্যাগের সময়। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের ছেলে সোহেল তাজ প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার পদত্যাগপত্র পেশ করেছিলেন। সোহেল তাজ রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেয়ার উদ্দেশ্যেই পদত্যাগপত্র দিয়েছিলেন। সেটি তিনি একাধিকবার সংবাদপত্রে দেয়া বক্তব্যে বলেছেন; কিন্তু তার পদত্যাগপত্র দীর্ঘ দিন ঝুলিয়ে রাখা হয়। ইস্তফা দেয়ার পরও তাকে মন্ত্রী হিসেবে বহাল দেখানো হয়।
এবার মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র পেশ করার একটি খসড়াও মন্ত্রীদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয় এবং তাতে তারিখ উল্লেখ না করে শর্তসাপেে পদত্যাগপত্র প্রদানের বিষয়টি থাকে। এ খসড়া অনুযায়ী মন্ত্রীরা সর্বদলীয় সরকারের জন্য পদত্যাগের ‘অভিপ্রায়’ ব্যক্ত করলেও এর শিরোনামে পদত্যাগপত্র স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। সংবিধান বা প্রচলিত আইনে মন্ত্রীদের শর্তসাপেে পদত্যাগের সুযোগ নেই। এর আগে আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে একবার গণপদত্যাগ করেছিল। তখন দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে বলা হয়েছিল তাদের পদত্যাগপত্র স্পিকারের কাছে পৌঁছানোর সাথে সাথেই সেটি কার্যকর হয়ে গেছে। এখন বলা হচ্ছে তার উল্টোটা।
পৃথিবীর একনায়কতান্ত্রিক দেশগুলোতে নির্বাহী বিভাগ তথা শাসকদের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয় আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার পৃথকীকরণের মাধ্যমে এ তিন বিভাগের ক্ষমতার মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য আনার ব্যবস্থা করা হয়; কিন্তু নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের মধ্যে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা দেখা দিলে তখন নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে এবং তাতে সফলকামও হয়। এ ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব যদি আইন বিভাগের ওপর নিরঙ্কুশ হয়, তা হলে ক্ষমতাসীনদের রাষ্ট্রের সব বিভাগের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন সহজ হয়ে পড়ে। এ ধরনের একটি সুবিধাজনক অবস্থা রয়েছে বর্তমান শাসকদের সামনে।
সরকারের সাম্প্রতিক নানা কর্মকাণ্ডে তার প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। তা না হলে সরকারের আইনমন্ত্রী যখন পদত্যাগপত্র সংবিধান অনুসারে হয়নি বলে উল্লেখ করেন তখন তথ্যমন্ত্রী কী করে বলেন সংবিধান মেনেই তারা পদত্যাগ করেছেন। দুই মন্ত্রীর মধ্যে যার কথাই ঠিক হোক না কেন মন্ত্রীরা তাদের পদে বহাল থাকতে পারেন না।
মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি!
সংবিধানের মতো রাষ্ট্রের একটি সর্বোচ্চ দলিল নিয়ে এ ধরনের টানা-হেঁচড়া কাম্য নয়। এটি শুধু কাম্য নয় তাই নয় এ ধরনের কাজের জন্য বর্তমান সরকার সংবিধান সংশোধন করে শাস্তির ব্যবস্থাও করেছে। এ ব্যাপারে সংবিধানে ৭ক অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়েছে সর্বশেষ সংশোধনীর মাধ্যমে। এই ৭ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘(১) কোন ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায় (ক) এই সংবিধান বা ইহার কোন অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে; কিংবা (খ) এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।’
(২) ‘কোন ব্যক্তি (১) দফায় বর্ণিত (ক) কোন কার্য করিতে সহযোগিতা বা উস্কানি প্রদান করিলে; কিংবা (খ) কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে তাহার এইরূপ কার্যও একই অপরাধ হইবে। (৩) এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে।’ এই সর্বোচ্চ দণ্ড বলতে মৃত্যুদণ্ডকে বোঝানো হয়েছে।
সংবিধানের এই সংশোধিত অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে পদত্যাগ করার পরও মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান উল্লিখিত অনুচ্ছেদের অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
স্বেচ্ছাচারিতার শেষ কোথায়?
পদত্যাগ ইস্যুতে ৭ক অনুচ্ছেদের অপরাধ হলো কি হলো না তার চেয়ে বড় বিষয় হলো সরকার সংবিধানের বিধানগুলোকে নিজস্ব স্বেচ্ছাচারী ব্যাখ্যা দানের যে প্রবণতা দেখাচ্ছে, তা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।
সংবিধান অনুসারে সংসদের প্রথম অধিবেশন যে দিন বৈঠকে বসবে তার পর পাঁচ বছরপূর্তি হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর মেয়াদ পূর্তির আগে ভেঙে গেলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই বিধান অনুসারে ২৫ অক্টোবরের পর থেকে নির্বাচনকালীন সরকারের শুরু। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্তির পর এ সময়ে রাষ্ট্রপরিচালনার কথা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। আগের সরকার এ সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করলেও তা করবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে, নির্বাচিত সরকার হিসেবে নয়। তারা মৌলিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না। অথচ সংবিধানে উল্লিখিত ৯০ দিনের নির্বাচনকালীন সময় শুরু হলেও সংবিধানের এই বিধান লঙ্ঘন করে আগের সরকার দিয়ে তিন সপ্তাহ ধরে রাষ্ট্র চালানো হচ্ছে। সরকার এ ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছামতো একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে তফসিল ঘোষণার পরবর্তী সময়কে নির্বাচনকালীন সময় হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছে। এ ব্যাখ্যা ঠিক হলে এর আগে নির্বাচনের জন্য তিন মাস আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হতো না।
নির্বাচনকালীন সময়ে প্রশাসন থাকে নির্বাচন কমিশনের অধীনে। এ সময়ে প্রশাসনের সব নিয়োগ বদলি নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকে। অথচ তফসিল ঘোষণা না করার অজুহাতে এ সময়ে দিব্যি সব কিছু করে যাচ্ছে রাজনৈতিক সরকার। সর্বশেষ সংশোধিত সংবিধানে বলা হয়েছে, সংসদের দুই অধিবেশনের মধ্যবর্তী সময় ৬০ দিনের বেশি হবে না। এর একমাত্র ব্যতিক্রম হবে নির্বাচনকালীন সংসদের মেয়াদ পূর্তির পূর্ববর্তী ৯০ দিনে। এই ব্যতিক্রমের বিষয়টি সংবিধানে উল্লেখ করার কারণই হলো এ সময়ে সংসদের অধিবেশন বসবে না। অথচ কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে সংসদের অধিবেশন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না কার্য উপদেষ্টা কমিটির ক্ষমতা কোনোভাবেই সংবিধানের সুনির্দিষ্ট বিধানকে লঙ্ঘন করতে পারে না।
নির্বাচনকালীন সময়ে সরকার নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে এমন কোনো উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করতে পারে না। অথচ এখন সরকারপ্রধান প্রতিদিন ডজন ডজন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করছেন। এ ধরনের অব্যাহত সংবিধান লঙ্ঘনের বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দিয়েই হয়তো পাঠক এ মন্তব্যটি করেছিলেন, সংবিধানে একটি অদৃশ্য অনুচ্ছেদ রয়েছে যে অনুযায়ী কাজ করছে বর্তমান সরকার; কিন্তু এ ধরনের কাজের নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। ইতোমধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ নানা খবর পাওয়া যাচ্ছে। জানা গেছে, জাতিসঙ্ঘের শান্তি মিশনে পৌনে এক হাজার সদস্যের দুই ব্রিগেড সৈন্য পাঠানোর যে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন ছিল, সেটি অঘোষিতভাবে স্থগিত হয়ে গেছে। অতি সম্প্রতি আসা মিশনের সদর দফতরের এক চিঠিতে বাইরে শান্তি সেনা পাঠানোর আগে দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তির ওপর নজর রাখতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সাত বছর আগে এ ধরনের একটি চিঠি নিয়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। একের পর এক ঘটনা ঘটতে দেখা যায় এর পরে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন