রবিবার, ২৩ জুন, ২০১৩

সন্ত্রাসবিরোধী আইন : উদ্দেশ্য ও বাস্তবতা

সদ্য পাস হওয়া ‘সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) বিল ২০১৩ সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনেরা মনে করেন এটি ১৯৭৪ সালে প্রণীত বিশেষ ক্ষমতা আইনের চেয়েও ‘ভয়ঙ্কর মৌলিক মানবাধিকারও চরমভাবে লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিএনপি ও তার মিত্রদের অভিযোগ সরকার শুধু বিরোধী দলের গণ-আন্দোলন দমনের জন্য এ আইনে সংশোধনী এনেছে। এর প্রতিবাদে বিলটি পাসের মুহূর্তে এরা সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছেÑ ‘বিলটি বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি ও নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিল।’ 
সরকার মূল আইনটি ২০০৯ সালে সংসদে পাস করে। তিন বছর যেতে না যেতেই সরকার আইনটি সংশোধন করে, যা ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করে এবং গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এক বছর পর আবারো সংশোধনের উদ্যোগ নেয় সরকার। বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিলটির খসড়া এবারের বাজেট অধিবেশনের প্রথম দিন ৩ জুন সংসদে উত্থাপন করেন। সংসদের কার্যপ্রণালীবিধির ২৪৬ বিধি অনুসারে খসড়া বিলটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠায়। অতি অল্প সময়ের মধ্যেÑ দিনের হিসাবে মাত্র সাত দিন, আর ছুটির দিন বাদ দিলে মাত্র পাঁচ দিনÑ কমিটি বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সক্ষম হয়। বিলটি পড়ে পুরোপুরি বুঝতে যেখানে কয়েক দিন লাগার কথা; সেখানে মাত্র পাঁচ থেকে সাত দিনে কমিটির সদস্যরা একটি জটিল আইনকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজটি কিভাবে সম্পন্ন করলেনÑ প্রশ্নটি রয়েই গেল। আবার সংসদীয় স্থায়ী কমিটির দাবিÑ এরা নাকি বিলটির গুরুত্ব বিবেচনা করে ‘অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে এর খুঁটিনাটি দিক গুরুত্ব সহকারে পরীক্ষা করেছেন।’
বিলটিতে বিরোধী জোটের বেশির ভাগ এমপি অনেক ‘সংশোধনী প্রস্তাব’ আনেন। অনেকেই আবার এটাকে প্রত্যাহারের দাবিও জানান। সংশোধনী প্রস্তাবের পক্ষে সংসদে আলোচনায়ও অংশ নেন। তুলে ধরেন অনেক যুক্তিতর্ক। এসব যুক্তিতর্কের ধারধারেনি সরকার। বাতিলের দাবি মেনে নেয়া তো দূরের কথা, একটি সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণেরও প্রয়োজনীয়তা মনে করেনি সরকার।
সংশোধিত এ আইনের ২১ ধারার (৩) উপধারায় বলা হয়েছেÑ ‘কোন সন্ত্রাসী ব্যক্তি বা সত্তা কর্তৃক ব্যবহৃত ফেসবুক, স্কাইপি, টুইটার বা যেকোনো ইন্টারনেটের মাধ্যমে আলাপ আলোচনা ও কথাবার্তা অথবা তাহাদের অপরাধসংশ্লিষ্ট স্থির বা ভিডিও চিত্র পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক কোন মামলার তদন্তের স্বার্থে যদি আদালতে উপস্থাপন করা হয়, তাহা হইলে সাক্ষ্য আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, পুলিশ বা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক আদালতে সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণযোগ্য হবে।’ পুলিশের এ ‘সাক্ষ্য’র ভিত্তিতে একজন ফেসবুক বা অন্য মাধ্যম ব্যবহারকারীকে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের জেলের ঘানি টানতে হতে পারে।
প্রচলিত স্যা আইনে এ ধরনের আলামত আদালতে গ্রহণযোগ্য নয়। আর তাই ‘যাহা কিছুই থাকুক না কেন’Ñ এমন অংশের সংযোজনের মধ্য দিয়ে এ আইনে স্পষ্টভাবে স্যা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সরকার ফেসবুক-টুইটার ব্যবহারকারীদের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করেছে। অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্ক ব্যবহারে সাবধান করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে সরকার একজনের ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং তার চিন্তা ও সমালোচনার স্বাধীনতার ওপর সুস্পষ্টভাবে হস্তক্ষেপ করেছে, যা মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন। সংবিধানের ৪৩ ধারায় বলা হয়েছেÑ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের মাধ্যমে আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেে প্রত্যেক নাগরিকের প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক হতে নিজ গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকবে এবং চিঠিপত্র ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রার অধিকার থাকবে। এ অবস্থায় সামাজিক মাধ্যমের আলোচনা আলামত হিসেবে আদালতে উপস্থাপিত হলে জনগণের গোপনীয়তা বিঘœ হবে।
ভিন্নমতাবলম্বীদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে এ আইনে। যারা সামাজিক যোগাযোগের এসব মাধ্যম ব্যবহার করেন, তারা সাধারণত শিক্ষিত শ্রেণীর ভদ্র ও মার্জিত স্বভাবের। এদের বেশির ভাগ সময় বাসায় কিংবা নিজ অফিসে কাটে, যা সন্ত্রাসী চরিত্রের বিপরীত। এই বিল পাসের মধ্য দিয়ে পুলিশকে অপরিসীম ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যে ক্ষমতার একটা অংশ বিচারক-জজ সাহেবদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া। পুলিশও আমাদের ভাই। আমরা তাদের ক্ষমতা বাড়ানোর বিরোধিতা করতে পারি না; কিন্তু যে ক্ষমতা বিচারক-ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া, সাধারণ জনগণের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে প্রদান করা, এমনকি পুলিশ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ক্ষমতা খর্ব করে এ ক্ষমতা বাড়ানো আমরা তো এমন অপরিসীম ক্ষমতাকে মেনে নিতে পারি না।
এ আইনের ফলে একজন পুলিশ পরিদর্শক একজন সাংবাদিককে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করতে পারবে, ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া যেকোনো নাগরিকের মালামাল ক্রোক করতে পারবেÑ এমনটি মেনে নেয়া কিভাবে সম্ভব হতে পারে? এখন কথা হলো ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে একজন ব্যক্তিকে সন্ত্রাসী বানানো কিংবা অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করার কোনো যুক্তি আদৌ আছে কি? ‘নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবির। তার রয়েছে হাজারো ফেসবুক ফ্রেন্ড। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। অনেকেও আবার তার ফেসবুকে ট্যাগ করে, তার সাথে শেয়ার করে, তার স্ট্যাটাসে কমেন্ট করে। এ সম্পাদকের সাথে অনেকে চ্যাটও করে।’ কিন্তু নুরুল কবিরের নিজের ভাষ্য- তার কোনো ফেসবুক আইডি নেই। কাউকে এমনটি করতেও বলেননি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব:) তাজুল ইসলামকে কয়েক দিন আগে গুলশানের একটি হোটেলে একটি অনুষ্ঠানে বলতে শুনেছি- তার নামে ফেসবুকে একটি ভুয়া আইডি ছিল। বিষয়টি তার গোচরে আসার পর তিনি বন্ধ করার উদ্যোগ নেন। এ দু’টি উদাহরণের পর আমাদের কাছে বার্তা স্পষ্ট।
যদিও আমার চিন্তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, তবুও ধরে নিলাম এ আইনের পর ভয়ে হোক কিংবা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে হোক- ফেসবুক-টুইটারে সরকার কিংবা অন্য কারো সমালোচনা বন্ধ করে দিলাম। এমনকি আমি এসব মাধ্যম থেকে ডিঅ্যাক্টিভেটও হয়ে গেলাম। তাতেও কি রেহাই পাওয়া যাবে? মোটেও না। আমার অজান্তে আমার নামে নুরুল কবির কিংবা তাজুল ইসলামের মতো কেউ আইডি খুলে যা খুশি তা যে লিখবে না, তার কি নিশ্চয়তা আছে? একজন আমার ফেসবুকে আমার স্ট্যাটাসে প্রায়ই কমেন্ট করতেন। এখন লাইকও দেন না। তিনি নিজেও আগের মতো স্ট্যাটাসও পোস্ট করেন না। বিষয়টি তার দৃষ্টিতে আনলে আমাকে বলেন, ‘তোমার আঙ্কেল ফেসবুক ব্যবহারে সতর্ক হতে বলেছেন’। তার বুয়েটে পড়–য়া সন্তানসহ অন্য নিকটজনেরা এখন ফেসবুক ব্যবহারে খুবই সতর্ক। যদিও তাদের কষ্ট হচ্ছে। অন্য দিকে জানা একটি ঘটনা আমাদেরকে আরো ভাবিয়ে তোলে। বিগত এইচএসসি পরীক্ষার মাত্র কয়েক দিন আগে এক রাতে পুলিশ বাসায় হানা দিয়ে ধরে নিয়ে যায় এক পরীক্ষার্থীকে। কেউ কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি। কী দোষ ছিল তার? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তার এক বন্ধু যে কিনা সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মী। ওই বন্ধুটির সাথে কয়েক সপ্তাহ আগে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিল। তখন সে হুমকি দিয়ে বলেছিল দেখে ছাড়বে। হুমকি অনুযায়ী পরিকল্পনার ছক। এইচএসসি পরীক্ষার্থী বন্ধুর নামে ফেসবুকে ভুয়া আইডি খুলে সেখানে দেয়া হয় সরকারবিরোধী বেশ কয়েকটি স্ট্যাটাস। ব্যস! সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে রাত্রি-নিশিতে এ গ্রেফতার অভিযান। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads