সম্ভবত গাফফার চৌধুরী নিজেকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অদ্বিতীয় আঁকড় মনে করেন। তিনি যা বোঝেন বা আমাদেরকে বোঝাতে চান তার সবই নিখুঁত ও নির্ভুল। অবশ্য মি. চৌধুরী নিজেকে এমন ভাবলেও দেশের মানুষ তাকে অন্যভাবে চেনেন এবং তাকে সেভাবেই মূল্যায়ন করেন। তিনি প্রবাসে বসে দেশের মানুষের জন্য যেসব নসিহৎ খয়রাত করেন, আর দেশের মানুষ এসব খয়রাতি তৎপরতা যেভাবে মূল্যায়ন করেন তা তিনি যদি উপলব্ধি করতে পারতেন তাহলে হয়তো হাস্যরস সৃষ্টির এসব অপতৎপরতা অনেক আগেই বন্ধ করতেন। কিন্তু আমাদেরই চরম দুর্ভাগ্য তিনি যে বয়োবৃদ্ধ সে সম্পর্কে কোন উপলব্ধিই রাখেন না বা বয়সের ভারে তার উপলব্ধি ক্ষমতা একেবারেই লোপ পেয়েছে। যদি দেশের মানুষের তার সম্পর্কে ধারণাটা তিনি যথার্থই বুঝতে পারতেন এবং আগামী দিনে তার কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে পারতেন। আর বুঝবেনই বা কী করে? তিনি তো আর দেশে থাকেন না! দেশে থাকলে জনগণের কাছে তার একটা দায়বদ্ধতা থাকতো। তার দায়বদ্ধতা নেই বলেই তিনি তো যা-ইচ্ছে তাই বলতে ও করতে পারেন।
কয়েক বছর আগের কথা। বিগত বিএনপি সরকারের সময়। দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার বগুড়া থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক উত্তর কোণ’ পত্রিকার একটি নিবন্ধ দেখে বেশ চমকেই উঠেছিলাম। নিবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘মডেলিং এ গাদ্দার চৌধুরী’। কিছুটা হতচকিত হয়ে নিবন্ধটা পড়তে থাকলাম। দেখলাম নিবন্ধকার জাফর ইকবাল দৈনিক জনকন্ঠে প্রকাশিত গাফফার চৌধুরীর একটি লেখার প্রত্যুত্তরে নিবন্ধটি লিখেছেন। নিবন্ধের মাঝে মাঝে মি. চৌধুরীর লেখাকে উদ্ধৃত করে নিবন্ধকার তার বক্তব্যের অসারতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। মূলত গাফফার চৌধুরীর লেখাটা ছিল বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কে তুলনামূলক আলোচনা। মি. চৌধুরী তার লেখায় অনাকাক্সিক্ষতভাবে তারেক রহমানের নানানভাবে চরিত্র হনন করে তুলোধুনো করেছিলেন এবং হাসিনা পুত্র জয় সম্পর্কে নানান ধরনের গুণকীর্তন করে নিবন্ধকারের ভাষায় পচা মাল (?) বাজারজাত করার ক্যানভাস করেছেন। এতে অবশ্য নিবন্ধের নামকরণের সার্থকতা আছে বলে মনে হয়েছে। মূলত তিনি একজন প্রধানমন্ত্রীর পুত্রকে যেভাবে আক্রমণ করেছিলেন এবং তার সম্পর্কে যেভাবে বল্গাহীন কথাবার্তা বলেছিলেন তা কোন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি বিশ্বাস করতে পারেন না। পক্ষান্তরে হাসিনা পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কে যেভাবে গুণকীর্তন করা হয়েছিল তাতে তো জয় সাহেবেরই লজ্জা পাওয়ার কথা। হাসিনা পুত্র লজ্জা পেয়েছেন কী-না জানি না তবে নিবন্ধকার কিন্তু ছেড়ে কথা বলেননি। গাফফার চৌধুরী যেমন অনাকাক্সিক্ষতভাবে রূপকথার গল্পের মাধ্যমে তারেক রহমানের চরিত্র হনন করার অপপ্রয়াস চালিয়েছেন, ঠিক তেমনিভাবে নিবন্ধকার প্রামাণ্য তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে হাসিনা পুত্রের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করেছিলেন। গাফফার চৌধুরী যদি তারেক জিয়াকে আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত না করতেন তাহলে নিবন্ধকারও হাসিনা পুত্রের আমলনামা নিয়ে বয়ান দিতেন না। আর এভাবেই প্রবাসে থেকে বিভীষণরা আমাদের দেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ উত্তপ্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। কিন্তু গাফফার চৌধুরীর চরম সৌভাগ্য যে তিনি সমালোচনাটা বিএনপি নেত্রীর ছেলের বিরুদ্ধে করেছিলেন। যদি হাসিনা পুত্র সম্পর্কে এমন কুৎসিত মন্তব্য করতেন তাহলে তাকে আল্লামা বাবুনগরীর ভাগ্য বরণ করতে হত এতে কোন সন্দেহ নেই।
গাফফার চৌধুরী এবং তার প্রবাস কর্ম নিয়ে দেশের মানুষ সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল। পত্রিকায় একবার খবর বেরিয়েছিল যে, গাফফার তার লেখনির মাধ্যমে যা রোজগার করেন তা দিয়ে লন্ডন শহরে ৭ দিন জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব। কিন্তু তিনি লন্ডন শহরে খুবই শান-শওকতের সাথে চলাফেরা করেন। কিন্তু তার এসব বিত্তবৈভবের উৎস কোথায়? প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে তার বিত্তবৈভবের উৎস হচ্ছে মহল বিশেষের চাটুকারিতা। আর এই অবাধ চাটুকারিতার মাধ্যমে লব্ধ অর্থই তার বিলাসবহুল জীবনের মূল চালিকা শক্তি। তিনি মহল বিশেষের মনোরঞ্জনের জন্য কোন সত্য-মিথ্যা ও তথ্য-উপাত্তের ধার ধারেন না। তাদেরকে খুশী করাতে মুখে যা আসে তাই বলেন, মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখালেখি করেন। এজন্য অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক যায়যায় দিন এবং পরবর্তীতে দৈনিক যায়যায় দিন তার সম্পর্কে মূল্যায়ন প্রকাশ করেছিল, ‘যাহা লিখিব মিথ্যা লিখিব, মিথ্যা বৈ সত্য লিখিব না- মিথ্যুক চৌধুরী’ এই হলো মি. চৌধুরী সম্পর্কে দেশের মানুষের মূল্যায়ন।
কয়েক দিন আগে দৈনিক কালের কন্ঠে ‘সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা, সীমা ও তার প্রয়োগ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তার পুরো লেখাটিতে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, স্বাধীনতা কারো জন্য অবারিত নয়, এমন কী স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতার নাম নয় বরং স্বাধীনতাও আইন ও বিধি-বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এসব কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করার কোন সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু কথা হলো মি. চৌধুরী তার লেখনি ও বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্যের মাধ্যমে স্বাধীনতার এই সংজ্ঞাটাকে কতখানি অনুসরণ করে চলেন এবং আলোচিত নিবন্ধে তিনি তা অনুসরণ করেছেন কী-না তাই আজকের আলোচনার বিষয়।
মূলত গাফফার চৌধুরীর সর্ব সাম্প্রতিক লেখাটি লিখেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকারের দেশ ও জাতিসত্তাবিরোধী ষড়যন্ত্র, বিরোধী দলের ওপর নির্মম দলন-পীড়ন, কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে জাতীয় তামাশা, রাজপথে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশের ওপর নির্বিচারে গুলী, নির্বিচারে গণহত্যা, গণমাধ্যমের কন্ঠরোধ, আমার দেশ বন্ধ করে সম্পাদকের ওপর নির্যাতন, জনপ্রিয় মিডিয়া দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টিভি বন্ধের অনুকুলে সরকারের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য। তিনি তার নিবন্ধে লিখেছেন, ‘রাষ্ট্র বা সরকার যখন তার নাগরিককে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়, তখন রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের একটি অলিখিত দায়বদ্ধতা জন্মায়। রাষ্ট্র বা সরকার অত্যাচারী হলে অন্যায়ভাবে নাগরিক স্বাধীনতা বা বাকস্বাধীনতা হরণ করতে চাইলে অবশ্যই নাগিরকরা প্রতিবাদ জানাবেন, বিদ্রোহী হবেন। কিন্তু রাষ্ট্র বা সরকার রাষ্ট্রের বা জনগণের স্বার্থে স্বাধীকার ও নিরাপত্তার জন্য ব্যক্তি স্বাধীনতা জরুরী সময়ের জন্য আংশিক বা পূর্ণভাবে স্থগিত রাখে, তখন সেই ব্যবস্থাকে নাগরিক স্বাধীনতা বা অধিকার হরণ বলা যাবে না’।
তার ওপরের বক্তব্যে গাফফার চৌধুরী নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে মারাত্মক ভাঁড়ামীর আশ্রয় নিয়েছেন। এমন কী তার বক্তব্যের মধ্যে স্ববিরোধিতাও রয়েছে। তিনি তার বক্তব্যে আইনী কোন ব্যাখ্যা দেননি বরং মনের মাধুরী মিশিয়ে বিশেষ শ্রেণীর চাটুকারিতার জন্য সব কিছুতেই তালগোল পাকিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন যে, ‘রাষ্ট্র বা সরকার যখন পূর্ণ স্বাধীনতা দেয় তখন রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের অলিখিত দায়বদ্ধতা জন্মায়’। তার এ বক্তব্য সম্পূর্ণ দায়সারা গোছের। মূল কথা হলো রাষ্ট্র বা সরকার নাগরিকের পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে বাধ্য। এটা রাষ্ট্র বা সরকারের কোন অনুকম্পা নয় বরং নাগরিকের মৌলিক অধিকার। আর নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। আর এ জন্যই নাগরিক রাষ্ট্র বা সরকারকে ট্যাক্স বা কর দিয়ে থাকে। পক্ষান্তরে রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকও দায়বদ্ধ। এটাও নাগরিকের অনুকম্পা নয়। একজন রাষ্ট্রের সভ্য সকল প্রকার রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধান মেনে চলা নাগরিকের দায়িত্ব। অন্যথা হলে তা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু রাষ্ট্র বা সরকার যদি নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয় তাহলে নাগরিকদের সংক্ষুব্ধ হওয়ার ও নিয়মতান্ত্রিক ক্ষোভ প্রকাশ করার অধিকার আছে। কিন্তু কোন নাগরিক বা রাষ্ট্রের কোন গোষ্ঠী শ্রেণী রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর কোন কাজের সাথে জড়িত হয় তাহলে রাষ্ট্র বা সরকার তার বা তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার অক্ষুণœ রেখেই। কিন্তু জনাব চৌধুরী যে নাগরিকের অধিকার আংশিক বা পূর্ণভাবে স্থগিতের কথা বলছেন তা কোন গণতান্ত্রিক সমাজে গ্রহণযোগ্য নয় বরং তা ফ্যাসিবাদী ও নাৎসীবাদী সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। মূলত মি. চৌধুরী এবং তার অনুগামীরা নাৎসীবাদ ও ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মা বলেই দেশের মানুুষ জানে। কারণ, স্বাধীনতার সংজ্ঞায় মনীষীরা যা বোঝাতে চান তার সাথে গাফফার চৌধুরীর গালগল্প মোটেই ধোপে টিকে না। স্বাধীনতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ঐতিহাসিক র্যামজে মুইর বলেছেন, (By liberty I mean the secure enjoyment by individuals and by natural and spontaneous group of individuals, such as nation, church, trade union, of the power to think of their own thoughts and to express and act upon them using their own gifts in their own way under the shelter of the law, provided they do not impair the corresponding right of others.)
অর্থাৎ ‘স্বাধীনতা বলতে আমি ব্যক্তিদের দ্বারা এবং জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায়, ট্রেড ইউনিয়ন প্রভৃতি স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত সংস্থার দ্বারা তাদের নিজের ভাবনা নিজে ভাবার এবং সে অনুসারে কাজ করার ক্ষমতার সুনির্দিষ্ট উপভোগ বুঝি। তারা আইনের ছত্রছায়ায় বসে নিজ নিজ শক্তি নিজের অভিপ্রায় অনুসাবে ব্যবহার করবে এবং অন্যের অনুরূপ ক্ষমতার উপর হস্তক্ষেপ করবে না’। এ থেকে সহজেই অনুমিত হয় যে, তিনি যে স্বাধীনতার কথা ও রাষ্ট্রের করণীয় নিয়ে আলোচনা করেছেন তা বিশেষ শ্রেণীর মনোরঞ্জনের জন্যই করেছেন। এর সাথে বাস্তবতার কোন মিল পাওয়া যাবে না।
তিনি যে বিশেষ অবস্থায় নাগরিকের স্বাধীনতা আংশিক স্থগিত বা পূর্ণ স্থগিত করার কথা বলেছেন সে সম্পর্কেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে। স্বাধীনতার সর্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্রদাতা জন ষ্টুয়ার্ট মিল তার On Liberty গ্রন্থে লিখেছেন,
, (The only purpose for which power can be rightfully exercise over any member of a civilized community against his will is to prevent harm to others. His own good either physical or normal, is not a sufficient warrant. অর্থাৎ অপরের স্বাধীনতার ওপর ব্যক্তিগতভাবে বা সমষ্টিগতভাবে হস্তক্ষেপ করা একটি মাত্র ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য এবং তা হলো আত্মরক্ষা। কেবল অন্যের অনিষ্ট থেকে নিবৃত করার ক্ষেত্রেই কোন সুসভ্য সমাজের সদস্যকে, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর প্রয়োগ সমর্থন করা যায়। তার শারীরিক বা মানসিক উপকার হবে এ অজুহাতে তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করানো উচিত নয়।
দেশে আওয়ামী দুঃশাসন চলছে। গণতন্ত্র ও অবাধ নির্বাচনের রক্ষাকবচ কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে এই সরকার। সরকার বিরোধী দলকে তাদের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। সরকার বিরোধী দলের ওপর নির্মম দলন-পীড়ন চালালেও তারা রাজপথে কোন প্রতিবাদ করতে পারছেন না। এমন কী বিরোধী দলের ঘরোয়া কর্মসূচীগুলোকে গোপন বৈঠক আখ্যা দিয়ে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে কথিত রিমান্ডের নামে নির্মম নির্যাতন চালানো। তারা বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে শীর্ষ নেতাদের হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে। কথিত বিচারের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ম ও বিচারিক অসততা প্রমাণ হলেও সরকার গায়ের জোরে এই বিচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং একের পর এক জাতীয় নেতাদেরকে প্রাণদ-ে দ-িত করা হচ্ছে। সরকার শুধু বিশেষ একটি দল নয় বরং দেশের সকল বিরোধী দলকে ধ্বংস করার জন্য বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দিয়ে তাদেরকে কারারুদ্ধ করে রেখেছে। সরকারের জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদে জনগণ রাজপথে নেমে এলে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলী চালিয়ে পাখির মত মানুষ হত্যা করছে। মূলত সরকার দেশে অঘোষিতভাবে বাকশালী শাসন কায়েম করেছে। রাজপথ তো বিরোধী দলের জন্য অনেক আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যেসব গণমাধ্যম সরকারের গণবিরোধিতার গঠনমূলক সমালোচনা করতো সরকার একের পর এক সেসব গণমাধ্যম বন্ধ করে দিচ্ছে। সরকারের জিঘাংসার কারণে যমুনা টিভি তো আলোর মুখই দেখেনি। শুরুতেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে চ্যানেল ওয়ানের মত জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলকে। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও উপদেষ্টার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের কারণে আমার দেশ সম্পাদককে গ্রেফতার করে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়েছে এবং পত্রিকার প্রকাশনাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। দীর্ঘ আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি ও দেশের উচ্চ আদালতের নির্দেশে পত্রিকার প্রকাশনার অধিকার ফিরে পেয়েছিল। কিন্তু অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতির স্কাইপ কেলেংকারী ফাঁস ও আত্মস্বীকৃত নাস্তিক-মোরতাদদের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের জন্য সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আবারও গ্রেফতার করে নির্যাতন এবং পত্রিকার ছাপাখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কোন প্রকার কারণ ছাড়াই অতিজনপ্রিয় দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সরকারের এসব অপকর্মের জন্য গোটা দেশসহ বহির্বিশ্বে যখন সমালোচনার ঝড় উঠেছে তখনই এক প্রবাসী মওকাবাজ লেখক সরকারের সকল অপকর্মকে সমর্থন করে চাটুকারিতায় লিপ্ত হয়েছেন। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই বরং এসব তার স্বভাবসূলভ।
তিনি তার নিবন্ধে বলেছেন, ‘পাকিস্তান আমলে আইয়ুব সরকার যখন তথাকথিত প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করেছিল, তখন পাকিস্তানের উভয় অংশের সংবাদপত্র মালিক, সম্পাদক ও সাংবাদিকরা একযোগে প্রতিবাদ মিছিলসহ রাজপথে নেমেছিল। আমার মনে আছে, সে সময় ঢাকার প্রেসক্লাব থেকে সম্পাদক ও সাংবাদিকরা বিরাট প্রতিবাদ মিছিল বের করেছিলেন। মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন বিখ্যাত সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী ও আব্দুস সালাম। এমন কী বয়সের ভারে ন্যুব্জ মওলানা আকরম খাঁ সাংবাদিক এবিএম মুসার একটি ছাদ খোলা গাড়ীতে দাঁড়িয়ে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন’।
মজার ব্যাপার হলো তিনি তো পাকিস্তান আমলের কথা বলেছেন। তখন তো আমাদের দেশ স্বাধীনই ছিল না। পরাধীন দেশে অনেক কিছুই হতে পারে। আর এসব কারণেই তো লক্ষ্য প্রাণের বিনিময়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। যাতে করে আমাদের ওপর কোন অপশক্তির শকুনীর শ্যেণ দৃষ্টি না পড়ে। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর আমরা কী পেলাম? স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের শাসনামলে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হলেও তো মালিক, সম্পাদক ও সাংবাদিকরা তার প্রতিবাদ করার অধিকার পেয়েছেন। তারা জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে মিছিল, সমাবেশ ও শোভাযাত্রা বিনা বাধায় করতে পেরেছেন বলে গাফফার চৌধুরী নিজেই স্বীকার করেছেন। কিন্তু স্বাধীন দেশে, স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল ক্ষমতায় থাকার পরও আমার দেশ সম্পাদক গ্রেফতার, পত্রিকা প্রকাশনা স্থগিত এবং দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ হওয়ার পরও সাংবাদিক ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো কোন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করার সুযোগ পাননি। এমন কী প্রেসক্লাবের সামনে পুলিশ দিয়ে সাংবাদিকদের মানববন্ধনে হামলা চালানো হয়েছে। আওয়ামী রাজ্যে মানববন্ধন করার অধিকারও কারো নেই। তাহলে স্বাধীন দেশে আইয়ুব আমলের চেয়ে ভাল আছি? বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে।
তিনি ভিন্ন মতের কাগজগুলোর প্রতি খিস্তিখেউর করে বলেছেন, ‘কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই যখন জামাতি কাগজ ‘দৈনিক সংগ্রাম’, সাপ্তাহিক ‘জাহানে নও’. নেজামে ইসলামের কাগজ ‘নাজাত’ বা আরো একটি কাগজ ‘আজান’ বন্ধ হয়ে যায় বা বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন কেউ বলেননি সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে’।
‘এই পত্রিকাগুলো ভিন্নমত প্রচার নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বিরোধিতা, সাম্প্রদায়িক উস্কানি প্রদান ও হানাদারদের প্রচারণায় সহায়তা দানের অভিযোগ ছিল। এমন কী দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৈনিক পাকিস্তান (পরে দৈনিক বাংলা), অবজারভার, এমন কী দৈনিক সংবাদের দীর্ঘ দিনের সম্পাদকদের বিদায় দিয়ে নতুন সম্পাদক বসানো হয়। তখন কেউ বলেনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে এবং কোলাবরেটর কাগজগুলো বন্ধ করে দেয়া উচিত হয়নি। কারণ, তাতে বহু সাংবাদিক কর্মচ্যুত হয়েছেন’।
এ বক্তব্যের শুরুতেই তিনি চরম মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি যে সময়কে উদ্ধৃত করে যেসব তার ভাষায় সাম্প্রদায়িক কাগজ বন্ধ করার কথা বলেছেন সে তথ্য মোটেই ঠিক নয়। বরং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন তৎকালীন বাকশালী সরকার স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েমের লক্ষ্যে এবং জুলুম-নির্যাতনকে নির্বিঘœ করার জন্য The newspaper ( Announcement of declaration ) Act-1975 জারি করে ৪টি সংবাদপত্র ছাড়া বাকীগুলো বন্ধ করে দেয়। এখানে সাম্প্রদায়িক বা অসাম্প্রদায়িকের কোন কথা ছিল না। এর মাধ্যমে গণমাধ্যমের কন্ঠরোধ করা হয় এবং হাজার হাজার গণমাধ্যম কর্মী চাকরি হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হন। বাকশালী সরকার এই এক্ট পাসের আগেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করে আসছিলো। ১৯৭৩ সালের ২৯ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে দৈনিক গণকন্ঠ সম্পাদক জনাব আল মাহমুদ অভিযোগ করেছিলেন, ‘গণকন্ঠ অত্যন্ত বেআইনীভাবে বন্ধ করিয়া দেয়ার ফলে তথাকার পৌনে তিনশ’ সাংবাদিক ও কর্মচারি বেকার হইয়া পড়িয়াছেন। সাংবাদিক ও কর্মচারীদের মুহূর্তমাত্র সময় না দিয়া অফিস হইতে কাজ অসমাপ্ত রাখা অবস্থায় বাহির করিয়া দেয়া হইয়াছে’। ( ইত্তেফাক-৩০ মার্চ ১৯৭৩ )
তাই পত্রিকা বন্ধ করার পর কেউ এর প্রতিবাদ বা সমালোচনা করেনি তা নয় বরং সেসময় আওয়ামী লীগ সরকারের এ সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। কিন্তু বাকশালী অপশাসনের কারণে এর ব্যাপ্তি ঘটতে পারেনি। আওয়ামী লীগ বর্তমান সময়েও তো গণমাধ্যমের ওপর খড়গহস্ত হয়েছে। কিন্তু দেশের মানুষ কী সরকারের এসব অপকর্মের প্রতিবাদ করছেন না? অবশ্যই করছেন। কিন্তু সরকার তো প্রতিবাদ জানানোর অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছে। হেফাজতে ইসলামের লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ থেকে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি ও পত্রিকা খুলে দেয়ার দাবি জানানো হলেও সরকার সে সমাবেশের ওপর গুলী চালিয়ে হাজার হাজার নিরপরাধ ও নিরীহ আলেম উলামাদের হত্যা করা হয়েছে। সমাবেশের সংগঠন হিসাবে দেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা বাবুনগরীকে গ্রেফতার করে রিমান্ডের নির্মম নির্যাতন চালিয়ে তাকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এসবকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন মি. চৌধুরী?
গাফফার চৌধুরী তার নিবন্ধের শুরুতেই বার্নার্ড শ ও এইচ পি ওয়েলস ছড়ি ঘোরানোর গল্প শুনিয়েছেন। বার্নার্ড শ তার বন্ধু এইচ পি ওয়েলসকে বলেছিলেন, ‘আমার নাকের ডগা যেখানে যেখানে শেষ সেখানে তোমার স্বাধীনতা শুরু’। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো মি. চৌধুরী এর মাধ্যমে বোধ হয় তার নিজের নাকের কথাই বুঝিয়েছেন। তার কোন লেখায় তো কারো নাক, মুখ, চোখ রক্ষা করা হয় না বরং সবকিছু সমান করেই ছড়ি ঘোরাতে থাকেন। এতে প্রতিপক্ষের কী থাকলো আর কী গেল তা ভাববার কোন অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। আলোচ্য নিবন্ধেও তিনি তার ব্যত্যয় ঘটাতে পারেননি বরং বিশেষ মহলের খয়ের খাঁ করতে গিয়ে নিজের দেউলিয়াত্বই প্রমাণ করেছেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন