রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল- এই চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে দেশের জনগণের মধ্যে বেশ আগ্রহ ও কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছিল। জাতীয় নির্বাচনের আগে চার সিটির নির্বাচন নিয়ে মহাজোট ও ১৮ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা যেভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছিল তাতে এই নির্বাচনের গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, এই নির্বাচনের প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বে। ফলে চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও, এটি যেন জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি ব্যারোমিটার হয়ে উঠেছে। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেল, চারটি সিটিতেই মহাজোট সমর্থিত প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরাজয়বরণ করেছে, বিজয়ী হয়েছে বিরোধী ১৮ দল সমর্থিত প্রার্থীরা। এমন পরাজয়ে সরকারি ঘরানার নেতা-কর্মীদের মধ্যে নেমে এসেছে হতাশা।
চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আমরা মোটামুটিভাবে গণতন্ত্র চর্চার একটি চিত্র লক্ষ্য করলাম। তবে এই নির্বাচনেও সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের ভয়ভীতি, বাধা ও হুমকির ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে। এ প্রসঙ্গে বরিশালে পরাজিত মেয়র প্রার্থী হিরণ ও তার সমর্থকদের তা-বের কথা উল্লেখ করতে হয়। তারা প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থীর ওপর হামলা করেছে এবং তাদের হামলায় সাবেক এমপি আবুল হোসেন এখন হাসপাতালে। এমন আচরণ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে খুবই মন্দ উদাহরণ। তবে আশার কথা হলো এই যে, জনগণ ভয়ভীতি ও বাধা উপেক্ষা করে ভোট প্রদানের দায়িত্ব পালন করেছে এবং যার যা প্রাপ্য তা বুঝিয়ে দিয়েছে। এ কারণে আমরা বলতে পারি, চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, আমাদের জনগণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-দীক্ষায় ততটা অগ্রসর না হলেও, বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারা ভুল করেনি। তাই বলতে হয়, বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিকভাবে বেশ শিক্ষিত। রাজনীতিবিদরা কিংবা মেয়র প্রার্থীরা তাদের সাথে ওয়াদা করে ভুলে যাবেন, নির্বাচনী ওয়াদা কিংবা ইশতেহার ছুঁড়ে ফেলে দেবেন, তারপরও এদেশের জনগণ যথাসময়ে যথা সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করবেন তেমনটি আশা করা যায় না। এবারের চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আমরা জনগণকে পরিপক্ক রায় প্রদান করতেই দেখলাম। আমরা জানি সিটি করপোরেশন নির্বাচন একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এ নির্বাচনে স্থানীয় সমস্যা, সম্ভাবনা, উন্নয়ন ও স্থানীয় জনগণের সুবিধা-অসুবিধার দিকগুলোই বিশেষভাবে গুরুত্ব পাওয়ার কথা। কিন্তু এবারের নির্বাচনে লক্ষ্য করা গেল, স্থানীয় বিষয়গুলোর চাইতেও জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষার বিষয়গুলো যেন অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। দেশের কোটি কোটি মানুষের সাথে ঐ চার সিটি করপোরেশনের মানুষও লক্ষ্য করেছে, বিগত বছরগুলোতে বর্তমান সরকার কিভাবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর জেল-জুলুম ও নিপীড়ন চালিয়ে গেছে। তারা লক্ষ্য করেছে, সরকারদলীয় ক্যাডার ও সন্ত্রাসীরা কিভাবে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করেছে। পুলিশ ও প্রশাসন এসব দুষ্ট লোকদের দমন না করে বরং বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর নির্মম নির্যাতন করে এক ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। দেশে সরকার থাকার পরও হলমার্ক, ডেসটিনি ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির মত একের পর এক দুর্নীতির ঘটনা ঘটে গেছে। রেল দুর্নীতি ও কালো বিড়ালের গল্প জনগণের মুখে মুখে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কট, যানজট ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনদুর্ভোগের মাত্রা আরো বৃদ্ধি করেছে। এছাড়া সরকার জাতীয় বহু বিষয়কে কম গুরুত্ব দিয়ে দলীয় রাজনীতির স্বার্থে এমন কিছু ইস্যু সৃষ্টি করেছে যা জনমনে বিরক্তির উদ্রেগ করেছে। আমরা জানি, বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবর রহমান যুদ্ধাপরাধ বিষয়টির একটি সুরাহা করে গিয়েছিলেন। তার বিবেচনাকে পাশ কাটিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুটিকে নতুন মাত্রায় চাঙ্গা করা হলো। পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, স্বচ্ছ বিচারের চাইতেও সরকারের রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাওয়ায় যুদ্ধাপরাধ বিষয়টি জাতির মধ্যে বিভক্তির সৃষ্টি করেছে। সবশেষে শাহবাগ মঞ্চের ব্লগারদের প্রশ্রয় প্রদান ও হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের নিষ্ঠুরভাবে দমনের চিত্র জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে এসব বিষয়ের প্রভাব পড়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।
সরকারের নীতি-নির্ধারকরা এবং দেশের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার আকাক্সক্ষা প্রায়শই উচ্চারণ করে থাকেন। কিন্তু এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কথার সাথে কাজের মিল থাকা। আচরণে গরমিল থাকায় এখন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হলেই সরকার গণতান্ত্রিক হয়ে যায় না। গণতান্ত্রিক হওয়ার জন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক আচরণ। আচরণে সঙ্কট থাকায় নির্বাচনের পর আমরা গণতান্ত্রিক সমাজের বদলে পাই জুলুম-নির্যাতন ও নিপীড়নের এক অমানবিক সমাজ। এমন সমাজ জনগণ চায় না, এমন সমাজের জন্য জনগণ ভোটও দেয় না। বিষয়টি জনগণের মনে থাকলেও ক্ষমতার আসনে বসার পর ক্ষমতাসীনরা বেমালুম ভুলে যায়। এমন চিত্রে জনগণ সংক্ষুব্ধ হয় এবং যথাসময়ে রায় দেয়ার অপেক্ষায় থাকে। এবার চার সিটি নির্বাচনে আমরা জনগণের তেমন ভূমিকাই লক্ষ্য করেছি। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল থেকে সরকারের জন্য শিক্ষণীয় বহু বিষয় রয়েছে। সরকার শিক্ষাগ্রহণ করলে হয়তো গণআকাক্সক্ষার অনুকূলে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। এতেই সবার মঙ্গল। কিন্তু সরকারের মধ্যে এমন বোধোদয় ঘটবে কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন