বুধবার, ২৬ জুন, ২০১৩

শাহবাগীদের কর্মকান্ডেই সরকারের চার দুর্গের পতন ঘটেছে


দেশব্যাপী বহুল আলোচিত চার সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের পর এখন ভোটের ফলাফল নিয়ে শুরু হয়েছে নানা আঙ্গিকের বহুমাত্রিক হিসাব-নিকাশ ও নির্বাচনের চুলচেরা বিশ্লেষণ। সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ফলাফলে চারটিতেই মেয়র পদে বিরোধী দল তথা ১৮ দলীয় প্রার্থীদের বিপুল বিজয় অর্জন দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিম-লে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সরকার বা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এই নির্বাচনের ফলাফল আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে কোন প্রভাব ফেলবে না বলে ফলাও করে  প্রচার করা হলেও ১৪ দলের অনেকেই কিন্তু বলতে শুরু করেছেন যে, অবশ্যই এর প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বে। সরকারের দু’একজন মন্ত্রী অবশ্য স্বীকারই করেছেন সিটি নির্বাচনে মহাজোট প্রার্থীদের পরাজয় মূলত সরকার তথা মহাজোটের জন্য নিঃসন্দেহে একটি অশনি সংকেতও বটে। তবে কেউ স্বীকার করুক বা না করুক জনগণ যে এই সরকারের সার্বিক কর্মকা-ে রীতিমতো বিক্ষুব্ধ তা তারা প্রমাণ করেছেন। প্রাথমিকভাবে সরকারের দাবি করা ভোটের দুর্গ হিসেবে খ্যাত চার সিটির পতন ঘটেছে। শাহবাগীদের কর্মকা-েই যে এই ত্বরিত পতন হয়েছে এটা একবাক্যেই সবাই স্বীকার করছেন।  
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হবার পর থেকেই চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফলকে  রাজনৈতিক বিষেশজ্ঞ মহল থেকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এই ফলাফলকে কেউ বিরোধীদলের বাজিমাত, গণতন্ত্রের বিজয়, আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পরাজয়ে সরকারের বিজয় হিসেবে দেখছেন। কেউ নির্বাচন কমিশনের সাফল্য, সরকারের প্রতি অনাস্থা এবং বিএনপির সাফল্য মনে করছেন। কেউ এ রায়কে হেফাজতের বিজয়, নাস্তিক ব্লগারদের পক্ষ নিয়ে ওলামা-মাশায়েখের প্রতি সরকারের জুলুম-নির্যাতনের জবাব মনে করছেন। কেউ তত্ত্বাবধায়ক দাবির প্রতি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত রায়, সরকারের দুর্নীতি-অন্যায়-অপশাসনের জবাব, প্রতিপক্ষকে সরকারের তুচ্ছতাচ্ছিলের প্রতিবাদ হিসেবে দেখছেন। আবার কেউ সরকারের নানামুখী ব্যর্থতা ও ভুল সুধরে নেয়ার পরিবর্তে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর কৌশলের প্রতিবাদ, সরকারের প্রতি মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এবং আগামী দিনের ক্ষমতার রাজনীতির পরিবর্তনের ইঙ্গিত মনে করছেন। তবে আলোচনা সমালোচনা যেভাবেই হোক না কেন শাহবাগীদের কর্মকা-ে যে সরকারের চার সিটির দুর্গের পতন ঘঠেছে এটা এক বাক্যেই সবাই স্বীকার করছেন।
দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ চারটি সিটির নির্বাচনের পর বিশেষ করে রাজনীতিক, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, বিশিষ্টজন এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা নানাভাবে চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ‘ফলাফল’ বিশ্লেষণ করছেন। বিশিষ্টজনদের এই মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ নিয়ে বিতর্কে না গিয়েই সরল এবং সহজ কথায় বলা যায় মহাজোট সরকারের সাড়ে চার বছরের নানামুখী ব্যর্থতা, অপশাসন, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, প্রতিপক্ষকে তুচ্ছজ্ঞান করা, তথাকথিত প্রগতিশীলতার নামে ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা, দাড়ি-টুপি দেখলেই খিস্তিখেউর করা এবং দেশ-জনগণের প্রতি অবহেলার জবাব ‘ভোট বিপ্লবের’ মাধ্যমে দিয়েছেন ভোটাররা। জনগণ ব্যালটের মাধ্যমে ‘অপ্রতিরোধ্য রাষ্ট্রশক্তির’ বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নিজেদের অবস্থান ‘জানান’ দিয়েছেন। ‘বুলেটের চেয়ে ব্যালট শক্তিশালী’ প্রমাণ করে ক্ষমতাসীনদের ‘অহংকারে’ আঘাত হেনেছে।
১৪ দলীয় জোটের প্রার্থীদের পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ যেভাবেই করা হোক না কেন প্রকৃত অর্থেই নানাবিধ কারণে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোটাররা ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে ১৪ দল সমর্থিত প্রার্থীদের ভরাডুবি ঘটিয়েছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও বড় দুই দলের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে প্রচার-প্রচারণায় জাতীয় ইস্যুগুলো সামনে চলে এসেছে। এসব ইস্যুর মধ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রশাসনে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জুলুম নির্যাতন, দখলদারিত্ব, অপ্রতিরোধ্য ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাস, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, হলমার্ক-ডেসটিনি-ইউনি পে টু, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার লুট, প্রশাসনের ছত্রছায়ায় আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের দেশব্যাপী টেন্ডারবাজি ইস্যুগুলো সামনে চলে এসেছে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দলের দুর্নীতিবাজদের পক্ষে সরকার প্রধানের ‘সরাসরি অবস্থান’ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। চর দখলের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দখল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ওপর এসিড নিক্ষেপ, সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের জুলুম-নির্যাতন, ভর্তি বাণিজ্য, দিন-দুপুরে আজরাইলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বিশ্বজিৎ হত্যাসহ অসংখ্য মানবতাবিরোধী অপরাধ করলেও ছাত্রলীগের চিহ্নিত অপরাধীদের ‘ছায়া’ দিয়ে রাখার সরকারের কৌশল মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের দেশে দাড়ি টুপি পরিহিত মানুষ দেখলেই খিস্তিখেউর করা, দেশের আলেম ওলামা, মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্র বিশেষ করে অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতের ওপর জুলুম নির্যাতনের (মতিঝিলের শাপলা চত্বরে গভীর রাতে লাখ লাখ ওলামা-মাশায়েখের ওপর গুলী চালিয়ে বিতাড়িত করা) ঘটনা ভোটাররা ভালোভাবে নেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং চেতনার নামে নবী (সা.)-কে কটূক্তিকারী ব্লগারদের শাহবাগ মঞ্চের প্রতি সরকারের জোরালো সমর্থন, তাদের নিরাপত্তা দেয়া, তাদের আদেশ নির্দেশ পালন করা, খাবার সরবরাহ করা পক্ষান্তরে মতিঝিলে হেফাজতের নেতাকর্মীদের একরাত থাকতে না দিয়ে বর্বরভাবে বিতাড়িত করার ঘটনা মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। ফলে ইসলামপ্রিয় তৌহিদী জনতার মধ্যে যারা এতোদিন আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে তারা সিটি নির্বাচনে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
বাস্তবতাকে অস্বীকারকারী, দৃশ্যমানকে না দেখার ভান করার কৌশলী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের জনপ্রিয়তা  গত সাড়ে চার বছরে কতটা যে তলানীতে ঠেকেছে সেটা এদেশের একজন সাধারণ মানুষ বুঝতে পারলেও সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অধিষ্ঠিত ভিআইপিবৃন্দ কিন্তু কিঞ্চিতও বুঝতে পারেননি। চট্টগ্রাম মহানগরীর সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দীন চৌধুরী যখন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কুপোকাৎ হন তখনই আওয়ামী হাইকমান্ডের বোঝা উচিত ছিল যে, তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের বোধোদয় হয়নি। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির একজন বহিষ্কৃত নেতাও যখন সেখানকার নির্বাচনে আওয়ামী প্রার্থীকে ধরাশায়ী করেন তখনও তাদের চৈতন্যোদয় হয়নি। ঐ দিকে নারায়ণগঞ্জে সেলিনা হায়াত আইভী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হলেও হাইকমান্ড সমর্থিত প্রার্থীকে তিনি পরাজিত করেন। এই পরাজয়ের অর্থ ছিল, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি নারায়ণগঞ্জবাসীর অনাস্থা।
এরপর প্রায় এক বছর পরেই  এলো একসাথে চারটি বড় বড় সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। সেগুলো হলো সিলেট, খুলনা, রাজশাহী ও বরিশাল। এই চারটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনকে ঐ চারটি মহানগরীর অধিবাসীরাই নয়, সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ শুধুমাত্র স্থানীয় নির্বাচন নয়, জাতীয় নির্বাচনের আঙ্গিকে গ্রহণ করে। কারণ, এর মাঝে সারাদেশে এমন কিছু ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে যায় যেগুলো শান্তিপ্রিয় সাধারণ নিরীহ মানুষের নিস্তরঙ্গ জীবনে প্রবল ঢেউ সৃষ্টি করে। একটি বিচারের রায়কে কেন্দ্র করে তিন মাস ধরে ‘শাহবাগী’ বলে পরিচিত কিছু নাস্তিক যুবকসহ একটি মঞ্চের কয়েক ব্যক্তিকে সরকার জামাই আদরে পালপোষ করে। তারা তিনমাস ধরে ‘খতম কর’, ‘জবাই কর’ শ্লোগান সম্বলিত উত্তেজক বক্তৃতা করে জনগণকে সহিংসতার পথে উস্কে দেয়। পক্ষান্তরে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ, অতি দরিদ্র, নিরীহ, সহজ সরল আলেম ওলামাকে একটি মাত্র রাত অর্থাৎ ১২ ঘণ্টার জন্যও শাপলা চত্বরে রাত্রি যাপন করতে দেয়া হয়নি। রজনীর শেষ প্রহরে বাতি নিভিয়ে গভীর ঘন অন্ধকারে ১০ থেকে ২০ হাজারের স্ট্রাইকিং ফোর্স ঐসব আলেম ওলামার বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে। ঐ অভিযানে কতজন আদম সন্তান নিহত হয়েছেন সেটির সঠিক হিসাব কেউ জানেন না। তবে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকারের’ সর্বশেষ রিপোর্ট মোতাবেক ২০২ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন এবং ২৫০০ ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন। বিএনপি এবং হেফাজতে ইসলামসহ অনেক সংগঠন নিহতের সংখ্যা আড়াই থেকে তিন হাজার বলে দাবি করেছেন। নিহতের সংখ্যা যাই হোক না কেন, এত বড় একটি ভয়াবহ অভিযান, যার পরিণতিতে সংঘটিত মৃত্যুকে অনেকে গণহত্যা বলছেন, সেটির একটি বিচার বিভাগীয় তদন্তেরও ব্যবস্থা করেনি সরকার।
দেশের রাজনীতি সচেতন মানুষের কাছে একটি কথা খুবই জোরালোভাবে আলোচনা হচ্ছে আর তা হলো চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চারজন ছিলেন নিঃসন্দেহে হেভিওয়েট প্রার্থী। এদের মধ্যে সিলেটের বদরুদ্দিন কামরান, খুলনার তালুকদার খালেক, বরিশালের হিরণ, রাজশাহীর লিটন আওয়ামী লীগের সেন্ট্রাল লিডার। তাদের তুলনায় বিএনপির চার প্রার্থী জাতীয় পর্যায়ে বা সেন্ট্রাল লিডার নন। তৎসত্ত্বেও সিলেটে  কামরান হেরেছেন ৩৫১৫৭ ভোটে, রাজশাহীতে লিটন হেরেছেন ৪৮৩৮০ ভোটে, খুলনায় তালুকদার খালেক ৬০৬৭১ ভোটে এবং বরিশালে হিরণ হেরেছেন ১৮০১০ ভোটে। সিটি কর্পোরেশন বা কোনো পৌরসভার মেয়র বা সভাপতি নির্বাচনে এতো বিশাল ভোটে এই ৪২ বছরে আর কেউ পরাস্ত হননি। অবশ্য বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, যদি নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হতো এবং নির্বাচন কমিশন আরো নিরপেক্ষ ও কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করত তাহলে আওয়ামী লীগের প্রতিটি প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হতো।
নির্বাচনে চার সিটির কাস্টিং ও নন কাস্টিং ভোটের মধ্যেও আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের জন্য আরো ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে। চার সিটিতেই দেখা যাচ্ছে একটি বড় অংশের ভোটাররা এই নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। এই ভোটাররা আসলে কারা? কারা ভোট দিতে পারেননি? এমন দু’একটি সহজ প্রশ্নের জবাব বেরিয়ে আসলেই প্রকৃত অর্থে দেশবাসী বুঝতে পারবেন নন কাস্টিং ভোট বা এই ভোটাররা আসলেই কারা?
একটি কথা দেশবাসী যথেষ্ট সচেতনতার সাথেই অবহিত আছেন যে, চার সিটিতেই জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির এবং বিরোধীদলের আরো অনেক নেতাকর্মী আছেন যারা এই সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলা হামলায় ঘর ছাড়া অবস্থাতে রয়েছেন। তারা নির্বাচনেও ভোট দিতে পারেননি। যেমন কাস্টিং ভোটের হিসাবে বরিশালে কাস্টিং ভোট মাত্র ৭৩ ভাগ, রাজশাহীতে ৭৬ ভাগ, খুলনাতে ৬৭ ভাগ আর সিলেটে কাস্টিং ভোটের পরিমাণ মাত্র ৬৩ ভাগ। কাস্টিং ভোটের পরিমাণ যদি কমবেশি ৮৩ বা ৮৫ হতো তাহলে বিজয়ী  ও বিজিত প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের  ব্যবধানটা আরো অনেক বেশি হতো এটাই স্বাভাবিক একটি সমীকরণ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads