সিটি করপোরেশন নির্বাচন রাজনৈতিক পরিচয়ে হওয়ার কথা নয়। স্থানীয়
সরকারের এই নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের সরাসরি কোনো প্রার্থী না থাকলেও যারা প্রার্থী
হয়েছেন তাদের সবার রাজনৈতিক পরিচয় আছে। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল চার সিটি
করপোরেশনের চারজন প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিটি
করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী দেয়ায় বিরোধী দলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
স্থানীয়পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক পরিচয় সামনে
রেখেই তাদের নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। বিরোধী দল খুব স্বাভাবিকভাবেই এই
নির্বাচনে জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যুগুলো সামনে আনার চেষ্টা করবে। অরাজনৈতিক
নির্বাচনের আড়ালে মূলত রাজনৈতিক লড়াই এখন এই নির্বাচনে ঘটতে যাচ্ছে। নির্বাচন যত
ঘনিয়ে আসবে রাজনৈতিক উত্তাপ আরো বাড়তে থাকবে। শেষ পর্যন্ত প্রার্থীদের যোগ্যতা, মেধা কিংবা
উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মতো স্থানীয় সমস্যাগুলোর গুরুত্ব ভোটারদের কাছে কমে যাবে। এর
কিছু কিছু আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বিরোধী দল সিটি করপোরেশন নির্বাচন শুরুতে খুব গুরুত্বের সাথে নিয়েছে
বলে মনে হয় না। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকেই এই নির্বাচনকে শুধু গুরুত্ব নয়, রাজনৈতিক রূপ
দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা
মেয়র ছিলেন। ফলে এই নির্বাচনে তাদের পরাজয়ের অর্থ হবে শুধু প্রার্থীর পরাজয় নয়, ক্ষমতাসীন দলের
প্রতিও অনাস্থা। ফলে ক্ষমতাসীন দল আবার বিজয়ী হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
প্রচার-প্রচারণায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মধ্যে অনেক বেশি অংশগ্রহণ ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা
লক্ষ করা যাচ্ছে। এমনকি মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়ে আচরণবিধি
লঙ্ঘনের অভিযোগও উঠেছে। ক্ষমতাসীন দল এই নির্বাচনকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে তার
প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে খুলনা ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মন্ত্রীদের
উপস্থিতি। খুলনায় শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেখার
নামে নির্বাচনী এলাকা সফর করেছেন। রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকার অদূরে একাধিক
মন্ত্রী বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকে সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে
মন্ত্রীরা স্বীকার করেছেন। ঢাকাতেও ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতা সিটি করপোরেশন
নির্বাচনে বিরোধী দলসমর্থিত প্রার্থীর প্রচারণা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ক্ষমতাসীন
দলের পক্ষ থেকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যেভাবে রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ানো হয়েছে, বিরোধী দল এই
নির্বাচনকে অরাজনৈতিকভাবে বিবেচনায় নিলে তাতে শুধু তাদের পরাজয় নয়, রাজনৈতিক
বিপর্যয়ও নেমে আসতে পারে। কারণ এই নির্বাচনের ফলাফল আগামী দিনে জাতীয় রাজনীতিতে
কমবেশি প্রভাব ফেলবে।
সিটি করপোরেশন নির্বাচন কতটা নিরপেক্ষ ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবমুক্ত
হবে তা নিয়ে এখন থেকেই সন্দেহ ও সংশয় রয়েছে। এই নির্বাচনকে ক্ষমতাসীন দলের
জনসমর্থনের মাপকাঠি হিসেবে যত বিবেচনা করা হবে, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের
জন্য তত বেশি ঝুঁকি বাড়বে। কারণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে স্থানীয়
প্রশাসনে বড় ধরনের কোনো রদবদল করা হয়নি। সন্ত্রাসী বা অবৈধ অস্ত্রধারীদের ধরতে
চালানো হয়নি কোনো অভিযান। ফলে এরা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে। প্রার্থীদের সাথে এখন
প্রচারে অংশ নিচ্ছে। দেশের পুলিশ প্রশাসনকে যেভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে তাতে
ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকেরা আইন ভঙ্গ করলেও তারা চোখ বুঝে থাকছেন। তার প্রমাণ পাওয়া
গেছে সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী প্রচারে। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক প্রার্থীকে
একজন অস্ত্রধারী যুব নেতা নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে। সে ছবি
সংবাদপত্রে ছাপাও হয়েছে। কিন্তু তাকে পুলিশ গ্রেফতার করেনি। ক্ষমতাসীন দলসমর্থিত
মেয়রপ্রার্থী বলেছেন, তার নির্বাচনী প্রচারে কে অংশ নিচ্ছে, সেটি তার দেখার বিষয় নয়।
কিন্তু একই শহরে ভিন্ন চিত্রও দেখা যাচ্ছে। বিরোধী ছাত্র সংগঠনের একাধিক নেতাকে
গ্রেফতার করা হয়েছে। নিশ্চয়ই বিরোধী দলের সমর্থক প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারে
ভূমিকা রাখতেন। অর্থাৎ সিলেটের পুলিশ প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে
পারছে না। নির্বাচনের দিন যত সামনে চলে আসবে, এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটতে থাকবে।
পুলিশসহ প্রশাসন যদি এভাবে কোনো প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নেয়, তা হলে নীরবে
কেন্দ্র দখল করে ভোট সম্পন্ন হয়ে যাবে। সিটি করপোরেশন নির্বাচন যদি এভাবে
রাজনৈতিক ইজ্জতের প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয় তা হলে ভোট কেন্দ্র দখল করে বিজয়ী হওয়া
ঠেকানোর মতো মুরোদ বর্তমান প্রশাসন দেখাতে পারবে না। কারণ মন্ত্রী, সদ্যবিদায়ী
মেয়র বা ক্ষমতাসীন দলের চাওয়া-পাওয়া বা ইচ্ছে আকাক্সা আমাদের প্রশাসনের
কর্তাব্যক্তিরা গুরুত্ব দেবেন না-এমনটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও যথেষ্ট টাকার খেলা হবে বা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন
দলের জন্য এই খেলায় বিজয়ী হওয়া অনেক সহজ। কারণ ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনের টাকা
জোগায় ভূতে। এই ভূতদের দেখা যায় না, কিন্তু টাকা ঠিকই তারা উড়ায়।
এরা হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের বেনিফিশিয়ারি গোষ্ঠী। বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে
সামনে রেখে অনেক ভূত নাকি ঢাকা থেকে নৌপথে অনেক আগেই বরিশাল পৌঁছে গেছেন। এদের
টার্গেট বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার নিম্ন আয়ের বস্তিবাসী
ভোটারদের ওপর সওয়ার হওয়া। বিরোধী দলের প্রার্থী ভোটের অঙ্কের হিসাবে এগিয়ে
থাকলেও ভূতে জোগানো এই টাকায় সব হিসাব উলট-পালট হয়ে যেতে পারে। একই অবস্থা
খুলনাতেও। বিদায়ী মেয়র দায়িত্ব পালনের পর তার সম্পদ বাড়িয়েছেন কয়েক গুণ।
সম্পদের হিসাবের তালিকায় তার তথ্য নিজেই দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলসমর্থিত খুলনার
মেয়রপ্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের ২০০৮ সালে বার্ষিক আয় ছিল তিন লাখ ৬২ হাজার
টাকা। এখন তা দাঁড়িয়েছে চার কোটি ৬৭ লাখ টাকায়। বরিশালের মেয়রপ্রার্থী শওকত
হোসেন হিরণের ছয় লাখ ১২ হাজার টাকার বার্ষিক আয়। এখন তিন কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
সম্পদ গড়ার এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে কিছু অংশ খরচ করতে অসুবিধা কোথায়? এর বিপরীতে
বিরোধী দলের প্রার্থী কতটা কুলিয়ে উঠতে পারবেন, সেটি এখন বড় প্রশ্ন।
ক্ষমতাসীন দলের জন্য উদ্বেগ হচ্ছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয়
রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ এখন প্রভাবিত করছে। ইসলামপন্থী ভোট ব্যাংক বিশেষ করে হেফাজতে
ইসলামের কর্মী-সমর্থকদের ভোট এবার বড় ফ্যাক্টর হয়ে দেখা দিয়েছে। হেফাজতে
ইসলামের ৬ এপ্রিল মতিঝিলের মহাসমাবেশের পর রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলেছিলেন আগামী
দিনে এই শক্তি দেশের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি নির্ণয়ে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে।
কিন্তু ক্ষমতাসীন দল ইঙ্গ-মার্কিন ওয়ার অন টেররের পুরনো রণকৌশলের অংশ হিসেবে
ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। অপরাপর ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের মতো
হেফাজতে ইসলামকেও তারা শত্রু হিসেবে টার্গেটে পরিণত করেছিলেন। ক্ষমতাসীন দলের
পৃষ্ঠপোষকতায় শাহবাগে এই যুদ্ধের দামামা বাজানো হয়েছিল। হেফাজতে ইসলামের মতো
অরাজনৈতিক সংগঠনের শান্তিপূর্ণ এই সমাবেশের পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, হেফাজতিরা
লেঙ্গুর গুটাইয়া পলাইয়া গেছে। এরপর ৫ মে তারা যখন আবার ফিরে এসেছেন তখন সশস্ত্র
উপায়ে তাদের সরিয়ে দিয়ে আহাদ প্রকাশ করা হয়েছে। শাপলা চত্বরের অপারেশন ফাশ
আউটে কত লোক মারা গেছেন তার হিসাব সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি। রাতের অন্ধকারে
বাতি নিভিয়ে অপারেশন চালানোর পর সাধারণ মানুষের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে ধারণা
শত শত নয় হাজার হাজার। সঠিক তথ্য প্রকাশ করা না হলে ধারণা বা গুজব সত্য হিসেবে
প্রতিষ্ঠিত হয়। হেফাজতের বিরুদ্ধে পরিচালিত অপারেশনেও তাই হয়েছে।
হেফাজত নেতারা শুরু থেকে বলেছিলেন তাদের আন্দোলন ঈমান-আকিদা রক্ষার
আন্দোলন, কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। শাহবাগের আন্দোলনে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক
পৃষ্ঠপোষকতা ও সামরিক কায়দায় ৫ তারিখে অভিযান চালানোর পর তারা ভালোভাবে বুঝতে
পেরেছেন ঈমান রক্ষার আন্দোলন টিকে থাকতে হলে রাজনীতিবর্জিত ভূমিকা নেয়ার সুযোগ আর
তাদের সামনে নেই। শান্তিপূর্ণ একটি সমাবেশে যখন গুলি চালানো হয় তখন নিরস্ত্র
মানুষ আহাজারি করা, নিরস্ত্র উপায়ে জবাব দেয়ার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া তাদের কিছুু
করার থাকে না। এখন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শাহবাগের আন্দোলনকারীদের রাজনৈতিক
পৃৃষ্ঠপোষকদের কাছ থেকে হেফাজতের নেতাকর্মীরা মুখ ফিরিয়ে নেবেন, এটিই তো
স্বাভাবিক। হেফাজতের নেতাকর্মীরা বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীকে সমর্থন বা ভোট দিচ্ছেন
বিষয়টি তেমন নয়, তারা অবস্থান নিচ্ছেন শাহবাগের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাকারীদের বিরুদ্ধে।
এখন এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা
অভিযোগ করেছেন বিরোধী দলের সমর্থিত প্রার্থীর নির্বাচনে ধর্মকে ব্যবহার করছে। এই
অভিযোগ বিশেষভাবে আনা হয়েছে রাজশাহী ও খুলনার বিরোধী দলসমর্থিত প্রার্থীর
বিরুদ্ধে। এমন এক সময় এই অভিযোগ করা হয়েছে, যখন হেফাজতে ইসলামের নেতারা
বিরোধী দলের প্রার্থীকে সমর্থনের ঘোষণা দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন দল এতে আতঙ্কিত বোধ
করছে। এর মধ্যে সিলেটের ক্ষমতাসীন দলসমর্থিত মেয়রপ্রার্থী মাদরাসাগুলো থেকে তার
পক্ষে তেমন সাড়া পাননি। বাংলাদেশের নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহারে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ও
জাতীয় পার্টি কেউই পিছিয়ে থাকে না। যদিও এই প্রচারের কৌশল এক রকম নয়। কিন্তু
এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নয় বরং ধর্মভীরু মানুষের
ক্ষোভ ও বিক্ষোভের রূপটি আমরা ভোটের রাজনীতিতে দেখছি। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে
হেফাজত ইস্যু এর একটি উপসর্গমাত্র। হেফাজতের আন্দোলন ও অপারেশন ফাশ আউটের মাধ্যমে
এই আন্দোলন দমনের নিষ্ঠুুর প্রচেষ্টা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে রাজনীতিতে আরো বড়
ফ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত হবে। ক্ষমতাসীন দল রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করার জন্য
যে উগ্র ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের নীতি গ্রহণ করেছে, তা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
বরং মানুষ উপলব্ধি করছে তার ধর্মীয় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য রাজনীতিবিমুখ
হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মানুষের এই অবস্থান রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বলে অপরাধ
আকারে হাজির করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের এই চেষ্টা মানুষের
অনুভূতিকে আরো বেশি আহত করেছে। জাতীয় রাজনীতির এসব প্রভাব শুধু
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নয়, ভবিষ্যতে সব নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে।
বিরোধী দল সিটি করপোরেশন নির্বাচন শুরুতে খুব গুরুত্বের সাথে নিয়েছে
বলে মনে হয় না। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকেই এই নির্বাচনকে শুধু গুরুত্ব নয়, রাজনৈতিক রূপ
দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা
মেয়র ছিলেন। ফলে এই নির্বাচনে তাদের পরাজয়ের অর্থ হবে শুধু প্রার্থীর পরাজয় নয়, ক্ষমতাসীন দলের
প্রতিও অনাস্থা। ফলে ক্ষমতাসীন দল আবার বিজয়ী হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
প্রচার-প্রচারণায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মধ্যে অনেক বেশি অংশগ্রহণ ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা
লক্ষ করা যাচ্ছে। এমনকি মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়ে আচরণবিধি
লঙ্ঘনের অভিযোগও উঠেছে। ক্ষমতাসীন দল এই নির্বাচনকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে তার
প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে খুলনা ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মন্ত্রীদের
উপস্থিতি। খুলনায় শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেখার
নামে নির্বাচনী এলাকা সফর করেছেন। রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকার অদূরে একাধিক
মন্ত্রী বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকে সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে
মন্ত্রীরা স্বীকার করেছেন। ঢাকাতেও ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতা সিটি করপোরেশন
নির্বাচনে বিরোধী দলসমর্থিত প্রার্থীর প্রচারণা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ক্ষমতাসীন
দলের পক্ষ থেকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যেভাবে রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ানো হয়েছে, বিরোধী দল এই
নির্বাচনকে অরাজনৈতিকভাবে বিবেচনায় নিলে তাতে শুধু তাদের পরাজয় নয়, রাজনৈতিক
বিপর্যয়ও নেমে আসতে পারে। কারণ এই নির্বাচনের ফলাফল আগামী দিনে জাতীয় রাজনীতিতে
কমবেশি প্রভাব ফেলবে।
সিটি করপোরেশন নির্বাচন কতটা নিরপেক্ষ ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবমুক্ত
হবে তা নিয়ে এখন থেকেই সন্দেহ ও সংশয় রয়েছে। এই নির্বাচনকে ক্ষমতাসীন দলের
জনসমর্থনের মাপকাঠি হিসেবে যত বিবেচনা করা হবে, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের
জন্য তত বেশি ঝুঁকি বাড়বে। কারণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে স্থানীয়
প্রশাসনে বড় ধরনের কোনো রদবদল করা হয়নি। সন্ত্রাসী বা অবৈধ অস্ত্রধারীদের ধরতে
চালানো হয়নি কোনো অভিযান। ফলে এরা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে। প্রার্থীদের সাথে এখন
প্রচারে অংশ নিচ্ছে। দেশের পুলিশ প্রশাসনকে যেভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে তাতে
ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকেরা আইন ভঙ্গ করলেও তারা চোখ বুঝে থাকছেন। তার প্রমাণ পাওয়া
গেছে সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী প্রচারে। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক প্রার্থীকে
একজন অস্ত্রধারী যুব নেতা নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে। সে ছবি
সংবাদপত্রে ছাপাও হয়েছে। কিন্তু তাকে পুলিশ গ্রেফতার করেনি। ক্ষমতাসীন দলসমর্থিত
মেয়রপ্রার্থী বলেছেন, তার নির্বাচনী প্রচারে কে অংশ নিচ্ছে, সেটি তার দেখার বিষয় নয়।
কিন্তু একই শহরে ভিন্ন চিত্রও দেখা যাচ্ছে। বিরোধী ছাত্র সংগঠনের একাধিক নেতাকে
গ্রেফতার করা হয়েছে। নিশ্চয়ই বিরোধী দলের সমর্থক প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারে
ভূমিকা রাখতেন। অর্থাৎ সিলেটের পুলিশ প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে
পারছে না। নির্বাচনের দিন যত সামনে চলে আসবে, এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটতে থাকবে।
পুলিশসহ প্রশাসন যদি এভাবে কোনো প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নেয়, তা হলে নীরবে
কেন্দ্র দখল করে ভোট সম্পন্ন হয়ে যাবে। সিটি করপোরেশন নির্বাচন যদি এভাবে
রাজনৈতিক ইজ্জতের প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয় তা হলে ভোট কেন্দ্র দখল করে বিজয়ী হওয়া
ঠেকানোর মতো মুরোদ বর্তমান প্রশাসন দেখাতে পারবে না। কারণ মন্ত্রী, সদ্যবিদায়ী
মেয়র বা ক্ষমতাসীন দলের চাওয়া-পাওয়া বা ইচ্ছে আকাক্সা আমাদের প্রশাসনের
কর্তাব্যক্তিরা গুরুত্ব দেবেন না-এমনটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও যথেষ্ট টাকার খেলা হবে বা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন
দলের জন্য এই খেলায় বিজয়ী হওয়া অনেক সহজ। কারণ ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনের টাকা
জোগায় ভূতে। এই ভূতদের দেখা যায় না, কিন্তু টাকা ঠিকই তারা উড়ায়।
এরা হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের বেনিফিশিয়ারি গোষ্ঠী। বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে
সামনে রেখে অনেক ভূত নাকি ঢাকা থেকে নৌপথে অনেক আগেই বরিশাল পৌঁছে গেছেন। এদের
টার্গেট বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার নিম্ন আয়ের বস্তিবাসী
ভোটারদের ওপর সওয়ার হওয়া। বিরোধী দলের প্রার্থী ভোটের অঙ্কের হিসাবে এগিয়ে
থাকলেও ভূতে জোগানো এই টাকায় সব হিসাব উলট-পালট হয়ে যেতে পারে। একই অবস্থা
খুলনাতেও। বিদায়ী মেয়র দায়িত্ব পালনের পর তার সম্পদ বাড়িয়েছেন কয়েক গুণ।
সম্পদের হিসাবের তালিকায় তার তথ্য নিজেই দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলসমর্থিত খুলনার
মেয়রপ্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের ২০০৮ সালে বার্ষিক আয় ছিল তিন লাখ ৬২ হাজার
টাকা। এখন তা দাঁড়িয়েছে চার কোটি ৬৭ লাখ টাকায়। বরিশালের মেয়রপ্রার্থী শওকত
হোসেন হিরণের ছয় লাখ ১২ হাজার টাকার বার্ষিক আয়। এখন তিন কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
সম্পদ গড়ার এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে কিছু অংশ খরচ করতে অসুবিধা কোথায়? এর বিপরীতে
বিরোধী দলের প্রার্থী কতটা কুলিয়ে উঠতে পারবেন, সেটি এখন বড় প্রশ্ন।
ক্ষমতাসীন দলের জন্য উদ্বেগ হচ্ছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয়
রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ এখন প্রভাবিত করছে। ইসলামপন্থী ভোট ব্যাংক বিশেষ করে হেফাজতে
ইসলামের কর্মী-সমর্থকদের ভোট এবার বড় ফ্যাক্টর হয়ে দেখা দিয়েছে। হেফাজতে
ইসলামের ৬ এপ্রিল মতিঝিলের মহাসমাবেশের পর রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলেছিলেন আগামী
দিনে এই শক্তি দেশের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি নির্ণয়ে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে।
কিন্তু ক্ষমতাসীন দল ইঙ্গ-মার্কিন ওয়ার অন টেররের পুরনো রণকৌশলের অংশ হিসেবে
ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। অপরাপর ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের মতো
হেফাজতে ইসলামকেও তারা শত্রু হিসেবে টার্গেটে পরিণত করেছিলেন। ক্ষমতাসীন দলের
পৃষ্ঠপোষকতায় শাহবাগে এই যুদ্ধের দামামা বাজানো হয়েছিল। হেফাজতে ইসলামের মতো
অরাজনৈতিক সংগঠনের শান্তিপূর্ণ এই সমাবেশের পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, হেফাজতিরা
লেঙ্গুর গুটাইয়া পলাইয়া গেছে। এরপর ৫ মে তারা যখন আবার ফিরে এসেছেন তখন সশস্ত্র
উপায়ে তাদের সরিয়ে দিয়ে আহাদ প্রকাশ করা হয়েছে। শাপলা চত্বরের অপারেশন ফাশ
আউটে কত লোক মারা গেছেন তার হিসাব সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি। রাতের অন্ধকারে
বাতি নিভিয়ে অপারেশন চালানোর পর সাধারণ মানুষের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে ধারণা
শত শত নয় হাজার হাজার। সঠিক তথ্য প্রকাশ করা না হলে ধারণা বা গুজব সত্য হিসেবে
প্রতিষ্ঠিত হয়। হেফাজতের বিরুদ্ধে পরিচালিত অপারেশনেও তাই হয়েছে।
হেফাজত নেতারা শুরু থেকে বলেছিলেন তাদের আন্দোলন ঈমান-আকিদা রক্ষার
আন্দোলন, কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। শাহবাগের আন্দোলনে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক
পৃষ্ঠপোষকতা ও সামরিক কায়দায় ৫ তারিখে অভিযান চালানোর পর তারা ভালোভাবে বুঝতে
পেরেছেন ঈমান রক্ষার আন্দোলন টিকে থাকতে হলে রাজনীতিবর্জিত ভূমিকা নেয়ার সুযোগ আর
তাদের সামনে নেই। শান্তিপূর্ণ একটি সমাবেশে যখন গুলি চালানো হয় তখন নিরস্ত্র
মানুষ আহাজারি করা, নিরস্ত্র উপায়ে জবাব দেয়ার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া তাদের কিছুু
করার থাকে না। এখন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শাহবাগের আন্দোলনকারীদের রাজনৈতিক
পৃৃষ্ঠপোষকদের কাছ থেকে হেফাজতের নেতাকর্মীরা মুখ ফিরিয়ে নেবেন, এটিই তো
স্বাভাবিক। হেফাজতের নেতাকর্মীরা বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীকে সমর্থন বা ভোট দিচ্ছেন
বিষয়টি তেমন নয়, তারা অবস্থান নিচ্ছেন শাহবাগের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাকারীদের বিরুদ্ধে।
এখন এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা
অভিযোগ করেছেন বিরোধী দলের সমর্থিত প্রার্থীর নির্বাচনে ধর্মকে ব্যবহার করছে। এই
অভিযোগ বিশেষভাবে আনা হয়েছে রাজশাহী ও খুলনার বিরোধী দলসমর্থিত প্রার্থীর
বিরুদ্ধে। এমন এক সময় এই অভিযোগ করা হয়েছে, যখন হেফাজতে ইসলামের নেতারা
বিরোধী দলের প্রার্থীকে সমর্থনের ঘোষণা দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন দল এতে আতঙ্কিত বোধ
করছে। এর মধ্যে সিলেটের ক্ষমতাসীন দলসমর্থিত মেয়রপ্রার্থী মাদরাসাগুলো থেকে তার
পক্ষে তেমন সাড়া পাননি। বাংলাদেশের নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহারে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ও
জাতীয় পার্টি কেউই পিছিয়ে থাকে না। যদিও এই প্রচারের কৌশল এক রকম নয়। কিন্তু
এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নয় বরং ধর্মভীরু মানুষের
ক্ষোভ ও বিক্ষোভের রূপটি আমরা ভোটের রাজনীতিতে দেখছি। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে
হেফাজত ইস্যু এর একটি উপসর্গমাত্র। হেফাজতের আন্দোলন ও অপারেশন ফাশ আউটের মাধ্যমে
এই আন্দোলন দমনের নিষ্ঠুুর প্রচেষ্টা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে রাজনীতিতে আরো বড়
ফ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত হবে। ক্ষমতাসীন দল রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করার জন্য
যে উগ্র ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের নীতি গ্রহণ করেছে, তা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
বরং মানুষ উপলব্ধি করছে তার ধর্মীয় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য রাজনীতিবিমুখ
হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মানুষের এই অবস্থান রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বলে অপরাধ
আকারে হাজির করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের এই চেষ্টা মানুষের
অনুভূতিকে আরো বেশি আহত করেছে। জাতীয় রাজনীতির এসব প্রভাব শুধু
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নয়, ভবিষ্যতে সব নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন