আওয়ামী সরকারের সাড়ে চার বছরে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকারের প্রশ্রয়ে দলবাজি ও অগণতান্ত্রিক কর্মকা-ের কারণে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আইন-শৃংখলার চরম অবনতিতে মানুষ নিরাপত্তাহীন অবস্থার মধ্যে পড়েছে। উদ্বেগের বিষয়, আওয়ামী সরকারের অগণতান্ত্রিক নীতির কারণে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহের সদস্যদের হাতেও সারা দেশের মানুষ নিরাপদ নয়। তারা সরকারি দলের নেতা-কর্মী-ক্যাডার নামধারী সশস্ত্র সন্ত্রাসী অপরাধীদের মতই আচরণ করছে। তাদের দ্বারাও বেসুমার প্রাণহানি এবং বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। ফলে, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর সাধারণ মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে। এই আস্থাহীনতার কারণেই সাধারণ মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, নোয়াখালীর সূবর্ণচর উপজেলার নঙ্গলিয়ার চরে স্থানীয় জনতার গণপিটুনিতে ৬ ডাকাত নিহত ও ২ জন গ্রেফতার হয়েছে। স্থানীয় এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, ঐ দিন সকাল ১১টার দিকে সেলিম বাহিনীর প্রধান জলদস্যু সেলিমের নেতৃত্বে ১০/১২ জনের ডাকাতদল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ডাকাতিকালে এলাকার কয়েকশ’ বিক্ষুব্ধ মানুষ চারদিক থেকে তাদের ঘিরে গণপিটুনি দেয়। ঘটনাস্থলে বাহিনীর প্রধান সেলিমসহ চারজন নিহত হয়। নিকট অতীতে সারাদেশে গণপিটুনিতে চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ছিনতাইবাজ, টেন্ডারবাজ, অবৈধ দখলবাজ বা অন্য অপরাধী নিহত হওয়ার ঘটনার অনেক নজির রয়েছে। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব পালনে গাফিলতি দেখেও না দেখার ভান এবং দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থার পরিবর্তে সন্ত্রাসী অপরাধীদের প্রশ্রয় দেয়ার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটার অহরহ অভিযোগ রয়েছে। মানুষ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে প্রতিকার না পেয়ে বাধ্য হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে।
গত সাড়ে চার বছর ধরেই অভিযোগ রয়েছে আইন-শৃংখলা বাহিনী তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না বা সরকার ও সরকারি মহলই তাকে দায়িত্ব পালন করতে দিচ্ছে না। আওয়ামী সরকার ও সরকারের প্রভাবশালী মহলের হুকুমে বিএনপি-জামায়াতসহ ১৮ দলীয় গণতান্ত্রিক জোটের আন্দোলন-সংগ্রাম দমনে আওয়ামী সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনীর মতোই তাকে বেশী ব্যস্ত রাখা হচ্ছে। এমন সুবর্ণ সুযোগে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে খুন, গুম, অপহরণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জালিয়াতি, দখলবাজি, চোরাচালানীসহ সন্ত্রাসী অপরাধ তৎপরতা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। সারাদেশে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আইন-শৃংখলার এমন বেহাল দশায় সরকার, সরকারি মহল ও সংশ্লিষ্ট আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো উদ্বেগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। ওদিকে সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ পাখির মতো গুলী করে বাংলাদেশের মানুষ হত্যা করে চলছে। আওয়ামী সরকারের ভারত প্রীতির কারণে সীমান্ত অনেকটাই উন্মুক্ত ও অরক্ষিত। এই সুুযোগে অস্বাভাবিকহারে চোরাকারবার বৃদ্ধি পেয়েছে। সীমান্ত এলাকায় কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সরকার সীমান্তে বিজিবি’র শক্তি বৃদ্ধি না করে বরং দেশের অভ্যন্তরে বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম দমনে তাকে ব্যবহার করছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ভারী অস্ত্র উঁচিয়ে যুদ্ধংদেহী অবস্থায় যেভাবে বিজিবিকে টহল দিতে দেখা যায়, তাতে প্রতীয়মান হয়, দেশে যেন যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। বিজিবি’র যে কাজ নয়, সরকার তাকে সে কাজে ব্যবহার করছে। সরকার একইভাবে পুলিশ-র্যাবকে তাদের নির্ধারিত কাজের বাইরে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোটের উপর দমন-পীড়নে বেশী তৎপর রেখেছে। মনে করা হচ্ছে, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশকে রাজনৈতিক আন্দোলন দমনে ব্যবহার করার ফলে সীমান্ত অরক্ষিতসহ সার্বিক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এদিকে সরকারের তেমন খেয়াল আছে বলে মনে হচ্ছে না। অথচ দেশের সাধারণ মানুষের সার্বিক নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করাও বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের সাংবিধানিক অধিকার। বিজিবিসহ অন্যান্য আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে তাদের এই অধিকার খর্ব বা দমন করা সংবিধান অবমাননা এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পরিপন্থী বলেই আইন বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় এসেই আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিরোধী রাজনৈতিক দল দমন-পীড়নের দিকে যেভাবে ঠেলে দিয়েছে, তাতে পরিস্থিতি চরম অবনতির দিকেই যাচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষ চোর, ডাকাত, ছিনতাইবাজ, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, সন্ত্রাসীর উৎপাতে অসহায় হয়ে পড়েছে। গণপিটুনিতে ডাকাতের মৃত্যু, পুলিশী নির্যাতনে সোনারগাঁও ও মানিকগঞ্জে যুবকের মৃত্যু, উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার জোর করে কোটি টাকা আদায়ের সাম্প্রতিক ও অতীত ঘটনায় সাধারণ মানুষ আতংকগ্রস্ত। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর থেকে জনগণের ভরসা প্রায় উঠেই গেছে। একশ্রেণীর অসাধু পুলিশ সদস্যের কারণে আইন-শৃংখলা বাহিনীও আতংকে পরিণত হয়েছে। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই ইমেজ সংকট ও তার ওপর আস্থাহীনতার কারণেই দেশের সাধারণ মানুষ আইন হাতে তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
পুলিশসহ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধ দমনে সবসময়ই যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। শান্তি রক্ষায় তারা আন্তর্জাতিক সুনামেরও অধিকারী। অথচ আওয়ামী সরকারের সাড়ে চার বছরে সেই আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাবমর্যাদা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁচেছে। দেশ ও জাতির জন্য এটা কিছুতেই শুভ লক্ষণ ও কল্যাণকর নয়। আওয়ামী সরকারের হুকুমে বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি-জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের দমন-পীড়নে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে যতোটা অতি আগ্রহ, অতি উৎসাহ ও কার্যকর দেখা যায়, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নয়নে এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় ঠিক ততোটা দেখা যায় না। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে যদি জনগণ আইনী সহায়তা না পায়, নিরাপত্তা না পায় এবং অনিরাপদ হয়ে পড়ে, তবে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হতে পারে না। তখন তাদের সংক্ষুব্ধ ও আইন হাতে তুলে নেয়াটা কী অস্বাভাবিক কিছু? আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাবমর্যাদা ফিরিয়ে আনার জন্য রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে তাকে তার দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে। কোনোভাবেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন-পীড়ন ও আন্দোলন-সংগ্রাম ঠেকানোর কাজে ব্যবহার করা যাবে না। দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা রোধে সন্ত্রাসী-অপরাধীর যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সন্ত্রাসী-অপরাধীররা ধরা পড়ার পর আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর রহস্যজনক কারণে বের হয়ে আবারো যাতে অপরাধে জড়িয়ে পড়তে না পারে এ ব্যবস্থা করাই অপরিহার্য। তাহলেই কেবল আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরে আসবে এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা কমে আসবে বলে আমরা মনে করি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন