বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে খুব বেশি আলোচনা-টালোচনা কোথাও দেখিনি।
অবশ্য এনাদের নিয়ে আলোচনার তেমন একটা সুযোগও খুব একটা হয়নি। এর কারণ প্রধানত এই
যে, এরা কোনো জাতীয় নির্বাচন হ্যান্ডেল করেনি। উপনির্বাচনে কী করেছে-না-করেছে
সে বিষয়ে কেউ কোনো পরোয়াও করেনি। সবাই ধরে নিয়েছিলেন যে এই নির্বাচন কমিশন
সরকারের তাঁবেদারিই করত। স্থানীয় সরকার নির্বাচন এরা যা করেছে তাকে বলিহারি বলতে
হয়। যেমন নরসিংদী, সেখানে অত্যন্ত জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেনকে যিনি খুন করেছেন বলে
অভিযোগ, সরকার তাকে নানা কৌশলে নির্বাচনে প্রার্থী সাব্যস্ত করেছে। তা নিয়েও
নরসিংদীর ছোট শহর প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। নির্বাচন কমিশনের শত চেষ্টা
সত্ত্বেও তারা নারায়ণগঞ্জে মেয়র হিসেবে শামীম ওসমানকে জিতিয়ে আনতে পারেনি।
সেখানে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা বলা যায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী
প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভি।
নির্বাচন কমিশনের সম্ভবত সাধ্য ছিল না আইভিকে হারিয়ে দেয়ার কিংবা
শামীম ওসমানকে জিতিয়ে আনার। শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে জনরোষ এতই প্রবল ছিল যে
নির্বাচন কমিশনের সীমিত সাধ্য দিয়ে ডা: আইভিকে হারানোর সম্ভব হয়নি। আওয়ামী
লীগের নির্ধারিত প্রার্থী শামীম ওসমানকে হারিয়ে তিনিই জয় লাভ করেছেন। সেখানকার
মানুষও দেখিয়ে দিয়েছেন যে যদি তারা সুযোগ পান তা হলে আওয়ামী লীগকে তারা একেবারে
নাস্তানাবুদ করে ছাড়বেন।
নরসিংদীতেও প্রায় একই ঘটনা ঘটল। সরকারের তরফ থেকে যাকে প্রার্থী
দেয়া হলো তিনি একেবারেই নাস্তানাবুদ হয়ে গেলেন জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেনের
ভাই কামরুজ্জামানের কাছে। এসব নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের একটি নিজস্ব ভাষা আছে। আর তা
হলো জনগণের আবেগ লোকমান হোসেনের ভাই কামরুজ্জামানের প্রতি সাধারণ মানুষের অপরিসীম
সহানুভূতি জন্মেছে। এই বিশাল সহানুভূতি পেরিয়ে কারো পক্ষে জিতে আসা খুবই কঠিন
কাজ। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে সত্তরের দশক থেকে এ পর্যন্ত এ রকম ভাষাই
ব্যবহৃত হতে শুনে আসছি। সরকারপক্ষ যখন হেরে যায় তখন তাদের সান্ত্বনা হয় এইÑ এ ক্ষেত্রে জনগণের আবেগ এতটাই কাজ করেছে যে, তাকে কোনো
প্রতিশ্রুতি দিয়েই রোধ করা সম্ভব হয় না।
এ ছাড়াও আরো বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতেও সব
জায়গায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জিতিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। দুই-এক জায়গায়
আওয়ামী লীগ প্রার্থী জিতেছেন বটে। কিন্তু অন্যান্য স্থানে জিতেছেন বিরোধী দলের
প্রার্থী। একেবারে ছিল্লাবিল্লা করে সব আসন নিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। সম্ভব হয়ও
না। কেউ যদি সেভাবে গুছিয়ে দেয়, তা হলে সম্ভব হয়। যেমন ২০০৮ সালের নির্বাচনে মইনউদ্দিন, ফখরুদ্দীন আর ড. শামছুল
হুদা এ ‘ত্রিরতœ’ মিলে আওয়ামী লীগকে একেবারে
বেছে বেছে গুছিয়ে জিতিয়ে দিয়ে গেছে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয় তুলনামূলক ছোট পরিবেশে। এখানেই প্রায়
প্রত্যেকেই প্রত্যেককে চেনেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন কমিশন বা
সরকার এখন পর্যন্ত দখল করে নেয়ার মানসিকতা খুব একটা দেখায়নি। সরকার এখানে পুলিশ
বা মাস্তান দিয়ে খুব বেশি শক্তি ক্ষয় করতে চায় না। আবার পৌরমেয়র যিনিই হোন না
কেন, সরকার চাপাতে চাপাতে তার অবস্থান এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে, তাকে ইউএনওর
নির্দেশ মেনে চলতে হয়। তা ছাড়া তার ওপরে ‘মহাপ্রভু’ হিসেবে তো এমপি সাহেব আছেনই
অর্থাৎ নির্বাচন যতই হোক না কেন, পৌরমেয়র কার্যত এক ঠুঁটো জগন্নাথ।
এ নিয়ে এরা অনেক আন্দোলন করেছেন। অসহযোগিতা করেছেন। কিন্তু ফল
শূন্যই রয়ে গেছে। স্থানীয় সরকারের স্বাধীনতার যে কথা সংবিধানে লিপিবদ্ধ আছে, তা সেখানেই
ম্লানমুখে তাকিয়ে আছে। তার পরও পৌরমেয়রদের খুশি করতে সরকার তাদের একটি করে নতুন
গাড়ি দিয়েছেন। গাড়িতে সরকারি মনোগ্রামসংবলিত মার্কাও সাঁটা আছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। এর
অধিক আর কিছুই নেই। কিন্তু তাদের আশা আছে কোনো একদিন তারা তাদের ন্যায্য ক্ষমতা
ফিরে পাবেন এবং জনকল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন। জানি না, সেই সুদিন কবে
আসবে। আগে পৌরসভার প্রধানেরা চেয়ারম্যান বলে চিহ্নিত ছিলেন। কিন্তু তাদের সব
ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে নাম দেয়া হয়েছে মেয়র। ঢাকা মহানগরীর নির্বাচিত সদস্যও মেয়র, নরসিংদী পৌরসভার
নির্বাচিত সদস্যও মেয়র। এতে সম্ভবত দোষের কিছু নেই। ঢাকা মহানগর স্থানীয় সরকার, মুন্সীগঞ্জ
পৌরসভাও স্থানীয় সরকার; তা হলে উভয়েরই মেয়র হতে দোষ কোথায়?
দোষের কথা আমাদের কাছে প্রধান নয়, এখন টানটান উত্তেজনা ও
ঘটনাবহুল পরিস্থিতির ভেতর চার সিটি করপোরেশন রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট ও খুলনায়
মেয়র পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এগুলো পৌরসভা নয়, এগুলো মহানগর। এখানে জনসংখ্যা
বেশি, বাজেট বেশি, জনকল্যাণের সুযোগও সম্ভবত বেশি। আর এসব বড় শহরের এমপিদের হাত খুব
বেশি সম্প্রসারিত হয় বলে মনে হয় না। ফলে এগুলো সম্মানজনক স্থানীয় সরকার। এখানে
খুব বেশি ‘চুদুরবুদুর চলে না’। ফলে প্রকৃত নির্বাচনী পরীক্ষা দাঁড়ায় সেসব স্থানীয় সরকার
নিয়েই। আর নির্বাচন কমিশনের চেহারাও এখানেই উন্মোচিত হয়ে পড়তে থাকে। সে চেহারা
এখন উন্মোচিত প্রায়। বিভিন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত নীতিমালা সরকারি মন্ত্রী, উজির, নাজির, পৌর চেয়ারম্যান
কেউই বিন্দুমাত্র পরোয়া করছেন না। এখানেও সরকার যেন চাইছে ছলে-বলে-কলে-কৌশলে
নির্বাচনে জিততেই হবে। তেমনি নির্বাচন কমিশনার যেন তাদের জেতাতে দুই পায়ে খাড়া।
বাংলাদেশের সবাই দেখেছেন যে, সরকারি লোকেরা কিভাবে
নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন। আর কমিশন মুখে কুলুপ এঁটে চুপচাপ বসে আছে। যেন
স্থানীর সরকারের পৌরসভা পর্যন্ত তো চুপচাপই ছিলাম। তখন কেউ কথা বলেনি, এখন সিটি
করপোরেশন নির্বাচন আসামাত্রই বলতে শুরু করেছেন ‘জাত গেল, জাত গেল’। এটি তো ভালো কথা নয়। কার্যত আমরা তখনো যা করেছি, এখনো তাই করছি।
সুতরাং আমাদের দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। নির্বাচন এ রকমই হয়। এ হাঁকটি নির্বাচন
কমিশন এখনো দেয়নি। কিন্তু দিতে যে খুব বেশি দেরি সেটি এখন আর মনে হচ্ছে না।
নির্বাচন কমিশন নানা কাজ করে যাচ্ছে। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনীর সাথে বৈঠকে বসছে, বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকা সফর করছে। ঝুঁকিপূর্ণ নির্বাচনী আসনগুলো
চিহ্নিত করছে। কাজ তো আর কম না। সাংবাদিকেরা আছেন শুধু সমালোচনা নিয়ে। এই হলো না, ওই হলো না, সেই হলো না। কোনো
দিন কাউকে বলতে শোনা গেল না যে, এই হলো, ওই হলো, সেই হলো। এই নেতিবাচক প্রচারণার জন্য গোটা জাতি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে, এটি কিছুতেই মেনে
নেয়া যায় না। এটি সরকারের ভাষা, তেমনি নির্বাচন কমিশনের ভাষাওÑ এ থেকে খুব একটা
দূরে হওয়ার কথা না। এখনো সরবে প্রচার হচ্ছে না। সেটি প্রচার হতে আর দুই-এক দিন
লাগবে বলে মনে হয়।
বর্তমান স্থানীয় সরকার নির্বাচন কোনো দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়
না। এতে কোনো দলীয় মার্কাও ব্যবহৃত হয় না। দলীয় লোকদের এ প্রচারণায় যাওয়াও
নিষেধ। সরকারি উপায় উপকরণ ব্যবহারও নিষেধ অর্থাৎ যে যা কিছু করবে সব কিছু নিয়ম
মেনেই করবে। তবে হ্যাঁ, এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিএনপি আছে। ফলে আওয়ামী লীগের লোকেরা
সরকারি সব সুবিধা নিয়ে নির্বাচনী মাঠ চাঙ্গা করে তুলেছে। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় বলেই সিটি করপোরেশন
নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের অধীনে যদি সিটি করপোরেশন
নির্বাচনসহ সব নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন তা হলে আওয়ামী লীগের অধীনে জাতীয় সংসদ
নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না কেন? এটি হক কথা। কিন্তু জনতার
জোয়ারে এসব হক কথা কখনো কখনো দমকা হাওয়ায় উড়ে চলে যায়। এক দিন আগে লেখা এ
কলাম যখন পাঠকের হাতে পৌঁছাবে তখন নির্বাচনের ইতিবাচক-নেতিবাচক সব দিকই স্পষ্ট
হয়ে যাবে। সরকারের ভূমিকা, বিরোধী দলের অবস্থান, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, ইসির বিশ্বাসযোগ্যতা
কিছুই চাপা থাকবে না। পরিস্থিতিই বলে দেবে জনগণকে কখন কী করতে হবে।
দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টেলিভিশন সরকার বন্ধ করে দেয়ায় একটি
সংবাদপত্র তার জরিপে দেখিয়েছে যে টেলিভিশনের দর্শন বিপুলভাবে হ্রাস পেয়েছে। একটা
টেলিভিশন চ্যানেল নেই তো কী হয়েছে, আরো ডজন ডজন টেলিভিশন চ্যানেল
আছে। জনগণ সেগুলো দেখুক। তাদের তো কেউ বাধা দেয়নি। আর জনগণ দেখতে না চাইলে সরকার
তো আর চ্যানেল খুলে তাদের চোখ টানটান করে রাখতে পারবে না। কিন্তু সরকারকে এই
ইনডিকেটর বুঝতে হবে যে, জনগণ কী চায়। শেখ হাসিনার সরকার বাহাদুর অবশ্য এমনও জানান দিয়েছেন
যে, ২০২১ সাল পর্যন্ত তারা ক্ষমতায় থাকবে। আর এক লাঠিয়াল আওয়ামী নেতা
বলেছেন, শেখ হাসিনা যদি কারো কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তা হলে তিনি
অনন্তকাল ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন।
ব্যক্তিগতভাবে ১৯৬৮-৬৯ সাল থেকে ক্ষমতায় অনন্তকাল থাকা-না-থাকার
দ্বন্দ্ব দেখে আসছি। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতায় থাকার বহুত কোশেশ করেছিলেন।
কিন্তু থাকতে পারেননি। স্বাধীন বাংলাদেশের একেবারে শুরুতে শেখ মুজিবুর রহমান
একইভাবে অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকার জন্য সংবিধান সংশোধন করেছিলেন। এরপর অল্প কয়েক
মাসেই তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। ২০২১ সাল পর্যন্ত আমি বাঁচব কি না জানি না, মহান আল্লাহ
তায়ালাই সে কথা জানেন। বাঁচলে হয়তো দেখে যাবো, ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি
ক্ষমতায় আছেন কি নেই?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন