সোমবার, ১৭ জুন, ২০১৩

চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী রায় সরকারপক্ষের জন্য রেড সিগন্যাল

গত পরশু ১৫ জুন দেশের চারটি বিভাগীয় সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশালÑ এই চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়রপ্রার্থীরা বিপুল ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়রপ্রার্থীদের পরাজিত করেছেন। 
রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১৮ দল সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ১৩১৭৬০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ১৪ দল সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন পেয়েছেন ৮৩৩৮৯ ভোট। খুলনায় ১৮ দলের প্রার্থী মো: মনিরুজ্জামান মনি ১৮০০৯৩ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ১৪ দলের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক পেয়েছেন ১১৯৪২২ ভোট। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১৮ দলের প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী ১০৭৩৩০ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তার বিপরীতে ১৪ দলের প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান পেয়েছেন ৭২১৭৩ ভোট। অপর দিকে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও ১৪ দলের প্রার্থীকে পরাজিত করে ১৮ দল সমর্থিত প্রার্র্র্র্র্র্র্র্থী মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। সেখানে বিজয়ী মেয়রপ্রার্থী আহসান হাবীব কামাল পেয়েছেন ৮৩৭৫১ ভোট। আর পরাজিত প্রার্থী শওকত হোসেন লিটন পেয়েছেন ৬৬৭৭১ ভোট।
বিএনপি সমর্থিত বিজয়ী চার মেয়রপ্রার্থী ভোট পেয়েছেন মোট পাঁচ লাখ দুই হাজার ৯৪৩ ভোট। আর আওয়ামী লীগ সমর্থিত চার মেয়রপ্রার্থী পেয়েছেন মোট তিন লাখ ৪১ হাজার ৭৫৩। অর্থাৎ বিজয়ী প্রার্থী পরাজিত প্রার্থীদের চেয়ে দেড় গুণের মতো ভোট পেয়েছেন। আর চার সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর পদের মধ্যে ৬৫টি পেয়েছে বিএনপি, ২৮টি আওয়ামী লীগ, ৬টি জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী শাসনতন্ত্র ১ এবং স্বতন্ত্র ১২টি। এখানেও বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেছে।
স্পষ্টতই এ চারটি সিটি করপোরেশনের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থীরা বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থীদের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন। অন্তত ভোট পরিসংখ্যান বিবেচনায় এ সত্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ওই নির্বাচনের চার দিন আগে গত ১২ জুন দৈনিক ইনকিলাব চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন বিষয়ে একটি জনমত জরিপ প্রকাশ করে। এই জনমত জরিপে দেখানো হয়, চারটিতেই বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা ব্যাপক ব্যবধানে এগিয়ে। এই জরিপ রিপোর্টে পত্রিকাটি জানায়Ñ জয়ের পাল্লা বিরোধীদলীয় মেয়রপ্রার্থীর দিকে। চারটি সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচনে জনমত জরিপে এমন চিত্র বেরিয়ে এসেছে। জরিপে অংশ নেয়া ভোটারেরাই সরকারের বিগত সাড়ে চার বছরকে মূল্যায়ন করে এমন মতামত ব্যক্ত করেছেন।
তবে মেয়র পদে দায়িত্ব পালন করেছেন এদের অনেকেই এলাকায় নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালালেও ভোটের ক্ষেত্রে এর প্রভাব খুব একটা পড়বে বলে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা মনে করছেন না। চার মহানগরীতে জরিপে অংশ নেয়া ৬৩ শতাংশ ভোটার বিরোধী দল সমর্থক প্রার্থীর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। অপর দিকে ২৬ শতাংশ ভোটার সরকার সমর্থক প্রার্থীর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
জরিপটি বিভাগ ওয়ারি সিটি করপোরেশনের জনমতও প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয় রাজশাহীতে বিরোধী দলের মেয়রপ্রার্থীর প্রতি সমর্থন ৬৯ শতাংশ ভোটারের, আর সরকার সমর্থক প্রার্থীর প্রতি সমর্থন ১৮ শতাংশের। খুলনায় বিরোধী দলের মেয়রপ্রার্থীর প্রতি জনসমর্থন ৬১ শতাংশ ও সরকারদলীয় প্রার্থীর প্রতি সমর্থন ৩৫ শতাংশ ভোটারের। বরিশালে বিরোধীদলীয় মেয়রপ্রার্থীর প্রতি সমর্থন ৬০ শতাংশের আর সরকারদলীয় মেয়রপ্রার্থীর প্রতি সমর্থন ২১ শতাংশের। সিলেটে বিরোধীদলীয় প্রার্থীর প্রতি জনসমর্থন ৬১ শতাংশ আর সরকার সমর্থক মেয়রপ্রার্থীর জনসমর্থন ২৯ শতাংশ।
বাস্তবে বিরোধীদলীয় মেয়রপ্রার্থী ও সরকারদলীয় মেয়রপ্রার্থীরা যে ভোট পেয়েছেন তা মোটামুটি হিসেবে বলা যায় বিজয়ী প্রার্থীরা পরাজিত প্রার্থীদের তুলনায় দেড় গুণ ভোট পেয়েছেন; কিন্তু ওই পত্রিকার জরিপ মতে, তা হওয়ার কথা মোটামুটি দ্বিগুণের মতো। তার পরও এক বিবেচনায় ধরে নেয়া যায়, ওই জনমত জরিপ ছিল যথার্থ। কারণ সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনটি একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে অনুষ্ঠিত হয়েছে, তেমনটি দাবি করার সুযোগ নেই। কেন নেই, সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। এর আগে একটি বিদেশী সংস্থার জনমত জরিপের কথা প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে উল্লেখ করতে চাই। এই জরিপে বলা হয়েছে, সাড়ে চার বছরে বর্তমান সরকারের জনপ্রিয়তা ২০ শতাংশ কমেছে। ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ। এ মুহূর্তে তাদের জনপ্রিয়তা ২৮ শতাংশে নেমে এসেছে। পাশাপাশি বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা ৬ শতাংশ বেড়েছে। বিগত নির্বাচনে বিরোধী দল বিএনপি ভোট পেয়েছিল ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর জামায়াতে ইসলামীর ভোটসংখ্যা অটুট রয়েছে। এরা ভোট পেয়েছিল ৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। উল্লেখ্য, এ জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ মনে করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। অপর দিকে দৈনিক প্রথম আলোর এক জরিপ মতে, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ চায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আমরা দেখেছি, সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকেও এসব জরিপ সম্পর্কে উষ্মা প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, কিছু পত্রপত্রিকা মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে; কিন্তু চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল দেখে কিন্তু মনে হয়, এসব জরিপ রিপোর্ট যথার্থ বস্তুনিষ্ঠ, বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য নয়।
বলছিলাম, বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেই বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। তার পরও বলা দরকার, এরা প্রতিকূল এক পরিবেশে দাঁড়িয়েই শুধু জনজোয়ারের ওপর ভরসা করে এই নির্বাচনী লড়াইয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছেন। এই নির্বাচনী লড়াই তাদের জন্য একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে চলেনি। সরকারি দল তা হতে দেয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের এই নির্বাচনী লড়াই লড়তে হয়েছে এমন এক দলীয় সরকারের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে, যে সরকার বিগত সাড়ে চার বছর বিরোধী দলের প্রতি চরম অসহিষ্ণু আচরণ প্রদর্শন করেছে। বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠিয়েছে, রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে। মূলত নেতাকর্মীবিহীন এক পরিবেশে বিরোধী দলের প্রার্থীদের এ নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হয়েছে। নির্বাচনের আগের রাতে বিরোধীদলীয় বিভিন্ন প্রার্থীর এজেন্টদের বাড়িতে বাড়িতে পুলিশি তল্লাশির অভিযোগ উঠেছে। সিলেটে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদপ্রার্থী জুবের ভোটের আগের রাতে হামলার শিকার হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ওসমানি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খুলনার একটি কেন্দ্রে ব্যালটবাক্স ছিনতাইয়ের সময় দুই মেয়রপ্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, র‌্যাব ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে ব্যালটবাক্স উদ্ধার করে, ১৮ দলীয় প্রার্থী আহসান হাবীব কামাল ১৪ দলীয় সমর্থকদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। খুলনার খালিশপুরে ১৮ দলীয় প্রার্থী বিজয়ী হওয়ায় বিএনপি অফিস ভাঙচুর করেছে প্রতিপক্ষরা, রাজশাহীর লক্ষ্মীপুরে র‌্যাবের সাথে ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, বরিশালের ১৮ কেন্দ্র থেকে ১৮ দলীয় প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। সিলেটে নির্বাচনে সরকারি গাড়ি ব্যবহার হয়েছে, অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিত নির্বাচনের আগের দিন রীতিমতো সিলেট শহরে মহড়া দিয়েছেন, বহু আগেই মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগসহ নানা অভিযোগের কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। নির্বাচনের আগের দিন পুলিশ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে তার বরিশালের বাসা থেকে বের করে বরিশাল ছাড়া করার জন্য বারবার হানা দিয়েছে। সর্বোপরি এই নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট ছিল সরকারের এমন এক জনপ্রশাসন, যা অতিমাত্রায় ভারসাম্যহীন সরকারের নির্বিচার দলবাজির কারণে। জনপ্রশাসনে পদ না থাকলেও ঢালাও পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। আবার অসংখ্য কর্মকর্তাকে বিরোধী দলের সমর্থক বলে চিহ্নিত করে ওএসডি করে রাখা হয়েছে। অর্ধশতাধিক কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়েছে বাধ্যতামূলক অবসরে। পুলিশ বাহিনীতে দলীয়করণ চরমে। পুলিশ বাহিনীকে সমালোচকেরা আজ নাম দিয়েছেন গোপালগঞ্জের গোপালী বাহিনী। এ দিকে সরকারবিরোধীদের হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে সম্প্রতি এসেছে সংশোধিত সন্ত্রাসবিরোধী আইন। সংশোধিত এ সন্ত্রাসবিরোধী আইনকে বিবেকবান সাধারণ মানুষ দেখছে ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী হিসেবেই। এ আইন সংশোধন ব্যক্তিস্বাধীনতাকে হরণ করার নতুন এক কৌশল হিসেবে মনে করছেন দেশের বিশিষ্ট আইনজীবীরা। তাদের মতে, এই আইন ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করে ফেলবে। এই আইনের ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, স্কাইপসহ ইন্টারনেট ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ হবে। সামাজিক যোগাযোগ আড়িপাতার আওতায় আসবে। ফলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় একজন নাগরিককে গ্রেফতার করে যেভাবে হয়রানি করা হতো, এই আইনে সে সুযোগ সৃষ্টি করা হলো। মোট কথা, বিরোধী দল দমন-পীড়নের হাতিয়ার করার জন্যই আইনের এই বিতর্কিত সংশোধনী আনা হলো। অতএব বললে ভুল হবে না, চার সিটি করপোরেশনের একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তথা কম সুযোগ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলে ইনকিলাবের জরিপ মতে দেড় গুণ নয়, দুইগুণ ভোট পেয়েই বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা বিজয়ী হতে পারতেন।
চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থীদের ভরাডুবির প্রেক্ষাপটে সরকারি দল-জোটের নেতানেত্রীদের মুখে এখন একটি কথাই উচ্চারিত হবেÑ সরকার প্রমাণ করেছে, এ সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করেছে। সে জন্যই বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা বিজয়ী হতে পেরেছেন। যদি তা-ই হয়, তবে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় মেয়র হানিফও মির্জা আব্বাসকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেখানে কি তাহলে চারদলীয় জোট সরকার নিরপেক্ষ ছিল না? তা হলে কেন তখন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন করে তা আদায় করেছিল আওয়ামী লীগ।
চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে সরকার নিরপেক্ষ ছিল, সে দাবি করতে পারত যদি নির্বাচনে ওপরে উল্লিখিত ঘটনা না ঘটত। আসলে এ নির্বাচনে সরকারবিরোধী যে জনজোয়ার, তার তোড়ে সরকারের যাবতীয় অপকৌশল ভেসে গেছে। আর বিরোধী দলের প্রার্থীদের বিজয় হয়েছে নিশ্চিত। এ সত্যকে মেনে নিয়ে এখন সরকারি দলের নেতাকর্মীদের উচিত তাদের সাড়ে চার বছরের আমলনামা হাতে নিয়ে ভুলত্রুটি মাথায় রেখে ভবিষ্যৎ পথচিত্র তৈরি করা।
এই সাড়ে চার বছর এ সরকারের আমলনামা দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট। সরকার জনগণকে যতই বোকা মনে করুক, ভিন্ন মতের গণমাধ্যম বন্ধ করে যতই সরকারের গুণগান প্রচার করুক, সাধারণ মানুষ বোঝে সরকার কোনটা সত্য বলছে, আর কোনটা মিথ্যা বলছে। জনগণ এটাও বোঝে এই সত্য-মিথ্যার মাত্রা কতটুকু, কী এর আকার-প্রকার। জনগণ উপলব্ধি করতে পেরেছেÑ সরকার বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর কী ধরনের দমন-পীড়ন, দলন-মথন, জুলুম-অত্যাচার চালিয়েছে, ঠুনকো অজুহাতে মামলা দায়ের করে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের আটক করে রিমান্ডে কী ধরনের অমানবিক অত্যাচার চালিয়েছে, জনবিক্ষোভ থামাতে কী করে সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। গোটা দেশে সরকারি দলের লোকজনের দুর্নীতি আর লুটপাটের মহোৎসব চলেছে। সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনের লোকজন জোঁকের মতো লেগেছে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসবাজি, টেন্ডারবাজি আর মামলা-হামলাবাজিতে। যে কারণে বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে বলতে হয়েছে, দেশটা এখন চলে গেছে বাজিকরদের হাতে। দুর্নীতি কেলেঙ্কারির যে প্রবাদসম উদাহরণ এ সরকারের আমলে সৃষ্টি হয়েছে, তা এখন দেশ-বিদেশের সবার মুখে। হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ভিওআইপি কেলেঙ্কারি, রেলওয়ে নিয়োগবাণিজ্য কলেঙ্কারি, প্রশাসনে দলীয়করণসহ নানা কেলেঙ্কারি। দুর্নীতিবাজ সন্ত্রাসীদের বাঁচাতে সরকারের প্রাণান্তকর চেষ্টা মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। মানুষ দেখছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্ধত আচরণ। বিরোধী দলের ওপর তার কঠোরতা অসমান্তরাল। দেখামাত্র গুলি, রাজনৈতিক দলের অফিসে হামলা, তালা, বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ করা, দেশটাকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করার নীতি সাধারণ মানুষের পছন্দের নয়। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন, অপহরণের অভিযোগ উঠেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে। দলীয় পুলিশের উদ্ধত আচরণ সাধারণ মানুষ ঘৃণার চোখে দেখলেও সরকারপক্ষ তাদের নানাভাবে পুরস্কৃত করছে। সর্বোপরি সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দেয়াকে দেশের সাধারণ মানুষ সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার একটি অপকৌশল হিসেবেই বিবেচনা করছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী হয়তো সত্যই বলেছেন এই নির্বাচনের ফলাফল সরকারের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রায়। জানি না, সরকার এ সত্য কতটুকু উপলব্ধি করবে? তবে সরকারকে বুঝতে হবে, এ নির্বাচন সরকারকে একটি বিষয় জানিয়ে দিলোÑ সরকারের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ একাট্টা। পুলিশ দিয়ে রাজপথ দখলে রেখে বিরোধী দলের আন্দোলনে জনগণ নেই, এই আন্দোলন অর্থহীনÑ এমন বক্তব্য চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী রায় ভুল প্রমাণ করেছে। কদিন আগে সম্ভবত চুয়াডাঙ্গায় পাঁচটি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এর তিনটিতে নির্বাচিত হয়েছেন জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত তিন চেয়ারম্যান প্রার্থী। একটিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও অন্য একটিতে বিএনপি প্রার্থী চেয়ারম্যান হয়েছেন। এই তো কয়েক দিন আগে ঘাটাইল পৌরসভা নির্বাচনে পৌরসভা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন জামায়াত-সমর্থিত প্রার্থী। দ্বিতীয় অবস্থানে বিএনপি প্রার্থী। তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে অন্যান্য প্রার্থী থাকায় পঞ্চম হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী।
এক দিকে জনগণ ভোট দিয়ে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করে স্থানীয় প্রশাসনে পাঠাচ্ছে, অন্য দিকে দলবাজ এই সরকার কলমের খোঁচায় তাদের পদ কেড়ে নিচ্ছে। এই তো গত কয়েক দিন আগে প্রথম আলোর এক খবরে দেখলাম, দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সাম্প্রতিক জামায়াত-শিবির তথাকথিত তাণ্ডবের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে ৩১ জন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যকে সরকার সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে। কোনো ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই তাদের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ১৭ জন চেয়ারম্যান ও ১৪ জন ইউপি সদস্য। এদের মধ্যে একজন জাতীয় পার্টির এবং অন্যরা বিএনপি ও জামায়াতের স্থানীয়পর্যায়ের নেতাকর্মী। এক দিকে সরকার বলছে, অনির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা ছাড়বে না, দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে; অপর দিকে এভাবে বিরোধীদলীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিষ্ক্রিয় করে রাখা হচ্ছে। কোথাও কোথাও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শপথ পর্যন্ত নিতে দিচ্ছে না। বিরোধী দল ঠেকাতে এই হচ্ছে বাস্তবতা। এসব বাস্তবতা মাথায় রেখে সরকারকে আগামী দিনে পথ চলতে হবে। নতুন করে রচনা করতে হবে আওয়ামী রোডম্যাপ বা পত্র। বর্তমানে আওয়ামী লীগ যে পথে চলছে জনগণ তা পছন্দ করছে না। তা যদি দলটির নেতৃত্ব স্বীকার না করেন এবং সংশোধনের পথে পা না বাড়ান; তবে সামনে অপেক্ষা করছে সমূহ বিপদ। কোনো অজুহাতেই পার পাওয়া যাবে না।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads