আবারও ফিরে এসেছে ‘ঐতিহাসিক’ ১৬ জুন। দিনটি সংবাদ মাধ্যমের ‘কালোদিবস’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। কারণ, ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সরকারের মালিকানাধীন চারটি দৈনিক ছাড়া দেশে সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয়েছিল। সবকিছুর পেছনে প্রধান এবং নির্ধারকের ভূমিকা ছিল আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ এবং স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় বসার পর থেকেই সরকারের সমালোচনা এবং বিরোধী রাজনীতিকে সহিংস পন্থায় দমনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন শেখ মুজিব। সরকারের বিরোধিতাকে পাকিস্তানী কায়দায় রাষ্ট্র ও স্বাধীনতার বিরোধিতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তিনি। এর ফলে গণতান্ত্রিক বিরোধী দলের তো বটেই, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির সুস্থ বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। সরকারের উদ্যোগে দলীয় সন্ত্রাসকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, লালবাহিনী এবং জাতীয় রক্ষীবাহিনীসহ নানা বাহারী নামে বাহিনীকে বিরোধী দল দমনের জন্য লেলিয়ে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব। তিনি নিজে পল্টন ময়দানের জনসভায় বিরোধী দলের ওপর ‘লাল ঘোড়া দাবড়ায়া’ দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। কর্মীদের বলেছেন ‘সুন্দরী কাঠের লাঠি’ হাতে নিতে। সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদারকে হত্যার পর সংসদের ভাষণে জানতে চেয়েছেন, ‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’ প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে অনুসরণ করেছিলেন তার সহযোগীরাও। আওয়ামী লীগের বি-টিম নামে পরিচিত দল সিপিবির নেতা মণি সিং বায়তুল মোকাররমের সমাবেশে বিরোধী দলের প্রধান নেতা মওলানা ভাসানীকে ‘টুকরা টুকরা’ করে ফেলার হুংকার দিয়েছিলেন। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানা গেছে, শেখ মুজিবের মাত্র সাড়ে তিন বছরে বিরোধী দলের ৩৭ হাজার নেতা-কর্মী প্রাণ হারিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি সংবাদপত্রের ওপরও মুজিব সরকার প্রচ- দমন অভিযান চালিয়েছিল। সরকার ১৯৬০ সালে আইয়ুব সরকারের প্রবর্তিত প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্সই শুধু বহাল রাখেনি, ১৯৭৩ সালে সে কালাকানুনটিকেই ‘মুদ্রণযন্ত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স’ নামে প্রবর্তন করেছিল। এই অধ্যাদেশের আড়াল নিয়ে ক্ষমতাসীনরা একদিকে সরকার বিরোধী সংবাদ প্রকাশনার ওপর নিয়ন্ত্রণ চাপিয়েছেন, অন্যদিকে নিষিদ্ধ করেছেন একের পর এক সংবাদপত্রের প্রকাশনা । ১৯৭২ সালে মওলানা ভাসানীর ‘হক-কথা’ ছাড়াও নিষিদ্ধ হয়েছিল পাঁচটি সাপ্তাহিক ‘গণশক্তি’, ‘লাল পতাকা’, ‘নয়াযুগ’, মুখপত্র’ ও ‘স্পোকসম্যান’ এবং চট্টগ্রামের দৈনিক ‘দেশবাংলা’। আজকের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুদের মূল দল জাসদের দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’ও নিষিদ্ধ হয়েছিল। কবি আল মাহমুদসহ কয়েকজন সম্পাদককেও গ্রেফতার করেছিল সরকার।
কিন্তু এতকিছু করেও বিরোধী রাজনীতিকে নির্মূল করা দূরে থাকুক, দমন করাও সম্ভব হয়নি। সরকারের বিরুদ্ধে নতুন এক হাতিয়ারের যোগান দিয়েছিল ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ। কয়েক লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল সে দুর্ভিক্ষে। অমন অবস্থায় দরকার যখন ছিল সকল দলকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালানো শেখ মুজিব তখন ‘দ্বিতীয় বিপ্ল¬বের’ ডাক দিয়েছিলেন। এর পরিস্কার উদ্দেশ্য ছিল নিজের একচ্ছত্র নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং সরকার বিরোধিতাকে সমূলে উৎখাত করা। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের মাত্র কয়েক মিনিট স্থায়ী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছা ও নির্দেশে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। সংশোধনীর আগে পর্যন্ত শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, পাস করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এমনভাবে রাষ্ট্রপতি হয়ে বসেছিলেন যেন তিনি ওই পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে ছিল এক ভয়ংকর এবং বিচিত্র অবস্থা। চতুর্থ সংশোধনীর ফলে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং সকল রাজনৈতিক দল বাতিল ও বিলুপ্ত করে দেশে একটি মাত্র দল রাখার বিধান করা হয়। এই সংশোধনীর ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব ২৪ ফেব্রুয়ারি একমাত্র দল বাকশাল গঠন করেন। তার নির্দেশে তাকেই চেয়ারম্যান করে বাকশালের ১১৫ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় ৬ জুন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং বাকশালের চেয়ারম্যান শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি দৈনিক ‘ইত্তেফাক’, দৈনিক ‘বাংলা’, ‘বাংলাদেশ অবজারভার’ ও ‘বাংলাদেশ টাইমস’ ছাড়া দেশের সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয়েছিল ১৬ জুন। এর ফলে সাংবাদিক ও সংবাদপত্রসেবীরা বেকার হয়ে পড়েছিলেন। জাতি বঞ্চিত হয়েছিল সঠিক সংবাদ জানার মৌলিক অধিকার থেকে। এ অবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছিল শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর।
গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্পষ্ট পদক্ষেপ হলেও বাকশাল গঠনের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে যুক্তি কম দেখানো হয়নি। বাকশাল গঠনের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে অনেক যুক্তিই দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ শেখ মুজিব নাকি ‘মহৎ উদ্দেশ্য’ নিয়ে ‘জাতীয় প্ল¬্যাটফর্ম’ হিসেবে বাকশাল গঠন করেছিলেন! এ কথাও বলা হয়েছে যে, বাকশাল গঠনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছিল জাতীয় সংসদে। অন্যদিকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু এসব যুক্তিকে সমর্থন করে না। যে ‘বিশেষ পরিস্থিতি’র যুক্তি দেখানো হয় তার জন্য দায়ী ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বব্যাপী দুর্নীতি, কালোবাজারি ও চোরাচালানসহ প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা, সরকারের রাজনৈতিক নির্যাতন ও হত্যাকা- এবং সবশেষে ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। বাকশাল প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে দেয়া শেখ মুজিবের ভাষণেও এ সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লে¬খ রয়েছে। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দরকার যখন ছিল ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান কিংবা জরুরি ভিত্তিতে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করা, ক্ষমতাদর্পী শেখ মুজিব তখন উল্টো রাজনৈতিক আন্দোলন ও সরকার বিরোধিতার পথ বন্ধ করে দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি প্রথমে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। তারপর পর্যায়ক্রমে এগিয়েছিলেন বাকশালের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পথে।
সমগ্র এই প্রক্রিয়া ও কর্মকা-ের একমাত্র উদ্যোক্তা, নির্দেশদাতা, নিয়ন্ত্রক ও লাভবান ব্যক্তি ছিলেন শেখ মুজিব। সর্বময় ক্ষমতাও তার হাতেই কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। ‘জাতীয় প্ল¬্যাটফর্ম’ বলা হলেও বাকশাল বাস্তবে আওয়ামী লীগেরই নামান্তর মাত্র ছিল (বাকশাল বলতে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বোঝানো হয়েছিল, ‘আওয়ামী লীগ’ নামটিকে বাদ দেয়া হয়নি!)। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে যদি আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত দুটি দল ন্যাপ (মোজাফফর) এবং সিপিবির শোচনীয় পরিণতির উলে¬খ করা হয়। স্বাধীনতার পর প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই দল দুটি সরকারের লেজুড়বৃত্তি করে এসেছে। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে দল দুটিকে নিয়ে শেখ মুজিব ‘ত্রিদলীয় ঐক্যজোট’ও গঠন করেছিলেন। কিন্তু বাকশালের ১১৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে এমনকি কমরেড মনি সিং এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মতো দলীয় প্রধানরাও নেতৃত্বের অবস্থান পাননি। এই দু’জনকেসহ দুই দলের মাত্র ছয়জনকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেয়া হয়েছিল। তাদের ক্রমিক সংখ্যা ছিল ৭০-এর ঘরে। ওদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামী জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীসহ অন্য কোনো নেতাকে বাকশালে যোগ দেয়ার সুযোগই দেয়া হয়নি। মওলানা ভাসানীকে ১৯৭৪ সালের জুন থেকে সন্তোষে গৃহবন্দি রাখা হয়েছিল। কাজী জাফর আহমদ ও রাশেদ খান মেননসহ আওয়ামী লীগ বিরোধী অন্য নেতারা ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, কয়েকজন পালিয়ে বিদেশেও চলে গিয়েছিলেন। সুতরাং ‘জাতীয় প্ল¬্যাটফর্ম’ গঠনের যুক্তিকে রাজনৈতিক অসততা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
‘সাময়িক কালের’ জন্য গঠন করা হয়েছিল ধরনের যুক্তিকেও গ্রহণ করা যায় না। কারণ, সে ধরনের কোনো বিধান চতুর্থ সংশোধনীর কোথাও কিংবা বাকশালের গঠনতন্ত্রে ছিল না। গঠনতন্ত্রের বিভিন্ন ধারা-উপধারা বরং এ কথাই প্রমাণ করেছে, রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য নিয়েই বাকশাল গঠন করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ও কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন এবং সংসদ সদস্যদের মনোনয়ন দেয়া থেকে বাকশাল, রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতিটি বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতা ছিল শুধু শেখ মুজিবের। পরোক্ষভাবে একথাও ঘোষণা করা হয়েছিল যে, শেখ মুজিব আজীবন রাষ্ট্রপতি এবং বাকশালের চেয়ারম্যান থাকবেন।
চতুর্থ সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস করা হলেও অনস্বীকার্য সত্য হলো, ১৯৭৩ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদের পক্ষ থেকে এক দলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট চাওয়া হয়নি। শেখ হাসিনার তুলনায় অনেক বেশি জনপ্রিয় ও ক্ষমতাধর নেতা শেখ মুজিব ১৯৭৩ সালে ‘অ্যানালগ’ পদ্ধতিতে সকল ‘কম্ম’ সম্পন্ন করেছিলেন। ‘ওরে জিতাইয়া দে’, ‘ওরে হারাইয়া দে’ ধরনের নির্দেশ ও ধমকের জোরে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৭টি আসনেই জিতেছিল আওয়ামী লীগ। ওই সংসদেই সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতির ঘাড়ে বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চাপানো হয়েছিল।নির্বাচনী প্রচারণার সময় জনগণকে জানানো হয়নি যে, ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগ এত মৌলিক ধরনের ব্যাপক কোনো পরিবর্তন ঘটাবে। সংশোধনী পাস করার পরও গণভোটের আয়োজন করা হয়নি। অথচ এ ধরনের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোতে জনমত যাচাই এবং গণভোট অনুষ্ঠান করা গণতন্ত্রে একটি অবশ্যপালনীয় কর্তব্যÑ যেমনটি পরবর্তীকালে করেছে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংসদে শেখ মুজিব প্রবর্তিত প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি বাতিল করে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন করার উদ্দেশ্যে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছে। সর্বসম্মতিক্রমে পাস করা সত্ত্বেও এ প্রশ্নে গণভোট আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু বাকশাল গঠন এবং চতুর্থ সংশোধনী পাস করার সময় শেখ মুজিব এ ধরনের গণতন্ত্রসম্মত চিন্তাই করেননি।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে পঞ্চম সংসদের সেই অধিবেশনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে, যে অধিবেশনে শেখ মুজিবের চতুর্থ সংশোধনীকে কবর দেয়া এবং তার পরিবর্তে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। দ্বাদশ সংশোধনীর অর্থ প্রকৃতপক্ষে ছিল শেখ মুজিবের আরো একটি মৃত্যু। কিন্তু তারপরও সংসদে উপস্থিত আওয়ামী লীগের এমপিরা আনন্দে উল্লসিত হয়েছেন, একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরে নৃত্য করেছেন। শেখ হাসিনাও আওয়ামী এমপিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিভি ক্যামেরার সামনে হাসি মুখে দাঁড়িয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের স্টাইলে দুই আঙ্গুলে ইংরেজি অক্ষর ‘ভি’ বানিয়ে বিজয়ের বার্তা জানিয়েছেন জনগণকে। দেশবাসীর প্রত্যাশা ও আকাংখার পরিপ্রেক্ষিতে এই আনন্দ-উল্লাস স্বাভাবিক হলেও শেখ মুজিবের মনোভাব ও চিন্তাধারার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে কিন্তু মানতেই হবে যে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো মুজিব বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে মিলিতভাবে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করার জন্য আওয়ামী লীগের অন্তত এত বেশি উল্লসিত হওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। কেননা, দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাস্তবে শেখ মুজিবের সর্বশেষ ‘কীর্তি’কেই প্রত্যাখ্যান ও বাতিল করা হয়েছিল। অন্যদিকে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ এমপিদের উল্লাস দেখে মনে হচ্ছিল যেন তারা শেখ মুজিবের কোনো চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন!
এটা তাদের পরাজয় বরণ করে নেয়ার গণতন্ত্রসম্মত কৌশল হতে পারে। কিন্তু এভাবেই তারা একের পর এক মরহুম নেতার ‘কীর্তি’ ও চিন্তাধারাকে প্রত্যাখ্যান ও বাতিল করে এসেছেন। বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত ভুল ও অন্যায় ছিল বলেই মুজিব-উত্তর কোনো বছর ২৫ জানুয়ারির মতো ‘ঐতিহাসিক’ একটি দিবসকে আওয়ামী লীগ কখনো যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য ও সম্মানের সঙ্গে পালন বা উদযাপন করেনি। দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলো দিনটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দিনটিকে পার করেছে নীরবে। কারণ, তাদের পক্ষে শেখ মুজিবের সর্বশেষ ‘কীর্তি’ বাকশালকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা সম্ভব হয়নি। এটা আসলে হওয়ারও কথা নয়।
লজ্জা ও ব্যর্থতার সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কিছুটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পা বাড়াতে শুরু করেছে। এর ফলে একের পর এক আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম। দৈনিক আমার দেশ-এর প্রকাশনা একাধিকবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এখনো জেলখানায় রয়েছেন। তাকে রিমান্ডে নিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়েছে। দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদকেও সরকার গ্রেফতার করেছে, রিমান্ডে নিয়েছে। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা চাপিয়েছে। আরো কয়েকজন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভিকেও নিষিদ্ধ করেছে সরকার। চ্যানেল ওয়ানকে অনেক আগেই বন্ধ করা হয়েছে, যমুনা টিভিকে সম্প্রচারের সুযোগই দেয়া হয়নি। একযোগে চলছে অ্যাডভাইস বা পরামর্শের আড়ালে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা। সর্বশেষ এক উপলক্ষে গত ১২ জুনও তথ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, আরো কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমকে নাকি নিষিদ্ধ করা দরকার! মুখে না বললেও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এভাবেই সংবাদ মাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চলেছে। ফলে মানুষের শুধু ‘ঐতিহাসিক’ ১৬ জুনের কথাই মনে পড়ছে না, তারা আবারও বাকশালের ভয়ে ভীতও হয়ে পড়ছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন