বুধবার, ১৯ জুন, ২০১৩

প্রধানমন্ত্রীর একটি উক্তি


সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনো ১৫ জুন অনুষ্ঠিত চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে অর্থাৎ ক্ষমতাসীন আওয়ামী মহাজোটের শোচনীয় পরাজয় নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, চার মহানগরীতেই আওয়ামী সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে। বিএনপি ও জামায়াতসহ ১৮ দলীয় জোটের কাছে বিরাট ব্যবধানে হেরে গেছেন আওয়ামী লীগ ও তার মহাজোটের রথী-মহারথীরা। মেয়র পদে তো বটেই, কাউন্সিলর পদেও ক্ষমতাসীনদের লজ্জাকর ভরাডুবিই ঘটেছে। ১১৮টি পদের মধ্যে ৭০টিতেই জিতেছে বিএনপি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ পেয়েছে মাত্র ২৮টি পদ। জামায়াতে ইসলামী সাতটিতে এবং ইসলামী আন্দোলন একটিতে জিতলেও আওয়ামী মহাজোটের ™ি^তীয় প্রধান শরিক জাতীয় পার্টি পেয়েছে মাত্র দুটি পদ। মহাজোটের শরিক বামপন্থী ও কমিউনিস্টরাও কোনো পাত্তা পাননি। এতটাই জনপ্রিয়তা তাদের যে, ১৪ দলের কেউ এমনকি কাউন্সিলরও হতে পারেননি! বর্তমান পর্যায়ে কথা উঠেছে কিছু বিশেষ কারণে। প্রধান কারণ ক্ষমতাসীনদের প্রতিক্রিয়া। নিজেদের লজ্জা আড়াল করার জন্য ‘জনগণ উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিয়েছে’ এবং ‘গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে’ ধরনের নানা কথা তারা এমনভাবেই শুনিয়ে চলেছেন, যা শুনে মনে হতে পারে যেন গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটের অধিকারের জন্য মায়ার শেষ নেই তাদের! যেন বিরোধী দলকে দয়া করে জিততে দিয়েছেন তারা! যেন ওই নির্বাচনে সরকারের ব্যর্থতার এবং জনগণের ক্ষোভ ও প্রতিবাদের কোনো প্রকাশই ঘটেনি। অন্যদিকে সত্য আসলে কতটা কঠিন সেকথা জনগণ যেমন বুঝিয়ে দিয়েছে, তেমনি ক্ষমতাসীনদেরও তা না বোঝার কোনো কারণ নেই। এমন এক সময়ে উচিত যেখানে ছিল জনগণের ভাষার অর্থ অনুধাবন করা এবং সে অনুযায়ী বিশেষ করে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে পুনর্বহাল করা, ক্ষমতাসীনরা সেখানে আবারও উল্টো পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন। এ ব্যাপারেও প্রথমে এগিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্বাচনের পরদিন, গত রোববারও জাতীয় সংসদে তিনি আগের সুরে ও মেজাজেই কথা বলেছেন। তিনি শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিই প্রত্যাখ্যান করেননি, একই সঙ্গে বিরোধী দলকে ভয় দেখিয়ে বলেছেন, অসাংবিধানিক কাউকে আনার চেষ্টা করবেন না। তাহলে নির্বাচনই হবে না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে যে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় এবং জনগণ যাকে খুশি তাকে ভোট দিতে পারে সেটাই নাকি ওই চার সিটি নির্বাচনে আরো একবার প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং তত্তাবধায়ক সরকারের নামে অসাংবিধানিক কাউকে ক্ষমতায় আনার দরকার নেই। প্রধানমন্ত্রী প্রসঙ্গক্রমে আবারও ঘোষণা করেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সংবিধান অনুযায়ী এবং তার সরকারের অধীনেই। আরো অনেক কথাই বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। পাল্টা কথাও উঠেছে সঙ্গে সঙ্গে। কারণ, প্রধানমন্ত্রী বললেও এবং মুখে মুখে গণতন্ত্রের পূজারী হওয়ার অভিনয় করলেও সিটি করপোরেশনের এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা এদিক-সেদিক করার চেষ্টা কিন্তু কম করেননি। তারা পুলিশ ও র‌্যাবকেও যথারীতি ব্যবহার করেছেন। এ দুটি বাহিনীর বিরুদ্ধেও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী কর্মীর মতো তৎপরতা চালানোর জোর অভিযোগ উঠেছে। ১৮ দলের সম্ভাব্য শত শত ভোটারকে তারা ভোটকেন্দ্রে যেতে দেয়নি। ভোটকেন্দ্রের চৌহদ্দী থেকেও অনেককে বের করে দিয়েছে তারা। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যখন নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত কোনো কোনো কর্মকর্তা একথা পর্যন্ত না বলে পারেননি যে, র‌্যাব ও পুলিশ তাদের কোনো কথাই শুনছে না। এসবের পাশাপাশি র‌্যাব ও পুলিশকে বিশেষ করে দাড়ি-টুপিওয়ালাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে দেখা গেছে। যেমন খুলনার একটি ঘটনায় ১০ জন দাড়ি-টুপিওয়ালাকে র‌্যাব আটক করেছে। তারা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ারও সুযোগ পাননি। শুধু তাই নয়, র‌্যাবের হাতে নির্যাতিত হয়ে খুলনায় ইসলামী আন্দোলনের একজন কর্মীর মৃত্যু ঘটেছে। ছিনতাই ও উদ্ধার নাটকেও অভিনয় মন্দ করেনি র‌্যাব ও পুলিশের লোকজন। তাদের সামনেই আওয়ামী ক্যাডাররা ব্যালটবাক্স ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। সে বাক্সই পরে তারা ‘উদ্ধার’ করে এনেছে। মাঝখানের সময়টুকুকে সিলমারা ব্যালট ভরে দেয়ার ব্যাপারে ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছে ক্যাডাররা। বলা হচ্ছে মূলত এজন্যই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা এত বেশি ভোট পেয়েছেন। না হলে তাদের ভোট কমতো অন্তত ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। হুমকি-ধমকি দেয়ার এবং লাখ লাখ টাকা ছড়ানোর ক্ষেত্রেও পিছিয়ে থাকেননি আওয়ামী প্রার্থীরা। একই কারণে জাতীয় নির্বাচনকালীন সম্ভাব্য পরিস্থিতি সম্পর্কিত আলোচনার সঙ্গে আবারও প্রাধান্যে এসেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের বিষয়টি। বস্তুত চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সবদিক থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনকে অনস্বীকার্য করে তুলেছে। অন্যদিকে সংসদের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী আবারও সংশয়ের সৃষ্টি করেছেন। যেমন ‘সংবিধান অনুযায়ী’ কথাটা তিনি এমনভাবে বলেছেন, যেন ওই সংবিধান এখনও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে! মাঝখানে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তদের নেতৃত্বে সংবিধানের খোলনলচেই যে পাল্টে ফেলা হয়েছে সে কথার ধারেকাছেও যাননি প্রধানমন্ত্রী। তিনি একথারও উল্লেখ করেননি যে, উচ্চ আদালতের বিতর্কিত যে রায়কে অবলম্বন করে তারা সংবিধানে কাঁচি চালিয়েছেন এবং সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করেছেন, সে রায়ের মধ্যেই পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে অভিমত দেয়া হয়েছিল। একজন ছাড়া দশ অ্যামিকাস কিউরির প্রত্যেকে এবং কথিত সুশীল সমাজের সকলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর ইঙ্গিত ও নির্দেশে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তরা সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকেই ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছেন। একই কারণে প্রধানমন্ত্রীর বলা উচিত ছিল, সংশোধনের আড়ালে যে সংবিধানকে তারা জাতির ঘাড়ে চাপিয়েছেন নির্বাচন হবে সেই সংবিধান অনুযায়ী। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেদিকে যাননি। তার বর্ণিত অসাংবিধানিক সরকারের বিষয়েও এ পর্যন্ত কম বলা হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক নামের যে সরকারকে উদাহরণ বানিয়ে বিরোধী দলকে তিনি জেলের ভাত খাওয়ানোর এবং রাজনীতি থেকে মাইনাস হওয়ার ভয় দেখাচ্ছেন সে সরকার তো ছিল তাদেরই ‘আন্দোলনের ফসল’! কথাটা প্রধানমন্ত্রীও সে সময় জোর গলায় বহুবার বলেছিলেন। প্রশ্ন হলো, নিজেদের আন্দোলনের সে ফসলকে নিয়েইবা তার এত ভীতি ও সংশয় কেন? মাত্র সেদিনের ঘটনা বলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করার পরিবর্তে আমরা মনে করি, সব পক্ষ যদি সততার সঙ্গে গণতন্ত্র ও সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে পারে এবং কোনো বিশেষ নেতা-নেত্রী যদি ক্ষমতায় আসতে পারবেন না বলে লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের মতো ভয়ঙ্কর পথে পা না বাড়ান, তাহলে কোনো ‘উদ্দিনদের’ পক্ষেই্ অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখল করা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। সেটা না করে কেউ বা কোনো দল যদি নিজেই গাছের গোড়া কেটে ওপরে ওপরে পানি ঢালার অভিনয় করে তাহলে আর যা-ই হোক, গণতন্ত্র ও সংবিধানকে সমুন্নত ও বাধাহীন রাখা যাবে না। এই সহজ কথাটা না বোঝার কোনো কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী সহজ ও গণতন্ত্রসম্মত সে পথেই আসতে চাচ্ছেন না। অন্যদিকে সাধারণ মানুষেরও কিন্তু মনে পড়ে গেছে, ২০০৮ সালের ডিজিটাল নির্বাচনে ঠিক কোন পন্থায় এবং কোন ‘উদ্দিনদের’ সাজানো ছক অনুযায়ী আওয়ামী লীগ এত বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসতে পেরেছিল। আমরা মনে করি, মানুষকে সেই ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়ার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর জন্য অন্তত সফলতা অর্জনের কিংবা লাভবান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। গণতন্ত্রের ব্যাপারে সত্যি সদিচ্ছা থাকলে তার বরং উচিত সময় থাকতে সংবিধানে সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা এবং তারপর নির্বাচন দেয়া।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads