মঙ্গলবার, ১১ জুন, ২০১৩

এখন সব কিছুই সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কবলে


পৃথিবীতে দুর্নীতি নিয়ে যারা কাজ করেন তারা দুর্নীতির এমন গহীন ভিতরে যান কিনা সে বিষয়ে বিপুল সন্দেহ বিদ্যমান। তা যদি যেতেন তাহলে বাংলাদেশের কর্মকা- দেখে তারা শুধু চমৎকৃতই হতেন না, সম্ভবত একথা ভাবতে গিয়ে শিহরিত হয়ে উঠতেন। এখানে সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ আদরের ধন। দুর্নীতি যে কোথায় হচ্ছে না সেটি আমাদের পক্ষে বের করা সম্ভব নয়। দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতি এখন বাংলাদেশে সর্বগ্রাসী রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে।
অথচ এই দুর্নীতি নিয়ে হেন কোনো গীবত নেই যা সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার আগ পর্যন্ত অবিরাম ক্রসে গেছে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক নামক যে জালেম সরকার এ দেশে আবির্ভূত হয়েছিলো সেটি সম্পর্কে একেবারে চুপ ছিলেন। বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনা চুপ থাকার কারণ পরে আর অস্পষ্ট থাকেনি। খেল দেখিয়েছিলেন তৎকালের ব্যবসায়ীদের প্রধান সংগঠন এফবিসিসিআই এর প্রধান আনিছুল হক। ঐ দুই বছরের জালেম সরকারের দোর্দ- প্রতাপ ও দুর্নীতি এমন জায়গায় পৌছেছিল যে, ঘটনা জেনেই আনিছুল হক দাবি করেছিলেন ৫০০ টাকার নোট বাতিল করা হোক। তাহলে প্রমাণিত হবে যে, কার কাছে কী পরিমাণ দুর্নীতির টাকা আছে। আনিছুল হক দুরদর্শী লোক। ২০০৭-০৮ সালে দুর্নীতির বিপুল টাকা কোথায় ছিলো তা কারো অজানা নয়।
আনিছুল হক নিজেও জানতেন এ নিয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে না। কারণ সেই সময়, সম্ভবত তিনি মনে করেছিলেন যে দুর্নীতির বিপুল টাকা মঈন-ফখর সরকারের লোকদের বাক্সে বন্দী আছে। এফবিসিসিআই এর প্রধান আনিছুল হকের এই আহ্বানের পর সরকারের মিডিয়ায়ই যেন এক বিপ্লব ঘটে গেল। সরকারি মিডিয়া থেকে মুহুর্মুহু প্রচার শুরু হলো যে, ৫০০ টাকার নোট বাতিলে সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই। এ ব্যাপারে কেউ যেনো কোনো প্যানিক সৃষ্টি না করে। অবরুদ্ধ বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমগুলো সরকারের এই গীত প্রচার করতে থাকলো। সন্দেহ নেই তারা নিরুপায় ছিলো। সেই ভানুমতির খেল কারোরই ভুলে যাবার কথা নয়।
আমাদের সকলেরই তখন দুগ্ধ-পোষ্য শিশু ছিল না। আমরা বয়োঃপ্রাপ্ত ছিলাম। বেশিরভাগ মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রবীণ ছিলেন। তারা উপলব্ধি করেছিলেন যে, এফবিসিসিআই দাবি করলো আর সরকার হুট করে এতোটা উতলা হয়ে উঠলো কেনো। সরকারের এমন উতলা হওয়ার পেছনে সুষ্পষ্ট কারণ ছিলো এই যে, যারা তখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছিলেন তাদের দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছিলো। দোকানদার, আড়তদার, পাইকার, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি কেউই তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। টাকা না পেলে তারা যে কি ভয়াবহ নির্যাতন করেছে সে কাহিনীর সামান্য অংশ আমরা সিরডাপে অনুষ্ঠিত এক অলোচনা সভা থেকে জানতে পেরেছি। নখের নিচে সুচ, গরম ডিম, ঠা-া আইচ-বার এগুলো সম্পর্কে সচেতন প্রায় সকল নাগরিকই অবহিত ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।
কিন্তু ধীরে, অতি ধীরে সমুদ্রের বিশাল জলোচ্ছ্বাসের মতন যখন সর্বশ্রেণীর মানুষ চতুর্দিক থেকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো তখন ৫০০ টাকার নোট ওয়ালারা কোথায় যেনো থমকে দাঁড়ালেন। এক লাখ লোকের বিপরীতে ১৬ কোটি মানুষ যখন নিঃশব্দে আস্তে আস্তে পর্বত-প্রমাণ উঁচু হয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করে তখন প্রতিরোধের চেয়ে পালাবার পথ খোঁজাই বেহতের হয়ে ওঠে।
মঈন-ফখর সরকারের অবস্থাও ঠিক তেমনি দাঁড়িয়েছিলো। তারা তখন পালাবার পথ খুঁজছিলো। অর্থাৎ এমন কারো কাছে তাদের ক্ষমতা দিয়ে যাওয়া দরকার যারা তাদের সকল দুর্নীতি ও দুষ্কর্মকে আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখতে পারে এবং সেটির বিচারের পথ চিরতরে রুদ্ধ করে যেতে পারে। এটি সমঝোতার প্রশ্ন। ক্ষমতায় আসীন হয়েই মঈন-ফখর সরকার বিএনপি বিনাশে এক যুদ্ধ ঘোষণা করে বসলো। যে যুদ্ধ ঘোষণার তারা কেউ ছিলো না। তাদের দায়িত্ব ছিলো দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জীবন উৎসর্গ করার। বিএনপি বিনাশ নয়। কিন্তু বিএনপি বিনাশের মিশন নিয়েই তারা যাত্রা শুরু করেছিলো। বিএনপির শত শত নেতা আর হাজার হাজার কর্মীকে তারা কারারুদ্ধ করেছিলো। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান (তৎকালে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব) তারেক রহমানের মেরুদ-ের হাড় ভেঙ্গে দিয়েছিলো। আর বাইরে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা অবিরাম করতালি দিচ্ছিলেন, চালিয়ে যান। বিষয়গুলো সাংবিধানিক হচ্ছিলো কি হচ্ছিলো না ভাববার দরকার নেই। আওয়ামী লীগ যদি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসে তাহলে সংবিধান সংশোধন করে এর বৈধতা দেবেন। রাজনীতিবিদ আর কাকে বলে!
এই ভিত্তি ভূমির ওপর ভর করে মরহুম আব্দুল জলিলের ভাষায় ‘পাতানো নির্বাচনের’ মাধ্যমে শেখ হাসিনা ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় আসীন হন। তখনো তিনি অবিরাম তারেক রহমান ও বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কাল্পনিক নানা অভিযোগ উত্থাপন করেন। মঈন-ফখর তো নিজেরাই বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিলো। ঠুঁটো জগন্নাথ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. শামছুল হুদা বেগম খালেদা জিয়াকে চিনতেই পারছিলেন না। মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে বিএনপিকে ভাঙ্গার চেষ্টা করেছিলো। সেও নির্বাচন কমিশনের ইতিহাসে এক মহাকলঙ্কজনক অধ্যায়।
এই কমিশনই আওয়ামী লীগ ভাঙ্গারও কম চেষ্টা করেনি। সেটি বোধ করি শুরুতে সমঝোতার অংশ ছিলো না। ক্ষমতা এমনই মজাদার ব্যাপার যে, কেউ কখনোই তা ছাড়তে চায় না। প্রত্যেকের ভাবখানা এমন যে, আমরা ক্ষমতায় এসেছি। অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকবো। কিন্তু অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকা যায় না। যদি কেউ উৎখাত নাও হয় তাহলে প্রাকৃতিক কারণে মৃত্যু এসে তাকে ক্ষমতা থেকে তুলে নিয়ে যায়। জনশ্রুতি আছে যে, আধুনিক মালয়েশিয়ার মহানায়ক ডা. মাহাথির মোহাম্মদ যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তখন তার মা নাকি তাকে বলেছিলেন, “বাবা ভাত পেট পুরে খেতে হয় না। যথেষ্ট হয়েছে। যথেষ্ট করেছো। এবার তুমি ক্ষমতা ছেড়ে দাও।” এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মাহাথির মোহাম্মদ ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে একজন বেসরকারি নাগরিক হয়ে যান।
রাজনীতির ঘাটে ঘাটে এমন শিক্ষার বহু ব্যাপার থাকে যেসব থেকে আমরা সাধারণত; কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করিনা। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেই একদিকে দুর্নীতি নিয়ে জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে বসলেন। অপরদিকে তার দল সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে ক্রমেই জড়িয়ে পড়তে থাকলো। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ঘর-বাড়ি দখল, হল দখল, দোকান-পাট দখল নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ালো। যতবার শেখ হাসিনার কাছে মিডিয়ার তরফ থেকে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলো ততবারই তিনি বললেন এইটুকু সময়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময়ে কি ঘটেছিলো সেটা মিলিয়ে দেখুন। দেখবেন সে তুলনায় কিছুই হয়নি। অর্থাৎ যারা এসব অপকর্মে লিপ্ত ছিলো শেখ হাসিনা তাদের আরো জোরেশোরে একই ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হবার প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় জানিয়ে দিলেন। নাগরিকের নিরাপত্তা হলো সূদুরপরাহত।
এরপর বিভিন্ন ইস্যুতে শত শত কোটি টাকার প্রমাণ মিলতে থাকলে মিডিয়া যতই নিয়ন্ত্রিত হোক তার ফাঁক-ফোকর দিয়ে সেসব তথ্য প্রকাশিত হতে থাকলো। কেনো প্রকাশিত হলো সেরকম একটি প্রতিহিংসার বশেই এখন আমার দেশ বন্ধ এবং এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান কারারুদ্ধ। অসুস্থ। বাংলাদেশ সরকার এইভাবে যে কী বিশাল দুর্নীতিবাজ সেটি মুখ ব্যাদান করে প্রকাশিত হয়ে পড়লো পদ্মা সেতু কেলেংকারিতে। এই কেলেংকারির সঙ্গে জড়িত সকল নামই আমরা জেনে গেছি। তারপরও আরো একটি নাম আছে যেটি কানাডিয়ান সরকার প্রকাশ করেনি। কার সেই নাম সেটিও নিশ্চয় এক সময় প্রকাশিত হবে। কানাডার আদালতে এসএনসি লাভালিয়ান কেলেংকারির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত যখন শুরু হবে তখন সে নাম আর গোপন থাকবে না।
তারপর সরকার এক আজব আইন করলো সে আইন হলো তেল-গ্যাস সংক্রান্ত কোনো চুক্তির বিষয়ে ভবিষ্যতে কোনদিন কোন আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। ধারণা করি, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। কেন চ্যালেঞ্জ করা যাবে না তার কারণ সম্ভবত এই যে, এর পেছনে সরকারের বড় বড় চাঁই জড়িত আছে। কিন্তু সরকার বুঝতেই পারছে না যে, ‘‘কে রুধিবে ঐ জোয়ারের জল, গগনে যখন উঠিবে চাঁদ”। এছাড়া হলমার্ক লুণ্ঠন, বিসমিল্লাহ গ্রুপের লুণ্ঠন, ডেসটিনির লুণ্ঠন ও প্রতারণা এখন এদেশের দুর্নীতির কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, হলমার্ক ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে এটা কোনো টাকাই না। তাহলে কোন্ নৈতিক অধিকারে খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এই সরকার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা চালিয়ে যাচ্ছে। কারো কি লজ্জা হয়?
সরকার পুলিশকে দিয়ে বিরোধী দল দমন করার চেষ্টা করছে। বিরোধী দলের চীফ হুইপকে যে পুলিশ কর্মকর্তা চরমভাবে মারধর ও লাঞ্ছিত করে সেই কৃতিত্বের জন্য তাকে প্রেসিডেন্ট পদক দেয়া হয়েছে। সবাইতো আর জয়নাল আবদিন ফারুখকে মারধরের সুযোগ পাচ্ছে না। তাহলে তাদের কি হবে। তারা এখন গ্রামে-গঞ্জে বেপরোয়া গ্রেফতার বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। মধ্যরাতে পোশাকে কিংবা সাদা পোশাকে গ্রামে গ্রামে হানা দিচ্ছে। গ্রেফতার করে আনতো বৃদ্ধ, শিশু, তরুণ, যুবকদের। তারপর অন্যায় ও জবরদস্তিমূলকভাবে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে শুরু করছে। সরকার দেখেও দেখছে না। তাদের ভাবখানা যেনো এমন এরা অনেক কষ্ট করেছে বিরোধী দলের নেতাদের হেভি পিটুনি দিয়েছে। কিছু টাকা তারা না হয় আদায় করেছে।

কিন্তু এরা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ইতিহাসও জানে না। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে রুশ সেনাবাহিনী যখন যুগোস্লাভিয়ায় মেয়েদের ওপর হামলা শুরু করলো তখন যুগোস্লাভিয়ার নেতা ব্রোজ টিটো জোসেফ স্ট্যালিনকে চিঠি লিখেছিলেন, আপনার সেনাবাহিনী যুগোস্লাভিয়ায় এমন অপকর্ম করছে। এটি বন্ধ করুন অথবা তাদের ফিরিয়ে নিন। যুদ্ধ তখন শেষ। স্ট্যালিন জবাবে লিখেছিলেন, আমার সৈন্যরা বরফের মধ্যে হাঁটু গেড়ে বছরের পর বছর যুদ্ধ করেছে আপনি তাদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ঐ চিঠির পর ব্রোজ টিটো সোভিয়েত বাহিনীকে পিটিয়ে যুগোস্লাভিয়া ছাড়া করেছিলেন। আর তারপর তিনি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহেরু, ইন্দোনেশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট সুকর্নো, মিশরের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসের, ঘানার প্রথম প্রেসিডেন্ট কওমি নকরুমাহকে নিয়ে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন গঠন করেন। ওনাদের জীবিত অবস্থা পর্যন্ত সে আন্দোলন অনেক জোরদার ছিলো তারপর সে আন্দোলন আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে যায়। ঢিলটি মারলে পাটকেলের জন্য অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে।
পুনশ্চ : বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান মহাদুর্নীতিবাজ এই গপ্পো গত ৮-১০ বছর ধরে আমরা ধারাবাহিকভাবে শুনে আসছি কিন্তু এর একটি ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তিকেও সাক্ষী হিসেবে হাজির করা সম্ভব হয়নি। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতির সাক্ষ্য দিতে সমাজের বেশ কয়েকজন বিত্তবান হাজির হয়েছিলেন। কীভাবে তারা শেখ হাসিনাকে উৎকোচ দিয়েছিলেন তার বিবরণও উল্লেখ করেছিলেন। এগুলো ইতিহাসের পাতা থেকে অতো দ্রুত মুছে যায় না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads