১৫ জুন ২০১৩ ইং তারিখে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট এ চার সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়ে গেল। চার চারটিতেই বিরোধী দলের প্রার্থীরা ব্যাপক জয় পেয়েছেন। তাই বলছি, প্রধানমন্ত্রী! আপনি জনগণের মনের ভাষা বুঝুন, রাজপথের শ্লোগান শুনুন, পথে পথে উত্তাল জনস্রোত ও জনসমুদ্র দেখুন। আর এবার বাস্তবে দেখলেন রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট এ চার সিটি কর্পোরেশনের জনগণের মনে কি আছে। জনগণ কাগজে কলমে অর্থাৎ ব্যালটের মাধ্যমে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করেছে। আপনি হারিয়েছেন আপনার চার চার জন নগর পিতাকে আর ১১৮ জন কাউন্সিলরের মধ্যে আপনার হাত ছাড়া হয়েছে ৭৫ জন।
গত ১ ডিসেম্বর ২০১২ ইং শনিবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি মৌলভী বাজারের জনসভায় প্রকাশ্যে বিরোধী দলীয় নেত্রীর উদ্দেশে বলেননি যে, “জনগণের মনের কথা শুনুন, জামায়াতের সঙ্গ ছাড়–ন; তা না হলে আপনার দুর্নীতির বিচার করা হবে।” গত ২৩ ডিসেম্বর বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেছিলেন, “যুদ্ধাপরাধের বিচার গ্রহণযোগ্য করতে হলে আগে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার করতে হবে”। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার ২৪ ডিসেম্বর ২০১২ ইং তারিখের অনলাইন জনমত জরিপে বিরোধীদলীয় নেত্রীর বক্তব্যের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছে ৬৭.৫০ শতাংশ, বিপক্ষে ‘না’ ভোট দিয়েছে ১৪.৯০ শতাংশ, ভোট দেয়া থেকে বিরত ছিল বা মন্তব্য নেই ১৭.৬০ শতাংশ পাঠকের, যার অনলাইন পাঠক সংখ্যা ছিলো মোট ৯,১৩৮ জন।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে যে কোন দলের যে কোন ব্যক্তি যখন নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন তখন সে ব্যক্তি কোন দলের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী থাকেন না। তারা তখন দেশের, জনগণের, রাষ্ট্রের বা সরকারের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী হয়ে যান। সে দেশে বিভিন্ন দল, মত ও পথের লোক থাকে। অতএব, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী যারা হবেন তারা সকল দলের, মতের ও পথের অর্থাৎ সে দেশের সকল মানুষের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের শপথ গ্রহণ করে থাকেন। যেমন বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় তফসিলের ১৪৮ অনুচ্ছেদের বিধান মতে তারা যখন শপথ গ্রহণ করেন তখন বলেন, “আমি.........ক.............., পিতা........খ........, সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করছি যে, আমি আইন-অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি/বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী/ মন্ত্রী/ প্রতিমন্ত্রী/ উপমন্ত্রী-পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব; আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব; এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।”
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শেখ হাসিনা কি তার দল আ’লীগের দলীয় প্রধানমন্ত্রী না বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের তথা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী? কোন দলের প্রধান ব্যক্তি সহ অন্যান্য ব্যক্তিগণ যখন নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন তখন তিনি আর সে দলের দলীয় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন না।
উপরোক্ত শপথের আলোকে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কি দায়িত্ব পালন করছেন? না আ’লীগের দলীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন? ভেবে দেখবেন কি? আপনার সাথে সাথে আপনার মন্ত্রী সভার সদস্যগণও কি শপথ ভঙ্গের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত নন? বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, আইন, তথ্য ও দপ্তরবিহীন মন্ত্রী তারা সকলেই কি যথারীতি শপথ ভঙ্গ করছেন না? গত ১ ডিসেম্বর ২০১২ ইং শনিবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি মৌলভীবাজারের জনসভায় প্রকাশ্যে বিরোধীদলীয় নেত্রীর উদ্দেশ্যে বলেননি? যে, “জনগণের মনের কথা শুনুন, জামায়াতের সঙ্গ ছাড়–ন; তা না হলে আপনার দুর্নীতির বিচার করা হবে।” আপনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ করেছেন যে, “আমি শেখ হাসিনা, সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ করিতেছি যে, আমি আইন-অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব; আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব; এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।” মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মৌলভীবাজারের জনসভার ঘোষণার সাথে আপনার শপথের মিল কোথায়? এ ঘোষণা শপথ ভঙ্গের সামিল নয় কি?
গত ৯ ডিসেম্বর ২০১২ ইং বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালীন ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা পুরান ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরীহ কর্মজীবী বিশ্বজিৎ দাসকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আর রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে। আপনার দপ্তর থেকে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ১৩ ডিসেম্বর ২০১২ ইং বিকাল ৫ টায় সংবাদ সম্মেলন করে বললেন, বিশ্বজিৎ দাসের হত্যাকা-ের সাথে জড়িতরা কেউই ছাত্রলীগের কর্মী নন। তিনি আরো জানালেন এ হত্যাকা- বিএনপি ও জামায়াতই ঘটিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর কি ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশের এহেন বক্তব্য দিতে পারে? দেশের মানুষ কি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলো বিশ্বজিৎ দাসের হত্যাকারী কে?
দেশের সকল ইলেক্ট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ার সুবাদে বিশ্ববাসী সচিত্র প্রতিবেদন দেখেছে, বিশ্বজিৎ দাসের হত্যাকারী কে, অতএব প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে ঘোষিত অভিযোগ শতভাগই অসত্য ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এহেন ঘটনা বা অসত্য বক্তব্য প্রধানমন্ত্রীর শপথের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ নয় কি? শপথ ভঙ্গের পর নৈতিক কারণে বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বপদে থাকতে পারেন কি?
“রামুর বৌদ্ধ-বিহারে আগুন, তাজরীন গার্মেন্ট-এর মানুষ পুড়িয়ে হত্যা, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু দুর্নীতি ও বিশ্বজিৎ দাসের হত্যাকা- এসবই যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্যে।” প্রধানমন্ত্রীর মুখে এ ধরনের বক্তব্য শোভা পায় কি? প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য যদি আমরা সঠিক ধরে নেই তা হলে তো বলতেই হয় আসলে আপনার দলের লোকেরাই তো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না। কারণ সমস্ত মিডিয়াতেই সচিত্র প্রতিবেদনের মাধ্যমে রামুর বৌদ্ধ-বিহারে আগুন লাগানোর জন্যে আপনার দলের লোকদেরকেই দায়ী করেছে যা চিত্রে দেখা গেছে। স্থানীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকেরাও আপনার দলের লোকদেরই নাম বলেছে। তাছাড়া গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টেও আ’লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নামই এসেছে। তাজরীন গার্মেন্ট-এর মালিকও আপনার দলীয় লোক। গত নির্বাচনে তিনি আপনার মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছে, প্রচুর অর্থও ব্যয় করেছে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির সাথে যারা জড়িত তারাও সকলেই আপনার নিয়োজিত মন্ত্রী ও আমলা তারা সকলে আপনারই লোক। বিশ্বজিৎ দাসকে যারা হত্যা করেছে তারা তো আপনার দলেরই ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা। আর আপনার সোনার ছেলেরা তো হত্যার কারণও বর্ণনা করেছেন। ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত রফিকুল ইসলাম শাকিল বলেছে, “যোগ্যতা প্রমাণের জন্যেই বিশ্বজিৎ দাসকে হত্যা করা হয়েছে।” তার এ কথার অর্থ কি এ নয় যে হত্যা বা খুন করতে না পারলে ছাত্রলীগে থাকা যাবে না?
এসকল ঘটনা যদি যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্যে হয়ে থাকে তা হলে তো বলতেই হয় যেখানে আপনার দলের লোকেরাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না সেখানে কি সাধারণ মানুষ এই প্রহসনের বিচার চাইতে পারে? যেহেতু আপনার মরহুম পিতা ১৯৫ জন প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়েছেন, সেহেতু আপনার দলের লোকেরা আপনার পিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই রাজনৈতিক কারণে প্রহসনের বিচার চায় না। অতএব, আপনি আপনার দলের ও সাধারণ মানুষের মনের কথা বুঝুন, শ্লোগান শুনুন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে প্রহসনের নাট্য মঞ্চ ভেঙ্গে দিন, বিচার বন্ধ করুন, আপনার পিতার আত্মাকে শান্তিতে থাকতে দিন।
এবার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার অনলাইন জনমত জরিপের কথা শুনুন। বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেছিলেন, “যুদ্ধাপরাধের বিচার গ্রহণযোগ্য করতে হলে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার করতে হবে”। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার ২৪ ডিসেম্বর ২০১২ ইং তারিখের অনলাইন জনমত জরিপে বিরোধী দলীয় নেত্রীর বক্তব্যের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছে ৬৭.৫০ শতাংশ, বিপক্ষে ‘না’ ভোট দিয়েছে ১৪.৯০ শতাংশ, ভোট দেয়া থেকে বিরত ছিল বা মন্তব্য নেই ১৭.৬০ শতাংশ পাঠকের, যার অনলাইন পাঠক সংখ্যা ছিলো মোট ৯,১৩৮ জন। অতএব আপনি নীরব পাঠকদের মনের কথা বুঝার চেষ্টা করবেন কি?
প্রধানমন্ত্রী আপনি মৌলভীবাজারের জনসভায় প্রকাশ্যে বিরোধী দলীয় নেত্রীকে নসিহত করেছিলেন, “জনগণের মনের কথা শুনুন, জামায়াতের সঙ্গ ছাড়–ন।“ আমি বলতে চাই জনগণের মনের ভাষা আপনিও বুঝুন, রাজপথের শ্লোগান শুনুন আর ১৫ জুন ২০১৩ ইং তারিখের চার সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে ক্ষোভের প্রকাশ বাস্তবে ব্যালটের জবাব দেখুন। মানুষ আপনার ওপর ও আপনার সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। তারা প্রকাশ্যে আপনার লগি-বৈঠার তা-বের কারণে, আপনার দলের শান্তির প্রতিক লাঠির ভয়ে, লোহার রড আর চাপাতি বাহিনীর খুনের দৃশ্য দেখে, লাইসেন্সবিহীন অস্ত্রধারী গু-া বাহিনী আর লাইসেন্স করা অস্ত্রধারী পুলিশ বাহিনীর ভয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে পারছেনা। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার অনলাইন জরিপ তারই সাক্ষী।
প্রধানমন্ত্রীকে আরো একটি পত্রিকার অনলাইন জনমত জরিপের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। গত ১৫ ডিসেম্বর ২০১২ ইং বাংলাদেশে বহুল প্রচারিত ইংরেজী দৈনিক দ্যা ডেইলি ষ্টার পত্রিকার জনমত জরিপের বিষয় ছিলো, “বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত আইনজীবীদের দাবী অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচার কাজ নতুন করে শুরু করার দাবির সাথে আপনি কি এক মত? দাবির পক্ষে ভোট দিয়েছে ৭৩ শতাংশ পাঠক আর বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন ২৬ শতাংশ পাঠক, ভোট দেয়া থেকে বিরত ছিলো ১ শতাংশ পাঠক। প্রধানমন্ত্রী ! তা হলে আপনি চেয়ে দেখুন দেশের ৭৩ শতাংশ মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের যেনতেন বা প্রহসনের বিচার চায়নি।
বর্তমান সরকারের দুর্নীতির চিত্র দেখে আপনি কি বলবেন? দুর্নীতির ব্যাপারে আপনার দলের প্রবীণ নেতা জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার বর্তমানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, “আমাদের দেশে বিভিন্ন সেক্টরে যে পরিমাণ দুর্নীতি হচ্ছে সে টাকা দিয়ে প্রতিবছর একটি করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব”। গত ২০/১২/২০১২ ইং দৈনিক যুগান্তরের জনমত জরিপে ১৫৭৩০ জন পাঠক ভোট দিয়েছেন। তার মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছেন ৭২.৬৫% বা ১১৪২৮ জন পাঠক। আর ‘না’ ভোট দিয়েছেন ২৭.৩০% বা ৪২৯৫ জন পাঠক। মন্তব্য করেননি ০.০৫% বা ৭ জন পাঠক। একই দিনে অর্থাৎ ২০/১২/২০১২ ইং দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার জনমত জরিপে ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছেন ৯৬.৪৫% পাঠক। ‘না’ ভোট দিয়েছেন ২.৮৮% পাঠক। মন্তব্য করেননি ০.৬৭% পাঠক। তাছাড়াও বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেছেন, “দেশ আজ দুর্নীতির করাল গ্রাসে ভারাক্রান্ত”। তাঁর এ মন্তব্যের ব্যাপারে ২৮/১২/২০১২ ইং দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার জনমত জরিপে ৬৩.৪৩% পাঠক হ্যাঁ ভোট দিয়েছেন। আর ৩৬.২৪ % পাঠক না ভোট দিয়েছেন। ০.৩৩% পাঠক কোন মন্তব্য করেননি।
প্রধানমন্ত্রীর মরহুম পিতা দুঃখ করে তৎকালিন আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “মানুষ পায় সোনার খনি, আর আমি পেলাম চোরের খনি”। আপনার পিতার সেই আওয়ামী লীগই তো আজকের এই আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও আপনার পিতার একনিষ্ঠ ভক্ত দেশের প্রবীণ সাংবাদিক, সকলের শ্রদ্ধেয় মুসা ভাই বলেছেন, “আওয়ামী লীগের সব চোর, মানুষ তাদের দেখলে বলতে শুরু করবে ঐ চোর যায়”। পত্রিকার নীরব পাঠকের মনের কথা সহ প্রধানমন্ত্রী বিষয়গুলো ভেবে দেখবেন কি?
আপনি কি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতের গুরুত্ব দেবেন না? আপনি কি দেখেননি গত ২৬ ডিসেম্বর ২০১২ ইং তারিখের বিরোধীদলের গণসংযোগ কর্মসূচি? কিভাবে সারা ঢাকা শহরে উত্তাল জনস্রোত থেকে জনসমুদ্র সৃষ্টি হয়েছিলো। আপনি কি হেফাজতে ইসলামের গত ৬ এপ্রিল ২০১৩ ইং তারিখে মতিঝিলের জনসমুদ্র দেখেননি? গত ৫ মে ২০১৩ ইং তারিখের ঝঞ্ঝার মতো উত্তাল বাংলাদেশ দেখেননি?
আপনি যশোরে বলেছেন, “খালেদা জিয়ার মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা মানায় না।” তাহলে কি মুক্তিযোদ্ধারা শুধু আপনার বা আওয়ামী লীগেরই সম্পদ? আর আপনিই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কথা বলবেন? যদি তা-ই হয় তাহলে আপনার মরহুম পিতা হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছেন এ ব্যাপারে আপনি কি বলবেন? যারা আওয়ামী লীগ করে শুধু তারাই কি মুক্তিযোদ্ধা? আর যারা আওয়ামী লীগ করে না তারা কি সকলেই রাজাকার?
আপনি বলবেন কি? ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশারফ সাহেব কোন সেক্টরের কত নম্বর মুক্তিযোদ্ধা? ড: ম.খা.আলমগীর কোন সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা? তার পরিবারের কে কবে কোথায় মুক্তিযুদ্ধ করেছেন? মতিয়া চৌধুরী কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন? জনাব হাসানুল হক ইনুই বা কোথায় মুক্তিযুদ্ধ করেছেন? লে: কর্ণেল (অব) ফারুক খান কোন পরিবারের মুক্তিযোদ্ধা? দীলিপ বড়–য়া কোন দেশের মুক্তিযোদ্ধা? নুরুল ইসলাম নাহিদ কোথাকার মুক্তিযোদ্ধা? এ্যাডভোকেট কামরুল তিনিই বা কোন পরিবারের কোথায় যুদ্ধ করেছেন?
প্রধানমন্ত্রী ! আপনি ও আপনার মন্ত্রী পরিষদের সদস্যগণ যদি মনে করেন, শপথ করা আর শপথ ভঙ্গ করা তেমন দোষের কিছু না ! হ্যাঁ এমনটা মনে করতে পারেন। এটা মেকিয়াভেলী মতাদর্শ। মেকিয়াভেলী সৃষ্টিকর্তা, ধর্ম বা নীতি-নৈতিকতা বলতে কোন কিছুই স্বীকার করতো না। তার দর্শন মূলত: শাসক ও শাসন কার্য বিষয়ক। তার মতে (১) শাসনকার্য পরিচালনার জন্যে ধর্ম, নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ বলে কিছু থাকবে না। (২) শাসক হবে শৃগালের মতো ধূর্ত ও সিংহের মতো হিংস্র। জনগণকে ভীত-সন্ত্রস্ত্র করে রাখতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। আইন প্রয়োগে কাজ না হলে প্রয়োজনে পাশবিকতার পথ অবলম্বন করতে হবে। পাশবিকতার ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখালে হিতে-বিপরীত হতে পারে। (৩) শাসক তার স্বার্থরক্ষার জন্যে যে কোন ওয়াদা, শপথ ও বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারবে। অতীতে যারা ওয়াদা বা শপথ ও বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে পরবর্তীতে তারা কেউ ঘৃণিত হয়নি। (৪) ধর্ম, নীতি-নৈতিকতার ব্যাপারে দ্বৈত নীতি বা উড়ঁনষব ঝঃধহফধৎফ অবলম্বন করা যাবে। জনসাধারণের জন্যে আইন-কানুন, বিধি-বিধান ও নীতি-নৈতিকতা অবশ্যই পালনীয়, শাসকদের জন্যে তা পালন করা জরুরী নয়। শাসক প্রয়োজন অনুযায়ী আইন অনুসরণ করবেন, প্রয়োজনে আইন বা বিধি-বিধান ও নীতি পরিবর্তন করবেন। (৫) শাসকের জন্য কপটতা তথা মিথ্যা কথা বলা দোষের কিছু নয়। প্রয়োজনে বেশ ধরবে ও ভান করবে। ভিন্ন পরিস্থিতির সব কিছু সবাইকে খুলে বলা যাবে না। পরিস্থিতি অনুযায়ী ওয়াদা বা শপথ করবে, দয়া দেখাবে, মানবতা রক্ষা করবে, ধর্ম মানবে, প্রয়োজনে ধর্মের বিরুদ্ধে কাজ করবে। অর্থাৎ সর্বাবস্থায় পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। (৬) মানুষকে প্রতারিত করা সহজ তবে এ কাজটা সু-কৌশলে করতে হবে। যে কোন পন্থায় শাসককে ক্ষমতা ধরে রাখতে হবে, প্রয়োজনে সন্ত্রাসী, গু-ামী ও ভ-ামী বা বিশ্বাসঘাতকতা করা কোন দোষ বা অপরাধ নয়।
জানেন কি? মানুষ পেছনের কথা ভুলে গেলেও স্মরণ করানোর লোকও সমাজে থাকে। এক সময় জনগণ তাদের হিসেব ঠিকই মিলিয়ে নেবে। আর এ ভয়েই কি আপনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছেন?
জানেন কি? মরহুম শেখ মুজিব ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৩ টি আসন লাভ করেছিলেন। এতো বিশাল বিজয়ের পর তিনি দ্রুততম সময়ের মধ্যেই বাকশাল নামে একনায়কতন্ত্র চালু করেছিলেন। মানুষের বাক স্বাধীনতা হরণ করেছিলেন। কারণ আপনার পিতা ভালো করেই জানতেন ১৯৭৩ সালের নির্বাচন কিভাবে হয়েছিলো, আর কি নির্বাচন হয়েছিলো। তার যদি এতো বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রতি আস্থা থাকতো তাহলে তিনি বাকশাল কায়েম করতেন না। ২০০৮ এর নির্বাচনে আপনি তার চাইতে কম আসন পেলেও তিন চতুর্থাংশেরও বেশী আসনে জিতেছেন। নির্বাচনে জিতে বাংলাদেশে সংবিধান তছনছ করে দিয়েছেন? তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছেন? তাহলে কি জনগণের প্রতি আপনার কোন আস্থা নেই? ইতোমধ্যে আপনিই স্বীকার করলেন যে, আপনার দলের লোকেরাই আপনার অনেক কর্মসূচি পছন্দ করছে না। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধের বিচার তারা বাধাগ্রস্ত করছে। আপনি যদি জনগণের মনের ভাষা বোঝেন, জনগণের শ্লোগান শোনেন, রাজপথে উত্তাল জনসমুদ্র দেখেন আর জনগণের দাবী মেনে নেন তাতেই আপনার দেশের ও জনগণের মঙ্গল।
চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পরের দিন অর্থাৎ ১৬ জুন আপনি মহান জাতীয় সংসদে আপনার অনির্ধারিত বক্তব্যে বলেছেন, “অনির্বাচিত তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইলে নির্বাচন নাও হতে পারে।” হ্যাঁ ! সরকারের হাতে ক্ষমতা আছে, দলীয় ক্যাডার আছে, প্রশাসন সরকারের নিয়ন্ত্রণে, র্যাব, পুলিশ, আর্মি ও বিজিবি সরকারের হুকুমে চলে, কিন্তুু বুঝতে হবে জনগণ কারও হুকুমের তাবেদার নন। অতএব, জনগণের ভাষা বুঝতে হলে জনগণের কাছে আসতে হবে। জনগণের কাছে আসতে হলে নির্বাচন দিতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে জনগণের ভাষা বুঝতে হলে বা জনগণের রায় নিতে হলে প্রয়োজনে গণভোটের ব্যবস্থা করতে পারেন। তারপরও বলবো জনগণকে ছেড়ে যাবেন না।
অতএব, প্রধানমন্ত্রী! আপনাকে বিনীত ভাবে বলতে চাই, আপনি জনগণের মনের ভাষা বুঝুন, রাজপথের শ্লোগান শুনুন, পথে পথে উত্তাল জনস্রোত ও জনসমুদ্র দেখুন। আর এবার বাস্তবে দেখলেন রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট এ চার সিটি কর্পোরেশনের জনগণের মনে কি আছে। জনগণ কাগজে কলমে অর্থাৎ ব্যালটের মাধ্যমে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করেছে। আপনি হারিয়েছেন আপনার চার চার জন নগর পিতাকে আর ১১৮ জন কাউন্সিলরের মধ্যে আপনার হাত ছাড়া হয়েছে ৭৫ জন। এটাই জনগণের মনের ভাষা। যত তাড়াতাড়ি আপনি তা বুঝবেন তাতে দেশ জাতি ও সকলেরই কল্যাণ হবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন