[বাংলাদেশের
অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি ভারতের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। গত কয়েক বছরে
ইন্দো-বাংলাদেশ সম্পর্ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় হুমকির পথ উন্মুক্ত করলেও বর্তমান সরকার
সন্ত্রাসবাদ দমনে আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। মার্কিন
পররাষ্ট্র দফরত]
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ভারত সফর করেন। পরে
শোনা যায় যে, দিল্লিতে তিনি কতকগুলো চুক্তি করে এসেছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি
হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক চুক্তিগুলো অনুমোদনের জন্য সংসদে পেশ করা হয়। কম
গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিগুলো সংসদের পাঠাগারে রাখা হয়। কোনো সদস্য আগ্রহী হলে
পাঠাগারে গিয়ে সে চুক্তির বিবরণ পাঠ করতে পারেন। কিন্তু শেখ হাসিনার স্বাক্ষরিত
চুক্তিগুলোর বিবরণ নিয়ে তো আলোচনা হয়ইনি, এমনকি চুক্তিগুলো সংসদের
পাঠাগারে রাখা হয়েছে বলেও শোনা যায়নি। শুধু তাই নয়, সে সফরে তিনি
কতকগুলো চুক্তিতে সই করে এসেছেন তার সংখ্যাও এ পর্যন্ত জানা যায়নি।
কয়েকটি কলামে তখন লিখেছিলাম, সন্দেহ করা যুক্তিযুক্ত হবে যে, স্বাক্ষরিত
চুক্তিগুলোতে এমন কিছু আছে যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী বলে
জনসাধারণের গ্রহণযোগ্য হবে না। সে সন্দেহ করার বিশেষ কিছু কারণ ছিল। আগের বছর (২০০৯)
২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহে বহু রহস্যময় ঘটনা ঘটেছে। সেসব রহস্য উদঘাটন করার
চেষ্টা তো দূরের কথা, ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টাই বেশি করে চোখে পড়েছে। জনমত যাচাইয়ের কোনো
চেষ্টা না করে তড়িঘড়ি ঐতিহ্যমণ্ডিত বিডিআর বাহিনীকে ভেঙে দিয়ে ভুঁইফোড় একটা
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বাহিনী গঠন করা হয়।
আরও একটা মারাত্মক পরিণতি হয়েছে বিদ্রোহের। ক্যাপ্টেন থেকে মেজর
জেনারেল পর্যন্ত বিভিন্ন মধ্য ও উচ্চ পদমর্যাদার ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তা
মর্মান্তিকভাবে নিহত হয়েছেন সে বিদ্রোহে। তার পর থেকে সেনাবাহিনীকে যেন পর্দার
আড়াল করে রাখা হয়েছে। স্বাধীনতা দিবস প্রভৃতি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে
সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ সব দেশেই আনুষ্ঠানিক ব্যাপার। এসব অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী
পারদর্শিতা ও সৌকর্যের কিছু দৃষ্টান্ত দেখিয়ে জনসাধারণকে আপ্যায়িত করে। তাতে
জাতি ও তার স্বাধীনতা প্রহরীদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রতি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ২০০৯
সালের সে অভিশপ্ত ২৫ ফেব্রুয়ারির পর থেকে তেমন কোনো প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ
সেনাবাহিনীকে দেখা যাচ্ছে না। নিহত এত বেশি কর্মকর্তার শূন্যতা আদৌ পূরণ করা
হয়েছে কি না, কিংবা কিভাবে পূরণ করা হয়েছে ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন রকম জল্পনা-কল্পনা
ও কানাঘুসা শোনা যায় প্রায়ই। কেউ কেউ বলছেন, সরকারদলীয় সমর্থক অফিসারদের
পদোন্নতি দিয়ে সেসব পদে নিয়োগ করা হয়েছে। সে গুজব খুবই বিশ্বাসযোগ্য। ক্ষমতা
পাওয়ার পর থেকে এ সরকার প্রশাসন, পুলিশ, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো, এমনকি বিচার বিভাগেরও চূড়ান্ত
দলীয়করণ করে ফেলেছেন। তা ছাড়া অতীতে কয়েকবার আওয়ামী লীগ সেনাবাহিনীকে ব্যবহার
করে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের চেষ্টা করেছে।
জাতীয় সেনাবাহিনী?
আরেকটি কানাঘুসা এই যে সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে জাতিসঙ্ঘের ভাড়াটে
সৈনিক হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী করে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। অর্থাৎ দেশের প্রতিরক্ষায়
এই গৌরবময় বাহিনীর জন্য কোনো ভূমিকা রাখা হচ্ছে না। সেটা অবশ্যই অত্যন্ত
ট্র্যাজিক ব্যাপার হবে, কেননা একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি পক্ষ ত্যাগ করে যে
স্বল্প সংখ্যক অফিসার ও জওয়ান মুক্তিযুদ্ধে অসম সাহস ও শৌর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন
তাদের পুণ্য স্মৃতি ইতিহাসের পাতা থেকেও মুছে যাবে।
এই আলোচনাগুলোর কিছু বিশেষ তাৎপর্য আছে। একাত্তরের ২৫ মার্চের
কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে আওয়ামী লীগ নেতারা সবাই
ভারতে চলে যান। তাদের আশ্রয়, আহার, বাসস্থান অর্থাৎ তাদের সামগ্রিক অস্তিত্বই নির্ভর করছিল ভারত সরকারের
দাক্ষিণ্যের ওপর। ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে যাওয়া এই অসহায়
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ভারত সরকার তাদের অসহায় অবস্থার
পুরোপুরি সুযোগ নিয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদের ‘নির্বাসিত সরকারকে’ একটা সাত দফা
চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে দিল্লি সরকার।
সে চুক্তির কতকগুলো বিধান ছিল এ রকম : স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র
নীতি এবং প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নেবে ভারত। অর্থাৎ বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো
পররাষ্ট্রনীতি কিংবা সেনাবাহিনী থাকবে না এবং বিডিআর বাহিনীকে ভেঙে দিয়ে ভারতের
সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের তত্ত্বাবধানে একটা বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বাহিনী গঠন
করা হবে। মনে রাখতে হবে যে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও পরের বছরের এপ্রিল মাস
পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীই ছিল বাংলাদেশে সর্বেসর্বা। ৭২-এর ফেব্রুয়ারি মাসের
শেষার্ধে আমি সড়কপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম বিবিসির সফরে। গোটা পথে আমার
কোনো অসুবিধা কিংবা সমস্যা হচ্ছে কি না খোঁজখবর নিচ্ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর লে.
কর্নেল ভানোট।
জানুয়ারি মাসে পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান দেশে
ফেরেন। তাজউদ্দীন আহমদের স্বাক্ষরিত সাত দফা চুক্তিটি তিনি গ্রহণ করতে পারেননি। সে
চুক্তি মেনে নিতে তাকে রাজি করাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং
ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু মুজিব ভারতীয় সেনাবাহিনী অপসারণের দাবিতে অটল থাকেন। তখন
বাংলাদেশের প্রতিটি নর-নারী, এমনকি হয়তো উদ্ভিদ এবং তৃণলতাও মুজিবের অনঢ় সমর্থক। তার দাবি মেনে
না নিয়ে ভারতের উপায় ছিল না। লক্ষ করতে হবে যে, কোনো দেশের সরকার যদি জনপ্রিয়
হয় তাহলে সে সরকারকে অপ্রিয় কিছু মেনে নিতে রাজি করানো ভিন্ন কোনো দেশের পক্ষে
সম্ভব হয় না। সরকারের অপ্রিয়তার সুযোগ নিয়েই কোনো দেশে বিদেশী অনুপ্রবেশ ঘটতে
পারে। বাংলাদেশেও হয়েছে ঠিক তাই। ভারত জানে তাদের (এবং ওয়াশিংটনের) খুঁটির জোরেই
প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। সুতরাং তার ওপর আবার সাত দফা চুক্তি চাপিয়ে দেয়া তারা সহজ
মনে করেছে। প্রধানমন্ত্রী খুব সম্ভবত দিল্লিতে সে চুক্তিও করে এসেছিলেন।
বিডিআর বিদ্রোহ এবং প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর
বিডিআর বিদ্রোহ বলতে গেলে কলমের এক আঁচড়ে তাজউদ্দীন আহমদের
স্বাক্ষরিত সাত দফা চুক্তির দু’টি দফা পূরণ করে দিলো। বিডিআর বাহিনীকে অবলুপ্ত করে বশংবদ একটা
বর্ডার গার্ড বাহিনী গঠন করা হলো। সে জন্যই বিএসএফ যখন বাংলাদেশী মানুষের ওপর
পাখির মতো অবলীলায় গুলি চালায় তখন বিজিবির দিক থেকে টুঁ শব্দটি শোনা যায় না।
অথচ বিডিআরের আমলের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তখনকার অবস্থা ছিল ‘ঢিলটি মারিলে পাটকেলটি খেতে
হবে’ গোছের। দ্বিতীয়ত, এক সাথে ৫৭ জন সিনিয়র অফিসারের হত্যা অবশ্যই বাংলাদেশের নিজস্ব
সেনাবাহিনীকে মারাত্মক রকম দুর্বল করে ফেলল। এ বাহিনী আরও দুর্বল করে দেয়ার পথও
তৈরি হলো কি না, কে জানে?
শেখ হাসিনা দিল্লি সফরে গেলেন বিডিআর বিদ্রোহের ১১ মাস পর। তার আগেই অত্যন্ত
ত্বরিত এশিয়ান হাইওয়ের গতি পরিবর্তন করে ফেলা হয়। মূল নীলনকশা অনুযায়ী কথা ছিল
যে, এশিয়ান হাইওয়ে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁও হয়ে বেনাপোলের পথে ঢাকায় আসবে
এবং চট্টগ্রাম ও টেকনাফ হয়ে মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে দক্ষিণ চীনে চলে যাবে। কিন্তু
রাতারাতি ঘোষণা হয় যে প্রস্তাবিত হাইওয়ে এক ধারায় নয়, দুই ধারায়
বাংলাদেশে ঢুকবে। এক ধারা বেনাপোল হয়ে এবং অন্য ধারা উত্তর-পশ্চিমের বুড়িমারী
হয়ে। কিন্তু উভয় ধারাই গিয়ে শেষ হবে ভারতের আসাম রাজ্যে। অর্থাৎ এশিয়ান
হাইওয়ে বাংলাদেশকে মিয়ানমার ও চীনের সাথে সংযুক্ত করবে না। নীলনকশা পরিবর্তনের
এই উদ্ভটতা ও অযৌক্তিকতা সবাইকে বিস্মিত করেছিল। অনেকেই (এই লেখকসহ) তখন তার তীব্র
সমালোচনাও করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের পর ঘটনাবলি নাটকীয় রকম বিবর্তিত হতে
থাকে। একেদুয়ে ঘোষণা আসতে থাকে যে ভারতকে উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যের সাথে
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে করিডোর দেয়া হবে বিনা মাশুলে (কেননা মাশুল নেয়া নাকি
অসভ্যতা হবে); সে লক্ষ্যে ভারত বাংলাদেশের সড়ক, রেল, নদীপথ এবং
সমুদ্রবন্দর মংলা ও চট্টগ্রাম অবাধে ব্যবহার করতে পারবে। আরও ঘোষণা হয় সড়ক, সেতু ইত্যাদি
অবকাঠামো তাদের ব্যবহারোপযোগ্য করার জন্য ভারত বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেবে।
তবে প্রয়োজনীয় কাজগুলো করবেন ভারতীয় প্রকৌশলীরা, ভারতীয় যন্ত্রপাতি ও ভারতীয়
উপকরণ ব্যবহার করে। সেসব কাজ থেকে বাংলাদেশের কোনো অর্থনৈতিক লাভ হবে না, কিন্তু সেসব সড়ক, সেতু ইত্যাদির
নিয়মিত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়ভার বহন করতে হবে বাংলাদেশকেই।
কার স্বার্থে মাহমুদ জেলে আর ইলিয়াস গুম?
২০১১ সালে ভারত বাংলাদেশের গোমতি নদী এবং ১৪টি খালে বাঁধ তৈরি করে। ১৩৪
চাকার ট্রেইলার যোগে অস্বাভাবিক প্রশস্ত ও ভারী যন্ত্রপাতি ত্রিপুরা রাজ্যে নিয়ে
যাওয়া হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন কারখানা স্থাপনের জন্য। বাংলাদেশের পরিবেশের ওপর তার
মারাত্মক ক্ষতির বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন আমার দেশ
পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এবং বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী।
স্পষ্টতই তারা একযোগে শেখ হাসিনা এবং ভারত সরকারের চুশূল হয়ে দাঁড়ায়। মাহমুদুর
রহমান এখন কারাগারে নির্যাতিত হচ্ছেন। ইলিয়াস আলীকে এক বছরেরও বেশি আগে তার গাড়ি
থেকে ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া হয় গাড়ি চালকসহ। তারা দুইজন কোথায়, কিভাবে আছেন কে
জানে?
তার পর থেকে বাংলাদেশের নদী ও সড়কপথ ব্যবহার করে ভারতের এক অংশ থেকে
অন্য অংশে পণ্য চলাচলের খবর প্রায়ই পাওয়া যায়। বিগত কয়েক দিনে খবর পাওয়া গেছে
যে এক চালান খাদ্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের নদীপথ ও আশুগঞ্জ স্থলবন্দর ব্যবহার
করে ত্রিপুরা রাজ্যে পাঠানো হয়েছে। আরেকটা খুবই উদ্বেগজনক খবর এই যে বাংলাদেশের
অনুরোধ কিংবা অনুমতি ছাড়াই ভারত নারায়ণগঞ্জে একটা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের
উদ্যোগ শুরু করেছে। এটা কোনো রকেট বিজ্ঞানের কথা নয় যে ভারতীয় পণ্য দিয়ে
বাংলাদেশের বাজার সয়লাব করা এবং বাংলাদেশের শিশু শ্রমশিল্পের টুঁটি টিপে মারাই এই
টার্মিনাল নির্মাণের লক্ষ্য।
বাংলাদেশের মানুষ প্রতিনিয়ত যা লক্ষ করছে, মার্কিন
পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদনে এখন সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেয়া হলো: বাংলাদেশের
অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতি ভারতের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। একই আওয়ামী
লীগের দুই সরকার, এক পিতা এবং এক পুত্রী। কিন্তু কি আকাশ-পাতাল তফাৎ। পিতা পোকায় কাটা
সার্বভৌমত্ব নিয়ে খুশি থাকতে রাজি ছিলেন না। তিনি তাজউদ্দীন আহমদের স্বাক্ষরিত
চুক্তি মেনে নিতে অস্বীকার করেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে ডাকসাঁইটে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা
গান্ধীকেও বাধ্য করেন। সম্ভবত সাত দফা চুক্তিতে সই করেছিলেন বলেই শেখ মুজিব
তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করেছিলেন। অন্য দিকে গণবিচ্ছিন্ন এ
সরকার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার আশায় ভারতের স্বার্থকে বড় করে দেখছেন, দেশের স্বার্থকে
নয়াদিল্লি সরকারের কাছে বন্ধক রেখেছেন। বাংলাদেশের মানুষ এখন অবাক বিস্ময়ে ভাবছে
স্বাধীনতার জন্য অতো ত্যাগ স্বীকার করার কোনো প্রয়োজন আদৌ ছিল কি না।
লাল জুজু, ইসলামি সন্ত্রাস
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদনে সন্ত্রাস দমন বাবদ বর্তমান
সরকারের প্রশংসা করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে সেটা মর্মঘাতী মনে হবে।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকার তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলেছে, স্বদেশে রাজনৈতিক
হত্যাগুলোকে সরকার বিদেশে সন্ত্রাস দলন হিসেবে দেখাতে চায়। শাপলা চত্বরের
গণহত্যার পরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি জাতিসঙ্ঘে গিয়েছিলেন। ১৯৩ সদস্যরাষ্ট্রের
প্রতিনিধিদের তিনি বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছেন যে আসলে সরকারের অভিযান ছিল
ইসলামি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে।
ওয়াশিংটনে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু দেশগুলোতে এই অপপ্রচারের বহু
ইচ্ছুক খদ্দের আছে। তার কারণও আছে। সোভিয়েত কমিউনিস্ট সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে
স্নায়ুযুদ্ধে মার্কিন সমরাস্ত্র নির্মাণ শিল্প ফেঁপে-ফুলে ওঠে। ুদ্রতর দেশগুলোকে
লাল জুজুর ভয় দেখিয়ে সম্পূর্ণ বিনা প্রয়োজনে শত শত কোটি ডলারের সমরাস্ত্র কিনতে
বাধ্য করা হয়। এ শিল্প মার্কিন ধনতন্ত্রের খুঁটি হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৮৯ সালে
আকস্মিকভাবে সোভিয়েত সাম্রাজ্য ভেতর থেকে ধসে পড়লে সমরাস্ত্র নির্মাতারা প্রমাদ
গুনেছিল। তাদের পোষা বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীগুলো (থিংকট্যাংক) এবং সমরাস্ত্র
নির্মাতাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া তখন ইসলামকে পশ্চিমা ধনতন্ত্রের পরবর্তী
শত্রুরূপে চিহ্নিত করে প্রচার শুরু করে।
নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে আল কায়েদাদের ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের
সন্ত্রাসী আক্রমণের (নাইন-ইলেভেন) পর ইসলাম নামটাই মার্কিন জাতি ও তাদের মিত্রদের
আক্রমণের টার্গেট হয়ে দাঁড়ায়। এখন মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম স্বৈরশাসকেরাও আরব
বসন্তের আতঙ্কে হাজার হাজার কোটি ডলারের সমরাস্ত্র কিনছেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
ইসলাম নামে মার্কিন জাতির রক্তে আগুন ধরে। শেখ হাসিনার সরকার যখন দাবি করে যে তারা
ইসলামি সন্ত্রাসীদের খতম করছে তখন মার্কিন জাতি ও মিত্রটা কিছুটা হলেও আশ্বস্ত বোধ
করে। যবনিকার অন্তরালে যে অস্ত্র নির্মাতারা খুশিতে আটখানা হয়ে উঠছে সে খবর রাখার
প্রয়োজন কেউ বোধ করে না। প্রকৃতপক্ষে সন্ত্রাস দমনের দাবির আড়ালে এই সরকার যে
তাদের রাজনৈতিক বিরোধীদেরই গণহত্যা চালাচ্ছে সেটা বিবেচনা করার ধৈর্য মার্কিন জাতি
কিংবা মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের নেই।
ওয়াশিংটনের চীনা জুজু
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রনীতি ভারতের দ্বারা প্রভাবিত
হওয়ায় ওয়াশিংটনের বিশেষ কিছু স্বার্থ আছে। পঞ্চাশের দশকে যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত
ইউনিয়নকে ঘিরে একটা শক্তি বলয় গঠন করেছিল। সোভিয়েত-উত্তর যুগে তারা সে রকমেরই
একটা বলয় সৃষ্টির চেষ্টা করছে চীনকে ঘিরে। এ ব্যাপারে ভারতের সাথে আমেরিকার
স্বার্থ অভিন্ন। চীনের সাথে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা প্রতিরোধে ওয়াশিংটন সত্যি সত্যি
সচেষ্ট।
এ দিকে বাংলাদেশে এখন মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই। সরকার মনে করে
দেশে মানুষ আছে শুধু তাদের গদি দেয়ার এবং সে গদিতে থিতু রাখার প্রয়োজনে।
বাংলাদেশের পুলিশ বিভাগের এবং অধিকারের হিসেবে দেখা যাচ্ছে বর্তমান আওয়ামী লীগ
সরকারের চার বছর পাঁচ মাসে বাংলাদেশে খুন হয়েছে ১৮ হাজার ২৮৯ জন। এর মধ্যে
রাজনৈতিক হত্যা হয়েছে ১০৮২টি। বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে ৬৫২টি। সাংবাদিক খুন
হয়েছেন ১৭ জন। গুম করার ঘটনাও ঘটেছে অনেকগুলো। এর মধ্যে আছেন বিএনপির সাংগঠনিক
সম্পাদক ইলিয়াস আলী, ঢাকার ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার চৌধুরী আলম এবং বিএনপি ও অন্যান্য
বিরোধী দলের নেতাকর্মী।
সরকারের হাতে ক্ষমতা আছে, তাদের কূটনীতিকেরা আছেন, দরিদ্র জাতির
অর্থে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কথায় কথায় বিদেশ সফরে যাচ্ছেন। দেশে আছে তাদের মিডিয়া।
ভিন্ন মত প্রকাশের সব চ্যানেল এখন অবরুদ্ধ। সুতরাং তারা বিদেশীদের যা খুশি তা-ই
বোঝাতে পারেন। অন্য দিকে দেশে আছে গণমানুষ। এ সরকারের ভাগ্য নির্ধারিত হবে তাদের
আদালতেÑ স্টেট ডিপার্টমেন্টে কিংবা ‘জনতার মঞ্চে’ নয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন